গত জুলাইয়ের ফ্রান্সের নির্বাচনে বামপন্থীরা ভাল ফল করলেও, স্থিতিশীলতার সঙ্কট জিইয়ে রেখে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর হাত ধরে দক্ষিণপন্থীরা ফের ক্ষমতা দখল করলো সেখানে। তার গতিপ্রকৃতি নিয়েই এই প্রতিবেদন।
গত ৩০ জুন এবং ৭ জুলাই দুই দফা ভোটের পরে, ফ্রান্সে বামপন্থীদের জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট ১৮২ টি আসনে জয়লাভ করে সংসদে সব চেয়ে বড় জোট হিসেবে এগিয়ে থাকলেও, সামগ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য পর্যাপ্ত আসনের কাছাকাছি ছিলোনা। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর হাত ধরে দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতা দখল করলো ফ্রান্সে। পার্লামেন্টে বেশি আসন পাওয়া বামপন্থী দলগুলোর জোটকে টপকাতে দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল দলগুলোর হাত ধরেছিল ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী দল। সংসদীয় নির্বাচনে ম্যাক্রোঁর এনসেম্বল প্রেসিডেন্ট শিবির ১৬৮ টি আসন জিতেছিল। শনিবার প্রধানমন্ত্রী মিশেল বার্নিয়ারের নেতৃত্বে নতুন সরকারের নাম ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট। একটি অমীমাংসিত সংসদীয় নির্বাচনের ১১ সপ্তাহ পরে দক্ষিনপন্থী ও মধ্যপন্থীদের জোট সরকার গঠন করলো৷রক্ষণশীল বার্নিয়ার ব্রিটেনের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্রেক্সিট আলোচনার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক পরিচিত।দক্ষিনপন্থীদের ক্ষমতার বাইরে রাখার প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দেওয়া নিউ পপুলার ফ্রন্ট নতুন মন্ত্রিসভা গঠনকে অগণতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে বলেছে, নির্বাচনে পরাজিতদের প্রতিনিধিত্ব করে এই মন্ত্রিসভা।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি ম্যাক্রোঁর অনুমোদনের জন্য একটি মন্ত্রিসভা জমা দেওয়ার কঠিন কাজ করেছেন। তাঁকে মন্ত্রিসভা গঠনে বিশেষ নজরে রাখতে হয়েছিল সংসদে সম্ভাব্য অনাস্থা প্রস্তাবে টিকে থাকার বিষয়টি।মন্ত্রিসভার ৩৯ টি পদ বণ্টন নিয়ে বিভিন্ন ব্লকের সঙ্গে দুই সপ্তাহ ধরে আলোচনার ফলে মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। মূল অংশে ১৭ জন সিনিয়র মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, যারা একসাথে প্রধানত মধ্য-দক্ষিণপন্থী সরকার গঠন করেছে। সাতজন মন্ত্রী হয়েছেন ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী আন্দোলন থেকে, যেটি নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল এবং তিনজন বার্নিয়ারের দক্ষিণপন্থী রিপাবলিকানদের থেকে, যা সংসদে দূরবর্তী চতুর্থ স্থানে রয়েছে।কট্টর দক্ষিণপন্থী মেরিন লে পেনের ন্যাশনাল ৱ্যালি, সংসদে যারা তৃতীয় স্থানে রয়েছে,মন্ত্রিসভায় তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই। তবে বামপন্থী জোট নিউ পপুলার ফ্রন্টের প্রতিনিধিদেরও বাদ দেওয়া হয়েছে, যারা প্রথম স্থানে রয়েছে।বিরোধী বামপন্থী রাজনীতিকরা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে তারা আস্থা প্রস্তাব নিয়ে নতুন সরকারকে চ্যালেঞ্জ করবেন। গত জুলাইয়ের নির্বাচনে, নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি) নামে বামপন্থী ব্লক সবচেয়ে বেশি সংসদীয় আসন জিতলেও, সরকার গঠনে সামগ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যথেষ্ট ছিলোনা। ম্যাক্রোঁ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বামরা স্থায়ী সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট সমর্থন জোগাড় করতে পারবে না। এই যুক্তিতেই ম্যাক্রোঁ বার্নিয়ারের দিকে ঝুকে পড়েন। রক্ষণশীল রিপাবলিকান (এলআর), ম্যাক্রোঁর দল ও তার মিত্র মধ্যপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন প্রধানমন্ত্রী বার্নিয়ার। সংসদ নির্বাচনে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে ছিল কট্টর দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ৱ্যালি। কিন্তু ম্যাক্রোঁ, বামপন্থীদের সঙ্গে না গিয়ে, কট্টর দক্ষিনপন্থীদের বর্জন করে অপেক্ষাকৃত নরম দক্ষিনপন্থীদের হাত ধরেন। অবশ্য তারপরও তাদের গঠন করা এই সরকার নতুন কোনো আইন পাসের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তাই আইন পাসের জন্য মেরিন লা পেনের ন্যাশনাল র্যালির মতো কট্টর দক্ষিণপন্থী দলগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে তাদের।
