ছোটবেলায় কোনো অজ্ঞাত সন্তানদল স্টেশনের গায়ে লিখে যেত 'নেতাজি ফিরে আসবেন।' নানাজনের মুখে নেতাজির নানা গল্প শুনে আমরাও ভাবতাম তাঁর ফেরার দিন সমাগত৷ বাঙালির চায়ের ঠেকে প্রায়শই দুর্নীতি-বেকারত্ব-খিদে-দারিদ্র্যর প্রসঙ্গে শোনা যেত, 'নেতাজি থাকলে এমনটা হত না…'।
১৯৯৭ সালে যখন সেই কিংবদন্তীর জন্মশতবর্ষ উদযাপন হল, তখন ক্লাস-এইট-নাইনের আমরা বুঝলাম, কোনো লোলচর্ম বৃদ্ধ এসে মোটেও এক মতিচ্ছন্ন, লক্ষ্যভ্রষ্ট দেশের দায়ভার নেবেন না৷ কিন্তু নেতাজিকে নিয়ে সেই উদ্দীপনা ফিরে এল বিগত কয়েক বছরে৷ সভা-সমিতিতে নেতাজিকে নিয়ে প্রচার শুরু হল। টিভিতে সিরিয়ালে নেতাজি৷ বিখ্যাত বাঙালি পরিচালকের পূজার রিলিজও নেতাজি-কেন্দ্রিক ছবি৷ ২০১৮ সালে ভারত জুড়ে পালিত হলো আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫তম বছর৷ সেই উপলক্ষ্যে চিরাচরিত প্রথার বাইরে গিয়ে চলতি বছরে দ্বিতীয়বার লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সুচারুভাবে নেহেরুর রাজ্যাভিষেক বনাম সুভাষের আত্মত্যাগের এক আখ্যান খাড়া করেন৷ নেতাজি-সংক্রান্ত ফাইল জনগণের সামনে আনার কথাও ঘোষণা করেন৷ এদিকে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের রাজ্যসরকারও তৎপর হয়ে কিছু নথি প্রকাশ করে৷ অর্থাৎ নেতাজিকে নিয়ে রাজনীতির হিড়িক পড়ে যায়৷
কেন নেতাজি হঠাৎ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন আবার? এভাবে প্রাসঙ্গিক হতে তিনি আদৌ চেয়েছিলেন কি?
২০১৯ সালের ২৩ শে জানুয়ারি উড়িষ্যার কেন্দ্রপাড়ায় নেতাজির জন্মদিন পালন উপলক্ষ করে গণ্ডগোল বাধে বলে খবর৷ জানা যায়, বিজেপি-আরএসএস নেতাজিকে তাদের ভাবাদর্শে দীক্ষিত দেশনায়ক বলে প্রচার করাতেই নাকি গোল বাধে৷ নেতাজী কি সত্যি ছিলেন বিজেপির নিজের লোক? বিভিন্ন দেশনায়ক, বিশেষত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, কাছের মানুষ বলে প্রচার করার একটা ঝোঁক আরএসএস-বিজেপির মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ কেন? অনুমান করা যেতে পারে, এ'ভাবে তারা দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে নিজেদের দল/সংগঠনটির অবস্থান পোক্ত করতে চায়৷ ইতিহাস বরাবরই রচিত হয় ক্ষমতাবানের ভাষ্য মেনে। সে অনুসারে অদলবদল ঘটেই থাকে স্কুলপাঠ্য ইতিহাস থেকে শুরু করে নানা স্তরের ইতিহাসের পঠন-পাঠনে৷ নিজের দলের নেতাদের উপর উজ্জ্বলতর আলো ফেলে ইতিহাস লেখেন সব সরকারপক্ষই৷ তাই কংগ্রেসের আমলে কংগ্রেসের নেতারাই ইতিহাসে প্রাধান্য পেয়েছেন। কিন্তু বিজেপির /আরএসএস এই যে মনীষীদের 'আপন' করে নিতে চাইছে, তার জন্য তাদের সত্যের স্থূল অপলাপ করতে হচ্ছে না তো?
