বাংলায় নির্বাচন আসছে, বিজেপি এখানে শাসকদলের মূল প্রতিপক্ষ, ক্ষমতা দখলের জন্য তাঁরা ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। তাঁদের মূল শ্লোগান " আর নয় অন্যায়"। তাঁদের মূল বক্তব্য তৃণমূল সরকারের সময়ে প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে, তাঁরা এসে দুর্নীতিমুক্ত সরকার দেবে। কিন্তু বিজেপি নিজেই কি দুর্নীতিমুক্ত? তাঁদের গায়ে কি কোনও কালিমা নেই?
আসুন দেখা যাক।
ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্য হিমাচল প্রদেশ। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন দুর্যোগকে সুযোগে রূপান্তরিত করতে হবে; অমনি রাজ্যের বিজেপি সরকার ঝাঁপিয়ে পড়লো এই আপ্তবাক্য বাস্তবায়িত করতে। ধাঁই ধাঁই করে দুখানা উদাহরণ তৈরী হল:
১. পিপিই দুর্নীতি:
হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর। সরকার বিজেপির। গত মে মাসের মাঝামাঝি, মানে লকডাউনের সময়কার ঘটনা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইতিউতি একটা অডিও ক্লিপের কথা পাওয়া গেল। দুই ব্যক্তির কথপোকথনের সেই ক্লিপ। একদিকে আছেন হিমাচল প্রদেশের স্বাস্থ্য নির্দেশক ডাক্তার অজয় গুপ্ত, অন্য দিকে পাঞ্জাবের চিকিৎসা সরঞ্জাম যোগানকারীদের প্রতিভূ ডাক্তার পৃথ্বী সিংহ। মাত্র তেতাল্লিশ সেকন্ডের এই অডিওয় শোনা গেলো ডাক্তার গুপ্ত পৃথ্বী সিংহের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে বলেছেন টাকাটা পেলে তিনি কাজটা করিয়ে দেবেন। এই অডিও ক্লিপ ফাঁস হবার পরে প্রথমে পৃথ্বী সিংহকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ডাক্তার গুপ্ত আর পৃথ্বী সিংহ দুজনেরই ফোন বাজেয়াপ্ত করে ফরেনসিক গবেষণাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আরও কিছু অডিও রেকর্ডিং উদ্ধার হয়েছে ফোন থেকে।
আপনি হয়তো ভাবছেন যে ঘুঁষ চাইলো অজয় গুপ্ত, আর প্রথমে গ্রেপ্তার হল পৃথ্বী সিংহ— এ কেমন বিধান। আমি বলবো দাঙ্গা করলো কপিল শর্মা, গ্রেফতার হল তারা যারা আটকাতে গেছিল— ঠিক ওই রকমই।
গুপ্তবাবু রাজ্যের বিজেপি অধ্যক্ষ রাজীব বিন্দোলের ঘনিষ্ঠ। অবস্থা হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় গুপ্তবাবুর প্রতিষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত বিজেপি রাজ্য অধ্যক্ষ রাজীব বিন্দোল পদত্যাগ করেন। মজার বিষয় হল রাজীব বিন্দোল কিন্তু মন্ত্রিসভায় ছিলেন না। স্বাস্থ্য দফতর ছিল মুখ্যমন্ত্রীরই দায়িত্বে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিজেপির রাষ্ট্রীয় অধ্যক্ষ জে পি নাড্ডার কাছের লোক হিসেবে পরিচিত রাজীব বিন্দোল। রাজ্য পার্টির দায়িত্ব নিজের হাতে নিতে বিধান সভার স্পিকার পদ ছাড়েন। তাহলে হঠাৎ উনি সরে গেলেন কেন?
২. স্যানিটাইজার দুর্নীতি
এটাও হিমাচলেরই ঘটনা। এ বছর জুন মাস নাগাদ খবরটি সামনে আসে। জানা যায়, হিমাচল প্রদেশের রাজ্য সচিবালয় মোট ৫৭০০ শিশি স্যানিটাইজার কিনেছে ললিতকুমারের কাছ থেকে। যদিও ললিত কুমারের আবার এতো বড় মেডিক্যাল সাপ্লাই দেবার মত লাইসেন্সই ছিল না। এখানেই শেষ নয়। ভারত সরকারের তরফ থেকে স্যানিটাইজারের সর্বাধিক মূল্য বেঁধে দেওয়া আছে। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান তার চেয়ে বেশি দামে তা কিনতে পারবে না। এই নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ১০০ মিলিলিটার স্যানিটাইজারের জন্যে খুব বেশি হলে ৫০ টাকা অবধি দেওয়া যায়। কিন্তু হিমাচলের বিজেপি ললিত কুমারের কাছ থেকে এই স্যানিটাইজার কিনেছে ১০০ থেকে ১৩০ টাকায়। মানে প্রায় আড়াই গুণ বেশি দাম দিয়ে। স্যানিটাইজারের বোতলে দামের লেবেল পাল্টে দিয়ে সাপ্লাই দিয়েছিলেন ললিতবাবু। খোদ রাজ্য সচিবালয়ের ভেতরে এরকম দুর্নীতি হলে বাকি জায়গায় কি চলছে তা নিয়ে উদ্বেগ স্বাভাবিক। এমনটা নয় যে এই দুর্নীতির ঘটনা সামনের আসার পর কেউ গ্রেফতার হয় নি। কিন্তু এই দুটো দুর্নীতিরই বৈশিষ্ট হল, দুর্নীতিতে জড়িত উচ্চ পদস্থ আমলা ও বিজেপি নেতাদের প্রথমে আড়াল করা হলেও পরে বিরোধী দল গুলির চাপে কয়েক জন গ্রেফতার হয়।
