সে অনেক কাল আগের কথা। তখন আমি আমার ছেলের চেয়েও বয়সে অনেক ছোট। তখন আমার সপ্তম শ্রেণী। একটা সাইকেলের লোভ মামাবাড়ির আব্দার ছেড়ে চলে আমাকে চলে আসতে বাধ্য করেছিল নিজেদের বাড়িতে। তখন আমাদের যৌথপরিবার। আমার দাদী সংসারের মালকিন। আমার দাদো, শুধু আমাদের পরিবারের নয়- এলাকার অভিভাবক। আর বাড়িতে অনেক কাজের মানুষ। কে মাঠ সামলাচ্ছেন, কে ঘাট সামলাচ্ছেন, কে বাগান সামলাচ্ছেন। হাড়ি সামলাচ্ছেন বাড়ির বউয়েরা, তাঁদের সঙ্গী কয়েকজন কাজের মহিলা। আব্বা-চাচারা তাঁদের নিজের নিজের কাজকাম করছেন। এমনকি, বাড়িতে আমার মতো ছোট যারা, তারাও সব নিজের মতো আছে। ঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠছে, ঠিক সময়ে বিছানায় যাচ্ছে। নিয়ম করে সকাল-সন্ধ্যা পড়তে বসছে। স্কুলে যাচ্ছে। সময় মতো খাচ্ছে দাচ্ছে। তারপর নিজের এঁটো থালা ধুয়ে রাখছে। না, এসবের জন্য কারও হুকুমের দরকার ছিল না। বাড়ির বারান্দায় একটি দেওয়াল ঘড়ি টাঙানো ছিল, ঘণ্টা বাজিয়ে যেন সেই ঘড়িটাই হুকুম দিত। আমার খুব অসহায় লাগত। নিজেকে কেমন বন্দি বন্দি মনে হতো। আমাদের বাড়ির দেওয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুরগাছটির মাথার দিকে তাকিয়ে অনন্ত আকাশে আমি মুক্তি খুঁজতাম। কিংবা আমাদের বাড়ির পাশের সেই ডুমুরের গাছটি, যার ডালে এসে বসত নানারকমের পাখি, তাদের উদ্দেশ্য করে আমি প্রার্থনা করতাম, মুক্তি দে আকাশ! মুক্তি দে গাছ! মুক্তি দে পাখি! এই বন্দিদশা আমার ভাল লাগছে না। আমি মুক্তি চাই ...
উৎসব
আব্বা চেয়েছিলেন আমি যেন গ্রাজুয়েট হই। তাহলে তিনি আর আমার কোনও ইচ্ছেতেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন না। আব্বা তাঁর কথা রেখেছিলেন। সেই মতো আমি বি. এ পাশ করে সাপের পাঁচ পা দেখেছিলাম। ক্লাব, ক্যারাম খেলা, তাস খেলা, আরও কত কী!
একদিন ক্লাবে বসে তাস খেলছি, হঠাৎ এসে হাজির ফকিরপাড়ার কসুমুদ্দিন চাচা। আব্বার স্নেহের ভাই, বন্ধু। বললেন- বাবা, কাল তোমাকে একটু চেন্নাই যেতে হবে।
আমি তো অবাক! মহানগর বলতে তখন এক-আধটু যা দেখা তা আমাদের কলকাতা। আর সে-ই আমাকেই কি-না চেন্নাই যেতে হবে! জিজ্ঞেস করলাম- কেন?
কসুমুদ্দিন চাচা বললেন- একজনের চিকিৎসার জন্য।
- কার চিকিৎসার জন্য?
- আমাদের আজাহার ভাই।
মনে পড়ে গেল আমার আজাহার চাচাকে। মল্লিকপুরে বাড়ি। মনোহারি-পট্টিতে যাঁর একটা ছোট চৌকি ছিল। যেখানে বসে তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা টর্চ, লাইটার, তালা মেরামত করতেন। আব্বা বেতন পেলে মাসকাবারি বাজার যাঁর কাছে রেখে আসতেন। স্কুল শেষ করে সেই বাজার আমি যাঁর কাছ থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতাম। এমনকি, স্কুল এসে এক-দু’টাকার প্রয়োজন পড়লে আমি যাঁর কাছে গিয়ে হাত পাততাম।
আমি না বলতে পারলাম না। তাস খেলা ছেড়ে বাড়ি ফিরে মাকে বললাম। মা সম্মতি দিলেন।
ভোরবেলা যখন বেরোচ্ছি, আব্বা কিছু টাকা দিলেন আমার হাতে। বললেন, আজাহার ভায়ের চিকিৎসার জন্য যদি আরও টাকার দরকার হয়। ফোন করে জানাবি।
চেন্নাইয়ের ‘শঙ্কর নেত্রালয়’। সেখানে আজাহারচাচাকে নিয়ে গিয়েও তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফেরানো যায়নি। সেটা অন্য গল্প। আসলে আমি ওই সফরে যেটা উপলব্ধি করেছিলাম, সেটাই বলতে চাইছি।
আমরা গিয়ে উঠেছিলাম চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশন সংলগ্ন পার্ক টাউনের একটি হোটেলে। একদিন হাসপাতাল ঘুরে এসে রাত্রে শুয়ে আছি ঘরে। হঠাৎ জোর বাজনার আওয়াজ! না বেরিয়ে পারলাম না। রাস্তায় নেমে দেখি লোকজন আনন্দ করতে করতে ছুটছে সেই বাজনা লক্ষ্য করে। তাহলে নিশ্চয় কোনও উৎসব!
কিন্তু এত রাতে আবার কী উৎসব? কৌতুহলে আমিও ওদের সঙ্গী হলাম। আর গিয়ে দেখলাম, একজন বয়স্ক বস্তিবাসী মারা গেছে। বস্তিবাসীর তাই অমন আনন্দ।
সেদিন চেন্নাইয়ে ওই মৃত বৃদ্ধ বস্তিবাসীর মুখের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম, আসলে আমরা সবাই এক অদৃশ্য শৃংখলে বন্দি। মুক্তি চাইলেও আমরা মুক্তি পাই না। অস্তিত্ব যতক্ষণ ঠিক ততক্ষণই আমাদের বন্দি থাকতে হয়। সেটা মায়ের গর্ভ হোক কিংবা এই ধরাধাম। আমাদের মুক্তি এনে দেয় একমাত্র মৃত্যু। তাই হয়ত আমরা সবকিছুতেই উৎসব খুঁজি। সেটা জন্ম হোক কিংবা মৃত্যু। তাইতো এই করোনাকালে রাষ্ট্র তালি বাজাতে বললে আমরা অতি উৎসাহে থালি বাজাই। রাষ্ট্র মোমবাতি জ্বালাতে বললে বাজি-পটকা ফাটাই।