ঘুম থেকে উঠে আমার কি করার ছিল?স্কুলে যাওয়া না কলেজে যাওয়া? নাকি অফিসে যাওয়া? আমার মা এখন কোথায়? জীবিত না মৃত? কিছুই আমি মনে করতে পারছিনা। না,মনে করতে পারছিনা,ব্যাপারটা ঠিক তেমন না। আসলে প্রতিটা প্রশ্নেই আমার কাছে দুটো তিনটে করে অপশন আসছে। তার মানে কি? আমি বর্তমান থেকে হটাত করে পাস্টে চলে গেছি?নাকি বর্তমান থেকে আমার ভবিষ্যতে চলে গেছি? কিছুই বুঝতে পারছিনা। সব কেমন ঘেঁটে যাচ্ছে। মনে হয় উঠে চোখে মুখে জল দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে সব আবার ঠিকঠাক চলবে। কিন্তু আমার উঠতে ইচ্ছে করছেনা একদম। এরকম আমার আগে হয়েছে কিনা মনে পরেনা। আমি উঠছি না কারণ গোটা সিচুয়েশনটা আমি উপভোগ করছি। খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। মাথার কাছেই সিগারেট আর লাইটার। শুয়ে শুয়েই জ্বালানো যাবে। কিন্তু সিগারেটের ধোয়া দিমাকে গেলেই সব রিচার্জ হয়ে যাবে। অতএব শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকলাম,মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম সব কিছু।
হটাত করে আমার একটা সিনেমার কথা মনে পরে গেল। ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণ্ রেখা। মনে না পরার এই হাওয়ায় হটাত এই সিনেমাটার কথা কেন মনে এলো কে জানে! এটাই হয়তো গ্রেট ওয়ার্ক। ক্রাইসিস টাইমে মানুষের সঙ্গ দিয়ে দেয়। আমি সিনেমাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। আনেকদিন আগে এটা দেখেছিলাম। এর গল্প,ক্যারেক্টারস বা অন্য কিছু সেভাবে মনে পড়ল না। শুধু সাদা কালো ছবিতে সুবর্ণরেখা নদি,বালির পার আর পাহাড়গুলো দেখতে পারছিলাম চোখ বুজলে। ছোটো ছোটো টিলা এদিক ওদিক,দূরে দলমা পাহাড়।
কিন্তু আমার এই সিনেমাটার কথা কেন মনে এলো? কেন? কেন? আমি সেই ইষ্টম্যান কালার নদীর বালিতে নেমে পড়লাম চোখ বুজে। হাঁটতে লাগলাম বালিয়াড়ির উপর দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে হটাত ঠোক্কর খেলাম পায়ে। একটা পোড়া কাঠের গুড়ি। বাবাকে সুবর্ণরেখার চরেই পোড়ানো হয়েছিল...
এতক্ষণে আমার উঠে বসতে ইচ্ছে করল। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। মনে পরছে একটু একটূ করে সব। এখন দুপুর। আজ সকাল থেকে খুব বৃষ্টি পরে চলেছে। লিখতে লিখতে ভাত ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এসেছিল। কখন যেন লেখা থামিয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ফাঁকা বাড়ি। কেউ নেই। নেই কোনো শব্দও। দরজা খুলে বারান্দায় এলাম। একটা নিঃসঙ্গ ব্রেসিয়ার দড়িতে ঝুলছে শুকোবার আশায়। ওটা সায়ন্তনীর। ও কি এই ঝুলে থাকা ব্রেসিয়ারটার মতোই নিঃসঙ্গ? হয়ত। কারণ আমিতো ওকে সঙ্গ দিতে পারিনা। কারণ আমি নিজেই নিঃসঙ্গ। যা আমার নেই তা ওকে দিই কিভাবে? কিন্তু ওকে আমি ভালবাসি। ও ও বাসে।
সম্পর্ক কি শুধু ভালবাসায় বাঁচে? মনে হয়না। তাহলে আর কি কি লাগে? অনেক কিছুই লাগে হয়ত। সবটা না হলেও তার কিছু কিছুতো লাগেই। যদি আইরিন থাকতো তাহলে হয়তো আর কিছুই লাগত না। কিন্তু আমি ও সায়ন্তনী কেউই আইরিন কে রাখতে পারিনি।
২।
সায়ন্তনী বাড়ি ফিরেছে। সোফায় শরীর ছেড়ে মোবাইলে ফেসবুক করছে। উল্টোদিকে বসে আমি ইউ টিউবে সূবর্ণরেখা দেখছি। আমরা কেউ কারোর সাথে কোনো কথা বলছিনা। কথা কি শুধু মুখে বলা হয়? না। ত্তাহলে আমরা কথা বলছি। সেই কথা সশব্দ না হয়তো। তবুও বলছি।
আমি- আমাদের কি কথা ফুরিয়ে গেছে?
সায়ন্তনী- হয়তো।
আমি- আইরিন থাকলে এমনটা হতোনা।
সায়ন্তনী- কেন?
আমি- এখন আমরা তাহলে আইরিনের শরীর স্বাস্থ,পড়াশুনো বা ওর সারাদিনের দুষ্টুমিগুলো নিয়ে কথা বলতে পারতাম।
সায়ন্তনী- এখনো বলতে পারি। ধরে নাও আইরিন আছে।
আমি- ভার্চুয়াল?
সায়ন্তনী- হাঁ।
আমি- রিয়েলিটি ছেড়ে ভার্চুয়ালে?
সায়ন্তনী- তাই তো আছি আমরা। আমি ফেসবুকে,তুমি সুবর্ণরেখায়।
আমি- সূবর্ণরেখা ভার্চুয়াল নয়। গিয়ে দ্যাখো,আমরা থাকি না থাকি সে তার মতো বয়ে চলেছে।
সায়ন্তনী- আইরিনও আছে। আমরা তাকে জন্ম দি না দি,সে ঠিক আছে কোথাও না কোথাও।
সায়ন্তনী এসে আমার পাশে বসল। আমরা বসে বসে আইরিনের কান্ড কারখানা দেখতে লাগলাম। ও একমনে ড্রয়িং করে চলেছে। সামনে না খাওয়া দুধের গ্লাশ।
সায়ন্তনী জিগ্যেস করল,কিসের ছবি আঁকছিস রে আইরিন?
ও ড্রয়িং থেকে মুখ তুলে বলল,নদীর ছবি।
আমি প্রশ্ন করলাম,কোন নদী?
আইরিন বলল,সূবর্ণরেখা
সূবর্ণরেখা কলকলিয়ে বয়ে চলেছে। স্বচ্ছ জলে ভিতরের নুড়ি-পাথর দৃশ্যমান। আমি আর সায়ন্তনী ঘুমিয়ে পরছি ক্রমশ। আমাদের মাঝখানে আইরিন...