প্রথমে উত্তরবঙ্গ তারপর জঙ্গলমহল। বাংলা ভাগের তালিকা ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে। প্রথমে আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বার্লা,পরে বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। পশ্চিমবঙ্গকে ভেঙে টুকরো করার দাবি উঠছে বিজেপির ভিতর থেকে।যদিও এই দাবির সঙ্গে সোচ্চার হয়ে গলা মেলাতে পারেনি রাজ্য বিজেপির নেতৃত্ব তবে তাঁরা তত্ত্ব খাড়া করছেন আসলে এসব দাবি মানুষের ক্ষোভ, বঞ্চনা থেকে তৈরি হচ্ছে। ভোটের ফল যদিও সেই তত্ত্বের সাক্ষী দিচ্ছে না। তাহলে আজ কেন উঠে আসছে এই সব উদ্ভট দাবি। আসুন একটু পিছনে ফিরে তাকান যাক। ২০২০ সালের অক্টোবরে বিজেপির এক দলীয় সভায় অমিত শাহ ঘোষণা করেন যে বিজেপির ভারত জয় তখনই সম্পুর্ন হবে, যখন কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ এই দুটি রাজ্যে তাঁরা জয়পতাকা ওড়াতে পারবেন। পশ্চিমবঙ্গকে নিশানা করে শুরু হয় যেমন কথা তেমন কাজ।লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে যা যা করণীয় তার সব কিছু করতে শুরু করেন দল ও সরকার। নির্বাচন কমিশনকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসনিক দায়িত্বে নিজেদের পছন্দের লোক বসিয়ে, নিজেদের সুবিধে বুঝে ভোটের এক দীর্ঘ নির্ঘন্ট প্রস্তুত করে, কলকাতা হাইকোর্টে নিয়ে আসা হয় নিজেদের পছন্দের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি। রাজভবনে আরএসএস স্বেচ্ছাসেবক জগদীপ ধনকর আগে থেকেই ছিলেন। এই ভাবে চারিদিক দিক থেকে আটঘাট বেঁধে বিজেপি সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের উপর। প্রচারের ঢক্কানিনাদে সাধারণের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এই বিশ্বাস যে এবার বিজেপিই পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসছে। উত্তরভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক অস্মিতা প্রতিদিন মজা করা শুরু করে রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। ভোটের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে ৭০% ওপর ভোট পড়ায়, বিজেপি ধরে নেয় যে এই ভোট প্রতিষ্ঠান বিরোধী, এবং আরও চড়া করে তাদের প্রচারের ঝাঁঝ। একসময় ভোটপর্বের শেষে ফল ঘোষণা হয়, বিজেপির নির্মম নিরন্ধ্র পতন ঘটে।
এই হার, বিশেষ করে এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর হাতে, মেনে নিলেও, মনে নিতে পারেনি বিজেপি। ক্ষেপে যাওয়া হাতির মত প্রথমে তারা নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকা প্রশাসনের সুবিধা নিয়ে সারা বাংলা জুড়ে শুরু করে এক লাগামছাড়া হিংসার, যা পরবর্তীতে আরও বড় আকার নেয়। মুখ্যমন্ত্রীর শপথের দিন তারা রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন দাবি করে। এসবে কাজ হল না দেখে সিবিআই লেলিয়ে দিয়ে সম্পুর্ন বেআইনিভাবে গ্রেপ্তার করা হয় রাজ্যের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও দুই নেতাকে। চেষ্টা চলে মুখ্যমন্ত্রীকে কোর্টে তোলার, সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির হার যে আসলে প্রধানমন্ত্রী মোদির হার, এই নিয়ে সরব হয় জাতীয় সংবাদমাধ্যম। ব্র্যান্ড মোদিকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে সর্বভারতীয় স্তরে বিরোধী অক্ষের প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পরে। যেনতেন প্রকারেন মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যে বন্দি করে রেখে প্রতিহিংসা নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী মোদি, এরপর আক্রমন করেন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যসচিবকে। সেই প্রক্রিয়াতেও আপাতত ব্যাকফুটে কেন্দ্র। এখন তাঁদের সম্বল নিছক হুমকি। রাজ্যের 'পদ্মপাল' জগদীপ ধনকর এবং নেপথ্যে কতিপয় আরএসএস শীর্ষ নেতৃত্বের তাগিদে এবার বাংলাকে টাইট দিতে বঙ্গভঙ্গের ডাক। যদি একটা অস্থিরতা তৈরি করা যায়, তার প্রয়াস। একদিকে পদ্মপালকে দিয়ে ৩৫৬-র জুজু, অন্যদিকে রাজ্যভাগের ডাক। মমতাকে রাজ্যের কাজে ব্যস্ত রাখাই হল মূল উদ্দেশ্য।
