পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পরিবেশের সাত কাহন পর্ব-দুই ভারতে পর্তুগিজ আগমনের ইতিবৃত্ত

  • 10 November, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 922 view(s)
  • লিখেছেন : শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
জলপথে যাত্রা করা জাহাজ দখল করা ইউরোপীয় জলদস্যুরা যখন রাজানুগ্রহে জাহাজে করে বাণিজ্য করতে এসে দেশ দখল করে তখন তারা হয়ে ওঠে আবিষ্কারক। ইউরোপ থেকে এভাবেই ভারতে আগমন করেছিল ভাস্কো-দা-গামা। লুঠেরা পর্তুগিজরা রাজ্য স্থাপন করেছিল গোয়া, কালিকটে।

ইবেরিয়ান উপদ্বীপ অঞ্চল বেশ প্রাচীন এবং পৃথিবীর ভূগোলে যে নানা ধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল দেখা যায় এটি তার মধ্যে পড়ে। গ্রিকরা এই অঞ্চলের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী, ইবেরো-এ সংস্পর্শে এই অঞ্চলের নামকরণ করে ইবেরিয় উপদ্বীপ, অঞ্চলটি তিন দিক থেকে জলবেষ্টিত, একদিকের সঙ্গে স্থলভাগের সংযোগ রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের এই অঞ্চলের দখল রয়েছে স্পেন এবং পর্তুগালের হাতে।

উত্তর-পূর্ব দিকের  পিরানিজ পর্বতমালা এই অঞ্চলকে ইউরোপের বাকি অঞ্চল থেকে পৃথক করে রেখেছে আর জিব্রালটার প্রণালী এই উপদ্বীপকে উত্তর আফ্রিকা থেকে আলাদা করে দিয়েছে। ধারে কাছের সমুদ্রগুলো অতলান্তিক মহাসাগর ও ভূমধ্য সাগর। ইবেরিয়া নিয়ে এতো কথার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে ইউরোপীয় জাতিগুলির সাম্রাজ্যবাদী অভিযানের প্রথম দিকের দুই মহানায়ক, স্পেন ও পর্তুগালের এই অঞ্চলে অবস্থানের জন্য। এরাই প্রথম ইউরোপের স্থলভাগ ছেড়ে অচেনা জলপথে সোনা, রুপো, খাদ্য আর দাসদের সন্ধানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে “স্বর্গ”-র উদ্দেশে পাড়ি দেয়। এই “স্বর্গ” তাদের কথামালায় বর্ণনা করা ছিল “এল্ডোরাডো”, কখনও বা “গার্ডেন অফ হেভেন” হিসেবে। এরাই এক সময় আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে নতুন দুনিয়ায় হাজির হয়, যাকে সাম্রাজ্যবাদী চেতনা-সম্পৃক্ত বুদ্ধিচর্চার কেন্দ্রগুলি “কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার” বা “ভাস্কো ডা গামা-র ভারতে শুভাগমন” বলে বর্ণনা করে শিশুপাঠ্য বইগুলিকে ভরিয়ে তুলেছেন!

ক্রিস্টোফার কলম্বাস-এর আমেরিকা লুণ্ঠনের যাত্রার চার বছর আগে পর্তুগাল দেশটির লিসবন শহর থেকে, সে দেশের রাজার আর্থিক ও সামরিক আনুকূল্যে এক পাক্কা জলদস্যু, বার্থলোমিউ ডিয়াজ-এর নেতৃত্বে একদল জাহাজি নাবিক-জলদস্যু আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ইউরোপ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে পৌঁছনোর এক রাস্তা খুঁজে বের করে। সময়কাল ১৪৮৮।

ঔপনিবেশিক ও জাতিদম্ভে লালিত, ইউরোপের “আলোকায়ন পর্ব”-এর কিছুকাল আগেই সে যুগের আহ্লাদিত ইতিহাসবিদরা বলেন যে মানবজাতির ইতিহাসে “অভিযান পর্ব”-এর সূচনা হলো। এই অভিযান পর্ব গণহত্যার রক্তে লাঞ্ছিত, অত্যাচার, যুদ্ধবিগ্রহ আর অ-মানবিকতায় পঙ্কিল কলঙ্কময় এক অধ্যায়, যার এক সামান্য রূপায়ণ আমরা আমাদের উপমহাদেশের জন্য দেখতে পাবো।

