পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নাগরিকতার সহজপাঠ ও একটি নতুন সত্যাগ্রহ

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 507 view(s)
  • লিখেছেন : অত্রি ভট্টাচার্য
পরিচালক বিনয় শুক্লার মতে, 'রবীশ শুধুমাত্র একজন প্রচলিত টিভি সংবাদ উপস্থাপক ছিলেন না। বেশিরভাগ উপস্থাপক দর্শকদের প্রশংসা করেন। তিনি সক্রিয়ভাবে তার শ্রোতাদের তিরস্কার করছিলেন এবং তাদের বলেছিলেন যে তারা সঠিক কাজ করছেন না।' এই তিরস্কারের মাধ্যমেই রবীশ এই ভেঙ্গে যাওয়া গণতন্ত্রকে বাঁচাতে বারবার নাগরিক সক্রিয়তা দাবি করেছেন।

ইন্ডিয়া জোটের বিজেপি বিরোধী দলগুলি নরেন্দ্র মোদি সরকারের হয়ে হিন্দুত্ববাদী ঘৃণা ছড়ানো এবং সরকারর প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন নিউজ অ্যাঙ্করকে বয়কট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জাতীয় কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খেরা একটি ভিডিও বিবৃতিতে বলেছেন, 'আমরা এই ঘৃণা-ভরা আখ্যানকে বৈধতা দিতে চাই না যা আমাদের সমাজকে ক্ষয় করছে।'

'আমরা ঘৃণার এই শোরুমগুলিতে অংশ নেব না।'
ইন্ডিয়া জোটের অভিমত স্পষ্ট যে, তাদের সদস্যরা ভারতের জনপ্রিয়তম কিছু টিভিনিউজ ব্যক্তিত্ব সহ ১৪জন অ্যাঙ্করের প্রোগ্রামে উপস্থিত হবেন না।

উত্তেজনাপূর্ণ এবং মোরগ-লড়াইয়ের মত এই  বিতর্ক অনুষ্ঠানগুলি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একটি প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কখনও কখনও এক ডজন বা তার বেশি প্যানেলিস্ট শুধুমাত্র দর্শকের নেতিবাচক  মনোযোগ আকর্ষণের জন্য টিভিস্ক্রিনে লড়াই করতে থাকে।

বিরোধী দলগুলি দীর্ঘদিন ধরে এই কর্পোরেটীয়- নিউজ নেটওয়ার্কগুলিকে নিরপেক্ষতার মৌলিক মানদন্ড মেনে চলতে ব্যর্থ  এবং অন্যায়ভাবে বিরোধীদের কার্যকলাপকে নেতিবাচক ভাবে উপস্থাপিত করছে বলে অভিযোগ করেছে।

মোদির ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর গ্লোবাল প্রেস ফ্রিডম র‍্যাঙ্কিংয়ে ভারত ২১ স্থান পিছিয়েছে এবং এখন ১৮০টি জরিপকৃত দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে রয়েছে।

যে সাংবাদিকরা সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন করেন তারা প্রায়শই নিজেকে সিদ্দিক কাপ্পানের মত জেলের অন্দরে খুঁজে পান এবং বিজেপির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী সমর্থকদের দ্বারা সোশ্যাল মিডিয়ায় শিকার হন।

যদিও এসবে বিন্দুমাত্র, চক্ষুলজ্জার উদ্রেক ঘটেনি এই বিজেপি-আরএসএস- কর্পোরেট নিউজ অ্যাঙ্করদের মিথোজীবি চক্রের অন্দরে। বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া আউটরিচের দায়িত্বে থাকা  অমিত মালব্য টুইটারে জানিয়েছেন, 'তাদের (যে সকল অ্যাঙ্করদের বয়কট করা হয়েছে) তাদের এটিকে সম্মানসূচক ব্যাজ হিসাবে পরা উচিত'। ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের মালিকানাধীন একটি হিন্দি চ্যানেল আজ তক-এর সুধীর চৌধুরী বয়কট হওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে একজন। তার মতে, যারা 'তাদের (বিরোধী জোটের) বুট চাটতে অস্বীকার করছে' তাদের উপর আঘাত করা হয়েছে। এই জন্য তিনি ইন্ডিয়া জোটকে টুইটারে উপহাসও করেছেন।

