পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ইন্ডিয়া জোটের কাছে আমাদের প্রত্যাশা

  • 24 June, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 721 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে, আবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী, তবে এবার তাঁর ক্ষমতা কিছুটা হলেও কমেছে। তবে বিরোধীরাও কিঞ্চিৎ শক্তি বাড়িয়েছে। এবার এই নতুন সরকারকে কীভাবে চাপে রাখা সম্ভব, তা নিয়ে একটু কথা বলার প্রয়োজন। আজ থেকেই শুরু হচ্ছে, সংসদের নতুন অধিবেশন, তার আগে এই কথাগুলো হয়তো প্রাসঙ্গিক হলেও হতে পারে।

নির্বাচন পর্বের শেষে অষ্টাদশ লোকসভা গঠিত হয়ে গেছে। নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীর ছাপ্পান্ন ইঞ্চি নেতৃত্বে নব নির্বাচিত বিজেপি পরিচালিত মন্ত্রীসভাও তার কাজ যথারীতি শুরু করেছে। যথা, সৈয়দ হুসেন এবং অরুন্ধতী রায়কে চোদ্দ বছর আগেকার কোনো বক্তৃতার ভিত্তিতে ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তারির আয়োজন এবং আদানিকে ছত্তিসগড়ে কয়লা তোলার জন্য একটা আস্ত জঙ্গল প্রদান। কাজের মধ্য দিয়েই তো কার্যকর্তাদের চেনা যায়। বিজেপি-র নির্বাচনী ইস্তাহার খুঁজলে এই দুটি কাজের প্রাক-ভোট প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাবে না। মোদী তৃতীয় পর্বের গ্যারান্টি যুক্ত জুমলাবাজির যাত্রা এইভাবেই শুরু হল। মোদীর গত পাঁচ বছরের স্বচ্ছ শাসন কালে ভারতের মোট ৬,৬৮,৪০০ হেক্টার জঙ্গল সাফ হয়েছে। আরও খানিক না হয় হল। গণতান্ত্রিক অধিকার এবং বাক্‌স্বাধীনতাও একই ভাবেই দেশে সাফ হয়ে চলেছে। আরও সাফ হওয়ার গ্যারান্টি দামোদর দিয়েই রেখেছেন।  

এই অবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী অবস্থানে বসে ইন্ডিয়া জোটের কিছু যে করণীয় আছে তা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে আগামী সপ্তাহেই যখন নতুন সংসদের অধিবেশন শুরু হচ্ছে, সেখানে সকলে মিলে একমুখী হয়ে সম্মিলিত ভূমিকা পালনের অবকাশ তৈরি হচ্ছে।

প্রথম কাজই হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক অধিকার ও বাক্‌স্বাধীনতার সম্প্রসারণের দাবিতে সোচ্চার হওয়া। সংসদের ভেতরে এবং বাইরে। ভেতরে সংসদীয় নিয়মকানুনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সরকারের স্বৈরাচারী পদক্ষেপগুলিকে নগ্নভাবে উন্মোচন করে দিতে হবে। যেভাবে ভিমাকোরেগাও মামলায় বিচার শুরু না করে বিনা বিচারে এতগুলো বিশিষ্ট মানুষকে বছরের পর বছর জেলে পুরে রাখা হয়েছিল এবং স্টান স্বামীকে মেরে ফেলা হল, তার জবাবদিহি চাইতে হবে। সেই ধারাতেই অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে মামলার তোড়জোরের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে।

দ্বিতীয়ত সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে বিষাক্ত ধোঁয়া বিজেপি এবং বিশেষ করে তার দুই প্রধান মাতব্বর নরেন মোদী এবং অমিত শাহ দেশ জুড়ে ছড়িয়েছে, সেই সব মন্তব্যের অডিও ও ভিডিও ক্লিপ সংগ্রহ করে সংসদে উত্থাপন করে রেকর্ড করানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এমন ভাবে, যাতে সংখ্যাধিক্যের জোরে যদি শাসক ফ্রন্ট তাকে আটকেও দেয়, বিভিন্ন বড় ও ছোট গণমাধ্যমের প্রচারে তা দেশে ও বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। তার ভিত্তিতে দুই মন্ত্রীর কৈফিয়ত চাইতে হবে সংসদের ফ্লোরে।

এবং বাইরেও। অর্থাৎ, প্রচুর জনসভা করে করে এই সব ক্লিপ দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, কারা আজ শাসন তখতে বসে আছে, কীভাবে তারা দেশবাসীকে দেখছে।

