র্যাগিং একটা বর্বর কাণ্ড। র্যাগিং-এর পরিণামে প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রের মৃত্যু হলে, তাকে হত্যা বলা হোক বা না হোক, তাকে নিন্দা করার মতো ভাষা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কী করে এমন ঘটনা ঘটল, কারা এর জন্য দায়ী—তদন্ত করে খুঁজে বের করা এখন পুলিশ ও প্রশাসনের দায়িত্ব। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকেও খুঁজে দেখতে হবে, তাদের ব্যবস্থাপনায় কী কী ফাঁক থেকে যাওয়ার ফলে এরকম ন্যক্কারজনক এবং ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। যাতে আগামী দিনে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম রক্ষার জন্যই এটা জরুরি।
কিন্তু আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, সেই জরুরি কাজগুলি করার বদলে র্যাগিং-কে কেন্দ্র করে ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে গেছে এক নতুন তরজা। এই তরজার লক্ষ্য দ্বিবিধ: ক) যাদবপুর তথা রাজ্যের মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাসে এখনও টিকে থাকা গণতান্ত্রিক খোলামেলা বহুস্বর পরিবেশকে এই সুযোগে ধ্বংস করে ফেলা; খ) ওখানে টিএমসিপি এবং এবিভিপি-র বাস্তু গড়ে তোলার লক্ষ্যে যতটা পারা যায় ফাঁকা জমি নিষ্কাশণ করে হাতে তুলে দেওয়া। দুই দখলদার বাহিনী প্রায় হাতে হাত ধরাধরি করেই পুরো দস্তুর কাজে নেমে পড়েছে। পদ্মপাল যে একজন পদ্মমার্কা অধ্যাপককে প্রয়োজনীয়তা যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও অস্থায়ী উপাচার্য পদে নিয়োগ করেছেন, এতে এই তরজার একটি হাতল খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে এল। বিশ্বভারতীর পর এবার যাদবপুরকে ধ্বংস করার কাজে একজন বিদ্যুৎ-দোসরকে মাঠে নামানো হল কিনা, অচিরেই জানা যাবে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের প্রশাসনিক পরিস্থিতি এক কথায় ভয়াবহ। একটা মাত্র তথ্য দিলেই এটা খানিক বোঝা যাবে। সমগ্র ক্যাম্পাসে যেখানে ন্যূনতম ৩৮০ জন নিরাপত্তা কর্মী লাগে, সেখানে এখন আছে মাত্র ৮০ জন। প্রতি দিন অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে একাংশ ছুটি নিলে মোটামুটি জনা ষাটেককে দিয়ে ৩৮০ জনের কাজ করিয়ে নিতে হয়। যা আসলে হয় না। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আলাদা রাখার জন্য নতুন হোস্টেল তৈরির বরাদ্দ অনুমোদন করেও রাজ্য সরকার অর্ধেকও দিতে পারে না। এরকম আরও অনেক ঘটনার কথা নানা সময়ে কানে আসে। আমার যখন আসে, নদী পেরিয়ে নবান্নের দিকেও নিশ্চয়ই যায়। বা ঘটনাগুলির গঙ্গোত্রী বোধ হয় ওখানেই।
“আতঙ্কপুর” ঘোষণাকারী নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী এসব ঘটনার অস্তিত্ব কি জানেন? না জেনে থাকলে তাঁকে নিয়েই আমাদের দুশ্চিন্তা শুরু হবে। জেনে থাকলে তাঁকে এবার মাথা ঠান্ডা করে ভেবে বলতে হবে, যাদবপুরকে “আতঙ্কপুরী” বানানোয় তাঁর সরকারের কোনো অবদান আছে কিনা। শিক্ষামন্ত্রীও কি রক্ষী সংখ্যার বিষয়টা জানেন না? না জেনেই কি মার্ক্সবাদী মাওবাদী বামপন্থীদের উপর দোষারোপ করে দায় এড়াতে চাইছেন?