এমনিতে স্বাধীনতার যুদ্ধে বিজেপির 'সংগ্রামী' আইকন বলতে আছেন শুধু বিনায়ক দামোদর সাভারকর, যাঁর জীবনের বিপ্লবী অধ্যায় আন্দামানে নির্বাসিত হওয়ার পরই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারপর তিনি ইংরাজ-বিরোধিতা না করার মুচলেখা দিচ্ছেন বা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে বিজেপি নেতা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপায়ীও বলেছেন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন-এর সময় তিনি 'ভুলক্রমে' ধরা পড়েন ও পরবর্তীকালে ক্ষমা চেয়ে ছাড়া পান। এমতাবস্থায়, স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ না হোক, অন্তত পরোক্ষ সংযোগ তৈরি করার চেষ্টায় দলটি মরিয়া হয়েই কি কাছে টানতে চাইছে কোন কোন মনীষী-কে?
বিজেপি গান্ধীকে কিয়দংশে আপন করার চেষ্টা করেছে, যিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাণপুরুষ। নেহেরু-বিরোধী প্রচারে তারা ব্যবহার করছে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলকেও। প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী হলে নাকি কাশ্মীর সমস্যাই তৈরি হতে দিতেন না। অথচ নেহেরুর ক্যাবিনেটের এক বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন প্যাটেল এবং কাশ্মীর বিষয়ক সিদ্ধান্তে তাঁর কোনো 'নোট অফ ডিসেন্ট'-ও পাওয়া যায় না। তাঁর সঙ্গে নেহেরুর মতানৈক্য নিশ্চয় ছিল, কিন্তু তা ছিল নগণ্য। অন্যদিকে, চরমপন্থী ক্রান্তিকারী ভগৎ সিং-কে আপন করে নেওয়ার চেষ্টাটি আরোই চমকপ্রদ, কারণ তিনি ছিলেন আপাদস্তক বামপন্থী বিপ্লবী।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে নেতাজীর ক্ষেত্রে। বলা হচ্ছে, হিন্দু মহাসভার বিনায়ক দামোদর সাভারকরই নাকি নেতাজিকে বলেছিলেন অক্ষশক্তির সঙ্গে আঁতাত গড়ে ইংরাজদের বিরুদ্ধে লড়তে৷ আরএসএস-এর সঙ্গে আবার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজের তুলনা টানারও চেষ্টা চলছে৷ প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে নেতাজির জাতীয়বাদ ও সাভারকরের জাতীয়তাবাদ অনেকটা একই প্রকৃতির। এসব কি সঠিক তথ্য?
ইতিহাস কী বলে?
স্কুল-পাঠ্য ইতিহাসেও জানা যায়, নেতাজী জীবনের বেশির ভাগ সময়েই ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য। পর পর দুবার কংগ্রেসের সভাপতিও নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে তিনি ত্রিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। কংগ্রেসের মধ্যে থেকেও তাঁর মতাদর্শ ছিল সমাজবাদ-অভিমুখী, জওহরলাল নেহেরুরও তা-ই। কিন্তু লড়াই-এর পদ্ধতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের নেতাদের মতপার্থক্য ঘটে। অহিংস পথে গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করে৷ নেতাজি সশস্ত্র সম্মুখ সমরের পথ অবলম্বন করার পক্ষপাতী ছিলেন৷ তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অক্ষশক্তি( জার্মানী ও জাপান)-র সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করেন৷
উল্লেখ্য, এর আগেও,কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত দেয়, সেখানে সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেন। জওহরলাল নেহরু সহ অন্যান্য যুবনেতারা তাঁকে সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রস পূর্ণ স্বরাজের অ্যাজেন্ডা গ্রহণে বাধ্য হয়।
মূলত মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনার পর তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ শাসক তাঁকে এগারবার কারারুদ্ধ করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও তাঁর সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; বরং ব্রিটিশদের দুর্বল সময়ের সদ্ব্যাবহার করে স্বাধীনতা অর্জন করা যাবে বলে তিনি ভাবেন । যুদ্ধের সূচনালগ্নেই তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান পাড়ি দ্যান তাদের সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন। এই বাহিনীর সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুর-সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর।
