পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মৌজা ডোমপাটি

  • 29 August, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1733 view(s)
  • লিখেছেন : রামকুমার মুখোপাধ্যায়
ঘরে মন টেকে না বিনোদ ডোমের। মাঘের ছ-তারিখ হয়ে গেল। পৌষের তেইশ তারিখে মহাজন এসেছিল। তিনপণ কুঁড়চির মালা ঘরে গাঁথা পড়ে আছে। হাতে টাকা না এলে গাছ আনতে পারবে না। বন-কমিটির ফি জমা দিতে হবে। হাতও ফাঁকা, সংসারও ফাঁকা। বউ গেছে বড়োমেয়ের ঘর ডিহরে। শৈলেশ্বরের মেলায় তিনদিন ভিডিও-শো হবে। মেয়ে খবর পাঠিয়েছিল। ছেলে গেছে আরামবাগ। আরামবাগের যাত্রাদল তেরোখানা আসর পেয়েছে। ছেলে ফুলুট বাজাবে। নাতিদুটো গোল্লায় গেছে। বাঁশির বদলে বাঁশ ধরেছে। দিনেরবেলা এর-তার জমিতে খাটে, রাতে বনের পথ ধরে মানুষজন গেলে মাথায় লাঠি তোলে।

ক্যানেলের কালভার্টে বসে বিনোদ পিঠটাকে রোদ খাওয়াচ্ছিল। চানবেলা হয়ে গেল কিন্তু রোদে তাত নেই। জয়পুর থেকে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত চোদ্দো-পনেরো কিলোমিটারের যে রাস্তা তার পুরোটাই বনপথ। শীতের উত্তুরে হাওয়া শাল-ইউক্যালিপটাসের গায়ে কাঁপুনি ধরাতে ধরাতে বয়ে যায়। বুনো হাওয়ার গোঁ বেশি। মাঠের হাওয়ার মতন গতি নেই কিন্তু ভেতরে গুমোর আছে। গায়ে শক্ত কামড় বসায়। শরীরে চিড় ধরে, পায়ে ফাটল।

বিনোদ ভাবছিল দ্বিতীয় গেলাস চা খাবে কিনা। ভজহরি চায়ের দাম চাপিয়ে দিয়েছে। ধান কাটার পর চল্লিশ পয়সা থেকে পঞ্চাশ করেছে। বাইরের লোকদের জন্যে ষাট। বাইরের লোক বলতে শালের পালা আনতে আসা লোকজন। লরির লোকজন ও কখনো কখনো থামে। মাঝে মাঝে মোটরসাইকেল এসে দাঁড়ায়। সন্ধের দিকে থানার জিপ ঘোরাফেরা করে। বাস থামিয়ে গত বছর তিন বার ছিনতাই হয়েছে। স্টেটবাস না পেরোনো পর্যন্ত থানার লোকজন চা-চপ খায়। চা ছাড়া ভজহরির দোকানে মুড়ি-ছোলাসেদ্দও মেলে। চেনালোক হলে দু-চার বোতল ভেতো মদও জোগাড় করে দেয় ভজহরি।

বিনোদ বসে থাকতে থাকতে একটা ট্রাকটার ভজহরির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। সূর্যে আলোটাকে বাঁ-হাত দিয়ে আড়াল করে বিনোদ। রতন মিস্ত্রির মুখটাকে সে স্পষ্ট চিনে ফেলে। বিনোদকেও চিনতে অসুবিধে হয় না রতনের। বিয়ে, পইতে, মুখেভাত, যাত্রা, গাজন এমন হাজার পরবে বিনোদ বাজনা বাজিয়েছে। বাঁকুড়া-হুগলি-বর্ধমান জেলা এক সময় সে চষে বেড়িয়েছে। এখন মাইক, ভিডিও, বক্সগানের রমরমা হলেও বছর দশ-পনেরো আগেও বিনোদের নামে সবাই এক ডাকে চিনত। বিনোদকে দেখে রতন মিস্ত্রি হাঁক মারে, ‘কেমন আছো গো খুড়ো?’

