বিহারে নির্বাচন তালিকার যে বিশেষ নিবিড় সংশোধন হল তার থেকে নির্বাচন কমিশনের মনোভাব স্পষ্ট হতে আর বাকি কিছু নেই। পরিস্কারই বোঝা যায় তাদের মূল উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া। বিহার দিয়ে শুরু হলেও এই প্রক্রিয়া চলবে গোটা দেশ জুড়ে। এরপর পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ওড়িশ্যার কথা বলা হচ্ছে। বিহারের মানুষ প্রতিরোধে সামিল হচ্ছে, পালা আসছে আমাদেরও, বুঝে ও যুঝে নেওয়ার।
আপাতভাবে মনে হতে পারে, নির্বাচন তালিকার সংশোধন হবে- এতে আপত্তির আর কী আছে। নতুন করে যতটা সম্ভব নির্ভুল নির্বাচন তালিকা তৈরি করা হলে মন্দ কী? ব্যাপারটা এত সরল হলে এতে আপত্তি করার সত্যিই কিছু ছিল না। উপর উপর দেখলে বা নির্বাচন কমিশনের কথাবার্তা শুনলে যেমনটা মনে হয় একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, বিষয়টা একেবারেই তেমন নয়। ফলে আপাতভাবে যা দেখানোর বা বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে তার গভীরে গিয়ে তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের বিষয়টা বুঝে নিতে হবে। একে একে বিন্দু ধরে ধরে আমরা বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করব:
১) ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন শুধু সাধারণ সংশোধন মাত্র নয়। কয়েক মাস আগেই বিহারে ভোটার তালিকার সংশোধন হয়ে গেছে। তাহলে আবার এখন সংশোধনের প্রশ্ন উঠছে কেন? আসলে, এখন যেটা হচ্ছে, সেটা কোনও সংশোধন নয়- এটা হচ্ছে নতুন করে ভোটার তালিকা তৈরি।
২) ভারতের সংবিধান অনুসারে, জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ সম্পত্তির পরিমাণ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ভোটাধিকার একটি মৌলিক অধিকার। দেশের প্রতিটি মানুষ যেন এই অধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। ভারতে এই প্রক্রিয়া ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক। স্বাধীন ভারতের প্রথম ভোটার তালিকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোটার তালিকা, যেখানে ভাষা, ধর্ম, জাতপাত, শিক্ষার মান বা অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো বাধা রাখা হয়নি। শুধুমাত্র ২১ (পরে কমিয়ে ১৮) বছর বয়সের সময়সীমা রাখা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের লোক বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য যাচাই করে ভোটার তালিকায় নাম তোলার কাজ করে। পরেও, আবেদনের মাধ্যমে তালিকায় নাম তোলার ব্যবস্থা থাকলেও, এতদিন পর্যন্ত মানুষের কাছে পৌঁছানোর মূল দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশনেরই।
এই প্রথমবার, ভোটার তালিকায় নাম তোলার দায়িত্ব পুরোপুরি তুলে দেওয়া হচ্ছে ভোটারের কাঁধে। বিহারে নাম তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২৪ শে জুন, যারা ২৫ শে জুলাই-এর মধ্যে নাম তোলার ফর্ম জমা করতে পারবে, শুধু তাদেরই নাম খসড়া ভোটার তালিকায় থাকবে বলে বলা হয়। নাম তোলার ফর্মে চাওয়া হয়েছে আবেদনকারীর সদ্য তোলা ছবি, স্বাক্ষর, কিছু সাধারণ ব্যক্তিগত তথ্য ও নাগরিকত্বের প্রমাণ। ফলে চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় শুধু তাদেরই নাম থাকবে- যারা নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি দিতে পারবে। এদিক থেকে বিশেষ নিবিড় সংশোধন হল ঘুর পথে NRC লাগু করার প্রয়াস।