আমাদের দেশের সত্তর শতাংশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে বামপন্থীদের কোনো অস্তিত্ব নেই। সেখানে অধিকাংশ জায়গায় আজকাল বিদ্যার্থী পরিষদের মতো ভয়ঙ্কর দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলি ছাত্রসংসদ চালায়—নির্বাচিত অথবা মনোনীত। সেখানকার হোস্টেলগুলিতে র্যাগিং আছে কিনা, ছাত্ররা মারা যায় বা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় কিনা খবর রাখেন? রাখার প্রয়োজন বোধ করেন? এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কমাস আগেই একটি ছাত্র র্যাগিং-এর ফলে আত্মহত্যা করেছিল।
এক মাস আগে জুলাইতে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের কলেজে গ্রাম থেকে আসা প্রথম বর্ষের এক আবাসিক মেধাবী ছাত্র –উজ্জ্বল গোস্বামী—অগভীর পুকুরে ডুবে মারা গেছে। মিশনের সাধুরা সেই মৃত্যুকেও দুর্ঘটনা বলে চালানোর জন্য সমস্ত আধ্যাত্মিক অস্ত্র প্রয়োগ করে চলেছে। ফলে তার খবর হয়নি। দৃশ্য-পাঠ কোনো মাধ্যমেই। সেই ঘটনা নিয়ে টিএমসি বা বিজেপি-র কোনো হেলদোল হুমকি ইত্যাদি নেই। কেন? যাদবপুর থিসিস লোপাট হয়ে যাবে বলে? মৃত্যু বা হত্যাতেও কি যত মত তত পথ? ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ফৌজদারি বিধি??
সিসিটিভি বসালে সিকিউরিটি যে এক নয়া পয়সাও বাড়ে না, যদি সিসিটিভিরও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা না থাকে, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ঘটনাই তার প্রমাণ। এই প্রমাণ খড়্গপুর আই আই টি-ও দিয়েছে। বছর দশেক আগে আমার পরিচিত একজন কেন্দ্রীয় সরকারী স্কুলের প্রিন্সিপালের অভিজ্ঞতা হল, সিসিটিভিতে মোড়া স্কুলেই রাতের বেলায় ভয়ঙ্কর ডাকাতি সংঘঠিত হয়েছিল। নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এগুলো অআকখ বোধ। যা দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে অনুপস্থিত।
সিসিটিভি তো পঞ্চায়েত ভোটের সময় বুথে বুথেও ছিল। তাতে ৫৭ জনের মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। ছবিগুলো হয়ত একা একা কেঁদেই গেছে। আজও কেঁদে চলেছে। একজনও হত্যাকারীকেও ধরা যায়নি।
নারদা নায়ক শুভেন্দু অধিকারী যাদবপুর নিয়ে এত লাফাচ্ছে কেন? সে কি গিয়েছিল আইআইটি খড়্গপুরে, যেখানে গত বছর (২০২২) অক্টোবর মাসে একজন প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃতদেহ অন্য রুমে আবিষ্কৃত হয়েছিল? সে কি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বলে যায়নি, নাকি, ছাত্রের নামে একটা আরবি ফারসি ছাপ ছিল বলে যাওয়া উচিত কাজ বলে মনে করেনি? নাকি দুটোই?? তখন তার র্যাগিং বিরোধী চেতনা কি ভেন্টিলেশনে ঢোকানো ছিল? যাদবপুর বলেই সেই চেতনা এখন বাইরে ফুটে বেরচ্ছে?
এবিভিপি তথা বিজেপি দিল্লির জেএনইউ-তে কিংবা হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করেছে আমরা ভুলে গেছি বলে ভাবছে নাকি? রোহিত ভেমুলার মৃত্যুও কর্তৃপক্ষের দুঃশাসনিক র্যাগিং ছাড়া আর কী? তা নিয়ে শুভেন্দুর বক্তব্য কী? সিসিটিভি সেসব জায়গায় কাকে বাঁচাতে পেরেছে বা এখনও পারছে?
র্যাগিং-এর কারণে মৃত্যু একটা চরম দুঃখজনক ঘটনা। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে এসে কয়েক দিনের মধ্যে মৃত্যুলোকে চলে যাওয়ার মতো খারাপ পরিণতি আর হয় না। র্যাগিং একটা অসভ্য ধর্ষকাম অপকৃতি। এর মধ্যে আছে শক্তিমানের দুর্বলের উপর দৈহিক মানসিক নির্যাতন করে তৃপ্তি পাওয়ার এক দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা। দেশের পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও এই মানসিকতাই বর্তমান। এমনকি স্কুলে স্কুলেও দেখা যায়, একজন ছাত্র একটু অন্য রকম (তোতলা, বেঁটে, ইত্যাদি) হলে বাকিরা তার পেছনে লাগতে থাকে এবং অনেক সময়ই তার স্কুলে আসা দুর্বিষহ করে তোলে। এই সব কিছুর বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী জনমত গঠন এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার দিকে দিকে।
১৯৭৮-৮৪ সময়কালে আমি যখন এআইডিএসও-র কলেজ স্ট্রিট এলাকায় কাজ দেখার দায়িত্বে ছিলাম, ইডেন হিন্দু হোস্টেলে আমাদের সদস্য বোর্ডাররা সমস্ত রকম র্যাগিং বন্ধ করে দিয়েছিল। রঞ্জিত বিশ্বাস, অমর চৌধুরী, নভেন্দু পাল, সুব্রত গৌড়ী, নির্মল (পদবী ভুলে গেছি), প্রবীর পণ্ডা, রথীন পাল, দীপেন দাস, প্রমুখ সিনিয়র ছাত্র কর্মীরা পাঁচটা ওয়ার্ডের ঘরে ঘরে ঢুকে দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষের ছেলেদের কঠোর ভাবে বারণ করে দিয়েছিল প্রথম বর্ষের ছাত্রদের পেছনে লাগতে। আর প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আশ্বস্ত করে রেখেছিল, যে কোনো সমস্যা হলেই তাদের জানাতে এবং নির্ভয়ে থাকতে। হোস্টেলে এতে ডিএসওর সমর্থক সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল সেই সময়। কেন না, অদ্ভুত ঘটনা হল, র্যাগিং ভীত প্রথম বর্ষের ছাত্ররাও অনেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠে র্যাগার হওয়ার বাসনায় লালায়িত হয়ে ওঠে। {নামগুলি উল্লেখ করতে বাধ্য হলাম। আমার এই বিষয়ক ফেসবুক পোস্ট তুলে নিয়ে হোয়াটসআপে একজন শেয়ার করায় সেখানে নাকি আর একজন আমাকে “মিথ্যাবাদী” বলে মন্তব্য করেছেন এবং জানিয়েছেন, সেই সময়ে নাকি হিন্দু হোস্টেলে এআইডিএসও-র একজন বাদে আর কোনো কর্মী ছিল না।}
সুতরাং র্যাগিং বন্ধ করা যায়। র্যাগিং একটি প্রতিরোধ যোগ্য প্রবণতা। প্রতিরোধ মানে কেবল সিসিটিভি নয়, ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া নয়। ক্যাম্পাসে পুলিশ পিকেট বসিয়ে ছাত্রদের উপর খবরদারি করা নয়। কলেজ স্কোয়ারে প্রতিবাদী সভা নিষিদ্ধ করে দেওয়া নয়। প্রতিরোধ মানে হল একটা সুস্থ স্বাভাবিক খোলামেলা প্রতিবাদী পরিবেশ গড়ে তোলা। যাকে বিজেপি এখন সর্ব প্রযত্নে ধ্বংস করার আয়োজন চালাচ্ছে। টিএমসিও সেই পথেই হাঁটছে।
