"বোঁলিয়ে, হ্যাঁয় কি নেঁহি হ্যাঁয়।" হ্যাঁ না না? চ্যানেলের প্যানেলে প্যানেলে, বিশেষত হিন্দি চ্যানেলের সঞ্চালক, সঞ্চালিকারা এই আপ্তবাক্য বা সুরখানি রপ্ত করেছে। ইহা আসলে উনিজির বচন। দুর্দান্ত সাফল্যের ভোটে জেতার আগে, ২০১৪-র নির্বাচনী প্রচারে উনিজি, মানে নরেন্দ্র মোদি, প্রসঙ্গ তুলে ভিড় ও শ্রোতার ভাবার আগেই নতুন প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন করছেন, - "বোলিয়ে, হাঁ ইয়া না?" তার প্রশ্নটাই উত্তর। আর গত এক দশকে প্রশ্নের উত্তর নেই। ২০১৪ - আসার আগেই অবশ্য স্কুলের পরীক্ষা আর টিভি-সংবাদে ব্রড-কোয়েশ্চেন হাওয়া। আরো একটু চিন্তা, প্রসঙ্গের তলানিটুকুর খোঁজ, বা ভাবনার অবকাশ নেই। বরং, খানিক দ্রুত কুইজ কন্টেস্টের মেজাজে কুইজ মাস্টারের উত্তরের সঙ্গে উত্তর মেলার খেলা। টিক মার্ক না মিললে নম্বর নেই। তবে চ্যানেলের প্যানেলে বেঠিক উত্তরে আছে টিপ্পনি, বাছাবাছা কয়েন-বুলি।
তারপর, ধীরেধীরে মিডিয়া উনিজির পকেটস্থ হল। প্রকল্পের চেয়ে বিজ্ঞাপনে বেশি খরচ করা উনিজির সরকার - সরকারের গুণ গাইলে তহবিল দেবে, অথবা দেবে না। অতএব, দ্রুততার সঙ্গে উনিজির 'গোদ ভর গয়ি'। গোদি মিডিয়া আসলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের চিন্তা ও সাজানো সাফল্যের প্রচারক, সঙ্গে নিন্দা ও সমালোচনা হটিয়ে দেবার ডিজিটাল ঝাঁটা।
তবু টিআরপি বহিয়া যায়, কেউ বলছেন না, 'ও টিআরপি তুমি - বইছো কেন!' খেয়াল করে দেখবেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় বা গুজরাট দাঙ্গার সময়, কম টিভি-চ্যানেল থাকলেও ছবি পাওয়া গেছে। গুজরাট দাঙ্গার সময় মোদির গুজরাটে কিন্তু ডবল ইঞ্জিন সরকার। থামানো যায়নি সম্প্রচার। স্পটে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট করেছেন সাংবাদিকরা। পথে বাধা এসছে, তবু সম্প্রচার-সাংবাদিকতা থামেনি। অটলবিহারী বাজপেয়ী ক্ষমতায় থাকলেও - সমাজ দখল করতে পারেনি আরএসএস। সংখ্যালঘু বা দলিত পিটিয়ে মারলে অনলাইন রিপোর্টিং-এ দাঁডিয়ে পড়তেন কেউ না কেউ। সম্প্রচার আটকানো যায়নি। সংবাদদাতা-চ্যানেল লুকিয়ে দিতে পারেনি ঘটনার খবরাখবর।
২০১৪ সালে আরএসএস-মোদির ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং চলেছে। ধর্ম ও জাতের নামে পিটিয়ে মারা, এবং সম্প্রচার সাংবাদিকতার তালিকা থেকে তা সরিয়ে দিতে পেরেছে বিজেপি। ততদিনে বেঁচে থাকা ছোট চ্যানেল কোম্পানি হাওয়া। মোদি ক্ষমতায় আসার অনেক আগেই অবশ্য হিন্দি, ইংরেজি, আঞ্চলিক চ্যানেল-গ্রুপ তৈরি হয়েছে। বিনোদন, সংবাদ, ধর্ম, খেলা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম - এক-একটি গ্রুপের ফুল প্যাকেজ। বিনোদনে সংস্কারী সিরিয়ালে ঘনঘন বাজ পড়বে, সংবাদের চ্যানেলে ঠিকাদার স্ক্রিনে হুমড়ি খেয়ে বলবে - 'নেশন ওয়ান্টস টু নো।' ভাষার ভিত্তিতে হিন্দিবলয় বা ইংরেজি চ্যানেলের এলিট দর্শকের কানে তালা লাগিয়ে যখন অর্নব গোস্বামী চিৎকার করছেন, প্রশ্নে তখন মোদির সুর - 'বোলিয়ে হাঁ ইয়া না'। তবেই বিজ্ঞাপন, তবেই জনমতের প্রসাদ - তবেই অমৃত সম টিআরপি।