৩) বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR)- এর ক্ষেত্রে, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুসারে ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের নাগরিক বলে মানা হবে। সঠিক নাম ও অপরিবর্তিত ঠিকানাসহ সেই ভোটার তালিকার প্রতিলিপি জমা দিলে তা নাগরিকত্বের প্রমাণ বলে গণ্য হবে ও নতুন তালিকায় সেই নাম রাখা হবে। নির্বাচন কমিশন দাবি করছে যে, এর মাধ্যমেই নাকি বেশিরভাগ ভোটারের নাম নতুন তালিকায় তোলা সম্ভব।
নির্বাচন কমিশনের দাবি (আসলে মিথ্যাচার): বর্তমানে বিহারের ভোটার তালিকায় ৭.৮৭ কোটি মানুষের নাম আছে। আর ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় নাম ছিল ৪.৯৬ কোটি মানুষের। তাহলে নতুন করে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিয়ে নাম তুলতে হবে ২.৯১ কোটি মানুষকে—যা মোট ভোটারের প্রায় ৩৭%।
আসল অবস্থা: ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় যাদের নাম ছিল, সেই ৪.৯৬ কোটি মানুষের অনেকেই ইতিমধ্যে মারা গেছেন অথবা অন্য রাজ্যে স্থায়িভাবে চলে গেছেন। ফলে, বাস্তবে এই তালিকার কার্যকর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ৩.১৬ কোটি। ফলে নতুন করে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিয়ে নাম তুলতে হবে প্রায় ৪.৭১ কোটি মানুষকে—যা বর্তমান ভোটার তালিকার প্রায় ৬০%।
এখন এই যে ৪.৭১ কোটি মানুষ তাদের তিনটে ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
ক) ১৯৮৭ সালের পয়লা জুলাই এর আগে যাদের জন্ম অর্থাৎ এখন যাদের বয়স ৩৮ বছর বা তার বেশি, তাদের নাম যদি ২০০৩ এর ভোটার তালিকায় না থাকে তাহলে তাদের জন্ম সার্টিফিকেট জমা করতে হবে।
খ) ১৯৮৭ সালের পয়লা জুলাই থেকে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে যাদের জন্ম অর্থাৎ এখন যাদের বয়স ২২-৩৮ বছরের মধ্যে তাদের ক্ষেত্রে নিজের এবং মা অথবা বাবার নথি জমা করতে হবে।
গ) ২০০৩ সালের পরে যাদের জন্ম তাদের ক্ষেত্রে নিজের ও মা এবং বাবা দুজনকারই নথি জমা করতে হবে।
-- খ) ও গ) – এর ক্ষেত্রে মা বা বাবার ২০০৩ এর ভোটার তালিকায় নাম থাকলে সেই নথি গ্রাহ্য হবে, তবে ভোটারের জন্ম সার্টিফিকেট লাগবে।
সহজেই বোঝা যায়, এই সমস্ত নথি বেশিরভাগ মানুষের কাছেই নেই। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই নির্বাচন কমিশন ১১টি নথির একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে যেকোনও একটি নথির মাধ্যমে নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে।
এই ১১টি নথিকে বলা হয়েছে "নির্দেশক, কিন্তু চূড়ান্ত নয়" (indicative but not exhaustive) — অর্থাৎ, এই তালিকা পূর্ণাঙ্গ নয় এবং অন্য নথিও বিবেচনায় আসতে পারে।
বাস্তবতা:
এই ১১টি নথির মধ্যে ৬টি বিহারের ক্ষেত্রে কার্যত অপ্রযোজ্য — অর্থাৎ, হয় সেই নথিগুলোর অস্তিত্ব নেই, কিংবা খুবই নগণ্য সংখ্যক মানুষের কাছে তা আছে।
অতএব, ব্যবহারযোগ্য নথি রইল মাত্র ৫টি।
এই ৫টি নথির মধ্যে কতজন মানুষের কাছে কোনটি আছে, তার একটি আনুমানিক পরিসংখ্যান নিচে দেওয়া হল: (২ জুলাই ২০২৫। The Indian Express, Yogendra Yadav)
• জন্ম-সার্টিফিকেট: ~২.৮%
• পাসপোর্ট: ~২.৪%
• সরকারী চাকরি বা পেনশন আইডি: ~ ৫%
• কাস্ট সার্টিফিকেট ~১৬%
• মাধ্যমিক বা শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট: ~৩৫%
অথচ যে নথিগুলো বেশিরভাগ মানুষের কাছে আছে তাকে ধার্য করা হচ্ছে না, যেমন:
• ভোটার আইডি: ~৯৫%
• আধার: ~৯৩%
• রেশন কার্ড: ~৮০%