অনেকে ভাবছেন, যাদবপুরের মুক্ত পরিবেশই নাকি র্যাগিং-এর সম্ভাবনাকে বাস্তব করে তুলেছে। আমি একমত নই। খোলামেলা গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনেক ভালো দিক থাকলেও একটা খারাপ দিক হল, যে কোনো বদ লোক এর সুযোগ নিতে পারে। তার জন্য সেই পরিবেশকে খুন হতে দেওয়া বোধ হয় উচিত নয়। পরিবেশ বজায় রেখেই যারা বদ মতলব থেকে এর সুযোগ নিচ্ছে তাদের আটকাতে হবে।
এর বিকল্প হচ্ছে, সরকারের হাতে নিরঙ্কুশ শাসনের হাতিয়ার তুলে দেওয়া। যে রাজ্য পুলিশ আনিস খানের হত্যাকারীকে আড়াল করতে উৎকোচের লোভ দেখায়, তার হাতে কোনো ছাত্রই নিরাপদ নয়। যে রাষ্ট্র উমর খালেদকে বিনা বিচারে জেলে পুরে রাখে আর অনুরাগ শর্মাকে খুঁজে পায় না, ব্রিজভূষণের নারী হেনস্থার ভিডিও ফুটেজ খোঁজে আর মনিপুরে হামলাকারীদের হাতে পুলিশের অস্ত্রভাণ্ডার তুলে দেয়, তারা আর যাই করুক র্যাগিং আটকাতে পারবে না।
মদ গাঁজা নেশা এবং আরও কিছু অপকর্ম শুধু যে যাদবপুরেই হয় বা কেবল একালেই হয়, এমন নয়। আমাদের ছাত্র দশায় (১৯৭০-৭৭) কলকাতার প্রায় সব কলেজেই এই সব উপকরণের চর্চা ছিল। তখন অবশ্য কোথাও র্যাগিং থেকে মৃত্যু ঘটেছে বলে শুনিনি। এ আমাদের সমাজের আর এক সমস্যা। সদ্য যৌবন প্রাপ্ত বয়সে কলেজে এসে স্কুলের তুলনায় ব্যাপক স্বাধীনতা পেয়ে অনেক ছাত্রই তাকে কীভাবে কোথায় কতটুকু খরচা করবে ভেবে না পেয়ে এই সব করে থাকে। তাদের মনে হতে থাকে, এইভাবে তারা স্মার্ট হবে। আমার যেমন এই প্রক্রিয়ায় স্মার্ট হওয়া আর হল না। আমি আজও সিগারেটের স্বাদ কেমন তা জেনে উঠতে পারিনি। তবে আমি দেখেছি, শুরুতে যত নেশাই করুক, চার পাঁচ বছর পরে তাদের বেশিরভাগই শুধরে যায়। কিন্তু দুচার জন নেশার ফাঁদ থেকে বেরতে না পেরে ভয়ঙ্কর নেশারুতে পরিণত হয়। আমাদের ব্যাচে প্রেসিডেন্সির এক ছাত্র (হিন্দু হোস্টেলে থাকত) নানা রকম উপায়ে নেশা করতে করতে শেষ কালে এমন নেশাগ্রস্ত হয়েছিল যে তাকে কৌটোয় করে আনা সাপের কামড় খেতে হত নেশাগ্রস্ত হওয়ার জন্য। সে সব অন্য গল্প। কিন্তু সেই নেশার প্রশ্ন তুলে যারা এখন যাদবপুরের বিরুদ্ধে কামান দাগতে ব্যস্ত তারাও সম্ভবত হয় বাস্তব থেকে দূরে বাস করেন, অথবা, কাউকে না কাউকে জায়গা করে দিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
যে ছাত্ররা ২০১৯ সালে একদিন আসানসোলের ইমাম পুত্রের হত্যায় উস্কানিদাতা র্যাগার বাবুল সুপ্রিয়কে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আটকে দিয়েছিল এবিভিপি-র সভা করতে না দিয়ে, তাদের উত্তরসূরিরাই পারবে ক্যাম্পাসের হোস্টেলে র্যাগিং ঠেকাতে, র্যাগিং-জনিত মৃত্যু ঠেকাতে। এআইএসএ, পিডিএসএফ, এআইডিএসও প্রমুখ বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলিকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে, আমার বিশ্বাস তারা নেবেও।
অন্যরা বড় জোর ৮বি-তে লাফালাফি করবে। আর হুমকি দেবে। সেও ক্ষমতাসীনদের এক রকমের র্যাগিং। তারও তীব্র নিন্দা করছি।