স্পেনীয় জলদস্যুরাও স্পেনের রাণীর সহায়তায় এই একই কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে, পর্তুগাল চেয়েছিল ভারত মহাসাগরে পৌঁছনর জন্য পুরোপুরি জলপথের এই রাস্তা স্পেনের আগে খুঁজে নিয়ে তারা অন্যান্য ইউরোপীয়দের এড়িয়ে সরাসরি চীন, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং অবশ্যই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বা বাণিজ্যের নামে সেই দেশগুলোর সম্পদ লুঠপাটের মাধ্যমে হাতিয়ে নেবে।  ১৪৯২ সালের কলম্বাসের “অভিযান”-এর একমাত্র এই “মহৎ উদ্দেশ্য” ছিল। কলম্বাস-এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে “বাণিজ্য” প্রতিষ্ঠা করা।

“বাণিজ্য” করার নিমিত্ত এদেশের পর্তুগিজ দস্যুদের আগমনের ইতিহাসটি ইউরোপীয় জাতিগুলির সভ্য দুনিয়ার শিল্প-সংস্কৃতি-সমাজ-অর্থনীতি ধ্বংস করার গড়পড়তা কার্যক্রমের মতোই, তবে এগুলি তাদের প্রথম অভিযানগুলির মধ্যে পড়ে বলে গণহত্যা এবং আনুষঙ্গিক বর্বরতার দিকগুলি যথেষ্ঠ প্রোজ্জ্বলরূপেই উদ্ভাসিত হয়েছিল, পরবর্তীকালের শৈল্পিক সূক্ষ্মতা সেগুলি তখনও অর্জন করেনি। পর্তুগিজ রাজত্বের উদ্দেশ্য ছিল দূরপ্রাচ্য দেশে লভ্য সুগন্ধী ও মশলার বাণিজ্যটি কব্জা করা, আর তার জন্য প্রয়োজন জলপথ পাড়ি দেওয়ার উপযুক্ত কষ্টসহিষ্ণু নাবিক। আর এই দুই “গুণগত যোগ্যতা সম্পন্ন” মানুষ হাতের কাছেই তখন আকচার পাওয়া যেত, যাদের নাম জলদস্যু। ইউরোপের রাজন্যবর্গ তাই জলপথে বাণিজ্যের বাহানায় দস্যুতার অভিপ্রায়ে এই সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়োগ করতেন।

এই নিয়োজিত দস্যুদের হাতে ভার দেওয়া হয় ইউরোপীয়দের কাছে অজানা, অচেনা অঞ্চলের থেকে রসদ সংগ্রহের; কিন্তু তার জন্য আগে প্রয়োজন ছিল সেই সব অচেনা অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছনোর। এ কথা ভাবার কোনও কারণই নেই যে ব্যবসা-বাণিজ্য বা কাঁচা মাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য উৎপাদনে কেবল ইউরোপীয় শক্তিগুলির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। ইউরোপীয় শক্তিগুলির এই সব অঞ্চলে লুণ্ঠনের অভিপ্রায়ে আগমনের আগে সেই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটু সুলুকসন্ধান করা যেতে পারে। কিন্তু তারও আগে হিসেব নিতে হবে এমন অচেনা, অজানা দেশের অজানা সমুদ্রপথে পাড়ি দিয়ে এই সব অঞ্চলে ইউরোপীয়দের হাজির হওয়ার তাগিদটা কী ছিলো।

ভারত মহাসাগরের পূর্বদিকের শেষপ্রান্তে অবস্থান করতো পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ। বর্তমানের ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোকেই এই অঞ্চল বলে আজকে ধরা হয়। এখানে বেশ সুগঠিত একটি বাণিজ্যচক্র ছিলো মলুক্কাস-কে ঘিরে। এই নামটি আক্ষরিক অর্থ বাংলায় দাঁড়ায় মশলা দ্বীপপুঞ্জ। এটি এখনও সারা পৃথিবীর প্রায় সর্ববৃহৎ মশলা উৎপাদনের অঞ্চল। এখানে মেলে লবঙ্গ, জায়ফল, জৈত্রি।

