আমরা এই মুহূর্তে একটি ভয়াবহ অতিমারীর মধ্যে রয়েছি। যদিও আনলক চালু হয়েছে, তবুও সংক্রমণ এতটুকুও কমেনি, উল্টে বেড়েই চলেছে। বারবার মানুষকে বিভিন্ন ভাবে বলা হচ্ছে যে ‘ সামাজিক দূরত্ব’ বা ‘শারীরিক দূরত্ব’ মেনে চলতে। বারবার বলা হচ্ছে যে দূরত্ব বিধি মেনে চলতে, কিন্তু এই শারীরিক দূরত্ব কথাটার মানে কি? তাহলে কি কোনোদিন কোনও মানুষ আর অন্য মানুষের কাছাকাছি আসতে পারবেন না? কোনোদিন কোনও মানুষ তাঁর কাছের মানুষকে আর স্পর্শ করতে পারবেন না? অথচ কিছু সপ্তাহ আগেও কি কোনও একজন মানুষও ভাবতে পেরেছিলেন যে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়ার ভিডিও বাজারে তৈরি হবে, এবং কোটি কোটি মানুষ সেগুলো দেখবেন? একজন মানুষও কি ভেবেছিলেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা মাস্ক কেনার জন্য ওষুধের দোকানে ৩ ফুট দূরে লাইন দিতে হবে? কিছু দিন আগেও কোনও বন্ধু বা বান্ধবীর হাত ধরেছেন অবলীলায়, অথচ সেই হাত ধরতেই আজ কত মানুষের অনীহা, ভয়, কুণ্ঠা, সংকোচ। অথচ যে হাতের ছোঁয়ায় কত ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে,সেই হাতের ছোঁয়াকেই আজ মনে করা হচ্ছে ব্রাত্য। যদি সেখান থেকে সংক্রামিত হয় মারণ ব্যাধী। কিছুদিন আগে অবধি অনেকেই হয়তো সাধারণ শারীরিক প্রক্রিয়া হাঁচি, কাশি ইত্যাদি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না, তাঁরাই আজ কেঁপে উঠছেন এই সাধারণ শব্দে। সবার মধ্যে এক অজানা ভয়। সবাই বারেবারে হাত ধুচ্ছেন। এই যে আজকে প্রতিটি মানুষ বারবার করে হাত ধুচ্ছেন, এটা কি তাঁর পাপ ধোয়ার চেষ্টা। প্রতিটি মানুষ জীবনের কোনও না কোনও সময়ে যে জীবাণু ছড়িয়েছেন আজকে এই বারবার হাত ধোয়ার মধ্যে দিয়ে কি সেই পুরনো সমস্ত কিছু ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন? বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন, হয়তো একদিন জয়ীও হবেন তাঁরা, তার পরে হয়তো এই পৃথিবী করোনা মুক্ত হবে। তারপরেও কিছু মানুষ বেঁচে থাকবেন যারা এই স্মৃতি নিয়ে থাকবেন যে এমন এক অদৃশ্য জীবাণু এই পৃথিবীর মানুষকে আক্রমণ করেছিল যে মানুষকে তাঁর মনুষত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিল। যে মনে করিয়ে দিয়েছিল ঘৃণা ও বিদ্বেষ যে মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল তা খুবই তুচ্ছ। মনুষত্বের কাছে তার কোনও মূল্যই নেই। যে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে খিদে হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। খিদের চোটে কিছু শিশু নুন দিয়ে ঘাস খেতেও বাধ্য হয়েছিল।
যে পবিত্র দেবদেবীকে মানুষ নিজে হাতে সৃষ্টি করেছেন সেই দেবদেবীও আজ তাঁর আসন ছেড়ে নেমে এসেছে সর্ব সাধারনের সঙ্গে। যে মন্দিরের সঙ্গে মসজিদের এতো বিতর্ক সেই বিতর্ক হঠাৎ যেন থমকে গেছে। সমস্ত পুজো করার স্থান আপাতত বন্ধ, সমস্ত মসিজেদ আজ জোহরের নামাজ হবে না, কারণ কারুর অলিখিত ভয়ে আজ সমস্ত জমায়েত বন্ধ। বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বাস টারমিনাসের কোলাহল কিছু দিন আগে অবধি স্তব্ধ ছিল, আজ তা খোলা হলেও চারিদিকে যেন একটা ভয় কাজ করছে। এই ভয়ের পরিমাপ করার ক্ষমতা আপাতত মানুষের নেই। সে এতোটাই বড়, যে সে নিজেই একটা খবর, সে নিজেই একটা সুড়ঙ্গ, যার শুরু আছে হয়তো কিন্তু কোনও শেষ নেই। তার ভেতরটা শুধুই অন্ধকারাচ্ছন্ন... বিজ্ঞানীরা এই জীবাণুটিকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় রেখে এর একটা চেহারাও মানুষের সামনে এনে দিয়েছেন। এই টেনিস বলের মতো দেখতে কিছু শুঁড় যুক্ত জীবানুটি কিন্তু সমগ্র মানব জাতিকে বেশ কিছু প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকটি মানুষের যে আলাদা আলাদা উৎকণ্ঠা ছিল তা যেন এক লহমায় মিলে মিশে গেছে। একদিকে টেলিফোনে সরকারী নির্দেশাবলীর ফাঁকে, কানে কানে যেন এই জীবাণু বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত মনে করাচ্ছে --- “ তোমার একমাত্র পরিচয় তুমি একজন মানুষ, তোমার কোনও ধর্ম নেই, তোমার কোনও জাত নেই, তোমার কোনও ছুৎ- অচ্ছুৎ বিচার নেই, তোমার কোনও শ্রেণী নেই, তোমার কোনও অগ্রাধিকার নেই”।
