কতগুলো রেখা বা লাইন গেছে ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে। কোথাও সোজা, কোথাও আঁকাবাঁকা, কোথাও আবার খাঁজ-কাটা। লাইনগুলো গেছে চতুর্দিকে, বরফ-ঢাকা পাহাড় ডিঙিয়ে অথবা গহন অরণ্যের ভিতর দিয়ে, বন-বাদার পেরিয়ে। নদীর পার ধরে বা নদী পার হয়ে। শস্য-শ্যামলা মাঠের ওপর দিয়ে কিংবা মরুভূমির তপ্ত বালি মাড়িয়ে। এমনকি এও দেখা গেছে, লাইন গেছে বিস্তীর্ণ জনপদের মাঝখান দিয়ে - এই তো সেদিনও, তিন দশক আগে পর্যন্ত, ওইরকমই একটা লাইন চলে গিয়েছিল বার্লিন শহরকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে।
বাস্তবে কিন্তু লাইনগুলির কোনও অস্তিত্বই নেই। ওরা আছে রাষ্ট্রের কল্পনায়, আছে মানচিত্রে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় আর অহ-রহ রাষ্ট্রীয় প্রচারে ওরা অবশ্য অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে সাধারণ মানুষের হৃদয়-মনে, বিশ্বাসে। রাষ্ট্রের অধীনে থাকা প্রতিটি নাগরিককেই মেনে নিতে হয় কল্পনা-প্রসূত ওই লাইনগুলিকে। ওরা আসলে নির্দিষ্ট করে রাষ্ট্রের শাসনাধীন বা এক্তিয়ারভুক্ত এলাকাকে, নির্ধারণ করে তার সীমানাকে। ঠিক এই কারণেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বর্ডার বা সীমান্তরেখার সাথে। সীমান্ত নিয়ে তাই এত আবেগ, সীমান্তরক্ষা তাই দেশপ্রেমের মুখ্য সূচক, সীমান্ত রক্ষায় প্রাণ দেওয়া মানে শহিদের মৃত্যু বরণ করা।
যুদ্ধ চাই
করোনা সংক্রমণ কিংবা বেহাল অর্থনীতিকে ছাপিয়ে আজ এদেশে সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় চীন-ভারত সীমান্ত-সংঘর্ষ। স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক পরিসরেও তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিতর্ক বেঁধেছে চীনের ফৌজ লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ‘এলএসি’ বা ‘লাইন অফ একচুয়াল কন্ট্রোল’ – সেই ‘লাইন’ – পার হয়ে ভারতীয় এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে কিনা তা নিয়ে। সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যয়ের সাথে জানিয়েছেন কোনও অনুপ্রবেশ হয়নি। আর বিরোধীরা দাবি করছেন গালওয়ান ও দেপসাং উপত্যকা, প্যাংগং লেক ইত্যাদি এলাকায় চীনা সেনা এলএসি-র কয়েক’শ মিটার এপারে এসে ঘাঁটি গেঁড়েছে। চীন সরকার অবশ্য ওইসব এলাকাকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই ঘোষণা করে আসছে। টিভি-র পর্দায় স্যাটেলাইট ছবিতে কিছু বাঙ্কারের চিহ্ন স্পষ্ট হলেও সীমান্তরেখার কোনও হদিশ নেই – যা নেই তা থাকবেই বা কি করে - তাই ছবির ওপর আঁকাবাঁকা লাইন এঁকে দেখানো হচ্ছে চীনারা বর্ডারের এপারে। ষোল-সতের হাজার ফুট উচ্চতায় সারা বছর বরফে-ঢেকে-থাকা ওই খাড়া পাহাড়ের মাঝে বাস্তবে কোনও বর্ডার-লাইন থাকা কি আদৌ সম্ভব? সেই লাইন কেউ ক্রস্ করল কিনা, জনহীন, প্রাণহীন এলাকাটির দখল নিল কিনা, তাতে কার কি এসে যায়! মিডিয়াতে, পাড়ার চায়ের দোকানে চীনাদের প্রতি বিষোদ্গার তবু চলছেই। ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং-এর দেশের মানুষের প্রতি কোথা থেকে আসে এত ঘৃণা, এত বিদ্বেষ, কি ভাবে তৈরি হয় এমন শত্রুতা!