পশ্চিমবঙ্গে এই গোদি মিডিয়ার কঠিন পরীক্ষা ছিল ২০২১-এর নির্বাচন। সকাল থেকে প্রাইম টাইম পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রমের পর, 'বিজেপি আসছেই'- কত মিডিয়াকর্মীকে বলতে শুনেছি, ইয়াত্তা নেই। আসলে বিশ্বাস করে উঠতে হয়। জনতা বা দর্শককে ইন্টারেস্ট বোঝাতে গিয়ে পুতুল বানানো এসব মিডিয়াকর্মীরা নিজেরাই বিজেপি-আরএসএসের পুতুল হয়ে গেছেন সেই কবে। সমাজচিন্তার উপকরণ বদলে দেওয়া হয়েছে তাদের সামনে থেকে। সার্ভের নামে নামানো হয়েছে - সাজানো সংখ্যা। তারা তা বিশ্বাস করেছে, যেমন করে মৌলবাদী ভক্তমন। প্যানেলে তীব্র হয়েছে অ্যাঙ্কারের চিৎকার। উত্তর নেমে এসছে হ্যাঁ বা না'তে। অন্তত প্রত্যাশিত উত্তর। 'আমাগো দেখো বা আমাদিগে'- তো মিডিয়া শ্রমিকের আব্বুলিশের পর, ফের শুরু হওয়া এক্কাদোক্কা। বড় গ্রুপের টিভি-চ্যানেলগুলির পাশে, ছোট চ্যানেলগুলি আর কী করে! প্রিয়তম ভগবানসম টিআরপি-প্রসাদের লোভে নামিয়ে আনে একই সুর। চিৎকৃত হতে হতে সময়টা বুঝে নেয় - রাস্তার হর্ন আর মাছবাজারের হুল্লোড়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে কান ও গলা। চিন্তার প্রত্যঙ্গ তখন বিকল।
এবার আসি অন্যকথায়। মোদি জমানার পর বদলে গেল মিডিয়া। বিশেষত উত্তর ভারতে। আমরা উত্তর ভারতের পুঁজির বেসাতি মাত্র। দিনভর মন্দিরের ঘন্টা, স্টুডিওতে দাড়িওলা মুসলমান আর তিলক-তাগা সজ্জিত হিন্দু আর 'গর্ব সে কহো গরবিনী' অ্যাঙ্করময় ছিল না টিভি চ্যানেল। তবু, পলিসি ছিল। খবর না থাকা ড্রাই ডে'তে ভ্যান্তারা ছিল। ছিল গ্রামকে শহরে হেয় করার প্রচেষ্টা, ছিল প্রান্ত জনকে সবক শেখানো টিআরপি। ছিল চাপিয়ে দেওয়া আধাসত্য বা মিথ্যা। নিরপেক্ষ দাবি করা সংবাদ চ্যানেলের ভিড়ে এনডিটিভিও ছিল। প্রযুক্তিতে রপ্ত হওয়ার প্রচেষ্টা ছিল। সারা ভারতে দৃশ্য-শ্রাব্য বা ভিডিওর নেটওয়ার্ক সহজ নয়। তখনকার প্রযুক্তি যেমন ছিল আরকি! প্রথমে রাজধানী শহর, পরে জেলা শহর গুলোতে বসল প্রযুক্তি। স্পট রিপোর্টিং, ঘটনাস্হল থেকে লাইভ রিপোর্টিং এল। এবার ঘটনার ভিডিও আর পলিসি, মানে চ্যানেলের ফিনান্স, বিজ্ঞাপন ও নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক দলের অবস্হান সবসময় ঠিক রাখা যাচ্ছিল না। মিডিয়া কেন্দ্রিক পাওয়ার সেন্টারের বাবুরাও সদলবলে ঘেঁটে যেতেন তখন। নন্দীগ্রামে গুলি চলার দিন প্রথম ছবি পেল বাংলা চ্যানেল ২৪ ঘন্টা, জি-টিভির হিন্দি দর্শক সে ছবি দেখবে। দেখাতে হবে। টিআরপি সেখানে ভগবান। বাংলাতেও তখন পাঁচ-ছয়টি খবরের চ্যানেল, জি-টিভির বাংলা চ্যানেলটি তখন পলিসিতে রাজ্য সরকারের সমর্থক। অতএব