পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সিপিআই-এর জন্মদিন প্রসঙ্গে - কিছু সোজা কথা, স্পষ্ট কথা

  • 02 January, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 411 view(s)
  • লিখেছেন : বাসু আচার্য
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্মসাল নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। অবিভক্ত পার্টি ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বরকে প্রতিষ্ঠার দিন হিসেবে চিহ্নিত করলেও, পরবর্তী সময়ে দলীয় বিভাজন এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সেই মতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ১৯২০ সালের তাশখন্দের উদ্যোগ, কিংবা ১৯৩৪ সালের মিরাট-পরবর্তী সময়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মত দানা বাঁধতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নও একাধিকবার অবস্থান বদল করে। অবশেষে, ১৯৫৯ সালে, অবিভক্ত সিপিআই ১৯২৫ সালকেই স্বীকৃতি দেয়। লেখকের মতে, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রয়োজন বিতর্ক পরিহার করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলা।

পা-পা করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বয়স আজ ১০০ ছুঁয়েছে। অসংগঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের বয়স ধরলে অবশ্য তা ইতিমধ্যেই শতবর্ষ পেরিয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজও ঠিক করা গেল না এদেশে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম সাল কোনটা। গেল না বললে অবশ্য ভুল হবে—কারণ পার্টি অভিভক্ত থাকাকালীনই সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল যে, ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বরই পার্টির জন্ম তারিখ। কিন্তু পরবর্তীকালে একাংশের তুলনায় অন্য অংশের কৌলিন্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় সেই জন্মদিনটাও হাওয়া করে দিল কিছু লোক।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২০ সালে তৈরি হয়েছে না ১৯২৫-এ, এই নিয়ে বিতর্ক ছয় দশক পেরিয়েছে। ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জিরা সোভিয়েত তাশখন্দের 'ইন্ডাস্কি ডোম'-এ যে পার্টি গড়ে তোলেন তাকে মানব, না ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে কানপুরে যে সংগঠন গড়ে উঠল তাকে মানব—এই নিয়ে ঝুট-ঝামেলার অন্ত নেই। উপরন্ত, স্তালিন আমলে অর্থাৎ কমিন্টার্ন-কমিনফর্মের যুগে সোভিয়েত পার্টি আবার ঘোষণা করেছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম সাল ১৯৩৪ অর্থাৎ মিরাট-পরবর্তী সময়ে যখন সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন কমরেড গঙ্গাধর অধিকারী। সোভিয়েত পাটি অবশ্য পরবর্তীকালে স্তালিন আমলের এই বক্তব্যের পরিবর্তন ঘটায় এবং ১৯২৫-কেই মান্যতা দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশন থেকে বেরোনো রেজনিকভের 'The Comintern and the East' বইতে সে-কথা স্পষ্ট করে লেখাও আছে। কিন্তু একজন সামান্য গবেষক হিসাবে আমার মনে হয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম সাল হিসেবে সেইটাকেই ধরা উচিত যেটা অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির তরফে ঠিক করা হয়েছিল, যেখানে ১৯৬৪ সালের পাটি ভাগের সময়কার দু'পক্ষের নেতারাই ছিলেন উপস্থিত।
অবিভক্ত পার্টিতে সত্যিই যে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা আজ অনেকেই জানেন না। সেসব নিয়ে ভিরাসৎ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত আমার 'কুড়ি না পঁচিশ?' বইতে তথ্য ধরে ধরে আলোচনা আছে। সেখানে যেহেতু পার্টি গঠন সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত ঔ মতবাদের উপর দীর্ঘ গবেষণাধর্মী বক্তব্য তথা বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে, সেসব আমি এখানে বিস্তারিত আলোচনা করব না। সে-জন্য ওই বই পড়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু যেটা আদত বিষয়, অর্থাৎ পার্টি নিজের জন্মসাল সম্পর্কে কী বলেছে—তা আজকের নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্ট পার্টি কর্মীদের সামনে নিয়ে আসা ভীষণভাবে প্রয়োজন বলে আমি বোধ করি, এবং সেজন্য তা এখানে তুলেও ধরব।
ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন অতি-সাধারণ কর্মী ও গবেষক হিসাবে আমার আজকের অধ্যায়ন-লব্ধ অনুভূতি এই যে, ১৯৬৪ সালের পার্টিভাগের সঙ্গে পার্টির জন্মদিন সংক্রান্ত বিতর্কের একটা সম্পর্ক আছে। সংগঠনের অভ্যন্তরে যে লড়াই সেদিন চলছিল তারই অঙ্গ রূপে ১৯২০-২৫ বিতর্কের সৃষ্টি। তবে মনে রাখা দরকার, এই লড়াইয়ের প্রকৃতি ছিল অনেকাংশেই সাংগঠনিক। পার্টি ভাগের সময় নিচের তলায় যে মতাদর্শগত সংগ্রাম চলছিল, তা উপরের ধাপে ততটা ছিল না। সাদা চোখে দেখলে বোঝা যায়, নেতারা পার্টিটা ভেঙেছিলেন কারণ সাধারণভাবে জাতীয় ফ্রন্ট (এন.এফ.) এবং গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (ডি.এফ.)-এর প্রতিনিধিদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নে প্রথম পক্ষের সঙ্গে দ্বিতীয় পক্ষ দরকষাকষিতে পেরে উঠছিলেন না।