ইন্ডিয়া জোটকে সমস্ত কালা আইন প্রত্যাহারের জন্য সরব হতে হবে। ইউএপিএ এবং দেশদ্রোহ আইন, অতীতে যে উদ্দেশ্যেই তা চালু হয়ে থাকুক না কেন, তা যে কেবল মাত্র বিরোধীদের কণ্ঠস্বর রোধ করার জন্যই ব্যবহার হয়ে চলেছে, তা এর অপপ্রয়োগ দেখে বুঝতে আর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে জোটভুক্ত বামপন্থী দলগুলিকে প্রয়োজনে এই দাবিতে যুক্তি ও তথ্য সহ আওয়াজ তুলতে হবে এমন ভাবে যাতে কংগ্রেস সহ অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলের নেতারাও তা মানতে বাধ্য হন। আর এই মুহূর্তে অরুন্ধতী রায় এবং সৈয়দ হুসেন-এর মামলা এই অপপ্রয়োগ বুঝতে ব্যাপক সাহায্য করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

একই সঙ্গে এক দিকে নিট মেগাকেলেঙ্কারির যাবতীয় দায়ভার মোদী সরকারের উপরে চাপিয়ে তারা এর তদন্ত কোথায় কীভাবে করছে, অপরাধীদের কীভাবে চিহ্নিত করছে, পশ্চিম বাংলায় এসএসসি দুর্নীতির তদন্তে যেভাবে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এখন সেই তৎপরতা যাতে তারা দেখায়, তার জন্য সংসদের মঞ্চে যেমন জোরশোর আওয়াজ তুলতে হবে, তেমনই বাইরেও অসংখ্য জনসভা করে এই নিট দুর্নীতির নানা আখ্যানভাগ সাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সমস্ত দেশকে বঞ্চিত করে যেভাবে কয়েকটি সুচয়িত রাজ্যের ঘুস দিতে সক্ষম ছাত্রকে নিটের সুবিধা প্রদান করার ব্যবস্থা করা হয়েছে তাকে কেন্দ্রীয় সরকার এবং কেন্দ্রীয় শাসক ফ্রন্টের বড় শরিকের অপকীর্তি হিসাবেই তুলে ধরতে হবে।

এই সম্পর্কে যে মামলা রুজু হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে সেই প্রক্রিয়ায় ইন্ডিয়া জোটের বড় শরিকদের সামিল হওয়া উচিত। যাতে সমস্ত পক্ষের কথা এবং সমস্ত রাজ্যের কথা আদালতের কানে পৌঁছয়। যে যুক্তিতে রাজ্যের এক্তিয়ার থেকে ডাক্তারি শিক্ষায় ভর্তির পরীক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয় আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতেরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল, সেটা যে ভুল ছিল, আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার। ফলে সুষ্ঠু তদন্তের দাবির পাশাপাশি রাজ্য ভিত্তিক মেডিক্যাল জয়েন্ট পরীক্ষার প্রকরণও ফিরিয়ে আনার দাবিতে সোচ্চার হওয়ার এটাই প্রকৃষ্ট সময়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় শিক্ষা যে যুগ্মতালিকার অন্তর্ভুক্ত, এবং তার অর্থ যে রাজ্যেরও সক্রিয় অংশদারিত্ব, সেই কথাগুলি রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে উঠে আসা এখন অত্যন্ত জরুরি।

সেই সঙ্গে শুধু নিট নয়, গত দশ বছরে মোদী সরকারের আমলে যতগুলি দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে সেই সবগুলিকেই সামনে এনে প্রচার শুরু করা দরকার। এবং একই সঙ্গে তুলে ধরতে হবে, সরকার কীভাবে সেই সব কেলেঙ্কারির ঘটনাকে একের পর এক ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করে গেছে। এর মধ্যে আদানির বিরুদ্ধে হিন্ডেনবুর্গ রিপোর্ট অনুযায়ী তদন্ত, কয়লা কেলেঙ্কারি, শেয়ার বাজারের জালিয়াতি ইত্যাদিকেও ধরতে হবে। ধরতে হবে জাতীয় সড়ক নির্মাণে কেন্দ্রীয় সরকারের (আসলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের) বিপুল দুর্নীতি যা ক্যাগ-এর রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। এর পর ধাপে ধাপে প্রচারে নিয়ে আসতে হবে ভালো নোট বাতিলের ফলে এক টাকাও কালো ধন নিরুদ্ধারের কাহিনি, আর পাশাপাশি সরকারি সিদ্ধান্ত মানতে গিয়ে ১৬৩ জন নাগরিকের অপমৃত্যুর ঘটনা, যা নিয়ে মোদীর সরকার সংসদে একটা শোকবার্তাও উত্থাপন করেনি। তুলে ধরতে হবে করোনার সময় দুই বছরে (২০২০-২১) কেন্দ্রীয় শাসকের চূড়ান্ত অপদার্থতার কথা।

