সেদিন মাস মাইনের ক্রেডিট মেসেজ টোনে চমকে গেলেন দিবাকর বাবু। কেননা টোন মিউট করে রাখাটাই এ ঘোরকালে সচেতন নাগরিকের পরিচয়।কে কখন দেখে ফেলে কে জানে?নেহাত জানুয়ারির পর বেতন ভালই বেড়েছে।আর তাই ভয়টা বাড়ছেই। আসলে এতোটা সামলে চলা যায়? মেসেজ নীরব করা যায়।কিন্তু বিবেকের তো বেড়া হয়না। সে বারোকোটি তরতাজা বেকার তৈরির দিনেও মাছবাজারে চিত্ত ভাবনাহীন হয়ে এগিয়ে যায়। পাড়ার রেশনের হাহাকার লাইনের পাশ দিয়েও "বেশ ভাল আছির মত" হনহন করে হেঁটে যায়।
সরকারি চাকরি পাওয়ার চেয়ে যাওয়া কঠিন-- হঠাৎ ভিড় থেকে উড়ে আসা কথাগুলো শুনেই ভয়ে ভয়ে বাজারের থলে নিয়ে সরে গেলেন একজন।মানুষের পেটে ভাত নেই,আর বসে বসে বেতন!একটা গন্ডগোলের আন্দাজ করেই রোববারে প্রায় শূন্য ব্যাগ নিয়েই ঘরে ফিরে গিয়েছিলেন দিবাকরবাবু।আসলে দিবাকর দত্ত একটা নাম।এক মফস্বলের ছাপোষা কেরাণীমুখ।এরকম লক্ষ লক্ষ দিবাকর আজ ভয়ে ভয়ে বাজার করছেন। এটিএম ঘরের সুশীতল পরিবেশেও টাচস্ক্রিনে টাকার অংক লিখতে লিখতে ঘামছেন।মনে হয় কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। তাই নামমাত্র টাকা তুলেই বেরিয়ে আসছেন অসংখ্য ত্রস্ত মানুষ।কানে শোনা নয়, একদম চোখে দেখা।ছিনতাইয়ের ভয়ে ঘরে ফিরেও কাঁপছেন অসংখ্য সরকারি কর্মচারী।আসলে অভাবের দেশে এনারা চাকরি করায় বরাবর শ্রেণীশত্রু তো ছিলেনই।এখন হলেন গণশত্রু।কারণ এই বিশ্বজোড়া ফাঁদপাতা পরিবেশেও তারা হাসছেন ।মন্দার বাজারেও নিশ্চিন্তে দুচোখের পাতায় জুড়ে দিচ্ছেন ঘুম।পরিযায়ী শ্রমিকদের অসহায় দিনেও জুলাইয়ের ইনক্রিমেন্টের ফিসফিস খোঁজ নিয়েছেন অফিসে।মানুষ সব মনে রাখে।মানুষ সব দেখে রাখে।জবাব দেয় সময় হলে।
সুচিত্রা উত্তমের সাদাকালো ছবিতে তখনও ব্যারিস্টার মানেই সমাজের এলিট পাত্র।কলেজের অধ্যাপক বাতিল হয়েছেন বারবার।কিন্তু সে দিন গেছে চলে।এখন নাকি নিরাপত্তার অন্য নাম সরকারি চাকরি। তাই পিওন কেরাণীর ছুৎমার্গ গঙ্গাজলে ভাসিয়ে সবাই রিকুয়ারমেন্ট তৈরি করেছেন।পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন সেকথাই মনে করিয়ে দেয়।সরকারি চাকরি কাম্য।আসলে আমাদের চাওয়া তো সীমাহীন।তাই একবারও ভাবলাম না বেসরকারি চাকরিরতদের ভবিষ্যৎ কী? তাদের মেধা ,আর্থিক স্বচ্ছলতা, কর্মপরিসর,কর্মদক্ষতা কতটা?
