১
গ্যালিলিও গ্যালিলি, ছিলেন ইতালীয় প্রাকৃতিক দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ যিনি গতির বিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রেখেছিলেন। কোপার্নিকাসের সূর্য কেন্দ্রিক সিস্টেমের পক্ষে তাঁর ওকালতি শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত প্রক্রিয়ায় পরিণতি পায়। গ্যালিলিওর ক্রমবর্ধমান প্রকাশ্য কোপার্নিকানিজম তার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল। কোপারনিকান তত্ত্ব ধর্মবিরোধী, চার্চবিরোধী অতএব রাষ্ট্রবিরোধী। ফলে ১৬৩৩ সালে তিনি ইনক্যুইজিশনের মুখোমুখি হন। স্বলিখিত সমস্ত তত্ব প্রত্যাহার করে নিয়ে এবং ইনক্যুইজিশনের সামনে নতি স্বীকার করে গ্যালিলিও মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে বাঁচেন বটে কিন্তু গৃহবন্দীত্ব সহ আরও বহুবিধ শাস্তি আরোপিত হয় তাঁর ওপর। গ্যালিলিও তখন ৭০ বছর বয়সী। তবুও তিনি কাজ করতে থাকেন। গতি এবং পদার্থের একটি নতুন বই শুরু করেছিলেন। একটি গ্রন্থে তিনি তাঁর অপ্রকাশিত অধ্যয়নগুলি লিখেছিলেন। লিখেছিলেন দুটি নতুন বিজ্ঞান সংক্রান্ত সংলাপ। গতির গাণিতিক এবং পরীক্ষামূলক তদন্তের সংক্ষিপ্তসার করেছিলেন। পতনশীল দেহের নিয়মাবলী এবং প্যারাবোলিক মিশ্রণের ফলে ত্বরণের নিয়মাবলী সৃজন করেন।
৩১শে অক্টোবর ১৯৯২ সালে প্রকাশিত সংবাদে প্রকাশ যে রোমান ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওর নিন্দা করার ৩৫০ বছরেরও বেশি সময় পরে, পোপ জন পল ২, চার্চের সবচেয়ে কুখ্যাত ভুলগুলির মধ্যে একটি, গ্যালিলিওর নিন্দা (যা জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং পদার্থবিজ্ঞানীকে তার আবিষ্কারগুলি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য করেছিল), সে প্রসঙ্গে বলেন যে বিজ্ঞানীর প্রতি "অবিবেচকভাবে বিরোধিতা করেছিল (চার্চ)।” চার্চ এবং গ্যালিলিওর মধ্যে বিরোধ দীর্ঘকাল ধরে ইতিহাসের অন্যতম প্রধান চিহ্ন হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে যুক্তি এবং মতবাদ, বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের মধ্যে সংঘর্ষের।
২
বিশ্বের সর্বত্র “তদন্ত কমিটি” হলো রাষ্ট্রের হাতের একাঘ্নী বাণ, যা ব্যক্তিকে নতজানু করতে তাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে ফেলতে, তাকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করাতে, অথবা মেরে ফেলতে সক্ষম। রাষ্ট্র যখন কোনও ব্যক্তিকে অথবা তার কাজকে মুছে দিতে চায় তখন তদন্ত কমিটি হলো তার মুখোশের আড়ালে জল্লাদের মুখ। এবং বৈধ। কারা থাকে এইসব তদন্ত কমিটিতে? না বিষয় বিশেষজ্ঞ হওয়া নয়, আনুগত্য হয় যোগ্যতার প্রধানতম মাপকাঠি।
১৮ ই নভেম্বর ১৯৭৮। কোলকাতা শহরে ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায় নামে একজন দোষীর ভাগ্য নির্ধারণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে একটি 'বিশেষজ্ঞ কমিটি' নিযুক্ত করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল,তিনি নিজেকে দুর্গা নামের একটি মানব টেস্টটিউব শিশুর জন্ম প্রক্রিয়ার অন্যতম স্থপতি বলে দাবি করেন। (৩রা অক্টোবর, ১৯৭৮)। দ্বিতীয়ত, সরকারী আমলারা তাঁকে মুছে দেবার আগেতিনি মিডিয়ার কাছে সরকারী প্রতিবেদনটির নিন্দা করেছিলেন। তৃতীয়ত, তিনি তাঁর ছোট দক্ষিণ এভিনিউর ফ্ল্যাটে কয়েকটি সাধারণ যন্ত্রপাতি এবং একটি রেফ্রিজারেটর দিয়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন যখন অন্যরা এটি ভাবতেও পারে না, যদিও তাদের হাতে সমস্ত ব্যয়বহুল সম্পদ ছিল। (এই গবেষণায় ড. মুখোপাধ্যায়কে সহায়তা করেছিলেন অধ্যাপক ড. সুনীতি মুখার্জি এবং ডাঃ এস কে ভট্টাচার্য।) চতুর্থ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ, তিনি কখনই সরকারী আমলাদের সামনে মাথা নত করেননি এবং তাঁর সারল্য সবসময় তাঁর সমবয়ষ্ক চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীদের মধ্যে ঈর্ষার জন্ম দেয়।টেষ্টটিউব শিশু জন্মের তদন্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন একজন রেডিওফিজিসিস্ট এবং এতে একজন গাইনোকোলজিস্ট, একজন ফিজিওলজিস্ট এবং একজন নিউরোফিজিওলজিস্ট ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, এঁদের কারোরই আধুনিক প্রজনন প্রযুক্তি সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ছিল না। এমন কিছু লোক ছিল যারা তাদের জীবনের পুরো সময়কালে ভ্রূণ দেখেনি!সুতরাং, ন্যায়বিচারও যখন পূর্বনির্ধারিত, তখন উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন যে সেদিনের সবকিছুই একটি কূটনৈতিক জালে সাবধানে বোনা একটি অনিয়ন্ত্রিত বিতর্কে আটকে গিয়েছিল।কমিটি তার চূড়ান্ত রায় পেশ করে, "ডঃ মুখোপাধ্যায় যা দাবি করেন তার সবই ভুয়া।"
মাত্র ৬৭ দিন আগে, মানে ২৫শে জুলাই ১৯৭৮, বিশ্বের প্রথম মানব টেস্টটিউব বেবি লুইস জয় ব্রাউন ইংল্যান্ডের ওল্ডহাম জেনারেল হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। স্থপতি ছিলেন রবার্ট এডওয়ার্ড এবং প্যাট্রিক স্টেপটো। তাদের পদ্ধতিতে তারা এলপ্রোস্কোপ ব্যবহার করে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে। কিন্তু ডাঃ মুখোপাধ্যায় ল্যাপারোস্কোপ ব্যবহার না করেই যোনিপথে ছোট অপারেশন করে ডিম্বাণু সংগ্রহ করেন। তিনি একটি হরমোন এবং উন্নত ভ্রূণ ব্যবহার করে সংগৃহীত ডিম্বাণুর সংখ্যা বাড়িয়েছেন। অবশেষে, তিনি এটি গর্ভে স্থাপন করেন। ফলস্বরূপ, গর্ভাধানের সম্ভাবনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
তাঁর সমবয়ষ্ক চিকিৎসক এবং সরকারী আমলাদের প্রাণপণ উদ্যোগে তিনি শেষ পর্যন্ত শাস্তি পেয়েছিলেন। তাঁকে চক্ষু বিভাগে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, যা তার হরমোনের উপর কাজ করার সম্ভাবনাকে সিল করে দিয়েছে।সামাজিক বয়কট, আমলাতান্ত্রিক অবহেলা, তিরস্কার এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট তাঁকে ক্রমশঃ অবসাদগ্রস্ততায় নিমজ্জিত করে।ভারত সরকার তাঁকে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। অবশেষে ১৯শে জুন ১৯৮১ তারিখে তিনি তাঁর কলকাতার বাসভবনে আত্মহত্যা করেন। তিনি তার সুইসাইড নোটে লিখেছেন:
“আমি দিনের পর দিন হার্টঅ্যাটাকে নিহত হবার জন্য অপেক্ষা করতে পারি না।”
ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনী বিস্মৃতির অতলেই তলিয়ে যেতো যদি না টিসি আনন্দ কুমার, যিনি ভারতের দ্বিতীয় (আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম) টেস্ট-টিউব বেবির পিছনে মাস্টারমাইন্ড হিসাবে কৃতিত্বপ্রাপ্ত। তৎকালীন বৈজ্ঞানিক নথি অনুসারে "হর্ষ" (১৬ই আগস্ট ১৯৮৬) তখন ভারতের প্রথম মানব টেস্ট টিউব বেবির স্বীকৃতি পেয়েছেন। আইসিএমআর (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ) এর ডিরেক্টর ডঃ টিসি আনন্দ কুমার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার কিছু ব্যক্তিগত নোট পড়ে, পর্যালোচনা করে, কুমার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে তিনি প্রথম নন। ১৯৯৭ সালে তিনি বিজ্ঞান কংগ্রেসে অংশগ্রহণের জন্য কলকাতায় আসেন। ডঃ মুখোপাধ্যায়ের সমস্ত গবেষণা নথি তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। দুর্গার বাবা-মায়ের সাথে সতর্কতার সাথে যাচাই-বাছাই করার পর তিনি নিশ্চিত হন যে ডঃ মুখোপাধ্যায়ই ভারতের প্রথম মানব টেস্টটিউব শিশুর স্থপতি।তারপরই তাঁর কৃতিত্বকে ভারতীয় চিকিৎসক হিসাবে বিলম্বিত স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
দুর্গার পিতার শুক্রাণুর সংখ্যা কম ছিল।ডাঃ মুখার্জি জানতেন যে এই ধরনের অবস্থার তিনি কার্যকরভাবে গোনাডোট্রপিন দিয়ে চিকিৎসা করতে পারেন। গোনাডোট্রপিন থেরাপি এখন নিয়মিতভাবে কম শুক্রাণুর সংখ্যাযুক্ত পুরুষদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। ফলে ডাঃ মুখার্জীর আবিষ্কার শুধুমাত্র টেষ্টটিউব বেবির জন্মের সঙ্গেই নয়, উর্বরতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। আর ডাঃ সুভাষ মুখার্জী আবিষ্কৃত ইনভিট্রো পদ্ধতিই বর্তমানে সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি। 'ডিকশনারি অফ মেডিক্যাল বায়োগ্রাফি' তে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পাথব্রেকিং অবদানের জন্য বিশ্বের ১০০টি দেশের ১১০০ জন চিকিৎসা বিজ্ঞানীর নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। সেই অভিধানে কলকাতা শহরের মাত্র তিনটি নাম স্থান পেয়েছে। নামগুলো হলো; স্যার রোনাল্ড রস, শ্রী ইউএন ব্রহ্মচারী এবং ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) তাঁর অগ্নীশ্বর আখ্যানে এমনই একটি চরিত্রের কথা লিখেছিলেন। সেখান থেকে একটি চিঠির উল্লেখ করছি।
“কল্যাণবরেষুঃ
আমি আর তোমাদের কাছে ফিরব না। চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখলুম, তথাকথিত ভদ্রসমাজে কোথাও আমার স্থান নেই। কোথাও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারলুম না । হতচ্ছাড়া দেশকে গালাগালি দিয়ে দিয়ে ক্লাস্ত হয়ে পড়েছি । আবার হঠাৎ আবিষ্কার করেছি, এই দেশকেই ভালোবাসি এর শত দোষ সত্বেও। এ দেশ ছেড়ে কোথা যাব। তাই ঠিক করেছি, তোমরা যাদের অপাংক্তেয় করে রেখেছ তাদের মধ্যে গিয়েই এবার থাকব। বিদ্যাসাগর মশাই শেষ জীবনে সাঁওতালদের মধ্যে এসে বাস করেছিলেন । তিনি নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন তোমাদের ভালো করতে গিয়ে, আমি নাস্তানাবুদ হয়েছি কিছু না করেই। তাই ঠিক করেছি, যে কটা দিন বাঁচি ভদ্রসমাজের আওতা থেকে দূরে থাকব। জানি না তুমি কোনও কালোবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছ কিনা, যদি না হয়ে থাকো আশ্চর্য হব।কালোবাজারের আলকাতরা তো সকলের গায়েই লেগেছে।কালোবাজারের আস্তাকুড়ে যাদের কিলবিল করতে দেখি, তারা তো সবাই সাহেবী-পোশাক-পরা ভদ্রসম্তান। তাদের তোমরা বয়কট কর না, বরং সেলাম কর, কারণ তারা ধনী। গুণীদের নয়, ধনীদের পূজা করাই ভদ্রসমাজের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে । আমি দূর থেকে প্রণাম করে' সে সমাজ থেকে সরে পড়েছি।
আমাকে খোঁজবার চেষ্টা কোরো না। যে মহাসমুদ্রে এবার গা ভাসিয়ে দিতে চললুম, তার চেয়ে বড় সমুদ্র ভূগোলে নেই। এ সমুদ্রের ঢেউ দীন হীন আর্ত অসহায়েরা। এদের ত্রাণ করবার জন্যেই ভগবান নাকি মাঝে মাঝে মর্ত্যে অবতীর্ণ হন, তারও খোঁজ করবার ইচ্ছে আছে। ....
আশীর্বাদ জেনো সকলে।
ইতি
শুভার্থী অগ্নীশ্বর”
বাংলাভাষায় “অগ্নীশ্বর” কাহিনী নিয়ে একটি জনপ্রিয় সিনেমা নির্মিত হয়েছে। যেমন হয়েছিল তপন সিনহার “এক ডাক্তার কী মওত”। ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন নিয়ে আধারিত চলচ্চিত্র। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। শেষ পর্যন্ত সকলি বিনোদন ভেল। কিন্তু পৃথিবী তো থামেনা। চলতেই থাকে। ঘুরতেই থাকে। ইপ্পার সি মুভে। তবুও পৃথিবী ঘোরে।
আগের লেখা পড়ুন নীচের সূত্রে ঃ https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/still-the-earth-moves-part-1