‘জাড়ে গুটিয়ে দিল রে বাপ। এ শীত আর পার করতে লারবো।’

‘এসো। চা খেয়ে যাও।’

বিনোদ ওঠে। চা দোকানের বাঁশের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে।

‘খুড়ি কোথায় গো?’

‘সে আর বলিসনি বাপ। শৈলেশ্বরের মেলায় ভিডিও দেখতে মেয়ের ঘর গেছে।’

‘তালে তোমার জাড় তো লাগবেই’, হো হো করে হেসে ওঠে রতন। সে হাসিতে রতনের লোকজন যোগ দেয়। হাসির দমকে ভজহরির নীচে-মাড়ির নড়বড়ে দাঁত দুটো দোল খায়। সমবেত হাসিতে বিনোদের উপর-নীচ আটটি দাঁত ঝিলিক দেয়।

‘কোথায় যাবি রে? রতনকে বলে বিনোদ। ট্রাকটারের পেছনের ডালাতে কাঠের তক্তা দেখে বুঝতে পেরেছে মেলায় যাবে।

চায়ে চুমুক দিয়ে রতন বলে, ডাননে।’

বিনোদের কোটরে ঢোকা চোখ দুটো হঠাৎই ভেসে ওঠে। ডাননের মেলায় সেই ছোটো থেকে কতবার গেছে! মায়ের সঙ্গে যেত মেলায় মোড়া, ধুচুনি, কুলো বেচতে। পরে গেছে মেলার যাত্রাগানে ফুলুট বাজাতে। সেই যে তেরশো পঁচাত্তর সালে জামকুঁড়ি থেকে কাটানধারে চলে এল আর যায়নি। অথচ এমন কিছু দূর নয়। কাটানধার থেকে বন ধরে এগোলেই নদী। নদী থেকে এক দুপুর হেঁটে দিলেই বালসী। সেখান থেকে আর একটু গড়ালেই ডাননে। কিন্তু কাজ না থাকলে কার আর কোথায় যাওয়া হচ্ছে? তেমন তাড়া থাকলে বন পথ দিয়ে প্রকাশঘাটে আসা যায়। সেখান থেকে বাস ধরে হিংজুড়ি হয়ে ডাননে পৌঁছে যাওয়া যায়। কাজ থাকলে আর মন টানলে স্বর্গও নদীর এপার-ওপার।

বিনোদকে থ হয়ে যেতে দেখে রতন অবাক হয়। ডাননেতে খুড়োর মেয়েছেলে পোষা আছে নাকি! ফুলুটের সুর নিয়ে কারবার। কে জানে যৌবনে কার মনে কখন ফুঁ মেরে রেখেছে।

যাবে নাকি খুড়ো? রসিকতা করে বলে রতন।

‘আমি গিয়ে কী করব? তোরা তো দরজা-জানলা পিটিয়ে যাবি। আমার ভাত জুটবে কী করে?

তুমি রঙে থাকবে’ এখনো বসে আছে রতন। সে কাঠের রঙের চেয়ে মনের রং নিয়ে বেশি চিন্তিত।

চ তবে।’ উঠে পড়ে বিনোদ।

এবারে একটু চমকে ওঠে রতন। এতটা ভাবেনি। তবে ভাবার এমন কিছু নেই। মেলা করতে গেলে যত বাড়তি হাত তত লাভ। রান্নাবান্না করলেও রাতে মাল পাহারা দিলেও অনেক কাজ। রাতের বেলা এক ঝাল দরজা নিয়ে কেউ মাঠে নেমে পড়লে দুহাজার টাকায় ঘা। তার চেয়ে বিনোদ খুড়োকে খাওয়া আর হাত খরচটা ধরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।