কী আর করে! সেলিব্রিটি অ্যাঙ্কার বলছেন গুলি চলেনি, দেখাতে হচ্ছে গুলি-চালনা। টিআরপির ভগবান আর শয়তান মিলেমিশে একাকার। তার আগে অবশ্য বিখ্যাত লটারি কোম্পানি, মানে জি-টিভির মালিক সুভাষচন্দ্রার আরেকটি ব্যবসা, সুপার লোটো ব্যান করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। ঘুর পথে পশ্চিমবঙ্গে এল সুপার লোটো, আর ভায়া আলিমুদ্দীন রাজ্য সরকার পেল নিজস্ব পলিসি জানানোর চ্যানেল। অতঃপর টিআরপি-সাধনা। বিজেপি সাংসদ সুভাষচন্দ্রার সিপিএম চ্যানেল।
২০১১-র পর বিষয়টা সামান্য বদলালো। প্রযুক্তি পরিকাঠামো ছিলই। রাজ্যে পালা বদলের আগে চ্যানেলের প্যানেলে-প্যানেলে সারা জাগানো প্রাইম টাইম এডিটরখানির মুখ বদল হল। ভায়া হরিশ মুখার্জি রোড, ভায়া রাইটার্স হয়ে নবান্ন বদলে দিল চ্যানেলগুলির লোকাল পাওয়ার পয়েন্ট। রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপনও মূল্যবান৷ মাথা বদলালো, খানিক চড়া হল চ্যানেলের স্কেল।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন ভারতীয় সম্প্রচার সাংবাদিকতা ও সরকারী বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দ্রুত বদলের সময়। দু-একটি চ্যানেল বাদে, বিশেষত হিন্দি চ্যানেলগুলি আমূল বদলে নিল বিজেপি। টাইমস নাও থেকে তাড়া খেয়ে অর্ণব গোস্বামী আনলেন নতুন চ্যানেল। বাংলায় বাংলা জি-টিভি সুর চড়ালো। প্যানেলে মোদি ভাষ্য নকল হল, হিন্দি চ্যানেলের সুর নকল হল। প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ, এমনকি উত্তরদাতাও হতে শুরু করলো বিজেপির চ্যানেলের মুখেরা।
এ লেখা লিখতে লিখতে একটি ঘটনা মনে আসছে, খানিক আগের। আগস্ট, ২০১০। বীরভূমে জাতের বাইরে প্রেম করার অপরাধ আদিবাসী একটি মেয়েকে নগ্ন করে হাঁটালো মোড়লরা। মোবাইল ততদিনে ভিডিও জার্নালিজমে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে। চ্যানেলে চ্যানেলে চলল সে ছবি দিনভর। কিন্তু ছবি কতটা ঢাকা হবে? সন্ধ্যায় প্রাইম টাইম করতে গিয়ে ভিডিও এডিটর আমায় সটান বললেন, - বেশি ঢাকলে টিআরপি আসবে না। চিৎকার জুড়লাম, এথিক্সের কথা বললাম। ওমা, চ্যানেল এডিটর, ইনপুট এডিটর, আউটপুট এডিটর - সবাই চুপ। আওয়াজ উঠলো, 'ওর এত গায়ে লাগে কেন?' দিন কয়েক পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী মেয়েটিকে সম্মানিত করলেন। এবার আবার টিআরপি ভগবানের আরাধনা শুরু। দুর্গাপুজোর আগে, জীবনজয়ী মেয়েদের নিয়ে নিউজের প্যাকেজ বানানো হচ্ছে। আদিবাসী মেয়েটির বাইট এল, ছবি এল। সন্ধ্যায় ভেসে উঠল আবার আগের নগ্ন ছবি। শয়তানের ভগবান সাধনা, বা ভগবানটাই শয়তান। এভাবে ধর্ষণের পর ধর্ষণ, অপমানের পর আবারও অপমান করতে করতে একটা শ্রোতা-দর্শক নির্মাণ করেই ফেলেছে মিডিয়া। একবার ওই একই চ্যানেল হাওড়া স্টেশনে এক রিপোর্টার ও ক্যামেরা পার্সন রিক্রুট করলো। যাদের কাজ অভাবে পড়া বা বাড়তি রোজগারের জন্য দেহ বেচা মহিলাদের ছবি তোলা, তাদের সংলাপ, প্রয়োজনে নগ্ন - অর্ধনগ্ন ছবি তুলে দুনিয়াকে দেখানো, মরালিটির জ্ঞান দেওয়া আর টিআরপি বাড়ানো। এটা অবশ্য ২০১২ সালের ঘটনা। না, টিআরপি বাড়েনি। কিন্তু সেই সব ভাবুকদের মাইনে বেড়েছিল।