মনে পড়ছে, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধও হয়েছিল ওই একটা ‘লাইন’ নিয়েই – ম্যাকমেহন সাহেবের আঁকা লাইন। ওদিকে নেপাল সরকার সম্প্রতি তাদের সংসদে এক নতুন মানচিত্র পেশ করেছে যাতে উত্তরাখণ্ডের লিপুলেখ, কালাপানি, লিম্পিয়াধুরা ইত্যাদিকে নেপালের অন্তর্ভুক্ত হিসাবে দেখানো হয়েছে। ফলে, ভারত-নেপাল সীমানারেখা নিয়েও সংঘাতের পরিস্থিতি। আর কাশ্মীর? সেই ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকেই এলওসি – ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ – এটাও ‘লাইন’ - নিয়ে পাকিস্তানের সাথে তো আমাদের নিত্য ঝগড়া। মাঝে মধ্যে যুদ্ধ, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বিমান হানা এসব আর কি।
শেষ বিচারে তাই সীমান্তরেখা বা বর্ডার মানেই বিপুল রক্তক্ষয় - সেনায় সেনায় সংঘর্ষ, এদেশে ওদেশে যুদ্ধ। আর, যত যুদ্ধের উন্মাদনা তত অস্ত্র-ব্যবসার আর যুদ্ধ-শিল্পের পোয়া বারো। তাছাড়া, মানুষের অধিকার কেড়ে নেবার, মৌলিক সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর এমন সহজ উপায় আর কি আছে? ষাটের দশকে কারা যেন দেওয়ালে লিখতঃ ‘যখনই মানুষ চায় বস্ত্র ও খাদ্য, সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য।’
দেওয়াল, কাঁটাতার, দেশভাগ
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ নির্বাচনের সময় লাতিন আমেরিকা থেকে আগত অভিবাসীদের সম্পর্কে দেশবাসীর মনে অহেতুক ভয় জাগিয়ে তুলেছিলেন। বার বার বলেছিলেন, মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে দেওয়াল তুলে দেবেন। প্রেসিডেন্ট হবার পর, সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে সচেষ্টও হয়েছিলেন কিন্তু দেওয়াল গড়ার বিপুল খরচ কংগ্রেস কিছুতেই অনুমোদন করেনি। ট্রাম্প শেষমেশ সরকারটাই শাটডাউন বা পুরোপুরি বন্ধ করে দেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মেক্সিকোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানারেখা প্রায় ২,০০০ কিলোমিটার। এর একেবারে পশ্চিম প্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলে সান দিয়েগো ও তিজুয়ানার মাঝে ‘ফ্রেন্ডশিপ পার্ক’। এই পার্কেই নির্দিষ্ট দিনে অতি অল্প সময়ের জন্য গুয়াটেমালা, নিকারাগুয়া, হ্নডুরাস, সান সাল্ভাদোর অথবা খোদ মেস্কিকো থেকে আসা মার্কিন দেশে কর্মরত অভিবাসীরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করার অনুমতি পান। কিন্তু একে অপরকে স্পর্শ করতে পারেন না। কেননা, এখানে পাহাড় থেকে সমুদ্রতট পর্যন্ত রাখা আছে ১২ ফুট উচ্চতার ইস্পাতের স্তম্ভের সাথে জড়ানো মোটা তারের জাল – জং-ধরা, কুৎসিত, যেন অমঙ্গলের পুর্বাভাস। বেড়ার এপার থেকে মা ওপারে তার সন্তানকে দেখতে পান কিন্তু আদর করতে পারেন না। ছেলে বাবার হাত ধরতে পারে না, ভাই পারে না ভাইকে আলিঙ্গন করতে, বর বউকে চুমু খেতে। এ ব্যবস্থা ট্রাম্পের আগে থেকেই।
ক্ষমতায় আসীন হয়েই ট্রাম্প বেআইনি অভিবাসন বন্ধ করতে কয়েকটি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে নিষ্ঠুরতম, বর্বরতম, সব চেয়ে অমানবিক হল সীমান্ত পার হবার সময়ে ধরা-পড়ে-যাওয়া মায়ের কোল থেকে শিশু সন্তানকে কেড়ে নিয়ে আলাদা রাখা। সীমান্তের অভিশাপ?