তবে এও বলা দরকার যে, শুধু এন.এফ.-ডি.এফ. বিরোধ দিয়ে পুরো বিষয়টা ধরা বা বোঝা যায় না। কেবল মতাদর্শের কারণেই যদি পার্টি ভাঙতো, তাহলে কি কমরেড ভূপেশ গুপ্ত, কমরেড বিশ্বনাথ মুখার্জিরা "জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব"-এর লাইনের অনুগামী অংশের সঙ্গে থাকতেন, নাকি কমরেড জ্যোতি বসু "জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব"-এর পক্ষাবলম্বীদের নেতা হতেন! ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দগুলোও কাজ করেছিল যার কারণে আমার নিজের জেলা নদিয়ায় কমরেড সুশীল চ্যাটার্জি এন.এফ. অনুগামী হিসেবে "জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব"-এর পক্ষ নেওয়ায় জেলার আর এক নেতা কমরেড অমৃতেন্দু মুখার্জি, যিনি নরমপন্থী হিসাবেই চিহ্নিত ছিলেন ও সংগঠনে ছিলেন কমরেড সুশীল চ্যাটার্জির বিরোধী, "জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব"-এর পক্ষে দাঁড়াণ।
তবে, পাটি ভাগের আগে যে বিরোধ ও বিতর্ক সংগঠনের অভ্যন্তরে চলছিল, তা নিশ্চিতভাবেই পছন্দ-অপছন্দের উপর ভিত্তি করে ছিল না। তার নির্দিষ্ট মতাদর্শগত উৎস ছিল এবং এক পক্ষ অপর পক্ষের উপর চেপে বসার উদ্দেশ্যেই পার্টি গঠন সংক্রান্ত বিতর্ক উত্থাপন করেছিলেন।
যাইহোক, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন কবে হয়েছে এই নিয়ে অবশ্য প্রথম প্রশ্ন তোলে  ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি। তাঁদের মুখপত্রের তরফে তাঁরা জানতে চেয়েছিলেন সিপিআই-এর জন্ম তারিখ কোনটা। এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে নানাবিধ মতামত ঘোরাফেরা করছিল। অবশেষে, বিভ্রান্তির অবসান ঘটাতে, অবিভক্ত পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী ১৮ আগস্ট, ১৯৫৯ তারিখে অজয় ঘোষ, পি.সি. যোশী, বি.টি. রণদিভ, এম. বাসবপুন্নিয়া (মিনিটস্ লেখক), জেড.এ. আহমেদ, এস.এ. ডাঙ্গে এবং এ.কে. গোপালনের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ১৯২৫-কেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের সাল হিসাবে গ্রহণ ও নির্দিষ্ট করতে হবে। তারই ভিত্তিতে সিপিআই কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর প্রতিনিধি রূপে কমরেড বি.টি. রণদিভে ১৯৫৯-এর ২০ আগস্ট ইন্দোনেশিয়া কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র 'দ্য রিভিউ অব ইন্দোনেশিয়া, জাকার্তা'-কে জানান—"The Communist Party India was founded in the month of December in the year 1925. Even before that there were individual communists and communist groups working in different centres in the country. But it was in December 1925 at a meeting of representatives of these various groups of communists in the country held at Kanpur that the Communist Party of India was formed."
কিন্তু "গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট" এবং "জাতীয় ফ্রন্ট"-এর প্রতিনিধিদের মধ্যে পার্টির অভ্যন্তরে যখন লড়াই তিক্ত হয়ে উঠল, তখন এই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত জন্মদিন নিয়েই শুরু হয়ে গেল বাকবিতণ্ডা। কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ পার্টির জন্ম সাল ও তারিখ নিয়ে এই সময়ে একটা বই লেখেন যার ইংরেজি তর্জমা পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র "নিউ এজ মান্থলি"-তে প্রকাশিত হয়। এর পেছনেও অবশ্য নানাবিধ গল্প ছিল, কিন্তু সেই ডিটেলে যেতে চাই না এখানে। তো জাতীয় ফ্রন্টপন্থীদের খানিকটা টাইট দিতে গণতান্ত্রিক ফ্রন্টপন্থীরা, যাঁরা পশ্চিমবঙ্গ পার্টিতে ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ, রাজ্য পরিষদের উদ্যোগে ১৯৬১ সালে পার্টি গঠনের চল্লিশতম বর্ষপূর্তি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সিপিআই-এর বিজয়ওয়াড়া পার্টি কংগ্রেসে কী হয়েছিল তা আজ সকলেরই জানা। দুই গোষ্ঠীর আকচা-আকচিতে সংগঠন সেদিন এমনিই ভেঙে পড়তো যদি কমরেড অজয় ঘোষ এবং কমরেড মিখাইল সুসলভ না থাকতেন। ফলে বিজয়ওয়াড়ায় অভ্যন্তরীণ লড়াইকে একটা বিশেষ স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য জমি প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়ে গেল পার্টির জন্ম তারিখকে কেন্দ্র করে। এখানে বলে রাখা ভালো, রাজনৈতিক প্রশ্নে "জাতীয় ফ্রন্ট" না "গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট"—কে ঠিক ছিল তা এখানে আলোচ্য নয়; কিন্তু পার্টির জন্মদিনকে যে ডি.এফ.-পন্থীরা ব্যবহার করেছিলেন নিজেদের উপদলীয় উদ্দেশ্য সাধনের আয়ুধ হিসাবেই তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা আজ আর হয় না।


