বাংলার মুসলমান সমাজ বদলাচ্ছে। নিজেদের মতো করে এগোনোর প্রয়াসে অর্জিত সেই বদল। সাচার কমিটির ভাবনা-দিশায় তারা চালিত হওয়ার সুযোগ পায়নি, কিংবা রঙ্গলাল মিশ্র কমিটি বা গোপাল সিং কমিটির সুপারিশের কাঙ্খিত ছায়া এখানে নেই। ফলে পরিসংখ্যানে এ ছবি ধরা নেই। পরিসংখ্যান জুড়ে ছবিটা কিন্তু নৈরাশ্যের। সরকারি চাকরির হার কমতে কমতে গত দশকের শতকরা ২.৩ থেকে বর্তমানে ১.৬৫। শিক্ষা-স্বাস্থ্যে সরকারি অবহেলা বিছানো। এই জায়গায় অলক্ষ্যে এগোনো আলো-আঁধারির মতো। কথা হল, আলোকিত দিকটাও আছে।
আসুন, একটা গ্রামে খোঁজখবর নেওয়া যাক। পূর্ব বর্দ্ধমানের এই গ্রামটি থেকে গত বছরে কোরবানির পরে কেরল যাওয়ার টিমে নতুন ছ’জন যোগ দিয়েছিল। দু’জন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে এক বছর বসেছিল। একজন এগারো ক্লাশের পর আর এগোয়নি। বাকি তিন জন বছর তিনেক আগে অষ্টমে পাঠ চুকিয়ে বাবার সঙ্গে ক্ষেতে টুকটাক কাজ করত। সব মিলিয়ে এ গ্রাম থেকে সত্তর জন মুসলিম যুবা-কিশোর— বেশিরভাগ কেরালা, কেউ কেউ মুম্বাই, দিল্লী বা চেন্নাই পাড়ি দিয়েছে। রাজমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে, কাঠের মিস্ত্রি, বাগিচায় কাজ, সোনা বা ইমিটেশনের কাজ, জড়ির কাজ। এরা এমন সব কাজে নিযুক্ত শ্রমিক। ভিন রাজ্যে মজুরি বেশি, কাজ বেশি। পরিশ্রমেরও লম্বা বহর। ভালো রোজগারের নিশ্চয়তায় এরা ছোটে ভিন রাজ্যে।
গ্রামটিতে যারা ছয়-সাত বছর, কি তারও কিছু বেশি সময় বাইরে রোজগার করছে, তারা সবাই গ্রামে একতলা পাকা বাড়ি বানিয়েছে। অনেকে মোটর সাইকেল কিনেছে। কেউ কেউ বাড়িতে মিনি ডীপ টিউব ওয়েল বসিয়েছে। অনেকেরই বাড়ি বানানোর মতো ভিটে ছিল না। এরা ডাঙ্গা বা চাষের জমি দু’তিন কাঠা কিনে ভিটে বানিয়ে নিয়েছে। বেশ চড়া দামেই কিনেছে। এদের দৌলতে ভিটের উপযোগী জায়গার দাম বাজার ছাড়া বেড়ে গেছে। বাইরে থেকে ছেলেদের পাঠানো টাকায় অনেকে, যারা ভূমিহীন ক্ষেতমজুর, চাষের জমি বন্ধক নিয়ে বা ঠিকায় চাষ করে। চাষে লোকসানও হয় কখনো। তা হোক, পরের জমিতে মুনিষ খাটার অবসানে এক অনির্বচনীয় মুক্তির স্বাদ উপভোগ করে। নিজের হাতে নিজের চাষে মনে বড় প্রসন্নতা। কেউ কেউ যাদের কাজ ও রোজগার বেশি, তারা কিছু বেশি টাকা জমিয়ে দু-আড়াই বিঘে চাষের জমি কিনেছে।
এ গ্রামে মোট মুসলমান পরিবারগুলোর প্রায় অর্ধেক, যেখানে ভূমিহীন বা সামান্য জমি আছে এমন পরিবারগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ, ভিন রাজ্যে কাজে যাচ্ছে। সারা রাজ্যে অধিকাংশ গ্রাম থেকে এই অভিবাসন চলছে। মুর্শিদাবাদ, মালদার মতো জেলাগুলো থেকে বেশি। সারা রাজ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান পরিবার থেকে ভিন রাজ্যে অভিবাসন ঘটছে। এই বিপুল অভিবাসনের সুবাদে রাজ্যে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা মুসলমান জনপদে ঢুকছে। এই দিয়ে দরিদ্র পরিবারগুলোর দারিদ্র্য ঘুচেছে। অভিবাসী ছেলেদের পরিবার ঘিরে আশা-স্বপ্নের বাঁধন খুলে গেছে। চলনে-বলনে এরা স্বচ্ছন্দ। এদের রোজগার স্থানীয় বাজার ও কৃষিতে মদত জোগাচ্ছে।
সরকারি কোনো প্রকল্প বা সহায়তায় নয়, মনের সাধ-আহ্লাদ মনে চেপে, পরভূমে মাথা গুঁজে থেকে, কায়ক্লেশে এরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়ে নিয়েছে। নিজেদের সমাজের প্রান্তিকতার মতো পরবাসে এদের এই জীবনযাত্রা এমনই অসংলগ্ন যে, এদের শুধু গড়া নেই, ভাঙাও আছে। মুসলিমদের মধ্যে এই অংশটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। কেননা ব্যবহারিক জীবনে তার কোন সুফল দেখতে পায়নি। কর্মজগতের একঘেয়েমি ও পরিশ্রান্তির চোরাপথে নগর-জীবনের ভালোর থেকে মন্দ এদের জীবনে বেশি ছাপ ফেলেছে। গ্রাম-সমাজে এর খারাপ ফলাফল আছে। বিপরীতে এদের মধ্যে কারো কারো পরিবারে দেখা যায়, স্থানীয় বেসরকারি স্কুলে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করছে। নিজের বাড়িতে আলাদাভাবে বা দু’তিনজন মিলে প্রাইভেট টিউটর রাখছে। সরকারি স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্যও অনেকের পরিবারে এরকম প্রাইভেট টিউশনের ব্যবস্থা হয়। অধুনা লেখাপড়ার দস্তুর মতে ব্যাপারটা মানানসই। মুসলমান সমাজে আজকের টানাপোড়েনের মধ্যে তার সার্থকতা কতটা, তা চাক্ষুষ করা সময়ের ব্যাপার। ভালোভাবে বাঁচার এ এক খণ্ডিচিত্র। এই নিয়ে বাংলায় প্রান্তিক জায়গায় পড়ে থাকা মুসলিমরা উঠে দাঁড়াতে চায়।
২.