ঐ পাকা নয় কাজ।পাকাবাড়ির মজবুতির মতো দম নেই নিরাপত্তায়। তাই বেশিরভাগ মানুষের ভাবনার বিষয় ও বস্তু ,কোনটাই হতে পারেনি এই বেসরকারি ক্ষেত্রের ছেলেমেয়েরা। বরং একটা নিরাপত্তার জন্য হন্য হয়ে ছুটে বেড়ায় আস্ত দেশ।আস্ত সমাজ।যেখানে ছাঁটাইয়ের ভয় নেই।বেতন কমার ভয় নেই। রেডজোনে থেকে দপ্তরে না গিয়েও আধিকারিকের চোখরাঙানি নেই বা রাতের ডিনার খেতে খেতে হোয়াটসঅ্যাপে পিঙ্কসিল্প শব্দ করে ভেসে আসার ভয় নেই।শুধু আছে প্রতিনিয়ত হাজার পরাভবের মাঝেও একটু ভালভাবে জীবন বয়ে নিয়ে যাবার সুবন্দোবস্ত।তাই এ মুহূর্তে সরকারি বা আধাসরকারি সকল কর্মীরা ,সর্বসমক্ষে "চাকরি করি"বলতে দ্বিধায় আছেন।মানুষের রোষে পড়ার ভয়ে।
তবে রোষ তো একদিনে তৈরি হয়নি। যখন এক হকার পোস্ট অফিসে শেষ সম্বলের পঞ্চাশটাকা তুলতে গিয়েছেন বলে খবর হয়,তা রাষ্ট্রের লজ্জা।পরিযায়ী শ্রমিকের স্ত্রী কানের দুল আর বাচ্চার পায়ের তোড়া বেচে যখন ঘরের মানুষটির জন্য বাসায় ফেরার বাসভাড়া পাঠান,তখন নিরাপত্তা শব্দটাই তাসের ঘরের মত ভেঙে যায়।এ কেমন বাঁচা?লকডাউনে একশ্রেণীর মানুষ নেটফ্লিক্সে হরর মুভি দেখছেন আর শকুন্তলা, জামলোদের জীবনটাই হরর হয়ে উঠেছে।যে দৃশ্যের রিটেক হয়না।অনেকটা নাটকের মত।কিন্তু নাটক নয়।যা দেখেছেন ,যা শুনেছেন তার বিপক্ষে দাঁড়ানোর সাহস রাষ্ট্রের নেই।
এ যেন এক হেরে যাওয়া হরর ছবি।দর্শক আসনে একশো পঁয়ত্রিশ কোটি মানুষ।কেউ আলো জ্বলার অপেক্ষা করেননি।অন্ধকারেই মাথা নিচু করে মেনে নিয়েছেন সবটুকু।কেউ বলেছেন ,স্কুল বন্ধ থাকলে কী করব?কেউ পোস্ট করেছেন,সরকার বেতন দিলে কী করব?কেউবা সামান্য বেতন কেটে নেবার আশঙ্কায় মুখ কালো করে আছেন।অথচ তারমাঝেই সরকার তরফে পুজোবোনাসের নির্দেশিকা জারি হয়েছে।তাই এ এক বাধ্যবাধকতা।সরকারের সত্যিই কিছু করার নেই।সব রেভিনিউ বন্ধের পরেও তাই দেওয়ালে পিঠ ঠেকা অবস্থায় মদের দোকান খোলা হয়েছিল।সমস্ত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও সরকার নাকি বেতন দিতে বাধ্য।চাকরিজীবীদের আড্ডাস্থল থেকে কথাটা এসেছিল।আসলে এটা স্থায়ীত্ব নয়,এক আস্ফালনের স্টেটমেন্ট। নাহলে সরকারি চাকরির সংজ্ঞাই তো বদলে যাবে। তাই তো সরকারকে আসনে আমন্ত্রণ জানানো।সংকটকালেও দেশবাসীর মুখে মৃদু হাসির অস্তিত্ব ধরে রাখাটাও যেন সরকারের এক গুরুদায়িত্বের অন্তর্গত।
