ঢাকুরিয়া, শহীদ নগর এলাকাটি যারা চেনেন, তাঁদের কথা আলাদা, কিন্তু অনেকেই হয়তো এই জায়গাটা চেনেন না। যাদবপুর থানা থেকে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের দিকে যেতে মাঝখানে একটা জায়গা আসে, যার নাম গাঙ্গুলিপুকুর। মূলত কলোনি এলাকা হলেও, ইদানীং বেশ কিছু বহুতল তৈরি হয়েছে। কলকাতা কর্পোরেশনের ১০৫ এবং ৯২ ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে এই জায়গাটি। গাঙ্গুলিপুকুর মোড় থেকে দু পা হেঁটে গেলেই একটি পার্টি অফিস, না যেরকম সবাই দেখে অভ্যস্ত তেমন ঝাঁ- চকচকে নয়। এটি সিপিআইএমএলের পার্টি অফিস। এখন যারা সাঁ করে গাড়ি চালিয়ে ১০ মিনিটে যাদবপুর থানা থেকে বাইপাস ধরেন, তাঁরা অনেকেই হয়তো জানেন না, যে এই লিঙ্ক রোডের যে আন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলনের পিছনে সিপিআইএমএল যা তখন পরিচিত ছিল আইপিএফ নামে সেই দলের কি ভুমিকা ছিল। আজকের সময়ের অনেকেই হয়তো জানেন না, যে ওই পার্টি অফিসের পাশেই একটি চায়ের দোকান আছে, হাবুদার চায়ের দোকান।
আমি যখন থেকে ওই অঞ্চলে যাতায়াত করি, মোটামুটি ১৯৯২ সাল থেকে, যে সময়ে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল, তখন থেকে ওই চায়ের দোকানে চা খাই। এখন অবশ্য হাবুদা নেই, এখন চালায় হাবুদার ছেলে বাদলদা।
গত ৩৮ দিন করোনার জন্য সমস্ত কিছু বন্ধ, তাই হাবুদার দোকান বন্ধ। কিন্তু বাদলদা আছেন। ইদানীং যদি কেউ ওখানে যান তাহলে বাদলদাকে রোজ দেখতে পাবেন। বাদলদা এখন খুব ব্যস্ত। করোনার জন্য রোজ দিন এই পার্টি অফিস থেকে চাল,ডাল, আলু, পিঁয়াজ, সোয়াবিন দেওয়া হচ্ছে, আশেপাশের মানুষ যাঁদের প্রয়োজন আছে তাঁদের। রোজ সেই প্যাকেট করছেন বাদলদা। সারা দুপুর ধরে এই প্যাকেট চলছে, এবং সন্ধ্যেবেলা দেওয়া হচ্ছে সেই মানুষদের যারা কুপন নিয়ে আসছেন, তাঁদের।
ওই অঞ্চলে একটি রিক্সা স্ট্যান্ড আছে, যে রিক্সা চালকদের অনেকের রিক্সাই ওই পার্টি অফিসে রাখা থাকে। সুদাম, বাপি, সঞ্জয়রাও ইদানীং রিক্সা চালাতে পারছেন না, লকডাউনের কারণে। তবে তাই বলে তাঁদেরও কিন্তু কাজের কমতি নেই, তাঁরাও রোজ হাত লাগাচ্ছেন ওই ত্রাণের প্যাকেট তৈরির কাজে। আর বাদলদার আরও একটা কাজ আছে, সিপিআইএমএলের যে সমস্ত কর্মীরা বা অঞ্চলের মানুষেরা যাঁদের সাহায্য ছাড়া এই ত্রাণের কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত না, তাঁদের জন্য বাড়ি থেকে চা করে নিয়ে আসছেন, আবার কখনও রোজ এসে ৫০ টাকা দিচ্ছেন, চা খাওয়ার জন্য।
সারা দেশে অনেক মানুষ এই ত্রাণের কাজে নেমে পড়েছেন। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন এই সুদাম, বাপি, সঞ্জয় এবং বাদলদারা। এই মানুষেরাই তো আসল কমিউনিস্ট, এঁরাই তো মানুষের বিপদের সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে জানেন। এই মানুষদের হয়তো পুঁথিগত মার্ক্সবাদী শিক্ষা নেই, কিন্তু এই মানুষেরাই তো আসল শিক্ষক। এই মানুষদের কোনও হোয়াটসয়্যাপ বা ফেসবুক না থাকলেও, এই বাদলদারাই রোজ মানুষের কাছে যাচ্ছেন, এনারাই তো আজকের দিনের আমাদের শিক্ষক। এই তিনজন রিক্সা চালকদের বাড়ির মানুষেরা দূরে থাকেন, কিন্তু তাতে কি, অঞ্চলের মানুষদেরই তাঁরা আপন করে নিয়েছেন। সুদাম, বাপি সঞ্জয় রা কিছু কিছু মিছিলে হাঁটলেও বাদলদা কোনোদিন কোনও মিছিলে হাঁটেননি, কিন্তু তাঁদের মনে হয়েছে, এটাই তো আসল সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর।
এই মানুষদের থেকেই শিখতে হয়, এনারাই তো আসল শিক্ষক। লাল সেলাম কমরেডস।