বিনোদ ঘরের দিকে যায়। পিঠের চাদরটার ওপর একটা গামছা ফেলে বেরিয়ে আসে। বড়ো ছেলের বউয়ের নাম ধরে হাঁক মারে। তাকে মেলা যাওয়ার খবরটা দিয়ে আবার ঘর ঢোকে। ফুলুটটা বার করে আনে। যন্ত্র ছাড়া শিল্পী মানুষের থাকতে নেই। কাজ নেই তো ফুলুট বাজালে। কাজ করে ক্লান্ত হলে মনটাকে হালকা করে নিতে সুর ভাঁজলে।

বিনোদকে আসতে দেখে ড্রাইভার ট্রাকটরে স্টার্ট দেয়। রতন মিস্ত্রির লোকজন বিনোদকে এক হেঁচকায় ডালায় তুলে নেয়। বসার জায়গাও করে দেয়। ট্রাকটারের দোলায় বিনোদের মনে স্ফূর্তির দোল। ডাননে--ছাব্বিশ-সাতাশ সাল বাদ আবার ডাননের মেলায়।

বছর বছর মেলায় এলে বসার জায়গাটা পাকা হয়ে থাকে। দিঘির পশ্চিমপাড়ে কাঠের কারিগরদের বসার জায়গা। রতন মিস্ত্রির বসার জায়গা প্রথম। তারপর ভগলদিঘির করুণা মিস্ত্রির। করুণা মিস্ত্রিকে পেরিয়ে চুয়ামসনার নিরঞ্জন ছুতোরের। তার পরের জায়গা নাকাইজুড়ির আনন্দ মিস্ত্রির। আনন্দ মিস্ত্রির অবশ্য কাঠের কাজ নয়। সে আসছে গত বছর থেকে লোহার গ্রিল নিয়ে।

রতনের লোকজন মাল নামায়। বিনোদ রান্নার আর ঘর বানানোর জিনিসপত্র সাজায়। ঘর আর রান্নার জায়গা ভাল করে ঘিরতে হবে। ফাঁক পেলে দিঘির হাওয়াতে সব গোলমাল হয়ে যাবে। থাকার ঘরগুলো লম্বা-চওড়াতে সাড়ে পাঁচ হাত। খাড়াই তিন হাত। মাথায় ত্রিপল দিতে হবে। শীতে দেবতা কাঁদলে রক্ষে নেই। সামনেটা কাটা চট ঝুলিয়ে দিলেই দরজা।

প্রথম দিনে সাজ, বাকি দিনে নাচ। সাজতে সাজতে মাঝ রাত হয়ে যায়। খাওয়া-শোওয়ার ব্যবস্থা বিনোদ করেছে বলে রাত বারোটায় ভাতে বসা যায়। রতন খাওয়ার জায়গাটা চেঁছে সমান করে। নলিনী ঘরগুলো সরজমিন করে খড় বিছিয়ে দেয়। এবার পেট ঠান্ডা করে গা এলিয়ে দিলেই সকাল।

রতনরা হাত ধুয়ে এসে খেতে বসে। পচাই হ্যারিকেন তিনটে পাতের কাছাকাছি টেনে নেয়। শালপাতার ওপর বিনোদ চূড় করে ভাত ডালে। আলুভাতে আর বেগুনপোড়া দেয়। ভাতের ওপর বিউলির ডাল পড়তেই হীরেন স্লোগান দিতে শুরু করে--বিনোদদখুড়ো জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ। কারো হাতে আলুভাতে, কারো হাতে বেগুনপোড়া। সেই মুঠো করা হাত আকাশে উঠে যায়--বিনোদখুড়ো লাল সেলাম, লাল সেলাম লাল সেলাম।

