আধুনিক ডাক্তারিবিজ্ঞানের চলনবলন আর মতিগতি দেখে অনেকের মনে গত সত্তরের দশকের গোড়াতেই সংশয় জেগেছিল যে, এই পেশাটা দ্রুত এবং নিশ্চিতভাবে কর্পোরেট উদ্যোগে পরিণত হবে। ‘মেডিকেল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’-এর মতো একটি শব্দবন্ধের সঙ্গে আমাদের তখনই পরিচয়। তার মানে, ডাক্তারি বিজ্ঞান ক্রমশ ‘ডাক্তারি শিল্প’-এর রূপ নেবে, এই শিল্প জনস্বার্থের দাবি মানবে না, বরং জনস্বার্থকেই তার বশম্বদ হতে হবে, এই ছিল সতর্কবাণী। তবু এইসব দুশ্চিন্তা তখন তেমন দানা বাঁধেনি।
গত দু’বছরে করোনা-পারদর্শীদের হুহুঙ্কারে এখন অনেকের কাছেই, বিশেষ করে সরলমনা নাগরিকদের কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সত্তরের দশক পর্যন্ত ডাক্তারির প্রথাগত দর্শন আমাদের জানিয়েছিল যে,
আধুনিক ডাক্তারিতে অল্পকিছু মানুষেরই রোগ নিরাময় হবে, কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, বহু মানুষের কষ্টের উপশম হবে, আর সবচেয়ে বড় কথা, সমস্ত রোগী কিছু না-কিছু সান্ত্বনা পাবেই।
তার মানে, রোগী এবং জনসাধারণের জীবনে স্বস্তি আর শান্তির আয়োজন করাই এই দর্শনের মূল চিন্তা; তাই সে ছিল জনমুখী। কিন্তু এই ধারণাগুলো বিমূঢ়কায় হয়ে পিছু হটতে শুরু করল সত্তরের দশকের শেষ থেকে।
আধুনিক ডাক্তারিতে প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্যই ছিল। এর পর আধুনিক প্রযুক্তির ঘোড়া এমন উচ্ছল গতিতে ছুটতে থাকল যে আমরা ভাবলাম, নতুন নতুন প্রযুক্তির অলংকারসজ্জা্য ডাক্তারি বিদ্যাদেবী আরও রূপবতী হবেন, তাতে মানুষেরই লাভ। বুঝিনি যে, কর্পোরেট যদি প্রযুক্তির মালিক হয় তাহলে তা নিয়ে যথেচ্ছাচার হবে, তাতে আমাদের ক্ষতি। এসব নিয়ে আশির দশকেও বহু লেখাজোখা হয়েছে, বক্তৃতা হয়েছে, তর্কও। কেউ কেউ আমাদের পরিমিতি বোধের কাছে আবেদন রেখে বলেছিলেন,
ডাক্তারি উপকরণের ঝর্ণাধারায় অবগাহণ করে আমরা আজকাল রোগীর চিকিৎসায় কত কিছুই না করে ফেলতে পারি, কিন্তু আমাদের উচিত, যতটুকু যথাযথ শুধু সেটুকুই করা; আর আসল কথা হল, যা যথাযথ তা কিন্তু অতি সামান্যই।
ডাক্তারদের মনে অমন পরিমিতি বোধ জেগে উঠলে কর্পোরেট বাণিজ্যের বিপদ।
সেই বিপদ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়, বিজ্ঞানচিন্তার অভিমুখ পালটে দেওয়া। তখন নতুন বিজ্ঞান হয়ে যাবে শুকনো তথ্যের সম্ভার; সেই সম্ভার জনজীবনে সেঁটে দেওয়ার নামই নাকি অতি আধুনিক বিজ্ঞান। জনমানুষ কোনও সমসত্ত্ব বস্তুপিণ্ড না, বৈচিত্র্যই তার পরিচয়, তাই সে এত আকর্ষণীয়; এই ছিল আমাদের ধারণা। কিন্তু কর্পোরেট দর্শনের বদ হাওয়ায় কোন জনমানুষের কোনটা দরকার, কতটা, কখন, এই বিবেচনাগুলো ভেসে গেল; তার বদলে এল অন্য এক বিবেচনার যুগ - ডাক্তারি ব্যবসার স্বার্থে কী, কোনটা, কোথায়, কতটা দরকার। যে-পরিষেবা ব্যবসার হিসেবে ক্রমাগত লাভজনক কেবল তাই টিকে থাকবে। ডাক্তারি গবেষণার ধারণাগুলোও বদলাতে থাকল, কীভাবে একই মাপের, একই রঙের জামা সক্কলের গায়ে পরিয়ে দেওয়া যায়। অতএব, ডাক্তারি হয়ে গেল লোভনীয় ব্যবসার প্রকৃষ্ট উপায়।