নেতাজী দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে এই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি মূলত গড়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসুর হাতে। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রাসবিহারী বসু এই সেনাবাহিনীর দায়িত্ব সুভাষ চন্দ্র বসুকে হস্তান্তর করেন । একটি আলাদা নারী বাহিনী (রানি লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট)সহ এতে প্রায় ৮৫,০০০ (পঁচাশি হাজার) সৈন্য ছিল। এই বাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল এক স্বাধীন সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় "মুক্ত ভারতের সরকার" (আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ)। এই সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, আদালত ও আইন ছিল। অক্ষশক্তির ৯টি দেশ এই সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে নেতাজি যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
সুভাষচন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর আইএনএ-র হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে আইএনএ-তে যোগ দেবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন ঘটল না। যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে সঙ্গে জাপান তার সৈন্যদের আইএনএ থেকে সরিয়ে নিতে থাকে। জাপান থেকে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অবশেষে, জাপানের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে আইএনএ-ও আত্মসমর্পণ করে। মনে করা হয়, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইহোকুতে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নেতজির মৃত্যু হয়। তবে এই তথাকথিত দুর্ঘটনা ও তাঁর মৃত্যুর বিরুদ্ধ-প্রমাণও আছে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো ঐতিহাসিকরাও মনে করেন বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়নি৷
নেতাজির সমকালে আরএসএস-হিন্দু মহাসভা
যাইহোক, এবার দেখা যাক আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার কার্যাবলী৷ এইসময় আরএসএস কী করছিল? এমএস গোয়ালকর তাঁর সংগঠনের শাখায় শাখায় সেবকদের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধিতা থেকে বিরত থাকার বাণী প্রচার করছিলেন। হিন্দু মহাসভা কী করছিল? সাভারকর স্বয়ং যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরাজ ও মিত্রশক্তির পক্ষে থাকতে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন। তাহলে কী ভাবে এঁদের আর নেতাজির মতাদর্শ এক হওয়া সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে, মুসলিম লিগ-হিন্দু মহাসভা-আরএসএস, এই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি কেউই সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধিতা করেনি৷ নিজের নিজের সম্প্রদায়ের সুবিধা আদায়ই তাদের লক্ষ্য ছিল৷
বিজেপির আইকন সাভারকর ব্রিটিশদের পূর্ণ সামরিক সহযোগিতা দেওয়ার কথা স্পষ্ট বলেছিলেন মাদুরাইতে হিন্দু মহাসভার ২২ তম সেশনে ও ভাগলপুরে ২৩ তম সেশনে। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক শামসুল আলম 'সাভারকর সমগ্র' থেকে সাভারকরের উক্তি তুলে তুলে দেখিয়েছেন এই সত্য। ২২ তম কংগ্রেসে সাভারকর বলছেন, নীতিবোধের কথা বাদ দিলেও, যেকোনো সুবিবেচকের উচিত ইংরেজদের সাহায্য করা, কারণ বিশ্বযুদ্ধে ইংরাজ মোটেও এমনভাবে পরাস্ত হবে না, যাতে তারা ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। হিন্দুসভার কার্যনীতি তখনই স্থির হয়ে গেছিল৷ ২৩ তম কংগ্রেসে সাভারকর আবার বলেন-
'So far as India’s defence is concerned, Hindudom must ally unhesitatingly, in a spirit of responsive co-operation with the war effort of the Indian government in so far as it is consistent with the Hindu interests, by joining the Army, Navy and the Aerial forces in as large a number as possible and by securing an entry into all ordnance, ammunition and war craft factories…Again it must be noted that Japan’s entry into the war has exposed us directly and immediately to the attack by Britain’s enemies. Consequently, whether we like it or not, we shall have to defend our own hearth and home against the ravages of the war and this can only be done by intensifying the government’s war effort to defend India. Hindu Mahasabhaits must, therefore, rouse Hindus especially in the provinces of Bengal and Assam as effectively as possible to enter the military forces of all arms without losing a single minute.'