কিন্তু মধ্যযুগের ইউরোপীয়দের কাছে এই মহার্ঘ মশলার বিষয়টি একেবারেই নাগালের বাইরে ছিল। ১৩১৩-১৩১৫ সালের ইউরোপের মহাদুর্ভিক্ষ, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, পরিব্যাপ্ত ক্ষুধা আর অপরিসীম দারিদ্র্য ইউরোপের একদল দক্ষ নাবিকদের জলদস্যুবৃত্তি বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যান্য অনেক দেশের ধনবান ব্যক্তিদের কাছে প্রাচ্যের সুগন্ধী এবং মশলা আভিজাত্যের দ্যোতক হিসেবে তখন ক্রমেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এই ক্ষুধার্থ মানুষগুলোর কাছে মশলা-সমৃদ্ধ দেশগুলো হয়ে ওঠে এক স্বপ্ন রাজ্য।  এই একই ধারনা পোষণ করতেন স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি অঞ্চলের রাজা রাণীরাও। অতএব মশলার সন্ধানে পাড়ি জমানোর উদ্যোগ শুরু হলো, এই কর্মযজ্ঞের জন্য বরাদ্দ হলো এক ঐতিহাসিক নাম, আবিষ্কারের জন্য মহাঅভিযান। এই সূত্রে পাঠ্য বইতে নাম উঠল ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নাম, উঠলো ভাস্কো ডা গামা-র নাম। তবে ইতিহাসের পাতায় এদের স্থান হলো জলদস্যু এবং গণহত্যাকারীরূপে নয়, “আবিষ্কারের এই মহাঅভিযানের সফল আবিষ্কারক-নায়ক” হিসেবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে অতলান্তিক মহাসাগর ছাড়িয়ে ভাস্কো ডা গামা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে আশপাশের স্থলভাগ দেখতে পেলেন, সেই স্থলভাগ তাঁকে যার-পর-নাই বিস্মিত করে। তিনি ভেবেছিলেন যে তাঁর চোখে পড়বে “হত দরিদ্র, ক্ষুধার ভারে নুয়ে পড়া অসভ্য, বর্বর” একদল মনুষ্য-সদৃশ প্রাণী; আর তার পরিবর্তে তিনি কিনা দেখেতে পেলেন প্রাচুর্যে ভরপুর, জমজমাট ব্যবসার কেন্দ্র, উন্নত শহর আর অতি উন্নত সভ্যতায় অভ্যস্থ এক দল মানুষ! ভারত মহাসাগরকে ঘিরে ব্যবসার যে বিশাল ও সুবিস্তৃত জাল তারা দেখতে পায়, তার গভীরতা তারা তখন মোটেও বুঝতে পারে নি।  কিন্তু তাদের সঙ্গে ছিল দক্ষ নাবিক, ততোধিক পেশাদার সৈনিক, এগুলির যথেচ্ছ ব্যবহার করে ভারতের আজকের কেরল উপকূলের কালিকট, কোচিন, গোয়া দখল করে তারা রাজত্ব বিস্তারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

সেই সুদূর ঐতিহাসিক কাল থেকে, বা আরও যদি আরও পেছিয়ে যাই, তাহলে দেখবো সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য হিসেবে মরিচদানা-র গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। ভারত এবং চীন-এর মতো প্রাচীন সভ্যতার দেশগুলিতে এই মরিচদানা অনেকদিন থেকেই তার ভেষজ গুণের কারণে ব্যবহৃত হতো। রোমান সাম্রাজ্যে ধনবান ব্যক্তিদের খাদ্যতালিকায় যে সব সুস্বাদু খাদ্য থাকতো, সেগুলির রান্নায় মরিচদানা ( কালো মরিচ) ছিল একটি আবশ্যিক মশলা। মধ্যযুগের ইউরোপেও ক্রমে ক্রমে ধনীদের রান্নায় মরিচের ব্যবহার বাড়তে থাকে। এই মশলার সন্ধানে একদিক থেকে সাগরপাড়ির তাগিদ অনুভব করেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস, আর অন্য দিক থেকে ভাস্কো ডা গামা। আফ্রিকা ঘুরে কলম্বাস পৌছন ক্যরিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আর ভাস্কো ডা গামা পৌঁছন ভারতের কালিকট-এ।

