বাজেটে ২০২৫
দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, গত ১ লা ফেব্রুয়ারি, সংসদে, ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেছেন। বাজেটে বলা হয়েছে, ২০২৫-২৬ সালে অর্থনৈতিক বিকাশের হার বৃদ্ধি করা হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে কর, বিদ্যুৎ, নগরোন্নয়ন, খনি, আর্থিক ক্ষেত্রের সংস্কারে। কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, বিনিয়োগ এবং রপ্তানি – এর উপর ভর করে ‘বিকশিত ভারত -২০৪৭’ এর লক্ষ্যে পৌঁছানো হবে, সেই কথাও বাজেটে বলা হয়েছে।
২০২৫-২৬ সালের আর্থিক বর্ষের জন্য মোট বাজেট বরাদ্দ হয়েছে ৫০.৬৫ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের আয়ের সংস্থান মাত্র ৩৪.৯৬ লক্ষ কোটি টাকা যার মধ্যে ২৮.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা আসবে কর থেকে। সরকারকে বাজার থেকে ধার করতে হবে ১৪.৮২ লক্ষ কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ স্থির হয়েছে জিডিপির ৪.৪%। নমিনাল জিডিপির বৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০.১ %। ২০২৪-২৫ সালের জিডিপির পরিমাণকে ভিত্তি ধরে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের শেষে জিডিপি- র পরিমাণ দাঁড়াবে ২৮২. ৩ লক্ষ কোটি টাকা । সেই হিসেবে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ হবে প্রায় ১২.৪৪ লক্ষ কোটি টাকা।
বাজেটে অর্থের সংস্থান
সরকার বাজেটের অর্থ সংস্থানের যে পরিকল্পনা করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সরকারী কোষাগারে ৬৬% অর্থ আসবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর থেকে । ঋণ এবং অন্যান্য দায় থেকে ২৪% । ৯ % অর্থআসবে করবিহীন রাজস্ব (যেমন বিনিয়োগ) থেকে মাত্র ১% আসবে ঋণ বহির্ভূত মূলধন থেকে।
করযুক্ত আয়ের মধ্যে কর্পোরেট ট্যাক্স ১৭% এবং ব্যক্তিগত আয়কর ২২%। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ৩৯%। পরোক্ষ করের মধ্যে, পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) ১৮%। এছাড়া ইউনিয়নআবগারি শুল্ক থেকে এবং আমদানি শুল্ক থেকে যথাক্রমে৫% ও ৪%আসবে পরোক্ষ করে।
বরাদ্দকৃত অর্থ কোন কোন খাতে খরচ
বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের ২০%, সরকারের সুদ দিতে খরচ হবে এবং ‘কর এবং শুল্ক’ বাবদ রাজ্য সরকারগুলিকে তাদের প্রাপ্য ফেরৎ দিতে ব্যয় হবে ২২%। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হবে ৮%। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পগুলিতে ব্যয় হবে ১৬%। যার মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে স্পনসর প্রকল্পগুলির জন্য বরাদ্দ ৮%, অর্থ কমিশনের জন্য ধরা হয়েছে ৮%। ভর্তুকি দিতে সরকারের ব্যয় হবে ৬ % এবং পেনশন দিতে খরচ হবে ৪%। ‘অন্যান্য খাতে ব্যয় ’ ধরা হয়েছে ৮%।
তবে সবটাই ভবিষ্যত। অনেক সময়ই খরচ আর বরাদ্দের মিল থাকে না। সেরকমই কয়েকটা তথ্য তুলে ধরি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, বাজেট ভাষণের সময় নিয়মমাফিক নথিও পেশ করেছেন । তাতে দেখা গেছে, সরকারি খরচ বরাদ্দের তুলনায় কম। চলতি অর্থবর্ষের জন্য গতবারের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৪৮ লক্ষ ২০ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। এই অর্থবর্ষ শেষ হবে আগামী মার্চে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অনুমান, মোট খরচ পৌঁছাবে ৪৭ লক্ষ ১৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকায়। যার মানে, ১ লক্ষ ৪ হাজার ২৫ কোটি টাকা নিজেরই বরাদ্দের তুলনায় কম খরচ করেছে কেন্দ্র। ২০২৪-২৫’ অর্থ বর্ষের জন্য কেন্দ্রীয় সহায়তা প্রাপ্ত প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৫ লক্ষ ৫ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। সীতারামনের অনুমান এই খরচ পৌঁছাবে ৪ লক্ষ ১৫ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। আগামী ২০২৫-২৬’ অর্থবর্ষের জন্য সীতারামন বরাদ্দ করেছেন ৫ লক্ষ ৪১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১ লক্ষ ২৫ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। খরচ হবে ১ লক্ষ ১৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবর্ষে যদিও বরাদ্দ ১লক্ষ ২৮ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।