১৯৮০তে গোর্খাল্যান্ড, ১৯৯৫-এর কামতাপুর কিংবা ১৯৯৮-এর গ্রেটার কোচবিহার, ইতিপূর্বে বাংলা ভাগের দাবি যে ওঠেনি তা নয়। বিভাজনের রাজনীতিতে পারদর্শী বিজেপি ছিল এই সব কটি আন্দোলনের পিছনে। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকে কিভাবে মদত দিয়েছে, এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছে বিজেপি তা সবাই জানেন। এবারের বাংলা ভাগের ডাকে জনমানসে একেবারেই কোনও সাড়া পড়েনি। এমন কী, উত্তরবঙ্গ কিংবা জঙ্গলমহলের মানুষেরও কোনও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এবারের বাংলা ভাগের তাৎপর্য এই যে সেই অংশটিকে আলাদা করতে চাইছে বিজেপি যেখানে তারা ভালো ফল করেছে। দেখা যাচ্ছে ৭৭ টি আসনের ৪৫টি এসেছে এই দুই অঞ্চল থেকে। মুশকিল হচ্ছে যাঁরা বাংলা ভাগের খোয়াব দেখছেন তাঁরা না জানেন বাংলার ইতিহাস, না জানেন বাংলার ভূগোল। বৈচিত্রের বাংলায় উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহল দুটি অবিচ্ছেদ্য ভূখন্ড। পোড়ামাটি, ছৌ-নাচ, চা-বাগান, কাঞ্চনজঙ্ঘা বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয় না। বাঙালি মাত্রই নিজের ভাষা, রাজ্য সম্পর্কে সংবেদনশীল। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই দুই অঞ্চলকে দুই বোন বলে উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। দেশভাগের ক্ষত আজও কুরে কুরে খায় যে বাঙালিকে সে আর যাই হোক বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করবে না। বিজেপি ক্ষমতা পাওয়ার জন্য ভোটের আগে যে রকম তাড়াহুড়ো করেছিল, হেরে যাওয়ার পরও বড্ড বেশিদূর ভেবে ফেলেছেন তাঁদের কেউ কেউ। এই তাড়াহুড়ো করে বাঙালির মন না বুঝে এটাকে গো-বলয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে বিজিপি ভোটে নিজেদের পতন নিজেরাই ডেকে এনেছিল। এখন মমতাকে ঠেকাতে বঙ্গভঙ্গের দাবি, ৩৫৬-র দাবি তুলে আবার তারা নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারতে উদ্ধত।পশ্চিমবঙ্গের বিপুল জনাদেশের বিপক্ষে তাঁদের এই আস্ফালন মানুষ মোটেই ভাল চোখে নেবেন না। পদ্মপাল দিল্লি থেকে ডেকে এনেছেন মানবাধিকার কমিশনকে ভোট পরবর্তী হিংসার রিপোর্ট দিতে। এই সেই কমিশন, যার প্রধান বলেছিলেন মোদিজি একজন মনীষী। যে কমিশনের প্রধান একজন হুইল চেয়ারে বসা আসামিকে বাধ্য করেছিলেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতে। এমন নৃশংস একজন মানবতাবিরোধী অপরাধী আজ মানবাধিকার কমিশনের প্রধান ! মানুষ সব জানেন,ইয়ে পাবলিক হ্যায়, ইয়ে সব জানতে হ্যায়, এটা ভুলে যাচ্ছেন বিজেপি-আরএসএস-এর নেতৃত্ব। ওঁদের চেষ্টা হবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে করোনার অজুহাতে উপনির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে মমতাকে বাধ্য করা মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়াতে। নির্বাচন কমিশন এটুকু তো করবেনই, সাহেনশার কথায়। তাতে অবশ্য রাজ্যে সরকারকে ফেলে দেওয়া যাবে না। কারণ বিজেপি থেকে নেতাদের ঢল এখন তৃণমূলের দিকে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী না থাকলে বরং তিনি অলআউট খেলতে পারবেন। তিনি বসে থাকার মানুষ নন। তখন রাজ্যের বাইরে দাপিয়ে বেড়াবেন বাংলার বাঘিনী। ২০২৪-এর 'খেলা হবে' তখন আরও জমে উঠবে। আর রইল বঙ্গভঙ্গ। যে বাঙালি লড়াই করে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ রুখে দিয়েছিল, ৭১'এর যুদ্ধে ভাই বলে ওপার বাংলার মানুষকে এপার বাংলায় ঠাঁই দিয়েছিল, হাজার ষড়যন্ত্রে যে বাঙালির বুকে আজও টাইগার হিলের সূর্যোদয়ের আলো, তারা পাহাড়, ডুয়ার্স, মল্ল রাজাদের ভূম আলাদা করতে দেবে? বঙ্গভঙ্গ ছেলেখেলা নয়। ১৯০৫ সালে হাতে রাখি পরে রাস্তায় নেমে বাঙালি গেয়ে উঠেছিল "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।" গণআন্দোলনের পর ১৯১১ সালে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিলেন লর্ড কার্জন। সেই ঐতিহ্য, সেই পরম্পরা আমাদের উত্তরাধিকার। বঙ্গভঙ্গের প্রশ্ন উঠলে আমরা আবার রাখি পড়ব, রাস্তায় নামব, গণ আন্দোলন হবে। বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের উচিত অবিলম্বে সর্বভারতীয় নেতাদের হাতে একটি করে বাংলার ইতিহাস ও ভূগোলের বই ধরিয়ে দেওয়া।