প্রাচ্য দেশ সম্পর্কে ইউরোপের অধিবাসীরা ছিলেন সম্পূর্ণতই অজ্ঞ। ভারতে গোলমরিচের চাষের ইতিহাস কম বেশি প্রায় ১২০০ থেকে হাজার বছরের প্রাচীন। গোলমরিচের আদি রূপ, সেটি ভারতেই লভ্য ছিল, চাষীদের মুন্সিয়ানায় তা ক্রমে ক্রমে আজকের রূপ পেয়ে যায়। ভারতের নৌবাণিজ্যের রমরমার দিনে তা ব্যবসায়ীদের হাত ধরে গিয়ে পৌঁছয় আজকের ইন্দোনেশিয়ায়। মূলত দুই ধরনের মরিচকে চাষের ফসল হিসেবে ভারতীয় চাষীরা গড়ে তোলে—একটি লম্বা ধরনের, যেটি এখন আর ভারতে জনপ্রিয় নয় বলে প্রায় লুপ্ত, আর অন্যটি কালো দানা, যেটি এখানে এখনও প্রভূত পরিমাণে চাষ হয়। এই লম্বা মরিচের মূল চাষ হোতো ভারতের উত্তর-পূর্বে; আর দানা মরিচের চাষ হোতো দক্ষিণ-পশ্চিমে। লম্বা মরিচ তার ঝাঁঝ এবং তীব্র ঝাল স্বাদের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল এবং রোমান সাম্রাজ্যের আমীর-ওমরাহদের মধ্যে তার ঝাল স্বাদের জন্য এটি খুবই জনপ্রিয় ছিলো। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মধ্যযুগের ইউরোপে এই দানা মরিচ পৌঁছে যায় এবং তার স্বাদ ও গন্ধের জন্য ইউরোপের দেশে দেশে রান্নাঘরে সেটি স্থায়ী স্থান করে নেয়।

মিশরের রাজারা আজ থেকে কম বেশি ৩৫০০ বছর থেকে ৩০০০ বছর আগে মরিচদানা ব্যবহার করতেন। রাজা দ্বিতীয় রামেসেস-এর মমি-র নাকের ফুটোর মধ্যে মরিচের গুঁড়ো পাওয়া গেছে। এ কথা আজ আমরা সবাই জানি যে ভারত ও আরব বণিকদের মধ্যে নিয়মিত বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। মিশরীয় রাজারা, আরব বণিকদের মারফৎ ভারত থেকে নিয়মিত ধুনো, রজন-এর মতো এক ধরনের সুগন্ধী আঠা, যাকে আজ আমরা “মস্তকি” বলে থাকি এবং দারুচিনি আমদানি করতেন। নীল নদ বেয়ে তাঁরা তাঁদের বাণিজ্য তরীগুলিতে আরব বণিকদের কাছে হাজির হয়ে এই দ্রব্যগুলি সংগ্রহ করতেন এবং তার পর প্রাচীন “পুন্থ” অঞ্চলে সেগুলি এনে, সেখান থেকে ভেলায় করে মিশরীয় রাজত্বে নিয়ে আসতেন।  