যাইহোক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের মানসিকতা স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর কাছে স্পষ্ট ছিল, এবং সেই হেতুই কমরেড অজয় ঘোষের অসুস্থতার ফলে অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক রূপে কর্মরত কমরেড ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের কমরেডদের প্রতি লিখেছিলেন—"We understand that your state council has adopted a resolution to the effect that in 1961 we should celebrate the 40th anniversary of the foundation of the Party. The secretariat discussed the matter and has come to the conclusion that this is a question which cannot be decided by any other organ of the Party except the National Council. It will, therefore, be appropriate to take up the issue in the next meeting of the National Council."
কিন্তু আগেই বলেছি, ক্ষমতার ভাগাভাগিতে জাতীয় পরিষদে ডি.এফ.-পন্থীদের সেরকম বোলবালা ছিল না। ফলে ১৯২৫ সালকেই আবারও মান্যতা দেওয়া হয় যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৬৩ সালের ৫ জুন না-ভাঙা সিপিআই-এর কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর তরফে কমরেড গোবিন্দন নায়ার কর্তৃক প্রচারিত এই বক্তব্য থেকে—"We wish to inform all concerned that the Communist Party of India founded in December 1925 at a conference of communists held in Kanpur. Even prior to this there were some seven communist groups who functioned in several parts of the country and received guidance from the Communist International. But the Party known as the Communist Party of India came to be formed at the abovementioned conference held in Kanpur in December 1925, which was attended by more than 500 delegates. Prominent among those who attended were Muzaffar Ahmad from Calcutta; S. V. Ghate, R. S. Nimbkar and J. B. Bagerhatta from Bombay; Abdul Majeed from Lahore and C. K. Iyengar Singaravelu Chettiar were and from Madras.
"When the conference met in December 1925, both Comrades S. A. Dange and Shaukat Usmani were in jail.
"The Party Executive met on December 28 and elected Comrade S. V. Ghate as one of the General Secretaries."
এখন ঘটনা হচ্ছে, যে যাই বলুক, বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ দেখিয়ে দিচ্ছে পার্টি ভেঙে আমাদের কোনো লাভ হয়নি; বলা ভালো, ক্ষতিই হয়েছে। সর্বোপরি, ১৯৬৪-র ভাঙন এমনই এক ট্র্যাডিশনের জন্ম দিয়েছে যে আজ চূড়ান্ত ফ্যাসিস্ট আক্রমণের মুখেও আমরা একজোট হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। তাই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মুহূর্তে নতুন করে পার্টির জন্ম নিয়ে বিতর্ক তুলে কী লাভ হবে আমি সত্যিই বুঝতে পারি না। ১৯৫৯ সালে অবিভক্ত পার্টি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং তাতে যেহেতু বিবদমান দুই পক্ষের প্রতিনিধিরাই ছিলেন, তাকেই সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়। এখন তো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ার সময়। অভ্যন্তরীণ বিতণ্ডায় নিজেদের দুর্বল করা কোনো কাজের কথা নয়। কিছুতেই না!

0 Comments

Post Comment