ত্রিশঙ্কু সংসদ দীর্ঘমেয়াদে সরকারের টিকে থাকাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, যেহেতু বাম এবং অতি দক্ষিণপন্থী নেতারা ইতিমধ্যেই নতুন সরকারের পতন নিশ্চিত করার হুমকি দিয়েছেন। ন্যাশনাল ৱ্যালির (আরএন) সভাপতি জর্ডান বারডেলা নতুন সরকারের গঠনের তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি নতুন সরকারকে "পেছনের দরজা দিয়ে ম্যাক্রোনিজমে প্রত্যাবর্তন" হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং সরকারের "কোনও ভবিষ্যৎ নেই"বলে মন্তব্য করেছেন। রাজনৈতিক স্পেকট্রামের অন্য প্রান্তে, কট্টর বামপন্থী লা ফ্রান্স ইনসুমিসের ফায়ার ব্র্যান্ড নেতা জাঁ-লুক মেলেনচন নতুন সরকারকে "সাধারণ নির্বাচনে হেরে যাওয়া সরকার" বলে অভিহিত করেছেন।তিনি বলেছেন, মন্ত্রিসভার "কোন বৈধতা এবং ভবিষ্যত নেই।" ফ্রান্সের উচিত "যত তাড়াতাড়ি সম্ভব" এই সরকার থেকে "পরিত্রাণ" পাওয়া। তার দল সরকারের উপর "জনপ্রিয় চাপ বৃদ্ধি" করার হুমকি দিয়েছে। বামপন্থী দলগুলি, ছাত্র ও সমাজকর্মীদের গোষ্ঠীগুলি নতুন মন্ত্রিসভার নাম ঘোষণা হবার আগে থেকেই ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি শহরে শনিবার বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।সোশ্যালিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান অলিভিয়ার ফাউর বার্নিয়ার মন্ত্রিসভাকে "একটি প্রতিক্রিয়াশীল সরকার যা গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে" বলে কটাক্ষ করেছেন।
মিশেল বার্নিয়ারে প্রথম পর্যায়ে জোট গঠনের প্রচেষ্টা বামদের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। বামপন্থীদের যুক্তি ছিল, নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী জোট মন্ত্রিসভা গঠনে তাদের যে গুরুত্ব প্রাপ্য তা তাদের দেওয়া হয়নি।কট্টর দক্ষিনপন্থী ন্যাশনাল ৱ্যালি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বার্নিয়ারের প্রস্তাব। আগামী ১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী বার্নিয়ারে কে নতুন সংসদে সরকারের নীতি-নির্দেশনা ব্যাখ্যা করতে হবে। সেই সময় বামপন্থীদের সম্ভাব্য অনাস্থা প্রস্তাবের মোকাবিলা করে সরকারের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হলে বার্নিয়ারের অন্তত ন্যাশনাল ৱ্যালির নীরব অনুমোদনের প্রয়োজন।কিন্তু ৱ্যালির প্রধান নেত্রী মেরিন লে পেন গত সপ্তাহে ফরাসি সংবাদপত্র 'লে প্যারিসিয়েন'কে বলেছিলেন যে, তিনি আত্মবিশ্বাসী বার্নিয়ার তার দলের মানদণ্ডকে সম্মান করবেন এবং কিছু রাজনীতিবিদদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেবেন না।পাশাপাশি তিনি এই সতর্কবার্তাও দিয়ে রেখেছিলেন যে, "আমরা আগে থেকে অনাস্থা প্রস্তাব দিয়ে রাখিনি, তার মানে এই নয় যে তার কোনো সম্ভাবনা নেই।" তার দল থেকে এই সতর্কবার্তা নতুন সরকারের দুর্বলতাকেই হাইলাইট করে।মেরিন লে পেনের চিন্তার গতি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে সরকারের স্থিতিশীলতা।বামরা নতুন মন্ত্রিসভার বিরোধিতা করে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করলে, বার্নিয়ারে সরকারের পতন হতে পারে যদি দক্ষিণপন্থী দল প্রস্তাবের পক্ষে তার ভোট যোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।তবে রাজনৌতিক ভাষ্যকারেরা মনে করেন, মিশেল বার্নিয়ারের সরকারের এখনই পতন ঘটবে না। কট্টর দক্ষিনপন্থীদের হুমকি বা সতর্কবার্তা আসলে বার্নিয়ার সরকারকে চাপের মধ্যে রেখে ২০২৫ সালের বাজেট গ্রহণের সময় কিছু বিশেষ ছাড় আদায় করে নেওয়া। তবে যে কোনো সময় মেরিন লে পেনের হিসেবনিকেশে পরিবর্তন ঘটতে পারে।