জেনে অথবা না জেনে, বুঝে অথবা না বুঝে মানুষ চিরকালই তাঁর আসল যে পরিচয়, মানুষের পরিচয় তা সরিয়ে রেখে কখনও জাতি, কখনও ধর্ম, কখনও লিঙ্গ পরিচয় এই সমস্ত কিছু নিয়ে মেতে থেকেছে, একজন মানুষ অন্য মানুষকে মানসিক বা শারীরিক আঘাত করতেও দ্বিধা করেননি, আজকেও একজন ব্যক্তি মানুষ হয়তো শারীরিক ভাবে দূরে আছেন কিন্তু ধীরে ধীরে তিনিও তাঁর আসল পরিচয়কে আবিষ্কার করছেন। যেই মানুষটি তাঁর বন্ধুকে ধর্মের তুচ্ছ কারণে দূরে সরিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি, তিনি হঠাৎ যেন ভয় পেয়ে গেছেন। যখন আজকে একজন ব্যক্তি মানুষের বেঁচে থাকাটাই প্রশ্নচিহ্নের মুখে তখন কি সেই মানুষটি তাঁর পাশের মানুষের কি ধর্ম, কি লিঙ্গ, কি জাত এই নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন নাকি দুজনে মিলে একসঙ্গে বাঁচার চেষ্টা করবেন? আজ আমরা দেশের জমি অন্য দেশের কাছে দিয়ে দেওয়া হল না কি তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছি, কিন্তু কাল যদি কোনও দেশ নামক ধারণাটারই অস্তিত্ব না থাকে, তখন কি নিয়ে লড়বো?
কিন্তু মানুষ কি পারছে এই ধারণাতে পৌঁছতে? নাকি সে আরও গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে? নিজের চারধারে আরও কঠিন দেওয়াল তুলছে? প্রথমে তবলিগ জামাত, তারপরে বস্তির মানুষজন, তারপর পরিযায়ী শ্রমিক আর এখন গৃহ পরিচারিকাদের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। এরপর লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করা মানুষদের দিকে আঙুল তুলবেন তাঁরাই। আসলে অন্য মানুষদের দিকে আঙুল তোলাটাই আমরা শিখেছি। আমরা একবারও কি বলেছি যে করোনা সংক্রমণের প্রাথমিক দিকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলো কেন বন্ধ করা হল না? যে বিমানে চেপে করোনা নিয়ে উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষজন এই দেশে ফিরলেন তাঁরাই একমাত্র দায়ী এই করোনা সংক্রমণের জন্য এই প্রশ্ন কি আমরা তুলেছি? সবাই দায়ী, আমরা ছাড়া। সবাই করোনার বাহক, আমরা ছাড়া। সবাইকে নিন্দা করা হোক আমাদের ছাড়া। এই যে মধ্যবিত্তের মানসিকতা যা শুধুমাত্র ভয় আর আতঙ্ক ছাড়া কিছুই ছড়ায় না তা কি করোনা সংক্রমণ বা সমাজে তৈরি হওয়া করোনা সংক্রান্ত কালিমা মুছতে সাহায্য করে না উল্টে বাড়ায়? এই ধারণাই কি প্রথমে মুসলমানকে অপর বানানোর মধ্যে লুকোনো থাকে? এই অপরায়ন কিন্তু ধীরে ধীরে প্রবেশ করে পাড়া হয়ে নিজের বাড়ির মধ্যে, যেখানে নিজের কাছের মানুষের এই রোগ হলেও তাঁর কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তেলেঙ্গানাতে এক ৮০ বছরের বয়স্ক মহিলাকে তাঁর বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, যদি তিনি করোনার বাহক হন, এই ভয়ে। এই বাংলার এক পরিযায়ী শ্রমিক জলপাইগুড়িতে ফিরেছিলেন কেরালা থেকে। সরকারী নিয়মের মান্যতা দিয়ে তাঁর স্ত্রী তাঁকে বাড়ির রান্নাঘরে থাকতে দেন। একদিন পর তাঁকে খাবার দিতে গিয়ে দেখা যায় যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। ‘ মনে রাখবেন আমাদের রোগের সঙ্গে লড়তে হবে, রুগীর সঙ্গে নয়’ এটা প্রতিদিন হয়তো আমরা বহুবার শুনছি, কিন্তু আদপে কি করছি সেটা মনে করার কি সময় এখনও হয়নি?
একদিন নিশ্চিত পৃথিবী করোনা মুক্ত হবে। একদিন নিশ্চিত আসবে যেদিন মানুষ আবার একে অন্যের হাত ধরবেন শুধু বাহ্যিকভাবে নয়, অন্তর থেকে, হৃদয়ের টানে যখন প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকবে না। কাছের মানুষকে মানসিক বা শারীরিক আঘাত করার গ্লানি থাকবে না। কোনও ধর্ম থাকবে না, জাতি থাকবে না, রাজনৈতিক আক্রমণ, দলাদলি থাকবে না ধনী দরিদ্র ভেদাভেদ থাকবে না ...পৃথিবীতে শুধু থাকবে কিছু মানুষ। সারা পৃথিবীব্যাপী সাম্যবাদ কি নিজে থেকেই প্রতিষ্ঠিত হবে?