এতকাল পর, তবে কেন এত টিআরপি-সংলাপ? উঠল কথা যাদবপুর নিয়ে। ভয়ঙ্করতম র্যাগিং ও একটি কিশোরের মৃত্যুতে আমরা স্তম্ভিত, বিষণ্ন। চ্যানেলের প্যানেলে প্যানেলে দর্শক তাড়িয়ে ঢোকানোর ডাক গত দুশকের মধ্যে তীব্রতম। গ্রাম শহরের পথে কানে তালা লাগানোর ডিজে নিয়ে বের হচ্ছে যারা, তাদের কথা কি শোনা যায়? অতএব শব্দ হতে হবে আরো জোরে। বাংলায় চ্যানেলগুলির ২০২১-এর নির্বাচনে ব্যর্থ মনোরথের পর ২০২৪-এর পবিত্র নির্বাচনও এগিয়ে এসেছে। ফাইনাল টিউন চলছে। র্যাগিংয়ের অপরাধী ধরা জরুরি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে তৃণমূল, সিপিএম, বিজেপির মিছিল বাড়ে। 'বোঁলিয়ে, হাঁ ইয়া নাঁ' - উনিজির সুরে ও প্রশ্ন ছোঁড়ার ভঙ্গিমায় রপ্ত হয়েছে বাংলা খবরের প্রাইম টাইম। হিন্দি চ্যানেলের নকল সম্পন্ন হয়েছে তাই, আপনার রায় ছাড়াই 'আপনার রায়' স্বীকৃত হবে। র্যাগিংয়ের অপরাধীর বদলে যাদবপুরের যে কোনও রকমের প্রতিনিধিকে বুলিং আর পাল্ট র্যাগিংয়ে ভরিয়ে দেবেন হরিয়ানায় প্রশিক্ষিত বাংলা চ্যানেলের অ্যাঙ্কার। কারণ, প্রাইম টাইম, কারণ টিআরপি, কারণ টিআরপি শয়তান, কারণ টিআরপি ভগবান। ভগবান পারে ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে, শয়তানও।
সামনের নির্বাচনে অধরা বাংলায় আরো তীব্রভাবে ঝাঁপাবে বিজেপি। পাল্টা দেবে তৃণমূল। সন্ধ্যার প্যানেলে ঝাঁঝ বাড়বে। কুকথার বান আসবে। সাম্প্রদায়িক বিভাজন হবে। হিন্দু-মুসলিম হবে। খুন-বোমাবাজি হবে। ঘটনা ঘটার আগে ঘুরতে থাকা হাজারো ক্যামেরায় ধরা পড়বে না বোমের ব্যাগ বা ষড়যন্ত্র। কারণ, সে সাংবাদিকতা বিদায় নিয়েছে। পড়ে আছে স্রেফ টিআরপি গুচ্ছ। না, তা খায় না, মাথায় দেয় না। স্রেফ তার সাধনা করতে হয়। আর আসন্ন নির্বাচনের টিআরপি সাধনায় যাতে বাঁধা না আসে, ধর্মভোটের বাজারে সরিয়ে দিতে হয় কলকাতার কর্পোরেট চ্যানেলের মুসলমান অ্যাঙ্কারকে। শয়তান টিআরপির মত ভগবান টিআরপিও ভয়ঙ্কর।
আর হ্যাঁ, টিআরপি মানে, টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট, বা টার্গেট রেটিং পয়েন্ট।
একবার আমরা চার নম্বর চ্যানেলের কজন রাজনীতির কচকচানির দিনে বাউল গান চালিয়ে দিয়েছিলাম। অনভ্যাসের দিনে প্রথম তিনটি চ্যানেলের প্রাইম টাইম টিআরপি কমল। আমরা এলাম দুইয়ে। না, উনিজির গোদি মিডিয়ার যুগে, বহু বহুকাল আর তা সম্ভব নয়। অতএব, স্টার্ট, ক্যামেরা, অ্যাকশন - চেল্লানো স্টার্ট উইথ 'বোলিয়ে হাঁ ইয়া নাঁ! ভগবান হোক বা শয়তান, তুষ্ট হবেই - গ্যারান্টি!