সেই অতি আধুনিক যুগে চিকিৎসার বিষয়ে চিকিৎসকের নিদান না, অন্তরালে থাকা বাণিজ্যপ্রবরের নির্দেশই শিরোধার্য হবে। ডাক্তারি শিক্ষাপর্বও এমনভাবে গোছানো থাকবে যাতে ছাত্ররা প্রশ্নাতুর না-হয়ে ওঠে। অনেকে বারবার বলেছিলেন, যে-বিজ্ঞান প্রশ্ন করতে শেখায় না, প্রশ্নকে দাবিয়ে রাখে তা অপবিজ্ঞান, বিজ্ঞানের নামে ধর্ষকাম। এখন সেই ধর্ষকামই আমাদের শাসন করে। আশির দশক থেকে আপামর নাগরিক দেখতে থাকলেন, কীভাবে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা রুগ্নতর হতে হতে লজ্জায় অধোবদন হয়ে থাকল, আর অপরদিকে মুনাফালোভী স্বাস্থ্য পরিষেবার জয়যাত্রা। প্রকৃত প্রস্তাবে জনস্বাস্থ্য যে রাজনীতিকেই অনুসরণ করে, সেটা নতুন করে প্রমাণিত হল নয়া উদারতাবাদী, নব্বুইয়ের দশকে এসে। এই সর্বনেশে কাণ্ডে সরকারের কাজ ছিল, সাধ্যমতো তেলা মাথায় তেলের বন্দোবস্ত করা।
কুবেরগোষ্ঠীর মাথা তেল-চকচকে। সেখানে কুবেরশ্রেষ্ঠ হলেন, বিল গেটস। কিন্তু কেবল এইটুকু পরিচয়ে তার সন্তুষ্টি নেই, তাই তিনি নাকি এখন বিশ্বমানবহিতৈষী। তার মানব হিতৈষণার সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থ হয়ে দাঁড়াল, টিকা; পরিবেশে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য, অশালীন শত্রুর বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধের’ সবচেয়ে কেজো অস্ত্র নাকি, টিকাই। আমাদের বিভ্রান্ত, বিবশ করে দিয়ে তিনি ডাক্তারি বইপত্রের ভূমিকাও লিখে দিলেন, ডাক্তারি পত্রিকায় নিজের মনোবাসনার কথাও জানালেন। কিন্তু টিকা দিতে গেলে তার আগে যাচাইপর্ব (ট্রায়াল) থাকে, নিয়মকানুন, আইন থাকে, এক-এক দেশে এক-একরকম। আবার সেগুলো কীভাবে শিথিল করে দেওয়া যায় তা দেখভাল করার জন্য থাকে তারই তৈরি নানান্ সংস্থা। এই সংস্থাগুলোর কাজ হল, আইন আর নিয়মকানুনগুলো যেন শুধু খাতাতেই থাকে, কর্মক্ষেত্রে না।
বিরাট বিরাট ফার্মা কোম্পানিগুলো যে বিরাট বিরাট কেলেঙ্কারির অপসৌধ তা আগেই জানা ছিল; তাই টিকা নিয়ে ব্যাভিচারও ঘটতে থাকল। এমনই দুষ্কাণ্ড ঘটেছিল আমাদের দেশের অন্ধ্রপ্রদেশ ও গুজরাটে। জরায়ুমুখের ক্যানসার রোধ করবার নতুন টিকা নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল হতদরিদ্র কিশোরীদের উপর। বেশ কিছু মৃত্যু ঘটেছিল, বহু কিশোরী চূড়ান্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এর পরেও পরীক্ষাপর্ব থামেনি। এসব নিয়ে জনজীবনে কোলাহল উঠেছিল। সংবাদমাধ্যমের কোনও প্রশ্নের জবাব সরকারি অধিকর্তারা দেয়নি। এইসব বর্বরকাণ্ডে যে ফার্মা কোম্পানিগুলোর প্রত্যক্ষ হাত থাকে, কর্পোরেট বাণিজ্যকুশলীদের সঙ্গে খোদ সরকারের সেই অন্যায্য যোগসাজশের কথা আমাদের দেশের সম্মানীয় গবেষকরাও জানিয়েছেন। পরিস্থিতি তাতে পালটায়নি।
কারণ, সমস্যাটা দেশীয় না, আন্তর্জাতিক। মুদ্রামুর্ছনার ব্যঞ্জনা অতি ভয়ংকর। বেশ কিছু গবেষক, শিক্ষক এবং বিশেষজ্ঞের লেখায় সমৃদ্ধ ‘হ্যারিসন্স প্রিন্সিপলস অফ ইন্টারনাল মেডিসিন’ বইটি আধুনিক ডাক্তারিবিদ্যা্য বিপুলভাবে সমাদৃত, সম্মানিত। কিন্তু এই সম্মান কতটা যথার্থ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল ২০১৮ সালে, ‘ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল’-এ।
২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ওই সমাদৃত লেখকদের অনেকেই বড় বড় ওষুধ কোম্পানি এবং ডাক্তারি উপকরণ তৈরির সংস্থাগুলোর কাছ থেকে টাকা পেয়েছিলেন, যার পরিমাণ ছিল অন্তত ১১ মিলিয়ন ডলার।