সরকারি কর্মীরাই আসলে সরকারের মুখ।এই শ্রেণীর ওপরেই ন্যাস্ত থাকে সরকারের উন্নয়ন,অনুপ্রেরণার হালহকিকত।উন্নয়নের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ডোর টু ডোর পৌঁছে দেওয়াই তাদের কাজ।তাই এই শ্রেণী ভাল কাজ করলে সরকার ভাল।আর প্রবল ঝড়েও ভাঙাবাড়িতে ক্ষতিপূরণ না পৌঁছনোর কলঙ্কের ভারও নিতে হয়েছে এ শ্রেণীকেই।কেননা প্রশাসন কড়া ,সৎ হলে এ বিপুল অভিযোগের তির ছুটে আসত না।প্রশ্ন এখানেই।এ দুর্যোগেও সরকারি কোষাগারে যখন ভাঁড়ে মা ভবানী,তখনও বন্যাক্লিষ্ট,ঝড়জর্জর মানুষের সামান্য উঠে দাঁড়ানোর অর্থেও চোখ পড়েছে তাদের।সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা এটাই।যা একদিন রাষ্ট্রীয় জেহাদে পরিণত হলে এই শ্রেণীর কেউ নিস্তার পাবেন না।বেতন মাঝপথেই লুঠ হবে হয়তো।কেননা জনরোষ বন্দুক দিয়ে বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যায় না।যে নজির বিশ্বে ভুরি ভুরি। ত্রাণ বিলি করতে গিয়ে এক আম্ফানবিধ্বস্ত চাষী জানালেন,বাবু বেতন পাবার পরও এমনটা কেন করিলি?কেন করিলি বাবু?কুড়ি হাজারো ছাড়লি না তোরা?খামখা সরকারটারে বিপদে ফেলালি।ভরদুপুরে কথাগুলো ভাঙা ছাদে ঢাকা ত্রিপলের বুক ভেঙে আসা চড়া রোদ্দুরের চেয়েও চড়া ঠেকল আধিকারিকের।সেই এটিএম ঘরের গরম লাগার মত।তাই সাধারণ মানুষের বাঁচাকে একটু ভাল রাখতে যাদের হাতে বিপুল ক্ষমতা দেওয়া হল,সেই source এর মধ্যেই ভূত ঢুকলে সরকারেরও কিছু করার থাকেনা।একবছর বাদে কর্মীদের শোকজের চিঠিগুলো সেই টেন্ডারের পর মুদিদোকানের ঠোঙা হয়ে যায়।সুতরাং ভয় দেখিয়ে কদ্দিন?ভালোবেসে মানুষের জন্য কাজের তাগিদের ইচ্ছে না জাগলে লক্ষ লক্ষ সারপ্রাইজ ভিজিটের পরও চাল চুরি চলবেই।যেমন লকডাউনের মাঝেই এক প্রাথমিক শিক্ষক রেশন ডিলারের সাপ্লাই করা মিড ডে মিলের চালের প্রতি বস্তায় দেখেছেন চারকেজি করে চাল কম।শিক্ষক সচেতন।এই বোধ সকলের থাকেনা।উঁচুতরফে জানানোর কথা বললে ,কেঁদে ফেলেন ডিলার।এখানে সরকার কী করবে বলুন?তাই সব দুর্নীতির অপমান সরকারকে দিয়ে একটা ভোট জেতার অনুকূল প্লাটফর্ম তৈরি করা যায়।বিরোধীপক্ষ হিসেবে প্রাসঙ্গিক করা যায় নিজেদের।কিন্তু ঘুরেফিরে সেই লঙ্কায় গিয়ে রাবণ হবার গল্পটাই বিজয়মিছিল শেষে শপথ হয়ে যায়।ক্রমশ একটা সরকার গঠন করতে চলার প্রাথমিক রেজেলিউশন।