কোভিড এদের জীবনে অনিশ্চয়তা ডেকে আনলেও তা সাময়িক প্রমাণিত। ভিন রাজ্য থেকে গ্রামে ফিরে আসা ছেলেরা এখন আবার দলে দলে কর্মস্থলে রওনা দিচ্ছে। কিন্তু এই স্বস্তির সময়েই এদের জন্য অপেক্ষা করছিল অসম্ভব দু:সংবাদ। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে কেরালায় ও বাংলায় মুর্শিদাবাদের যে ন’জন মুসলিমকে গ্রেপ্তার করা হ’ল, তাদের মধ্যে পাঁচ জন অভিবাসী শ্রমিক। এরপর মুসলিমদের অভিবাসী জীবন কেমন হবে? এদেশে ‘সন্ত্রাসবাদী মানেই মুসলমান’, এমন বদনাম বিভেদ-বিদ্বেষের রাজনীতির সুবাদে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে বহুদূর। তখন এদের ভিন রাজ্যে মানুষের ও অবশ্যই সরকারের সন্দেহের কোপে পড়া অসম্ভব নয়। যারা ভিন রাজ্যে কাজে যেতে চায়, এই ধরপাকড় তাদের সামনে একটা বাধা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
অথচ এ এমন এক ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর গল্প যে, কারো স্নানাগারের চেম্বার হয়ে গেল সুড়ঙ্গ, কারো বাড়িতে থাকা চকোলেট বোম্ব হয়ে গেল বিষ্ফোরক তৈরির মালমশলা, কারো বাড়ির ইলেক্ট্রিক অয়্যারিংয়ের তার হয়ে গেল বিষ্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম। কারো কাছে নাকি দেশি পিস্তলও মিলেছে। তদন্ত এরকমই চলবে। চোখ রাঙানি চলবে। এদিকে হিন্দু মনে ভুল বার্তা পৌঁছে যাওয়ার অছিলায় ভোট-পার্টির নেতারা হিন্দু-মুসলমান উভয় দিক থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের দেশপ্রেমের প্রমাণ রাখলেন। আর ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা বোঝে, বিভেদপন্থীরা সামনের ভোটে হিন্দু-মেরুকরণের মওকা নিয়ে পাঁচকাহন করবে। অন্যদিকে অবশ্য ভোটাভুটির হিসেবনিকেশ সরিয়ে রেখে বিরোধিতা হ’ল। সামাজিক সংগঠন থেকে প্রতিবাদ হ’ল। তার পরিসর বড় নয়। কিন্তু সেখানে নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের জায়গাটা আছে। এইটুকু মাত্র মুসলমান সমাজের প্রতি সহমর্মিতা।
আমাদের দেশে স্বাধীনতার সময়কার আর আজকের সময়ে মুসলিমদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা বিচার করলে দেখি, মুসলমান সমাজে যা-কিছু অনগ্রসরতা, তা স্বোপার্জিত নয়, তা আরোপিত। প্রাতিষ্ঠানিক ও আরোপিত সামাজিক অবজ্ঞা, অবহেলা ও বাধার পাহাড় মুসলমান সমাজের সামনে সর্বদা দাঁড়িয়ে থেকেছে। আশ্চর্যজনকভাবে বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পীঠস্থান এই বাংলায় তার ব্যতিক্রম হয়নি।
আজ দেশে নতুন অর্থনৈতিক বিন্যাসের সুযোগে মুসলমান সমাজে অভিবাসী শ্রমে ভর করে উঠে দাঁড়াবার সংকল্প দানা বেঁধেছে। বাংলায় তার ওজন সবচেয়ে বেশি। কিন্তু দেশের শাসকগোষ্ঠীর চরিত্রে মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস-আত্মনির্ভরতা সহ্য হওয়ার নয়। তাই এ রাজ্যের মুসলিমদের সামনে প্রাতিষ্ঠানিক বাধাকে সন্ত্রাসবাদের নামে চরমে নিয়ে গেল কেন্দ্র সরকার। এই তাদের আসল উদ্দেশ্য। বাংলার মুসলিমরা তা হলে দাঁড়াবে কোথায়?