এমনকী, ওই বইটির লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই বহু ওষুধ এবং ডাক্তারি উপকরণের স্বত্তাধিকারীও বটেন। গবেষকরা জানিয়েছিলেন যে, ২০১৪ সালেও দেখা গেছে, অন্তত একজন লেখকের টাকা নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৫ লক্ষ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার।
টাকা নেওয়াটা অপরাধ না, কিন্তু টাকা যে নিয়েছেন সেকথা গোপন করাটা অপরাধ, অসততা। তাই ডাক্তারি পত্রিকায় বা বইতে কোনও লেখা ছাপাতে গেলে লেখক কোথাও কোনও আর্থিক স্বার্থে জড়িত আছেন কিনা সেকথা জানাতেই হয়। নইলে তাঁরা যেসব চিকিৎসার নিদান বা পরামর্শ দিচ্ছেন তা কতটা নিরপেক্ষ তা নিয়ে সংশয় থাকতে বাধ্য। তাই উপরোক্ত পাঠ্য বইয়ের যেসব গণ্যমান্য লেখকরা তাঁদের আর্থিক স্বার্থ-সম্পর্কের কথা জানাননি, তাঁরা বাস্তবিক, অপরাধী। শুধু তাই না, এই পাঠ্য বইটির প্রখ্যাত প্রকাশক, ‘ম্যাকগ্র-হিল’কে এসব কথা জানানো হলেও তারা কোনও জবাব দেননি। এককথায় তার মানে, কলুষ ঢুকে গেছে বিদ্যাদেবীর মন্দিরে, যা সুন্দর তা অপসৃত হবে।
তথ্য ছাড়া যে ডাক্তারি হয় না, নতুন নতুন তথ্যের আলোয় যে ডাক্তারি বিদ্যাও নতুন প্রাণ পায়, এসব কথা আমাদের জানাই ছিল। আমরা এও জানতাম যে, ডাক্তারি বিজ্ঞানের কর্মস্থল হল, জনমানুষের সমাজ। তাই শুধু পাথুরে প্রমাণ আর শুকনো তথ্য সংগ্রহ করলেই চলে না, বরং সেগুলো খাটাতে হয় এক-একটা সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতি আর সংস্কৃতির চলনের কথা মাথায় রেখে। তবেই ডাক্তারি বিজ্ঞানের প্রতিমায় প্রাণসঞ্চার করা যায়। কিন্তু সেই ধারণা ক্রমশ চুলোয় গেল, শুরু হল তথ্যের গোঁড়ামি। এমনকী, তথ্যের নকল নির্মাণও। তা নিয়েও প্রচুর তর্ক হল; বলা হল, কোনও তথ্য যদি কোনও ব্যাধির ঝুঁকি প্রমাণ করে, তবুও সেই প্রমাণ সকলের উপর একইভাবে খাটে না।
বলা হল, গবেষণাগারের সুনির্দিষ্ট পরিবেশ থেকে যে-তথ্য বেরিয়ে আসে তা জোর করে প্রাণজীবনের উপর খাটানো ভুল, তাতে ব্যাধির ঝুঁকি আর সাক্ষাৎ ব্যাধির তফাৎ গুলিয়ে যায়। রজ্জুতে সর্পভ্রম হলে শুধু বাণিজ্যই বাড়ে, তারই স্বাস্থ্য সমৃদ্ধ হয়, কেননা ব্যাধির অতিনির্ণয় আর অতিচিকিৎসাই তখন বিজ্ঞানের আলখাল্লা পরে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। জনমানুষের পক্ষে তা মর্মান্তিক, উঠতে-বসতে রোগের ভয়ে সে কাতরপ্রায় হয়ে থাকে, অনাবশ্যক আতংকে জবুথবু মানুষ তার স্বচ্ছন্দ জীবনের আহ্লাদ ভুলে যায়, স্বস্তি আর শান্তির মহানিষ্ক্রমণ ঘটে যায়। মোট কথা, ভোগান্তি ছাড়া জনমানুষের কপালে কিছুই জোটে না। আজ এই অতিমারির আবহে সে-কথাগুলোই নতুন করে প্রমাণিত হচ্ছে।
তবে এটাই বোধহয় ‘গ্রেশাম-এর সূত্র’,
খারাপ মুদ্রার দাপটে ভাল মুদ্রার অপসরণ।
ষোল শতকে রাণী এলিজাবেথকে শ্রেষ্ঠীপ্রবর থমাস গ্রেশাম সেকথাই বুঝিয়েছিলেন। আমরা অবশ্য তারও দুশো বছর আগে ‘মুদ্রাব্যবস্থা’ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড দেখেছি! একই সূত্র আজও আমাদের জীবনে অনবরত ঘটে যাচ্ছে... লক্ষ বছরের অর্জিত অভিজ্ঞতা জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে; কান্না, ঘাম আর রক্তের বিনিময়ে আধুনিক ডাক্তারি বিজ্ঞানের চারশো বছরের অর্জিত জ্ঞান কুণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নির্বোধ কর্পোরেট শাসনের সামনে। শুধু জনস্বাস্থ্যই না, যাবতীয় সামাজিক, আর্থিক আর রাজনৈতিক নীতিকৌশল নির্ধারণের ক্ষমতাও চলে যাচ্ছে ধনকুবেরদের হাতে। ছলনাময়ী পাখিরা আমাদের শেষ বস্ত্রখণ্ড, অধিকার বোধটুকুও কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। কুৎসিত অপসৃত করছে সুন্দরকে।