স্বাস্থ্যে বরাদ্দ ছিল ৮৯ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। এই মার্চে খরচ পৌঁছাবে ৮৮ হাজার ৩২ কোটি টাকা। আগামী অর্থবর্ষে বরাদ্দ ৯৮ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। বিভিন্ন সরকারি খাতে খরচের একই চিত্র। তথ্যের এই কচকচানি একটাই কারণে, বাজেটে বরাদ্দ ঘোষণা মানেই অর্থ ব্যয় হবে তা একেবারেই নয়। তবে সরকারি খরচ কম হলে তা জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির গতিকে কমিয়ে দেয়। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী সরকারি খরচ বাড়লে জাতীয় আয় বাড়ে (গভর্মেন্ট এক্সপেন্ডিচার মাল্টিপ্লায়ার)। গুণক আকারে।
আয়কর ছাড়ে সরকারি ভাবনা
এই বারের বাজেটের যে সিদ্ধান্তটি নিয়ে শোরগোল পড়েছে তা হ’ল আয়করে ছাড়।বাজেটে ঘোষণা হয়েছে বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ের উপর কোনও আয়কর দিতে হবে না। সরকারি কর্মচারীদের অতিরিক্ত ছাড় ৭৫০০০ টাকা (স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন)।অর্থাৎ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ১২.৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কর শূন্য। এই ছাড়ের ফলেসরকারের ১ লক্ষ কোটি টাকা রেভিনিউ কমবে এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ করমুক্ত হবেন – অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা সেই রকমই। তিনি আরও বলেন, “সকলের জন্য কর কমানো হচ্ছে। যাঁরা ২৪ লক্ষ টাকা আয় করেন তাঁদের ২০১৪ সালে ৫.৬ লক্ষ টাকা কর দিতে হত। এখন মাত্র ৩ লক্ষ টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ ২.৬ লক্ষ টাকা সাশ্রয়। সুতরাং, যাঁরা ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করেন শুধু তাঁরাই উপকৃত হবেন না, যারা বেশি আয় করেন তাঁরাও উপকৃত হবেন।"
এই কর ছাড়ের পিছনে যৌক্তিকতা হ’ল জনগণের একটা অংশের ব্যয়যোগ্য আয় বৃদ্ধি করা। যা তাঁরা ভোগ্যপণ্যের বাজারে খরচ করবেন।
আয়কর ছাড় নিয়ে আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মত
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের দাবি, কর ছাড়ের ফলে অতিরিক্ত অর্থ মানুষ দৈনন্দিন ব্যবহারের পণ্য কিনতেই খরচ করবেন। স্টেট ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাজেটে করছাড়ের সীমা বৃদ্ধির ফলে জনগণের হাতে বছরে অতিরিক্ত প্রায় ১.২ লক্ষ টাকা থাকবে। আর এই টাকার অনেকটাই যাবে খাদ্য-সহ বিবিধ ভোগ্যপণ্যে। ফলে বছরে অতিরিক্ত প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা ভোগ্যপণ্য ক্ষেত্রেপ্রবেশ করতে চলেছে ।অর্থাৎ কর ছাড়ে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে ভোগ্যপণ্য শিল্প। চাহিদা কয়েক গুণ বাড়বে। তাতে অর্থনীতিতেগতি আসবে। স্টেট ব্যাঙ্কের সমীক্ষার দাবি, এই ভোগ্যপণ্য শিল্প থেকে সরকারের জি এস টি বাবদ ৪০,০০০ কোটি টাকা আসতে পারে।
বাস্তবতা