রোমানীয় গল বা আজকের ফ্রান্স, জার্মানি এবং রোমানীয় বৃটেনেও কালক্রমে এই মরিচদানা হাজির হয়। অভিজাত মানুষদের রান্নায় মরিচের ব্যবহার তাদের সামাজিক উচ্চবর্গের এক সংকেতবাহী চিহ্ন হয়ে ওঠে। ওস্তাদ রোমান রাঁধুনি, আপিসিয়াস তাঁর রান্নার বইতে যত রান্নার সবিস্তার বর্ণনা দিয়েছেন, তার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ রান্নাতেই মরিচ ব্যবহারের নিদান রয়েছে! প্রায় পুরো প্রথম সহস্রাব্দ জুড়েই রোমানরা আরব সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতের দক্ষিণ উপকূলের মালাবারে এসে হাজির হতো। এই সব পাড়ির একটিতে একজন গ্রিক নাবিক ছিলেন, তিনি এই পাড়ির এক লম্বা বিবরণ লেখেন, যেটিকে এখন একট ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ধরা হয়। অনুমান করা হয় এই স্মৃতিকথাটির সময়কাল ১ম খৃস্টাব্দের আশপাশে হবে। এটির নাম “ পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রেশিয়ান সি”। এই সব সামুদ্রিক অভিযানে রোমান নাবিকরা সেকালের কেরলের মুঝিরিস শহর থেকে বস্তা ভর্তি মরিচ সংগ্রহ করতেন। এই বস্তাবন্দি মরিচের চালান আসতো ভারতের কেরল অঞ্চলের আজকের ময়ূরীখোড়ে, যা আজকের কেরলের পট্টনম অঞ্চল। গ্রিক ভূগোলবিদ স্ট্রাবো (জন্ম আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৬৩ সাল, মৃত্যুর তারিখ এখনও অজ্ঞাত) তাঁর গ্রন্থে লিখে গেছেন যে রোমান সম্রাটবৃন্দ অছরে প্রায় ১২০টি করে বাণিজ্যতরী ভারতে পাঠাতেন, এমন সময় তাঁরা বেছে নিতেন যাতে বর্ষার সময়ের বায়ুপ্রবাহ ব্যবহার করে বস্তাবন্দি মশলার ভারী জাহাজগুলিকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়। ফেরার পথে এই বাণিজ্যতরীগুলি লোহিত সাগর পর্যন্ত আসতো, সেখান থেকে বেরেনিস ( লোহিত সাগরে ধারে প্রাচীন মিশরের পশিমের একট বন্দর); এখানে মশলাগুলি খালাশ করা হতো। তারপর নীল নদ ধরে কিছুদূর গিয়ে প্রকাণ্ড সব ভেলায় করে সেগুলিকে নিয়ে আসা হোতো  রোমানীয় মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়াতে। সেখান থেকে আবার  জাহাজে এই মশলা পাড়ি জমাত ইউরোপে। শেষ পর্যন্ত  রোমের বিরাট বিরাট মরিচের গুদামে বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের রাখা হোতো। এই শতখানেক জাহাজ বাহিত হয়ে অবিশ্রাম ধারায় প্রাচ্য দেশ থেকে রোমে মরিচ ও অন্যান্য মশলা চালান অব্যাহত থাকে খৃষ্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত, এই সময়ের পর পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়।

সেই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বাণিজ্য যে ইউরোপীয় বাণিজ্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট ছিলো, তার ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়ে গেছে খৃস্টপূর্ব প্রথম শতকে গ্রিক দার্শনিক প্লিনি-র লেখায়। প্লিনি তাঁর বইয়ে লিখেছিলেন, “ এ রকম কোনও বছর ছিলো না, যে বছর রোমান সাম্রাজ্যের অর্থকোষ নিঃস্ব করে রোমান সাম্রাজ্য ভারতকে মশলা বাণিজ্য খাতে পাঁচ কোটি সেস্টেরেস [রোমান মুদ্রা, যার আজকের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি মার্কিন ডলার] দেয় নি। … আমরা এই মরিচ দানাকে এত ভালবাসি কেন? কোনও কোনও খাদ্য তার মিষ্টত্বর জন্য আমাদের আকর্ষণ করে, কেউ বা চেহারায়, কিন্তু মরিচের না চেহারা, না তার মিষ্টত্বের আমরা তাকে এত পছন্দ করি। আমরা এই মরিচকে পছন্দ করি তার ঝাঁঝের জন্য; আর এই জন্য আমরা বারে বারে ভারতে পাড়ি জমিয়ে এই বিচিত্র বস্তুটিকে প্রভূত অর্থের বিনিময়ে নিয়ে আসি। … মরিচ আর আদা তাদের আদি বাসভূমে অনাদরে বনে জংগলে আপনিই বেড়ে ওঠে; আর আমরা সেই অনাদরের বস্তুকে স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিনিময়ে নিয়ে আসি। …”