অর্থাৎ, এমন কিছু নথিকে প্রামাণ্য মানা হচ্ছে যা শুধু উচ্চবিত্তদের বা একটু অবস্থাপন্ন লোকেদের কাছেই আছে। দেখা যাচ্ছে মাধ্যমিক বা শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটের মাধ্যমেই একমাত্র কিছু সংখ্যক লোক ভোটার তালিকায় নাম তুলতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও নাম তোলার প্রশ্নে বিশাল বৈষম্য রয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে প্রথাগত শিক্ষা কুক্ষিগত: আর্থিক সচ্ছলতা, জাত ও লিঙ্গের ভিত্তিতে। ফলে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল, সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া এবং মহিলাদের নাম বাদ পড়ার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। এই ১১ টা নথির বাইরে আর কোন নথি নিতে নির্বাচন কমিশন যদি শেষ অবদি রাজি না হয় তাহলে ১.৫ থেকে ২ কোটি মানুষের নাম বাদ পড়ার সম্ভাবনা আছে, যা অভূতপূর্ব। নিয়মতান্ত্রিক পথে ভেতর থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিকেশ করার হয়তো এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হতে চলেছে বিশেষ নিবিড় সংশোধন।
কিন্তু নির্বাচন কমিশনের এরকম আচরণের কারণ কী? তার জন্য আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০২৩ সালে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ সংক্রান্ত নিয়মে পরিবর্তন আনে। আগে কমিশনের নিয়োগের জন্য যে কমিটি থাকত, তাতে থাকতেন—প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। কিন্তু নতুন আইনে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে তাঁর জায়গায় একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে রাখা হয়েছে, যিনি থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে। বর্তমানে সেই মন্ত্রী হচ্ছেন অমিত শাহ। ফলে বোঝা যায় নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা কোথায়, কার নির্দেশে তারা এই নিবিড় সংশোধনের প্রক্রিয়ায় নেবেছে। নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যাতে যা খুশি করিয়ে নেওয়া যায় তার জন্য তাকে বাড়তি সুরক্ষাও দেওয়া হয়েছে: নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে আদালতে আর কোনো মামলা করা যাবে না, সিভিল বা ফৌজদারি—কোনোটিই নয়।
এবারে দেখে নেওয়া যাক ভোটার তালিকাকে পূত পবিত্র করে তোলার জন্য যে বিশেষ নিবিড় সংশোধন, তার কাজের ধরণ ও ফলাফল:
১লা আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা এমন ফরম্যাটে প্রকাশ করা হয় যা নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়, ফলে ৬৫ লাখ লোকের নাম কি কারণে বাদ গেল তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। সুপ্রিমকোর্টে অনেক চেষ্টা করেও যখন আটকানো গেল না তখন বাধ্য হয়ে নির্বাচন কমিশন খসড়া ভোটার তালিকার সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণযোগ্য ফরম্যাটে প্রকাশ করল, কিন্তু তা দিল বুথ ভিত্তিক- ভেঙে ভেঙে, যাতে একসাথে নিয়ে সেই তথ্যের বিশ্লেষণ করা না যায়। কষ্ট ও সময়সাপেক্ষ হলেও সেই খসড়া ভোটার তালিকার বিশ্লেষণ অনেকে করেছেন। বিশ্লেষণে যা উঠে আসছে তা ভয়াবহ, কিছু নমুনামাত্র নিচে দেওয়া গেল:
১) ডাবল/ডুপ্লিকেট ভোটার (একই পরিচয়, দুই আইডি): মাত্র ১৫টি আসনে ৬৭,৮২৬টি সন্দেহজনক ডবল-এনট্রি; এর মধ্যে ৩৪,৩৯২টি ক্ষেত্রে পুরো পরিচয় (নাম, আত্মীয়ের নাম, বয়স) একই, কিন্তু দুটি আলাদা ভোটার আইডি রয়েছে। ( ৩০ আগস্ট ২০২৫। Reporters' Collective)
২) ভুয়া/অস্তিত্বহীন বাড়ির ঠিকানায় গুচ্ছ ভোটার: কেবল ৩টি আসনে (পিপড়া, বাঘা, মোতিহারি) ৮০,০০০-এর উপর ভোটার একই ঠিকানায় নিবন্ধিত—অনেক ঠিকানাই বাস্তবে নেই। শুধু পিপড়াতেই এক অস্তিত্বহীন বাড়িতে ৫০৯ জন, আরেকটিতে ৪৫৯ জন; বাঘায় ৯টি ঠিকানায় ১০০-এর বেশি ভোটার; মোতিহারিতে এক ঠিকানায় ২৯৪ জন। ( ১৭ আগস্ট ২০২৫। Reporters' Collective)
৩) পাটনা, মাঝুবনি ও পূর্ব চম্পারণ—এই ৩ জেলায় মোট ১০.৬৩ লাখ নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, যা সারা বিহারে বাদ পড়া ৬৫ লক্ষ ভোটারের ১৬.৩৫%। এই ৩ জেলার ৩৬টি আসনের মধ্যে ২৫টিতে যতো ভোটার বাদ পড়েছে, তার সংখ্যা আগের নির্বাচনের জয়ের ব্যবধানের চেয়েও বেশি। (২৬ আগস্ট ২০২৫। The Indian Express)
৪) যে ৬৫ লাখ ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে যাদের মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকেই জীবিত আছেন। এই সব ক্ষেত্রে গরিব মানুষের সংখ্যাই বেশি। রিপোর্টার্স কালেক্টিভ এবং কয়েকটি স্বাধীন অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাম বেশি বাদ গেছে, যেখানে একই জায়গার সংখ্যাগরিষ্ঠ ও তুলনামূলক সমৃদ্ধ ভোটাররা তেমনভাবে প্রভাবিত হয়নি।
৫) নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বিহারে ২০০০-এর বেশি এমন বুথ আছে যেখানে প্রতিটি বুথে ২০০-এর বেশি নাম বাদ পড়েছে। ২৯৭টি বুথ এমন যেখানে ৩০০-এর বেশি নাম বাদ পড়েছে। ৬৫টি বুথে ৪০০-এর বেশি এবং ১১টি বুথে ৫০০-এর বেশি নাম বাদ পড়েছে। যেখানে প্রতিটি বুথে গড়ে ১২০০-১৩০০ এর মতো ভোটার থাকে, সেখানে এত নাম বাদ যাওয়ার ঘটনা বেশ অস্বাভাবিক।
৬) অনেক বুথে ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র মৃত্যুর কারণে, মানে একজন ব্যক্তিও স্থানান্তরিত হননি, একজনও ডুপ্লিকেট পাওয়া যায়নি, একজনও নিখোঁজ নন। যারা বাদ পড়েছেন, সবাই কেবল মৃত। এই রকম বুথগুলোর সংখ্যা প্রায় ১৪২৪। আবার দেখা যাচ্ছে, বিহারে ১০১৪টি বুথ আছে যেখানে ৭০%-এর বেশি মানুষ মারা গেছেন যাদের বয়স ৫০-এর কম।
৭) এবার আসি বাদ পরা মহিলা ভোটারের সংখ্যার দিকে। বিহারে ২৮১টি এমন বুথ আছে যেখানে বাইরে যাওয়া মানুষদের মধ্যে ৮০%-এর বেশি মহিলা এবং ৯ ,০০০-এর বেশি এমন বুথ আছে যেখানে বাইরে যাওয়া মানুষদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা বেশি, পুরুষদের সংখ্যা কম- এই সকল ঘটনা যথেষ্ট অস্বাভাবিক।
এখন মুশকিল হল বৈধভাবে বাদ পড়া ভোটারদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই পুনরায় আবেদন করতে পেরেছেন, কারণ নাম যে বাদ গেছে তা জানতেই অনেক সময় চলে গেছে।
------- এই হল বিশেষ নিবিড় সংশোধনের বিশেষত্ব ও নিবিড়ত্বের নমুনা।
কি প্রক্রিয়ায় বা কোন ধরণের অনুসন্ধান বা আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন এই পদক্ষেপ নিয়েছে? Reporters’ Collective, RTI করে জানতে চায়: বিশেষ নিবিড় সংশোধন করার পেছনে থাকা নথি ও ফাইল (discussion files, correspondence, minutes, drafts ইত্যাদি) ও সেই ফাইলগুলোর নাম ও নম্বর (24 জুন 2025-এ SIR ঘোষণা সংক্রান্ত)। জানতে চাওয়া হয়েছিল কোনো “independent appraisal committee” তৈরি হয়েছিল কি না, এবং তার রিপোর্ট বা সুপারিশ ছিল কি না— Supreme Court-এ নির্বাচন কমিশনের দেওয়া এফিডেভিটে যার উল্লেখ ছিল। এই প্রশ্নের উত্তরেও নির্বাচন কমিশন মুখে কুলুপ এঁটেছে। কোন নথিই তারা দিতে পারছে না বা দিতে চাইছে না।
নির্বাচন কমিশন যা নাকি দেশের একটি স্বশাসিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, তার কাজে এত গোপনীয়তা কিসের? স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরি হচ্ছে বলে যে কমিশন সংশোধনের নামে এত গলা ফাটাচ্ছে তার নিজের কাজে এতটুকুও স্বচ্ছতা নেই কেন? সবচেয়ে মজার কথা, যে অনুপ্রবেশের কথা এত বড়াই করে বলা হচ্ছিল তার একটি নিদর্শনও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
পদ্ম-শিবিরের নির্দেশনায় চলা নির্বাচন কমিশন ২০২৪-এর লোকসভা এবং তার পরপরই হওয়া মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা নির্বাচনের ফল প্রভুর ঘরে চোরাই চালান দিতে পারলেও, এবার বিহারে কিন্তু সে ফেঁসে গেছে। মানুষ নির্বাচন কমিশনের চক্রান্ত বুঝতে পারছে, ধরতে পারছে বিজেপির সঙ্গে তাদের যোগসাজশ। রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব, দীপঙ্কর ভট্টাচার্যদের ভোটাধিকার যাত্রায় বিপুল জনসমাগম হচ্ছে; অন্যদিকে, বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা প্রচারে গিয়ে মানুষের তাড়া খাচ্ছে। বিপাকে পড়া পদ্ম-শিবির এখন পর্যন্ত তিনটি প্রচেষ্টা চালিয়েছে: পাকিস্তান থেকে বিহারে জঙ্গি ঢুকে পড়েছে বলে হৈচৈ তোলা; নিজেদেরই কোনো লোককে দিয়ে মোদির মায়ের নামে গালিগালাচ দিয়ে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা; এবং তাঁবেদার সংবাদমাধ্যমকে কাজে লাগানো। এই মিডিয়া হঠাৎ দেশের মনোভাব (Mood of the Nation) ও বিহারের নির্বাচনী সমীক্ষা করতে নেমে পড়েছে, এবং যথারীতি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের মতোই দেখানোর চেষ্টা করছে — যেন মোদিই এখনো দেশের অবিসংবাদিত নেতা, আর বিহারে বিজেপির জয়জয়কার আসন্ন। কিন্তু এসব করেও হালে পানি তেমন জুটছে না। তবে সামনে হয়তো আরও বড় ধরণের কোনো নাটক আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
আদানি-আম্বানিদের জাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ মানুষ যতই বিজেপির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে, ততই তারা মরিয়া হয়ে উঠছে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। ফলে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির "একে একে নিভিছে দেউটি"। বিজেপি একের পর এক সেগুলোর দখল নিচ্ছে। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের একের পর এক বেঞ্চ দখল হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ নিবিড় সংশোধনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান কী হবে, তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। নির্বাচন কমিশনও এখন বিজেপির দখলে। বিশেষ নিবিড় সংশোধন একটি অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ, যার লক্ষ্য দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া। এমনকি, হয়তো নাগরিকত্বও কেড়ে নেওয়া হবে। আর এই কাজটা একবার করতে পারলে সাধারণ মানুষের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার চালালেও ভোটের মাধ্যমে তাদের সরকার পাল্টানোর ক্ষমতা আর থাকবে না; মানুষকে নামিয়ে আনা যাবে প্রায় ক্রীতদাসের পর্যায়ে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেটুকু গণতান্ত্রিক অধিকার দেশের মানুষ অর্জন করেছিল, আজ তা চরম বিপদের মুখে। আমরা অবশ্যই অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারের বিস্তার চাই, কিন্তু তার জন্যও যা অর্জিত হয়েছিল তাকে রক্ষা করার প্রয়োজন। বিহারে নির্বাচন কমিশনের চক্রান্ত ও বিজেপির সাথে তাদের যোগসাজশ ধরা পড়ে গেছে। বিজেপি সেখানে এখন অনেকটাই কোণঠাসা — লড়াইটা চলছে। বিহারে প্রথম চোটেই বিশেষ নিবিড় সংশোধনকে একটা বড় আঘাত দেওয়া গেলে হয়তো অন্য রাজ্যে এর বিস্তারকে অনেকটা প্রতিহত করা যাবে। এখন দরকার, বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলোর আরও ঐক্য, বামপন্থীদের আরও সক্রিয়তা, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা-প্রেমী মানুষদের আরও অংশগ্রহণ।