পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নকশাল - কংগ্রেস হাতে হাত !

  • 27 February, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1137 view(s)
  • লিখেছেন : পার্থ প্রতিম রায়
প্রশ্ন হলো, সি পি আই (এম এল) – সরাসরি বা আড়াল থেকে এটা করছে কেন ? সত্তর দশকের জরুরী অবস্থার সময় কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের হত্যালীলার নায়ক কংগ্রেস, বা বিহারে সি পি আই (এম এল) এর ছাত্র নেতা চন্দ্রশেখরকে হত্যার পেছনে থাকা আরজেডি আজ সি পি আই (এম এল) এর মঞ্চে কেন ? বা এদের সবাইকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী মঞ্চে শামিল করার পেছনে সি পি আই (এম এল) এর উদ্দেশ্য কি ? এটা কি অনেকটা জ্যোতি বসুর সময়ের সি পি এম কে অনুকরণের চেষ্টা নয় ? উত্তর খুঁজলেন পার্থ প্রতিম রায়

সম্প্রতি বিহারের রাজধানী পাটনায় সি পি আই (এম এল) লিবারেশন দলের একাদশ পার্টি কংগ্রেস হয়ে গেল । সবাইকে অবাক করে মঞ্চে হাজির ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি সলমন খুরশিদ । ছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবও । সি পি আই (এম এল) এর দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সাথে হাতে হাত তুলে কংগ্রেস সহ সকলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনীতির একটি নতুন সমীকরণের ইঙ্গিতও দিয়েছেন । নীতীশ বলেছেন, আমরা তো তৈরি, কংগ্রেস তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসুক – আমরা অপেক্ষা করছি । তার সাথে তেজস্বী যাদব রিজিওনাল দলের গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, যে যেখানে শক্তিশালী সেখানে সে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ুক । আর কংগ্রেসের সলমন খুরশিদ এই আহ্বানকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ভালোবাসা জানানোর ব্যাপারে কে আগে আই লাভ ইউ বলবে সেটাই আসল সমস্যা । জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে, সাংবাদিক সম্মেলনে এনিয়ে জোরালো আলোচনার সূচনা হয়েছে । অথচ এই যে এতসব ঘটলো, এসবের পেছনে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সূক্ষ্ম ভূমিকা সবার চোখ এড়িয়ে গেল । দিল্লির এক বরিষ্ঠ সাংবাদিক অবশ্য একটি সংবাদ মাধ্যমে এটা বলে ফেল্লেন যে দীপঙ্করের পার্টির ডাকে এক মঞ্চে এসে জেডিইউ, আরজেডি বা কংগ্রেসের নেতারা সেটাই বলে গেলেন যা দীপঙ্কর তাদের দিয়ে বলাতে চেয়েছেন । আসলে, সি পি আই (এম এল) লিবারেশন, বিহার বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই বিজেপিকে আটকানোর যে কৌশলের কথা বলে চলেছে, যা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আহ্বানের মধ্যে নিহিত ছিল, ঠিক সেটাই পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে সর্বভারতীয় নেতাদের দিয়ে দীপঙ্কর বলিয়ে নিয়েছেন । ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইতে বামপন্থী ও কমিউনিস্টদের ঐতিহাসিক ভূমিকা মনে রেখে, সি পি আই (এম এল) কিভাবে আজ তা পালন করবে, এবারের পার্টি কংগ্রেস যে মূলত সেই লক্ষ্যে নিয়োজিত তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি । প্রচারের আলোর বাইরে থেকেও কিভাবে রাজ্য বা জাতীয় রাজনীতির ধারাকে প্রভাবিত করা যায়, সি পি আই (এম এল) তার একটি উদাহরণ হয়ে উঠছে । ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইতে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ভূমিকা নিয়ে নরেন্দ্র মোদিও কিন্তু বেশ সচেতন ।  তাই তার বক্তৃতায় বন্দুকধারী নকশালদের পাশাপাশি কলমধারী ও মগজধারী নকশালদেরও তিনি তার প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্ণিত করতে ভুল করেন না । এভাবেই ভারতীয় ফ্যাসিবাদ তার প্রধান শত্রুকে চিহ্ণিত করার মধ্য দিয়ে নিজেকেই আরো জোরালো ভাবে চিহ্ণিত করছে । অন্যদিকে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের ভারত জোড়ো যাত্রা, একের পর এক বামপন্থী শ্লোগানের মধ্য দিয়ে এক নতুন পরিচিতি তৈরির প্রকল্পে নেমেছে যা ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইতে কংগ্রেসের ভূমিকাকে আরো বেশি করে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে । কংগ্রেসের রায়পুর অধিবেশনের আগে, সি পি আই (এম এল) এর এই পার্টি কংগ্রেস, বিজেপি বিরোধী রাজনীতিতে নিজের ভূমিকা খুঁজে পেতে কংগ্রেসকে যে পরোক্ষে সাহায্য করবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই । ইতিমধ্যেই রায়পুরে মল্লিকার্জুন খাড়গের বক্তৃতায় এর আভাস পাওয়া গেছে ।