সম্প্রতি (১৭ জুন ২০২৪ সকালে) উত্তর বঙ্গের রাঙাপানিতে কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে এক মালগাড়ির যে ভয়াবহ সঙ্ঘর্ষ হয়েছে, যাতে মৃত্যু সংখ্যা তিরিশ ছাড়িয়ে গেছে এবং আহতের সংখ্যা অগুনতি, সেই ব্যাপারেও রেল মন্ত্রক তথা প্রধান মন্ত্রীকে চেপে ধরার প্রয়োজন আছে। ১৮০০০ ড্রাইভার পদে লোক নিয়োগ বন্ধ রেখে, রেলের নিরাপত্তা বিভাগে ১৭৮০০০ পদ শূন্য রেখে মোদী বন্দে ভারত সহ একের পর এক নতুন নতুন ট্রেন চালু করে চলেছেন, আর চ্যানেলে চ্যানেলে নিজের মুখের ছবি দিয়ে তার প্রচার করে যাচ্ছেন। আসলে সাধারণ নিরীহ রেল যাত্রীদের জীবন ও নিরাপত্তা নিয়ে, এমনকি রেল কর্মচারিদেরও জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে চলেছেন। রাতের পর রাত বিশ্রামহীন ভাবে চালকদের ট্রেন চালাতে বাধ্য করা হচ্ছে।রাঙাপানির ঘটনার পেছনেও পর পর চার দিন নাইট শিফটে গাড়ি চালাতে বাধ্য করার কথাই উঠে এসেছে। গত দুবছরে ২৮টি রেল দুর্ঘটনা দেখার পর এখন এগুলো নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে বললেও কম বলা হয়। দুবছর আগে বালেশ্বরের কাছে করমণ্ডল-ফলকনামা ভয়ঙ্কর সঙ্ঘর্ষের সময় কী এক “রক্ষাকবচ” প্রযুক্তির কথা শোনা গিয়েছিল রেলমন্ত্রীর মুখে। কীরকম একটা আধ্যাত্মিক কবচ যেন! আজ আমাদের এবং ইন্ডিয়া জোটের সদস্যদের সমবেত কণ্ঠে প্রশ্ন করতে হবে, সেই কবচের কী হল? কোন কোন গাড়িতে লাগালেন আপনারা? নাকি সেও সেই ১৫ লাখ টাকার মতোই আর এক সর্বশেষ মোদীয়-জুমলা??

পরিশেষে একটা পরামর্শ দিয়ে রাখছি।

ইন্ডিয়া জোটের শরিক যে যে দলের পরিচালনায় রাজ্য সরকার আছে (যেমন, টিএমসি, সিপিএম, কংগ্রেস, ডিএমকে, আপ, আকালি দল, ইত্যাদি) তারা নিজ নিজ রাজ্যে ১৬৩ জন নোটবাতিল শহিদদের নামে একটা করে এবং কৃষক আন্দোলনের প্রায় সাড়ে সাতশ শহিদদের নামে একটা করে শহিদ বেদী নির্মাণ করতে এবং ব্যাপক হইচই করে তার প্রতিষ্ঠা ও আবরণ উন্মোচন কর্মসূচি নিতে পারেন। এরকম একটা কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারলে শুধু জাতীয় স্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও একটা বিরাট প্রচার তোলা এবং প্রভাব ফেলা যাবে।

তবে এই সব কর্মসূচি সার্থক ভাবে নিতে হলে রাজ্য স্তরের প্রতিটি অবিজেপি শাসক দলের তরফেও নিজ নিজ রাজ্যের সীমানায় গণতান্ত্রিক অধিকারকে সম্মান রক্ষা সম্প্রসারণ করতে হবে। যেমন, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর এবং/অথবা এনকাউন্টারের মতো প্রতিটি ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করাতে হবে এবং দোষী আধিকারিকদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করাতে হবে। পাঞ্জাবের চাষিরা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে তাদের সমর্থন করব আর নিজেদের রাজ্যে শ্রমিক কৃষকদের আন্দোলনে পুলিশ দিয়ে পেটাব—এরকম অবস্থান আর যাই করুক বিজেপি-কে দুর্বল করবে না। পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার জন্যও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

উপরে বর্ণিত কাজগুলির কোনোটাই খুব কঠিন কিছু নয়। সদিচ্ছা সাহস ও দিশা থাকলেই যথেষ্ট।   

0 Comments

Post Comment