সরকার আয়করে ছাড় দিয়েছে। সবাই আহ্লাদে আটখানা। সরকার বলছে মানুষের হাতে বাড়তি অর্থ আসবে তাঁদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াবে। বাজারে কার্যকরী চাহিদা সৃষ্টি হবে। যা অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সাহায্য করবে। অর্থনীতিতে উন্নয়নের জোয়ার আসবে। প্রশ্ন হল দেশের মোট জনগণের মাত্র ৫.৮% জনগণ আয়কর দাখিল করেন। কিন্তু বাৎসরিক ১২ লাখ টাকা আয় করেন তার সংখ্যা হয়ত মোট জনগণের ২ % -৩% হবে। ১৪৪ কোটি জনগণের তুলনায় এই সংখ্যা খুবই সামান্য। এরপরও যেটা বলার মাসিক লাখ টাকা রোজগার করা জনগণের দুটি অংশ। একটি অংশের বয়স ২৫-৩৫ বছর। অপর অংশের বয়স ৩৬-৪৫ বছর। ম্যাক্রো ইকোনোমিক্স এর ‘লাইফ সাইকেল হাইপোথিসিস’ অনুযায়ী, চাকরির শুরুর দিকে এবং শেষে মানুষের ভোগব্যয় বেশি। আর মাঝ বয়সে মানুষের ভোগের তুলনায় সঞ্চয় প্রবণতা বেশি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী প্রথম অংশের জনগণ যাদের বয়স ২৫-৩৫বছরতাঁরা কর ছাড়ের বাড়তি অর্থে ভোগ করবেন। এই নিয়ে কোনও দ্বিধা নেই। কিন্তু অভিজ্ঞতায় বলে, তাঁদের ভোগের তালিকায় জায়গা নেবে বিদেশি বাইক, মোবাইল, জামা কাপড়, কসমেটিক্স এর মতন বিলাস বহুল দ্রব্য। ২০২৫ সালের বাজেটের পর এই দ্রব্যগুলির চাহিদা আরও বাড়বে কারণ সরকার এই সমস্ত বিদেশি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। ফলে প্রথম অংশের জনগণ কর ছাড়ের বাড়তি অর্থ দিয়ে দেশীয় অর্থনীতিকে কতটা চাঙ্গা করবে সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। অপর অংশটি যাঁদের বয়স ৩৬-৪৫ বছর, অর্থনীতির তত্ত্ব মেনে সেই মধ্যবিত্ত আয়কর ছাড়ের বাড়তি অর্থ হয় সঞ্চয় করবেন নচেৎ বাড়ি, গাড়ির মতন স্থায়ী সম্পদ কিনতে ব্যয় করবেন। সেই বাড়তি অর্থ বাজারের কার্যকরী চাহিদাকে খুব একটা প্রভাবিত করবে না।
অর্থনীতির প্রাথমিক তত্ত্ব অনুযায়ী গরীব নিম্নবিত্তের প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা মধ্যবিত্তের চেয়ে বেশি। ফলে অর্থনীতিতে সত্যিকারের কার্যকরী চাহিদা সৃষ্টি করতে চাইলে সরকারের উচিৎ ছিল গরীব নিম্নবিত্তের হাতে অর্থের জোগান বাড়ানো। বাজেটে সেই দিকটি উপেক্ষিত থেকেছে। অনেকে বলছেন কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে কৃষকের আয় বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। যারা একটু আধটু কৃষি ও কৃষকদের খোঁজ রাখেন, তাঁরা জানেন ফসলের ন্যায্য দাম না পেলে কিংবা উৎপাদন ব্যয় না কমাতে পারলে কৃষকের আয় বাড়বে না। কৃষি বাজার সংস্কার করে ফসলের সঠিক দাম পাওয়া বা কৃষি উপাদানের দাম কমিয়ে উৎপাদন ব্যয় কমানো – বাজেটে এই দুটিই অবহেলিত। দেশের জনগণের ৪৬% কৃষিতে যুক্ত তাঁদের হাতে বাড়তি অর্থ দিতে পারলে অনেক বেশি কার্যকরী চাহিদা তৈরি করা সম্ভব হ’ত।
দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার দীর্ঘ সময় ধরে খুব বেশি হয়ে রয়েছে। সরকার সেই হার কমাতে ব্যর্থ। যার প্রভাব পড়েছে ভোগ্যপণ্যের চাহিদায়। সরকার ভোগ্যপণ্যের জিএস টি -র হার কিছুটা কমিয়ে তার চাহিদা বাড়াতে পারতেন। সরকার জীবনদায়ী ওষুধে শুল্ক ছাড় দিয়েছেন। শুধু জীবনদায়ী ওষুধে ছাড় নয় গোটা ফার্মাসিউটিক্যাল ক্ষেত্রে জিএস টি তুলে নিয়ে সব ওষুধের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নিলে আপামর জনগণের হাতে কিছুটা অর্থ বাড়তি হ’ত। সেই অর্থ অন্যান্য ভোগ্যদ্রব্যের কার্যকরী চাহিদা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেপারত। ভোগ্যপণ্যের কার্যকরী চাহিদা বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে সরকার প্রত্যক্ষ করে ছাড় দিয়েছে। তার ভিত্তি খুবই সামান্য। কিন্তু পরোক্ষ করের ভিত্তি অনেক বিস্তৃত। সেইখানে ছাড় দিলে তা দেশের গরিব থেকে ধনী প্রত্যেকের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াত।
বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই, গরিব নিম্ন বিত্তের আয় বাড়ানোর উপায় বলা নেই।অথচঅর্থনীতির কার্যকরী চাহিদা সৃষ্টিতে এই দুয়ের ভূমিকা প্রত্যক্ষকর ছাড়ের চেয়ে অনেকবেশি।এখন দেখার, মাসিক একলাখি আয়ের উপর কর ছাড় কতটা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটায়।