 

এখন প্রশ্ন হলো, সি পি আই (এম এল) – সরাসরি বা আড়াল থেকে এটা করছে কেন ? সত্তর দশকের জরুরী অবস্থার সময় কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের হত্যালীলার নায়ক কংগ্রেস, বা বিহারে সি পি আই (এম এল) এর ছাত্র নেতা চন্দ্রশেখরকে হত্যার পেছনে থাকা আরজেডি আজ সি পি আই (এম এল) এর মঞ্চে কেন ? বা এদের সবাইকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী মঞ্চে শামিল করার পেছনে সি পি আই (এম এল) এর উদ্দেশ্য কি ? এটা কি অনেকটা জ্যোতি বসুর সময়ের সি পি এম কে অনুকরণের চেষ্টা নয় ? একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে এটা সম্ভব হচ্ছে বিহারের জাতপাত ভিত্তিক সামন্ত সমাজের বুকে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে রাজনীতি করার অভিজ্ঞতার কারণে ।  হিন্দি বলয়ের রাজ্য বিহার, জাত ও ধর্ম ভিত্তিক ভারতীয় সমাজের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ । দীর্ঘদিন এখানে জাতভিত্তিক সংঘাত ও উঁচু জাতের অস্ত্রধারী গুন্ডাবাহিনী দিয়ে দলিতদের একের পর এক গণহত্যা, রাজনীতির জমিকে ভয়ংকর কঠিন করে তুলেছিল । সেই কঠিন জমিতে দাঁড়িয়ে জাতভিত্তিক পরিচিতির আড়ালে থাকা অর্থনৈতিক ও শ্রেণি পরিচিতিকে সামনে নিয়ে আসার কষ্টসাধ্য দীর্ঘমেয়াদী কাজ সি পি আই (এম এল) করে এসেছে ও সফল হয়েছে । উঁচু জাতের হাতে নিচু জাতের মানুষদের লাগামহীন গণহত্যা আজ অতীত ইতিহাসের বিষয় । বিহারের রাজনীতি আজ আর শুধু জাতভিত্তিক নয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়, যেমন, শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য, মূল্যবৃদ্ধি, বন্দিমুক্তি ইত্যাদি আজ রাজনীতির প্রধান ইস্যু । তাই বিধানসভায় মাত্র ১২ টি আসন থাকা সত্বেও সি পি আই (এম এল) এর পার্টি কংগ্রেসকে নীতীশ, তেজস্বী বা সলমন খুরশিদরা গুরুত্ব দিতে বাধ্য হন । লোকসভায় সি পি এমের ৬০ টির বেশি আসন থাকা কালে বিরোধী রাজনীতিতে জ্যোতি বসুর দলের গ্রহণযোগ্যতা, আর লোকসভায় একটিও আসন না থাকা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের দলের বিরোধী রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা তাই এক বিষয় নয় ।

 

বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এই দেশের বৈচিত্র কে ফ্যাসিবাদ মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরির জন্য ব্যবহার করার ষড়যন্ত্র করে । শুধু ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠকে কেন্দ্রীয় ভাবে পক্ষে আনা নয়, স্থানীয় ভাবে বিভিন্ন ধরণের জাতি ও সংস্কৃতির মধ্যে দন্দ্ব তৈরি করে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠকে পক্ষে আনার জন্য ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়াও ফ্যাসিবাদীদের কৌশল । এই ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করতে পারা সহজ কাজ নয়, যদি না জাতপাত – ভাষা – সংস্কৃতি – ধর্ম – অর্থনীতির জটিল আন্তসম্পর্ককে বোঝা যায় । ধর্ম, জাতি, ভাষা – উপভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্রে দীর্ণ বিহারের মাটিতে সুদীর্ঘ লড়াই এর অভিজ্ঞতা থেকে সি পি আই (এম এল) এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অর্জন করেছে । তাই বিহারের রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদের কৌশল গুলি অনেক ক্ষেত্রেই পরাস্ত হয় । যেমন, সি পি আই (এম এল) এর মঞ্চ থেকে নীতীশ কুমারের দেওয়া বিরোধী ঐক্যের আহ্বানের ঠিক পরেই জে ডি ইউ থেকে উপেন্দ্র কুশওয়াহার পদত্যাগ ও নতুন দল গঠন, কোনো রাজনৈতিক অভিঘাত তৈরি করতে পারেনি । মানুষের সাথে থেকে প্রতিদিন লড়াই করতে করতে সমাজ ও অর্থনীতিকে বোঝা, আর ক্ষমতার অলিন্দে বিচরণ করতে করতে বোঝা – এই দু’য়ের মধ্যে অনেক তফাৎ । পশ্চিমবঙ্গে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ শ্লোগানের তাৎপর্যও এই তফাৎ টাকেই দেখিয়ে দেয় । ফ্যাসিবাদ বিরোধী দেশব্যাপী সংগ্রামে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যদের রাজনৈতিক কৌশলকে বুঝতে হলে এই তফাৎটাকে বুঝতে হবে ।

0 Comments

Post Comment