করোনা চলাকালীন কেন্দ্র সরকার সব মিলিয়ে প্রায় আটান্ন হাজার ভেন্টিলেটর মেশিনের বরাত দেয়। পিএম কেয়ারস তহবিল থেকে টাকার ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্র সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, মোট দুহাজার তিনশ বত্রিশ কোটি টাকা এই খাতে বরাদ্দ করা হয়। মানে একটি ভেন্টেলেটারের দাম বরাদ্দ হয়েছে চার লক্ষ টাকার কিছু বেশি। জুন মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে এই ভেন্টিলেটরগুলো ডেলিভারি হবার কথা ছিল। খবরের কাগজ গুলো জানাচ্ছে,ওই টেন্ডারে আগাভা হেলথকেয়ার নামের এক বেসরকারি সংস্থা মেশিন পিছু দেড়লাখ টাকার কোটেশন দিয়েছিল। তাহলে প্রশ্ন হলো দেড় লাখ টাকার মাল চার লাখ টাকা দিয়ে কেন কিনতে গেল সরকার? অনেকগুলি কোম্পানিকে বরাত দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে একটি হল জ্যোতি সিএনসি অটোমেশন। গুজরাটের রাজকোট শহরে এই কোম্পানির অফিস। বিভিন্ন খবরের কাগজ থেকে জানা যাচ্ছে, এই সংস্থাটি মোট পাঁচ হাজার ভেন্টিলেটরের বরাত পেয়েছে। এখন থেকেই জল ঘোলা শুরু:
এই কোম্পানিটি কিভাবে এত বড় বরাত পেল তা নিয়ে নানা মহলে নানা সংশয় আছে। আরটিআই-এর জবাব অনুযায়ী
১. কোনো মেশিন ডেলিভারি না করা সত্ত্বেও এই কোম্পানিকে আগাম পয়সা পৌছান হয়। সাধারণত সরকারি ক্ষেত্রে এরকম হয় না।
২. আরো তিনটি কোম্পানির ভেন্টিলেটর মেশিন মনোনীত হয়েছিল। স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত মহা নির্দেশকের অধীনে একটি কমিটি এই অনুমোদন দিয়েছিল। ভারত সরকারের অধীনস্ত ভারত ইলেকট্রিক্যাল ছিল এই তিনটি কোম্পানির মধ্যে একটি।
৩. ওই জ্যোতি সিএনসি অটোমেশানের তৈরি ধমন-১ নামের ভেন্টিলেটর নিয়ে নানা মহল থেকে নানা আপত্তি উঠেছে। আমেদাবাদের জেনারেল হসপিটালের সুপার ভি মোদি খোদ চিঠি লিখে রাজ্য সরকারের কাছে এই ধমন-১ এর অক্ষমতার কথা তুলে ধরেন।
৪. এই জ্যোতি সিএনসি অটোমেশানের মালিক হলেন পরাক্রম সিংহ জাদেজা। ইনি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানির কাছের লোক হিসেবেই পরিচিত।
৫. ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি নরেন্দ্র মোদি সোনার জলে লেখা নিজের নামের সুট পরে খুব দুর্নাম কুড়িয়েছিলেন, মনে আছে নিশ্চয়ই। পরে বলা হয়, কোনো এক গুজরাটি শিল্পপতি নাকে ভালোবেসে তাঁকে সুটটি উপহার দিয়েছিলেন। আজ্ঞে, জ্যোতি সিএনসি-র জনৈক প্রাক্তন প্রমোটার হলেন ওই গুজরাটি ব্যবসায়ী।
সম্প্রতি খবরে প্রকাশ যে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মুর্তি দেখার যে টিকিটের ৫.৫ কোটি টাকা তার কোনও হদিশ নেই, কে নিল এই টাকা তার জন্য কোনও কাগজে কোনও বড় খবর নেই, অথচ মানুষের ধারণা বিজেপি কোনও দুর্নীতি করতেই পারে না, তাহলে যারা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত, তাঁদেরকেই সসম্মানে বিজেপি দলে স্থান দেওয়া হয় কেন, এই প্রশ্ন করার কি এটাই উপযুক্ত সময় নয়? তাহলে যারা বলেন যে বিজেপি মানে স্বচ্ছতা,বিজেপি মানে কলঙ্কহীন প্রশাসন তাঁরা কি এই দুর্নীতি বা পিএমকেয়ারসের মতো এতো বড় আইনসিদ্ধ দুর্নীতিগুলোকে মেনে নেবেন? নাকি তাঁরা তৃণমূলের চুরি নিয়ে যতটা সরব তার থেকে একটু বেশী সোচ্চার হবেন সেটা কি ভেবে দেখার সময় হয়নি? আসলে তৃনমূল যে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তা আইনের চোখে অপরাধ, আর বিজেপিরটা আইনসিদ্ধ, সেই ধারণাতে কি আমরা নিজেরাও বিশ্বাস করি ?