যে অন্ধকার যুগকে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকবৃন্দ মধ্যযুগ বলে পণ্ডিতি ইতিহাসে বর্ণনা করে থাকেন, এমনকি সেই যুগেও সমগ্র ইউরোপে মরিচদানা রান্নার মশলা এবং ভেষজ হিসেবে প্রভূত সমাদর লাভ করেছিল।  রান্নায় অতুলনীয় স্বাদের কথা সরিয়ে রেখেও বলা যায় যে শীতের দেশে দীর্ঘকাল রান্না করা খাবারের স্বাদ বজায় রাখার জন্যও এই সব প্রাচ্য দেশীয় মশলার খুবই কদর ছিলো। মাংস, মাছ প্রভৃতি পচনশীল খাদ্যের সংরক্ষণকারী বস্তু হিসেবে আদা ও মরিচের ব্যবহার ছিল। উৎকৃষ্ট মদিরা পরিবেশনের অন্যতম অনুপান ছিলো এই মরিচগুঁড়ো।

মধ্যযুগের ইউরোপের অবস্থা পড়ে এলেও মধ্যযুগের সম্পত্তিবান ইউরোপীয়দের মধ্যে ভারতীয় মশলা ব্যবহারের কমতির কোনও ঐতিহাসিক নথি নেই। বরং মশলার বহুমুখী ব্যবহারের নথির সংখ্যা প্রচুর।  যেমন ধরা যাক স্কটল্যান্ডের প্রথম উইলিয়ামের কথাই ( ১১৬৫-১২১৪)। এই প্রথম উইলিয়াম যখন ইংল্যান্ডের প্রথম রিচার্ড-এর ( ১১৮৯-১১৯৯) সঙ্গে ১১৯৪ সালে দেখা করতে যান, তখন তিনি ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকে দৈনিক স্রেফ ভেট হিসেবে আজকের হিসেবে ২ কেজি দারুচিনি এবং ১ কেজি মরিচ পেতেন। পরিমানটি কোনও একজন মানুষের পক্ষে দৈনিক খরচের পক্ষে অবাস্তব রকমের বেশি, বোঝাই যায় এটি আসলে কৌশলে ভেট দেওয়ার একটি স্থানীয় কায়দা।

ইউরোপের আর একজন বিখ্যাত নাবিকের নাম মার্কো পোলো (১২৫৪-১৩২৪)। তিনি জলপথে ঘুরতে ঘুরতে ১২৭১ সালে চীন দেশে এসে হাজির হন। তিনি তাঁর নাবিক জীবনের দিনলিপিতে লিখেছেন যে চীনা রান্নার অন্যতম প্রধান মশলাই হ্লো দানা মরিচ। চীনের বহির্বাণিজ্যের অন্যতম পণ্যই ছিল এই মরিচদানা। মার্কো পোলো যখন চীনের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করছিলেন, তখন চীন দেশের এক শহর, হাংঝৌ, যা পরে ইউরোপীয় উচ্চারণে দাঁড়ায় হ্যাংকাউ, যা আজকের চীনের সর্ববৃহৎ লোকসংখ্যার শহর ঝেঝিয়াং, সেখানকার একজন আবগারি আধিকারিক তাঁকে হিসেব দিয়েছিলেন--  এই শহরে দৈনিক ১০০ কেজি মরিচদানা লাগে। চীনা বণিকরা সুমাত্রা এবং যবদ্বীপ (জাভা) থেকে ৫ থেকে ৬ হাজার বস্তা মরিচদানা আমদানি করতো, যার এক বড়ো অংশ তারা ইউরোপে রপ্তানিও করে দিত।

চীনে তখন সুং বংশের রমরমা রাজত্ব চলছে। চীনে বাণিজ্যের অনুমতি নিতে দক্ষিণ এশিয়ার যে সমস্ত রাষ্ট্রদূতরা আসতেন, তাঁরা নিয়ম করে চীনা রাজার জন্য ভেট হিসেবে প্রভূত পরিমাণে মরিচদানা নিয়ে আসতেন।

কেবল এক মরিচদানার লোভেই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের বুভুক্ষু মানুষরা প্রাচ্যের প্রাচুর্যের দেশ গুলি দখলের পরিকল্পনা ছকে।

 

এই লেখকের এই বিষয়ে আগের লেখাটি পড়ুন।

 

পরিবেশ-প্রতিবেশঃ আমাদের দেশ পর্ব-এক

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment