কেন্দ্রের শাসনধারাকে আরো নিরঙ্কুশ করতে, বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলোর ক্ষমতাকে খর্ব করতে নরেন্দ্র মোদী যেমন তাদের বিরুদ্ধে তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে লেলিয়ে দিচ্ছেন, সেরকমই এই লক্ষ্যে আর একটা যে অস্ত্রকে তিনি ব্যবহার করে চলেছেন তা হলো রাজ্যপালের পদ। রাজ্য প্রশাসনের প্রতি “সহায়তাকারী ও পরামর্শদাতা” রূপে রাজ্যপালদের যে ভূমিকা প্রত্যাশিত, সেটাই যথার্থ ও প্রথাগত বলে গণ্য হতো। আর, মোদী জমানায় বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলোর রাজ্যপালরা যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন তাতে তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বললেও অত্যুক্তি হবে না। বিরোধী-শাসিত রাজ্যের রাজ্যপালরা বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন, প্রশাসনিক কর্তাদের ডেকে পাঠিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করছেন, রাজ্যের শাসক দলকে মোদী সরকারের অনুগত করে তোলার লক্ষ্যে প্রচেষ্টায় কোনো খামতি রাখছেন না। জগদীপ ধনকর পশ্চিম বাংলার রাজ্যপাল থাকার সময় পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে শোনা গিয়েছিল– “তিনি প্রতিদিনই আমার অফিসারদের ডেকে পাঠান। জেলাশাসক, পুলিশ সুপার থেকে মুখ্য সচিব, সবাইকেই তিনি হুমকি দিচ্ছেন।…” তবে যে ব্যাপারটায় বিরোধী-শাসিত রাজ্যের রাজ্যপালরা একযোগে সমানভাবে সক্রিয় তা হলো রাজ্য আইনসভার পাশকরা বিলগুলোকে ঝুলিয়ে রাখা। পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, কেরল, তেলেঙ্গানা, পশ্চিম বাংলা– এই সমস্ত রাজ্যের রাজ্যপালরা কেউ কারুর চেয়ে পিছিয়ে থাকেন না। আর তাই রাজ্যগুলোকেও দ্বারস্থ হতে হয় সুপ্রিম কোর্টের।
আপ শাসিত পাঞ্জাবে রাজ্য আইনসভার এ বছরের জুন মাসে পাশকরা একাধিক বিল আটকে রেখেছিলেন রাজ্যপাল বানোয়ারীলাল পুরোহিত। ফলে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে আপ সরকার। সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয়– রাজ্য আইনসভায় পাশ হওয়া বিল রাজ্যপাল অনির্দিষ্টকাল ঝুলিয়ে রাখতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা ও মনোজ মিশ্রর বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২০০ অনুসারে রাজ্য আইনসভায় পাশ হওয়া বিল সম্পর্কে রাজ্যপালের কাছে তিনটে বিকল্প আছে– তিনি বিলে সম্মতি জানাতে পারেন, বিলের সম্মতি ঝুলিয়ে রাখতে পারেন, রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য বিলকে সরিয়ে রাখতে পারেন। তবে, বিলে সম্মতি জানাতে না পারলে তা রাজ্যের আইনসভাকে “যত দ্রুত সম্ভব” জানাতে হবে, বিলকে অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখাটা অসাংবিধানিক। আইনসভা সেই বিলকে অবিকলভাবে বা সংশোধনী সহযোগে পুনরায় রাজ্যপালের কাছে পাঠালে তিনি তাতে সম্মতি জানাতে বাধ্য থাকবেন। বিচারপতিরা প্রশ্নের কোনো অবকাশ না রেখে বলেন, রাজ্যপাল রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হলেও তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধি নন এবং তাঁর পদ আলঙ্কারিক। নির্বাচিত সরকারের আইন প্রণয়নের কাজকে ব্যাহত করার কোনো অধিকার তাঁর থাকতে পারে না। বিচারপতিরা রাজ্যপাল বানোয়ারীলাল পুরোহিতকে সতর্ক করে বলেন– বিলগুলোকে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রেখে তিনি আগুন নিয়ে খেলছেন।
পাঞ্জাবের রাজ্যপালের মতো তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল রবীন্দ্রনারায়ণ রবিও রাজ্য সরকার বিরোধী সক্রিয়তা কম দেখান নি। তিনিও রাজ্য আইনসভার পাঠানো ১২টা বিলকে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। বিলগুলো পাঠানো হয়েছিল ২০২০র জানুয়ারি থেকে ২০২৩-এর এপ্রিলের মধ্যে। সুপ্রিম কোর্ট ১০ নভেম্বর রবিকে তিরস্কার করে বিলগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে বলে। রবি ১৩ নভেম্বর ১০টা বিল আইনসভায় ফেরত পাঠান। এই ফেরত পাঠানোর পর প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, “বোঝাই যাচ্ছে আদালত নোটিশ দেওয়ার পর এই বিলগুলি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু তিনি তিন বছর ধরে কি করছিলেন?” বিধানসভা অধিবেশনের শুরুতে রাজ্য সরকারের তৈরি করে দেওয়া ভাষণই রাজ্যপাল পাঠ করেন। কিন্তু রাজ্যপাল রবীন্দ্রনারায়ণ রবি তৈরি করা ভাষণের একটা অংশের পাঠকে এড়িয়ে যান, যে অংশে রাজ্য সরকারের কর্মনীতি বিধৃত ছিল। এইভাবে রাজ্য সরকারের কর্মনীতির বিরুদ্ধে তিনি নিজেকে দাঁড় করালেন। রাজ্যপাল রবি নিজের ক্ষমতা জাহির করে ২৯ জুন রাজ্য মন্ত্রীসভার এক মন্ত্রী ভি সেনানিবাস বালাজিকে বরখাস্ত করেন। দুর্নীতির অভিযোগে ইডি ঐ মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করে রাজ্যপালের পক্ষে রাজ্যের মন্ত্রীকে বরখাস্ত করাটা বিধি ও প্রথা বিরোধী। রাজ্যপালের এই পদক্ষেপ নিয়ে গণরোষ বিস্ফারিত হলে রাজ্যপাল বরখাস্তের আদেশ স্থগিত রাখতে বাধ্য হন।
কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানও নিজের ক্ষমতার পেশি প্রদর্শন করে রাজ্য সরকারের কার্যধারাকে সমস্যাসংকুল করে তুলতেই সক্রিয় হয়েছেন। কেরল সরকারের আইনজীবী কে কে বেনুগোপাল সুপ্রিম কোর্টে জানান যে, রাজ্যপাল আটটা বিলে সম্মতি প্রদান না করে সেগুলোকে আটকে রেখেছেন। বিচারপতিদের কাছে তাঁর আবেদন ছিল– “ এটা কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।… রাজ্যপালও যে আইনসভার অঙ্গ সেটা তিনি বুঝতে চাইছেন না।” বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্য বিজেপির অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হয়ে সেই অনুসারে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে আরিফ বিজেপির কিছু কর্মীকে রাজভবনের কর্মী রূপেও নিয়োগ করেন। রাজ্য সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি করে রাজ্যের জনগণের স্বার্থকেই বিপন্ন করে তোলার অভিযোগও আরিফের বিরুদ্ধে ওঠে। তেলেঙ্গানার রাজ্যপাল তামিলসাই সৌন্দররাজনও আটটা বিল ঝুলিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ, এবং রাজ্য সরকারকে কালিমালিপ্ত করতে তিনি এই বালখিল্যতারও পরিচয় দেন যে, মহিলা বলে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করছে। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের বিরুদ্ধে সরকারের বিদ্বেষ পোষণের সুযোগটা ঠিক কোথায় তা বুঝে ওঠাটা সত্যিই দুষ্কর।
আর পশ্চিম বাংলায় আমরা তো প্রতিদিনই রাজ্যপাল বনাম রাজ্য সরকারের দ্বৈরথ প্রত্যক্ষ করছি। পশ্চিম বাংলাতেও সম্মতির জন্য রাজ্যপালের কাছে ২২টা বিল ঝুলে আছে বলে অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সংঘাত আমাদের নজরে আসে। মোদীর পছন্দের রাজ্যপাল সুযোগমত বিজেপির ধ্যানধারণার প্রতি বিশ্বস্ত ব্যক্তিদেরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য রূপে নিয়োগ করে থাকেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এরকমই একটা সুযোগ এনেছিল এই রাজ্যের রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের কাছে, এবং তিনি বিজেপিপন্থী অধ্যাপক বুদ্ধদেব সাউকে উপাচার্য রূপে নিয়োগ করতে ভুল করেন নি। এই সমস্ত ক্ষেত্রে বিবাদের মীমাংসায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সূর্য কান্ত পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন– “আপনারা আলোচনা করে সমস্যা মেটান।” এর পরও এ বিষয়ে কোনো লিখিত নির্দেশ নেই বলে রাজ্য সরকারকে চিঠি দেন রাজ্যপাল। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত রাজ্যপালের কৌঁসুলিকে তিরস্কার করে বলেন, “আগের দিন সবার সামনে বিচারপতি সূর্য কান্ত বলেছিলেন, আপনারা আলোচনা করে সমস্যা মেটান! তার পরেও আপনাদের লিখিত অর্ডার প্রয়োজন হয়?”
মোদী জমানার আগেও রাজ্যপাল পদের অপব্যবহার হয়নি এমন নয়। কেরলেই নির্বাচিত প্রথম অ-কংগ্রেসি নাম্বুদিরিপাদ সরকারকে বরখাস্ত করা থেকে নানা সময় ও পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে কংগ্রেসি সরকারের অভিসন্ধিকে বলবৎ করা ও কংগ্রেসের নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধিতে রাজ্যপালদের কাজে লাগানো হয়েছে। তবে নরেন্দ্র মোদী জমানায় শুরু হয়েছে রাজ্য সরকার ও রাজ্যপালদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির এক নতুন পর্যায়। রাজ্য প্রশাসনকে বিপর্যস্ত করে তুলতে এবং হিন্দুত্বর স্বার্থ সিদ্ধিতে রাজ্যপালদের ব্যবহার করাটা অনেক প্রকট হয়ে উঠেছে। নরেন্দ্র মোদী মুখে “সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা”র কথা বললেও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বিপর্যয় ঘটানোর অভিমুখেই তাঁর পদক্ষেপগুলো চালিত হয়। ভারতের বৈচিত্র্য ও বহুরূপতাকে বিপর্যস্ত করা, “এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি” র এজেন্ডার রূপায়ণ, নির্বাচনের পর সরকার গড়ায় অ-বিজেপি একক বৃহত্তম দলকে না ডেকে বিজেপিকে বিধায়ক জোগাড়ের সুযোগ করে দেওয়া, নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের গণতান্ত্রিক নীতির ওপর আক্রমণ– এই সব ভূমিকাতেই রাজ্যপালরা এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র যথার্থই বলেছেন, “তাঁরা (রাজ্যপালরা) রাজ্যের স্বার্থের চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থই বেশি সিদ্ধ করছেন। তাঁরা আইনি নির্দেশের ভিত্তিতে নিজস্ব বিচার-বিবেচনা প্রয়োগ করার চেয়ে রাজনৈতিক প্রতিভূ হিসেবেই বেশি সক্রিয় হন।” ব্রিটিশ জমানার গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়-এর ক্ষমতার ঐতিহ্যবাহী, গণতন্ত্রের খর্ব ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বিনাশে যুক্ত এই পদটির বিলোপই এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।