পশ্চিম এশিয়ার আরব ভূমির অথবা মধ্য আফ্রিকার মানচিত্রের ওপর চোখ বোলালে পরিষ্কার দেখা যাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়া দেশগুলি সবই প্রায় জ্যামিতিক আকারের। স্পষ্টতই, দেশগুলির ম্যাপ তৈরি হয়েছিল পুর্বতন ইউরোপীয়ান শাসকদের দ্বারা, তাদের খেয়ালখুশি মতন। আবার শাসনভার ছেড়ে দিলেও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এরা কিন্ত ধর্ম বা এথনিসিটির ভিত্তিতে দেশভাগের চক্রান্ত করতেও ছাড়েনি। সিরিয়া, ইয়েমেন বা লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ অথবা রোয়ান্ডাতে টুটসি-হুটুর দাঙ্গা তো এর থেকেই উদ্ভূত।
দেশভাগ বা পার্টিশনের কথা উঠলে সাদাত হাসান মান্টোর একটা বিখ্যাত গল্প মনে পড়ে - ‘টোবা টেক সিং’। গল্পটা এরকমঃ দেশভাগের বছর দুয়েক বাদে দু’দেশের কর্ণধাররা সিদ্ধান্ত নিল জনসংখ্যা ও সম্পত্তির মতো পাগলা আশ্রমের বাসিন্দাদেরও ধর্মের ভিত্তিতে বিনিময় করা হবে। হিন্দু, শিখ আসুক ভারতে, মুসলিম যাক পাকিস্তানে। খবরটা পৌঁছানোর পরে পাকিস্তানের এক আশ্রমে বাসিন্দাদের মধ্যে তীব্র চাঞ্চল্য দেখা দিল। বিষেন সিং এসেছিল টোবা টেক সিং গ্রাম থেকে। সবাইকে ও জিজ্ঞেস করতে লাগল – একজন নিজেকে ঈশ্বর বলে ঘোষণা করেছিল, তাকেও - টোবা টেক সিং ভারতে না পাকিস্তানে। কেউ এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারল না। নির্ধারিত দিনে পাকিস্তান সেনা তাকে বাসে করে বর্ডারে এনে ধাক্কা মেরে ভারতে পাঠাতে চাইল কিন্তু বিষেন সিং ভারতে যেতে নারাজ। দু’দেশের মাঝে যে একফালি জমি – নো ম্যানস্ ল্যান্ড – সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ধীরে ধীরে সূর্য নামলো, ওই একফালি জমিতে বিষেন সিং শুয়ে পড়ল। একদিকে কাঁটাতারের বেড়া, ওপারে পাকিস্তান। আরেকদিকে একইরকম কাঁটাতারের বেড়া, ওপারে ভারত। মাঝখানে টোবা টেক সিং।
পাঞ্জাব ও বাঙলার পার্টিশন লাইন নির্ধারণ করেছিলেন ব্রিটিশ ব্যারিস্টার সার সিরিল র্যাডক্লিফ। যিনি দেশভাগের মাত্র কয়েক মাস আগে প্রথমবার ভারতে পদার্পন করেন। এ ভূমির ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি, রীতিনীতি সম্পর্কে তার সম্যক জ্ঞান না থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। র্যাডক্লিফ-সৃষ্ট এভাবে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া দেশভাগের পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। হয়েছিলও তাই - বাপ-ঠাকুর্দার কাছে আমরা শুনেছি। অসংখ্য প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস – খুশওয়ান্ত সিং-এর ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ – এবং বেশ কিছু সিনেমা ও ডক্যুমেন্টারীর মাধ্যমে আমরা সকলেই এ ব্যাপারে কমবেশি অবগত।
১৯৯৭ সালে নির্মিত অমর কানোয়ার-এর ‘এ সিজন্ আউটসাইড’ (৩০ মিনিট) ছবিটির কথা না বললেই নয়। পাঞ্জাবে ওয়াঘা-আতারি বর্ডারে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ১২ ইঞ্চি চওড়া সাদা লাইনকে ঘিরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় গেট বন্ধ করার সময় যে চমকপ্রদ এবং জমজমাট নাটক সৃষ্টি হয় সেটাই এই ছবিটির বিষয়বস্তু। বর্ডারের ওই লাইনটি তখন হাস্যকর লাগে, মনে হয় এর কোন মানে হয় না।
পার্টিশন, প্রেম
আরেকটি ছবি অজয় ভরদ্বাজের ‘মিলাঙ্গে বাবে রতন ডি মেলেতে’ (৭৫ মিনিট; ২০১২) – ‘দেখা হবে বাবা রতনের মেলায়’। বাবা রতন মানে সুফি সাধক বাবা হাজী রতন শাহ। পাঞ্জাবের ভাতিণ্ডা শহরে তার স্মৃতিসৌধ। প্রতি বসন্তে তার এই মাজারে মেলা বসে, হিন্দু-শিখ-মুসলিম-নাস্তিক সকলেই আসে দূরদূরান্ত থেকে, কীর্তন-ভজন-কাওয়ালির মেঠো সুর ছড়িয়ে যায় আকাশে বাতাসে, পাগল হয়ে ওঠে মন। গানের কথায় মজনুকে আল্লাহ্ ডেকে পাঠায়, মজনু বলে লায়লার সাথে দেখা হলেই আল্লাহ্-র সাথে দেখা হবে।
বাবা রতনের মেলা চলে আসছে দেশভাগের অনেক আগে থেকেই। দেশভাগের সময় যারা পাকিস্তানে চলে গিয়েছেন তারা আর আসতে পারেন না। কিন্তু্ এই সময়টা তাদের মন কেমন করে, মনে পড়ে যায় পুরোনো বন্ধুদের, পুরোনো দিনের কথা। পার্টিশন কি ভুলিয়ে দিতে পারে ভালবাসার স্মৃতি!
ছবির শেষ দৃশ্যে দাড়িওয়ালা এক ফকির, যার কথা কবিতার মতো, যার হাসি প্রেমে ভরপুর। সে জানায় সে সিপিআই(এম-এল)-র সদস্য। প্রেম ছাড়া কি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা যায়!