অর্থাৎ হিন্দুদের নিজ-স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জাপানের বিরুদ্ধে ইংরাজদের সামরিক শক্তি বাড়াতে হবে। এ'ব্যাপারে অসম ও বাংলার হিন্দুদের উৎসাহিত করতে হবে৷
যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নতুন নতুন সামরিক বাহিনী গঠনের প্রয়োজন পড়ল, তখনও সাভারকরের হিন্দু মহাসভাই হিন্দুদের সৈন্য হিসেবে নাম লেখানোর জন্য প্ররোচণা দিতে লাগল, যা নেতাজির কাজ ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। সাভারকর এই সময় সরাসরি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য নিয়োগের কর্মকাণ্ডের অংশ ছিলেন বলেও জানা যায়। এই সৈন্যবাহিনী পরবর্তীকালে নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীকে নির্মম ভাবে দমন করে। হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে একাধিক 'নিয়োগ কমিটি' গঠিত হয়। হিন্দুমহাসভার উদ্যোগেই কেন্দ্রীয় উত্তর-ভারতীয় হিন্দু মিলিটারাইজেশন বোর্ড ও কেন্দ্রীয় দক্ষিণ-ভারতীয় হিন্দু মিলিটারিরাজেশন বোর্ড গঠনের কথাও জানা যাচ্ছে, যারা হিন্দু সিপাহীদের নানাবিধ অভিযোগ শুনত৷ দুটি বোর্ডের মাথারাই ছিলেন হিন্দু মহাসভার নেতাবৃন্দ। এমনকী মুসলিম-লিগ, যারা ইংরাজদের সরাসরি বিরোধিতা কখনও করেনি, তারাও অন্তত এভাবে ইংরাজদের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেনি।
সাভারকর যাদের হয়ে সুপারিশ করতেন, ব্রিটিশ
সৈন্যবাহিনীতে তাদের চাকরি ছিল পাকা। এমনটাই বোঝা যায় তাঁর এক ধন্যবাদার্থক টেলিগ্রাম থেকে। কমান্ডর ইন চিফ ও ভারতের ভাইসরয়কে তিনি টেলিগ্রাম করছেন দুই পরিচিত ব্যক্তির নিয়োগের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে।
'YOUR EXCELLENCY’S ANNOUNCEMENT DEFENCE COMMITTEE WITH ITS PERSONNEL IS WELCOME. HINDUMAHASABHA VIEWS WITH SPECIAL SATISFACTION APPOINTMENT OF MESSERS KALIKAR AND JAMNADAS MEHTA.'
এই বাহিনীই পরবর্তীকালে নির্মমভাবে দমন করে আজাদ হিন্দ ফৌজকে। তাহলে সাভারকর মূলত নেতাজির স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাই করেন৷
ফরোয়ার্ড ব্লকের সাপ্তাহিক কাগজে ৪ মে, ১৯৪০ সালে সুভাষ যা লিখছেন, তা এরকমঃ
‘That was a long time ago when prominent leaders of the congress could be members of the communal organisations like Hindu Mahasabha and Muslim League. But in recent times, the circumstances have changed. These communal organisations have become more communal than before. As a reaction to this, the Indian National Congress has put into its constitution a clause to the effect that no member of a communal organisation like Hindu Mahasabha and Muslim League can be a member of an elective committee of Congress.’
অর্থাৎ এককালে সাম্প্রয়ায়িক দলগুলির সদস্য হয়েও কংগ্রেসের সদস্য হওয়া যেত, কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে, এরা আরও সাম্প্রদায়িক হয়েছে, তাই কংগ্রেসের সংবিধান বদলেছে এবং এখন হিন্দু মহাসভা বা মুসলিম লিগের মতো সংগঠন করার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস করা যায় না৷।
হিন্দু মহাসভায় যোগ দেওয়ার পর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি নিজের ডায়রিতে বলছেন, সুভাষচন্দ্র তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। বলেছেন, বাংলায় হিন্দু মহাসভাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করলে তিনি বাধা দেবেন।
“He ( Subhash Chandra Bose) would see to it, BY FORCE IF NEED BE, THAT IT WAS BROKEN BEFORE IT WAS REALLY BORN.”
কেন? কারণ তিনি মনে করতেন হিন্দু মহাসভার মতো সাম্প্রয়ায়িক শক্তির দ্বারা ভারতের কোনো মঙ্গল হতে পারে না৷ পরবর্তীকালে বলরাজ মাধক নামক হিন্দু মহাসভার আরেক নেতার বয়ানে জানা যাচ্ছে, ডঃ মুখার্জী কলকাতায় সভা আয়োজন করার চেষ্টা করলেই সুভাষচন্দ্র ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা নাকি বাধা দিচ্ছেন৷
গুমনামি বাবা
অন্তর্হিত নেতাজির সঙ্গে জনৈক গুমনামি বাবার
সাদৃশ্যের গল্পও নতুন করে চাউর করা হচ্ছে সুপরিকল্পিত ভাবে। বাংলায় এই মর্মে সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত একটি ছায়াছবিও নির্মিত হয়েছে। অথচ মুখার্জি কমিশনের মত অনুসারে গুমনামি বাবা বা ভগবানজি আদৌ নেতাজি নন। তিনি নিজেও কখনও তা দাবি করেননি। এই সাধুর জিনিষপত্র খানাতল্লাশি করেও এমন কিছুই পাওয়া যায়নি, যার কারণে তাঁকে নেতাজি বলে দাবি করা যায়। বসু পরিবারও তাঁকে নেতাজি বলে মানতে নারাজ। উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদের এই সাধু এমনই সুবিখ্যাত হয়েছিলেন যে অখিলেশ যাদব তাঁর নামে মিউজিয়ামও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নেতাজীর দৌহিত্রের পুত্র ও হাভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুগত বসু স্বাভাবিক ভাবেই উক্ত ছায়াছবি নিয়ে আপত্তি তোলেন৷ নেতাজির আরেক দৌহিত্রের পুত্র চন্দ্র কুমার বসু বিজেপির নেতা হওয়া সত্ত্বেও এই ছবির বিরোধিতাই করেন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে। ছবির আসল খুঁটি হল, দিল্লি-নিবাসী প্রাক্তন সাংবাদিক অনুজ ধর, পরে তাঁর সঙ্গী চন্দ্রচূড় ঘোষ ও তাঁদের ‘মিশন নেতাজি’ সংস্থার গবেষণা। তাঁদের দাবি, সে দিন আদৌ কোনও বিমান দুর্ঘটনাই হয়নি। না ঘটতেই পারে। তা বলে, গুমনামি বাবাকেই নেতাজি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সপক্ষেও কোনো প্রমাণ নেই।
এই গুমনামি বাবা ফৈজাবাদে ১৯৮৫ সালে মারা যান। তাঁকে ঘিরে এমন গুজব ছড়িয়েছিল যে সন্দেহ নিরসন করতে ২০১৩ এলাহাবাদ হাইকোর্টকে বিশেষ প্যানেল গঠন করতে হয়েছিল বাবার আসল পরিচয় খুঁজতে৷ তিনি যে নেতাজি ছিলেন না, সে ব্যাপারে প্যানেল নিশ্চিত হয়। হঠাৎ করে বিগত বছরখানেক ধরে এই গুমনামি বাবা আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছেন। নতুন করে তাঁকে নিয়ে লেখালেখি, ছবি হচ্ছে৷ এখানে আসল কথাটি বলে রাখা যাক। তথাকথিত এই গুমনামি বাবার জিনিষপত্রের মধ্যে আরএসএস-এর গোয়ালকরের একটি চিঠি পাওয়া গেছিল৷ সুতরাং নেতাজিকে গুমনামি বাবা প্রমাণ করতে পারলেই আরএসএস-এর সঙ্গে তাঁর যোগ প্রমাণ করা যায়৷
ধর্মনিরপেক্ষ নেতাজি
বলা বাহুল্য, বিজেপির মূল বিরোধী যেহেতু নেহেরু পরিবার তথা কংগ্রেস, সুতরাং নেহেরু বনাম সুভাষ ন্যারেটিভটি তাদের প্রচারকার্যের জন্য উপযুক্ত। তারা প্রচার করছে যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেহরু ও গান্ধী পরিবারের কৃতিত্ব জাহির করতে গিয়ে নাকি সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানকে খাটো করে এসেছে কংগ্রেস৷ এ কথা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। নেতাজির ফাইল ইত্যাদি জনসমক্ষে আনার প্রস্তাবও অতি সাধু। কিন্তু তার পিছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অন্য হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল৷ সেই উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সুহাসিনী সায়গল(সিপিএম-এর পলিটবুরো মেম্বার ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর লক্ষ্মী সায়গল-প্রেম সায়গলের কন্যা) নেতাজির ধর্মনিরপেক্ষ ভাবাদর্শে আলোকপাত করে তাই বারবার মনে করাচ্ছেন যে, নেতাজি কোনোমতেই বিজেপির লোক নন৷
নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণ যখন একে অপরের সংগ্রামের সাথী (কমরেড ইন–আর্মস) হয়ে উঠবে, তখন সকলের জীবন একই লক্ষ্যে নতুন প্রেরণায় জাগ্রত হবে এবং এরই সঙ্গে গড়ে উঠবে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, উন্মোচিত হবে এক নতুন দিগন্ত, উন্মেষ ঘটবে এক নতুন দৃষ্টির৷ এই বিপ্লব যেদিন আসবে সেদিন ভারতীয় জনগণ এক পরিবর্তিত জনগণে পরিণত হবে৷ … দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার ক্যানসার নির্মূল করা …বর্তমান অবস্থায় প্রায় অসম্ভব মনে হতে পারে৷ কিন্তু এই কাজই অনেক সহজ হয়ে যাবে যদি একটি বার আমরা সমগ্র জাতিকে জড়িয়ে বিপ্লবী মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে পারি’’৷
তিনি বললেন, ‘‘গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত খণ্ড চিন্তা নয়, সমগ্র জাতিকে জড়িয়েই চিন্তা করতে ও অনুভব করতে আমাদের শিখতে হবে৷ সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রের যে সত্যটি সম্বন্ধে আমাদের নিরক্ষর দেশবাসীর চোখ আমাদেরই খুলে দিতে হবে, তা হল, ধর্ম, জাত ও ভাষার পার্থক্য থাকলেও আর্থিক সমস্যা ও অভিযোগগুলি আমাদের সকলেরই এক৷ … দারিদ্র ও বেকারি, অশিক্ষা ও রোগগ্রস্ততা, কর ও ঋণের বোঝা সব সমস্যাই হিন্দু ও মুসলমান সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের জনগণকে একইভাবে আঘাত করে এবং এগুলির সমাধানও সর্বাগ্রে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করে৷’’
সুভাষচন্দ্র স্বয়ং কংগ্রেসকে সেকুলারিজমের আদর্শে দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়া উচিত৷ ধর্ম ব্যক্তি বিশেষের হওয়া উচিত৷ ব্যক্তি হিসাবে মানুষ যে ধর্ম পছন্দ করে তা অনুসরণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে৷ কিন্তু ধর্মীয় বা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়৷ তা পরিচালিত হওয়া উচিত শুধুমাত্র অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিচার বুদ্ধি দিয়ে৷’’
স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু মহাসভার ভূমিকায় অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে নেতাজি ঝাড়গ্রামের এক সভায় বলেছিলেন, ‘‘সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন৷ ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলে হিন্দুমাত্রেই শির নত করে৷ ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে৷ … এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন৷ তাঁদের কথা কেউ শুনবেন না, আমরা চাই দেশের স্বাধীনতাকামী নরনারী এক প্রাণ হয়ে দেশের সেবা করুক। ''
এই হিন্দু মহাসভা ইত্যাদিরই বর্তমান অবতার বিজেপি আজ আরও উগ্রতার সাথে ধর্মান্ধতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই হাতিয়ার করেছে। এদের হাত থেকে নেতাজির ভাবমূর্তিকে উদ্ধার করা কি কর্তব্য নয়?
এটি মিনি-বই হিসেবে ২০২০ সালের বইমেলাতেও প্রকাশিত হয়েছিল।