তবুও প্রতিষ্ঠিত ডাক্তারি মহলের একাংশে একই রব, এই নাকি আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা। কিন্তু যে-বিজ্ঞান জনসমাজকে স্বস্তি দেয় না, যে-বিজ্ঞান শর্তহীন আনুগত্য চায় সে তো বিজ্ঞানই না, বিবৃতিমাত্র; তা প্রচারকুশলী রটনাবিদদের কাজ। যুগশ্রেষ্ঠ রটনাবিদদের আমরা দেখেছি, হিটলারের জমানায়, জার্মানিতে। তখনকার নির্মম, নিষ্ঠুর বিজ্ঞানচর্চাও সুবিদিত। মনে পড়ে, সেই জমানায় প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ডাক্তার ‘পবিত্র’ মানুষ গড়ার হিটলারি পরিকল্পনায় মদত জুগিয়েছিল।
তাহলে উপায়? সেকথা ভাবলে মনে পড়ে, ঊনবিংশ শতকের স্মরণীয় গণিতবিদ জ্যাকবি-এর কথা,
সমস্যাগুলোকে উলটো দিক থেকে দেখলেই সমাধানের পথ বেরিয়ে আসে।
উলটো মানে, সহজ জিনিসটা দেখতে হবে একেবারে সহজ ভাবে: কোন নিয়মে কার, কতটা সুখ, কতটা অসুখ। দেখতে হবে, কতটা ছাড়লে কতটা প্রাপ্য, কোন রোগের ঝুঁকিতে কতটা বিপদ, রোগের চেয়ে প্রতিষেধক আর নিরাময়ের যন্ত্রণা বেশি কিনা। জ্যাকবির শিক্ষা মাথায় রেখে, বীজগণিতের নিয়ম মেনে, উলটোদিক থেকে অঙ্ক না-কষলে জনস্বাস্থ্যের নীতি আর কৌশল তৈরি করা যাবে না।
বদান্যতা দেখানো বড় বড়, বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাজ না; তারা ব্যবসায় ‘বিনিয়োগ’ করে, প্রাপ্তিযোগ না-থাকলে তা ভুল বিনিয়োগ। সেটা তাদের দোষ না, কেবল ধর্ম। সেই ধর্ম রক্ষা করা ছাড়া তাঁদের কোম্পানিতে যে আর কোনও ‘মডেল’ নেই সেকথা ‘নোভার্তিস’ কোম্পানির কর্তাই স্বীকার করেছেন। তাই এরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য যা খরচ করে তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ করে বিজ্ঞাপন আর বিক্রিবাটার কলাকৌশলে। দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া আর বিভ্রান্তি ছড়ানো সেই কৌশলেরই অঙ্গ। ২০০০ সালে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার একটি রচনায় বলা হয়েছিল,
‘সম্প্রতিকালে ওষুধ কোম্পানিগুলো যতরকম ওষুধপত্র বাজারে এনেছে তার মাত্র এক শতাংশ গ্রীস্মপ্রধান দেশের ব্যাধিগুলোর জন্য’ ব্যবহারযোগ্য।
সেখানে একথাও বলা হয়েছিল যে, কর্পোরেটদের সদর দপ্তরে সুন্দর করে লেখা থাকে, তারা মানবতা রক্ষায়, পীড়িতের সেবায় নিয়োজিতপ্রাণ। যা লেখা থাকে না তা হল, তাদের মানবতা পীড়িতের পকেটের বাইরে বেরোতেই পারে না। এমন কথা আমরা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ যোসেফ স্টিগলিতস-এর কাছেও শুনেছি, ২০০৬ সালে, ডাক্তারি পত্রিকাতেই।
রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় উন্নয়নশীল আর দরিদ্র দেশগুলো যে নানারকম আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোতে সই করে তার বদলে তারা বঞ্চনা আর অপমান ছাড়া আর কী পায়?
আর এখন, ২০২২ সালের ছবি দেখে মনে হচ্ছে, জানতে পাচ্ছি, কর্পোরেট অনুদান ছাড়া রত্নখচিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও পক্ষাঘাতে কাত।
তাই আজকের অতিমারিতে কর্পোরেট গোষ্ঠী যখন জনহিতে অতিব্যস্ত হয়ে উঠল তখন তাতে আমাদের সন্দেহ জাগবেই, আলবাত। এই যে আজ কয়েকটা নিছক পরীক্ষাপ্রার্থী, যাচাইপ্রার্থী টিকাকে আপামর নাগরিকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হল, আজকের অতিমারি-পালিত বেদজ্ঞ অতিজ্ঞানী্দের মনে তা নিয়ে কেন সন্দেহ জাগেনি, আমরা জানতে চাইব না? এই দুর্লভ জ্ঞানতপস্বীরা তো টিকাবিজ্ঞান, অতিমারির বিজ্ঞান, ডাক্তারি পরিসংখ্যান ইত্যাদি এমনভাবে গুলিয়ে দিতে চায় যাতে কর্পোরেটরাই প্রশ্রয় পেয়ে যায়। অথচ আমাদের জনমানুষের সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি তো এই দেশের মাটি আর জলহাওয়াতেই আছে, নাকি?
অবুঝ নকলনবিসরা জানিয়েছে, এখন নাকি
নতুন নতুন রঙ ধরেছে সোনার পৃথিবীতে...!
ভাল কথা; তবে আমরা বলছি, ‘নতুন’ যদি আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্যের উপযোগী হয়, তাহলে সাদরে মেনে নেব। কিন্তু ‘নতুন’ আদর্শের দাপটে যদি নাগরিক জীবনের হীন, উঞ্ছ প্রবৃতিগুলোই গেড়ে বসে, উচ্ছল অভিজ্ঞতাগুলো যদি রসাতলে যায়, তাহলে তো আপত্তি জানাবই। আপাতত তাদের ‘নতুন’ আদর্শে আস্থা রাখতে পারছি না, কেননা দেখছি, ভাইরাস তার কৌশল পালটায়, অথচ ভাইরাস তাড়াবার আহাম্মকি কৌশলগুলো আর পালটায় না। এই বুদ্ধি নিয়ে তো আর ‘ভাইরাস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হয় না।
বুঝতে আমাদের বড্ড দেরি হয়ে যায়। ‘থ্যালিডোমাইড বিপর্যয়’ বুঝতেও অন্তত চার বছর লেগেছিল। তাই আরও দেরি হয়ে গেলে আমাদেরই সমূহ সর্বনাশ।
তথ্যসূত্র ঃ
https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/NEJM197111042851929
https://www.bmj.com/content/360/bmj.k1118.long
Evidence-based medicine from a social science perspective. Hallam Stevens. Australian Journal of General Practice. Volume 47, Issue 12, December 2018
Scrooge and intellectual property rights. Joseph Stiglitz. British Medical Journal, December 23, 2006, Volume 333, pp. 12
A Bitter Pill for The World’s Poor. Isabel Hilton. The Guardian, Jan 5, 2000
https://economictimes.indiatimes.com/articleshow/41280050.cms
Bill Gates throws down gauntlet to medical researchers. Haroon Ashraf. The Lancet. Vol 361, February 1, 2003.
Medicine as a Corporate Enterprise: A Welcome Step? Poduval M, Poduval J., Mens Sana Monographs, Vol. 6(1), Jan – Dec 2008. P157-174.