বৃহস্পতিবার, ১৪ই সেপ্টেম্বর, ভারত জোট ১৪ জন সংবাদ উপস্থাপকের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে এবং বলেছে যে তাদের প্রতিনিধিদের তাদের নিজ নিজ শো এবং ইভেন্টে পাঠানো হবে না।

তালিকায় অদিতি ত্যাগী (ভারত এক্সপ্রেস), আমান চোপড়া (নিউজ ১৮ ইন্ডিয়া), আমিশ দেবগন (নিউজ ১৮ ইন্ডিয়া), আনন্দ নরসিমহন (সিএনএন নিউজ ১৮), অর্ণব গোস্বামী (রিপাবলিক টিভি), অশোক শ্রীবাস্তব (ডিডি নিউজ), চিত্রা ত্রিপাঠি (আজ তাক), গৌরব সাওয়ান্ত (ইন্ডিয়া টুডে), নাভিকা কুমার (টাইমস নাউ), প্রাচি পরাশর (ইন্ডিয়া টিভি), রুবিকা লিয়াকত (ভারত ২৪), শিব অরুর (ইন্ডিয়া টুডে), সুধীর চৌধুরী (আজ তক), এবং সুশান্ত সিনহা (টাইমস নাউ নবভারত)। এরা প্রত্যেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত চাটুকার, স্যুট-ব্যুট পরিহিত ইংরেজি দাঙ্গাবাজী আর কর্পোরেট দালালির স্বর।

বয়কট ঘোষণার পরপরই, নিউজ ব্রডকাস্টার ফেডারেশন এবং নিউজ ব্রডকাস্টার অ্যান্ড ডিজিটাল অ্যাসোসিয়েশন ইন্ডিয়া জোটের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি জারি করে। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্তটি 'জরুরি অবস্থা'র ঘটনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়।

একথা ভুলে গেলে চলবে না, গত বছর আদানি অধিগ্রহণের আগে পর্যন্ত বিজেপি একমাত্র সরকার-বিরোধী কন্ঠস্বর  এনডিটিভিতে তাদের প্রতিনিধি পাঠায়নি।
ভারতীয় শিল্পপতিদের মধ্যে মোদী-ঘনিষ্ঠ হিসাবে সবথেকে পরিচিত গৌতম আদানি,
গত বছর এনডিটিভির মালিকানায় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশীদারিত্ব অর্জন করেছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত টেলিভিশনে শেষ প্রধান সমালোচনামূলক কন্ঠস্বর  হিসাবে দেখা যাচ্ছিল এনডিটিভিকেই।

আরএসএস এই অধিগ্রহণকে ভারতের 'মূলধারার মিডিয়াতে বহুত্ববাদের সমাপ্তি' হিসাবে বর্ণনা করেছিল।

এনডিটিভির আদানি-কর্তৃক অধিগ্রহণের পরেই সেখানকার চাকরি ছাড়তে হয়েছিল ম্যাগসাইসাই পুরস্কার প্রাপ্ত রবীশ কুমারকে। যিনি দীর্ঘদিন ধরেই, এই ঘৃণা উৎপাদনকারী মিডিয়াকে বর্জন করতে বলছিলেন। জোর গলায় বলছিলেন টিভি নিউজ না দেখার কথা। যে গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহের ধারণা থেকে আজ এই কর্পোরেট-মিডিয়াকে বয়কটের ডাক দিচ্ছে ইন্ডিয়া জোট, তার বীজ বুনেছিলেন নির্ভীক রবীশই। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে 'While We Watched' নামক একটি তথ্যচিত্র। যেখানে নির্মাতা বিনয় শুক্লা, সাংবাদিক এবং জনপ্রিয় টিভি সংবাদ উপস্থাপক রবীশ কুমারকে অনুসরণ করেছেন ক্যামেরায়। একটি বিধ্বস্ত নিউজরুমের পটভূমিতে তিনি রবীশকে দেখিয়েছেন সংবাদ জগতের পুরানো- নীতিগুলিকে ধরে রাখতে অপারগ এক বোকা নাবিকের মত। যিনি ভাবছেন তার সাংবাদিকতা এখনও প্রাসঙ্গিক কিনা। যিনি নিজেকে নিজেই বলছেন, জিরো টিআরপি অ্যাঙ্কর। এই তথ্যচিত্রটি সেই দ্বিধা এবং একটি অন্ধকার বাস্তবতাকে উপস্থিত করেছে যা আজ ভারতীয় সাংবাদিকতা এবং তার নিউজরুমকে জর্জরিত করে - এক অজানা ভয়, ছাঁটাই, শাটডাউন, স্থবিরতা, মৃত্যুর হুমকি এবং আদর্শের সাথে আপস যা এই পেশার অনেক মানুষকে প্রতিনিয়ত সহ্য করতে হচ্ছে।

পরিচালক বিনয় শুক্লার মতে, 'রবীশ শুধুমাত্র একজন প্রচলিত টিভি সংবাদ উপস্থাপক ছিলেন না। বেশিরভাগ উপস্থাপক দর্শকদের প্রশংসা করেন। তিনি সক্রিয়ভাবে তার শ্রোতাদের তিরস্কার করছিলেন এবং তাদের বলেছিলেন যে তারা সঠিক কাজ করছেন না।' এই তিরস্কারের মাধ্যমেই রবীশ এই ভেঙ্গে যাওয়া গণতন্ত্রকে বাঁচাতে বারবার নাগরিক সক্রিয়তা দাবি করেছেন। বুঝিয়েছেন, যে নাগরিক হয়ে ওঠার কোন সহজপাঠ নেই। এর জন্য প্রয়োজন ক্ষমতার বিপক্ষে একজন নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

আপনি সম্ভবত এতক্ষণে  দেখে ফেলেছেন - শাহরুখ খান অভিনীত অ্যাকশন-থ্রিলার জওয়ান। এই ৩০০ কোটি টাকার অ্যাকশন-থ্রিলারটি সম্ভাব্য সর্বাধিক প্ল্যাটফর্মে দেওয়া হয়েছে। যদিও বিনয় শুক্লার ডকুমেন্টারিতে এখনও ভারতে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায়নি৷ এই চলতি এক সপ্তাহ কেবল আমাদের সিনেমার সৃজনশীল বৈচিত্র্যের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনেনি, এটি আশাহীন দর্শকদেরও আশ্বস্ত করেছে যে লড়াই চলছে। যথেষ্ট। যাইহোক, জওয়ান সম্পর্কে ইতিমধ্যেই লেখালেখি হয়েছে অনেক। স্বাভাবিকভাবেই, সকল বিঘ্নহরণকারী নায়কের অপেক্ষায় বসে থাকা উপমহাদেশে একজন রক্তমাংসের সাংবাদিকের প্রতিদিনকার চিৎকার হয়তো খানিক ম্লান হয়ে যায়।
আপনি যদি ইন্ডিয়া জোটের সমর্থকও না হন, সমস্যা নেই। শুধুমাত্র টেলিভিশন স্ক্রিন কালো করে ওই একক-প্রতিবাদী মানুষটির কথা শুনুন। যিনি অঞ্জন দত্তের সুবিদিত গানের লাইনটিই বারবার যেন উচ্চারণ করছেন- জানলা খুলে আকাশটাকে দেখো, টিভি দেখোনা। ওটা দেখলে, ওই অষ্টপ্রহর চিৎকারের শিকার হলে তুমিও পরিণত হবে এক দাঙ্গাবাজে, এক ফ্যাসিস্ট রোবটে। যে নিজের পড়শি চেনেনা।

0 Comments

Post Comment