বিনোদ খেয়ে উঠতে উঠতে রতনরা ঘুমে অসাড়। দু-চারটে দোকানে এখনো খুটখাট চলছে। বিনোদ হাত ধুয়ে একটা বিড়ি ধরায়। কখন ঘুম আসবে কে জানে! বয়েস বাড়ছে, ঘুম কমছে। আজকাল ভাবনাচিন্তাও হয়। ছেলেটা অর্ধেক সময় হুগলি-বর্ধমানে পড়ে আছে। দেশে-ঘরে তেমন কাজ নেই। দু-চার বিঘে জমি থাকলে ঘরে খেটে বাইরে খেটে পুষিয়ে যেত। ঘরের ছেলে ঘরে আছে এর চেয়ে আর কি সুখ আছে! বিদেশে পড়ে না থাকলে সব হত। গানবাজনার দলগুলোকে আবার জুড়তে পারত। যন্ত্র নিয়ে বসতে পারত। রেওয়াজ না থাকলে বাঁশিতে ফুঁ দেওয়া যায়, প্রাণ আনা যায় না। নাতি দুটোর ওপর কোনো ভরসা নেই বিনোদের। মানুষের মন চুরি করতে শিখল না, শিখল মাল চুরি করতে।

হয়তো সবই হত জামকুঁড়ি না ছাড়তে হলে। জামকুঁড়ির মোহন্তদের অস্থলে পাঁচ বিঘে জমি চাষ করত বিনোদ। ডোমপাটি মৌজার জমিতে ফসল মন্দ হয় না। চলে যাচ্ছিল। বিনোদ শুনেছিল এক সময় জামকুঁড়ির মল্লরাজ তার কোনো এক পূর্বপুরুষকে কাঁদির পর কাঁদি জমি দিয়েছিল। সে সব জমি হস্তান্তর হয়ে যায় পরে পরে। রাজা দামোদর সিংহের দেওয়া সে সব জমির গল্পই শুধু শুনেছিল বিনোদ। সে যখন লাঙল ধরে তখন সবই রাজপরিবারের পূজারি মোহন্তদের দখলে। দেড়শো-দুশো বিঘের মালিক তারা। ডাঙাপুকুর মিলিয়ে তখনো সেটা একটা রাজত্ব। বাংলার তিয়াত্তর সাল নাগাদ মোহন্তদের জমি নিয়ে হাঙ্গামা বাধে। মোহন্তদের দাপট ছিল। কথায় কথায় বন্দুক বেরোত। লাঙল যার জমি তার স্লোগান যখন উঠল তখনই জমি থেকে উৎখাত হয় বিনোদ। তার আগে থানা-পুলিশ হয়েছে। এক রাতে পুকুরের পাড়ে বিনোদের বুকের ওপর বন্দুকটা তুলে ধরল ছোটো মোহন্ত। বলল, রাত পেরোবার আগে না পালালে তার সংসারের কেউ সকালে সূর্যের মুখ দেখতে পাবে না।

রাতারাতি পালিয়ে গেল বিনোদ। নাতি দুটো এখনকার মতন শক্ত হলে টিকে থাকত। কিন্তু বিনোদ টিকতে পারেনি। ফুলুটের নলে যে ফুঁ দেয় বন্দুকের নলে তার ভীতি থাকবেই। কারো সঙ্গে যুক্তি করার ও সুযোগ পায় নি। কার সঙ্গেই-বা যুক্তি করবে? আন্দোলনের অনেক নেতাই তখন হয় জেলে, নয় পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাইরে বলতে হাই-ইস্কুলের অ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টার কার্তিক বাঁড়ুজ্জে। মাথায় চাদর ঢাকা দিয়ে তার ঘরে গেছল বিনোদ। বিনোদ স্পষ্ট শুনে ছিল ওপর থেকে বাঁড়ুজ্জে বউকে বলেছিল দেখা হবে না বলে দিতে। তিনখানা পুলিশ কেস যার ওপর, কে তাকে আশ্রয় দেবে?

রাতারাতি নদী পেরিয়ে বন ডিঙিয়ে কাটানধারে চলে এসেছিল। কেউ আর তার খোঁজ করেনি। না পুলিশ না গাঁয়ের লোকজন। গাঁয়ের মানুষের ওপর অভিমানে ওমুখো আর কোনোদিন হয়নি বিনোদ। ফিরে যাওয়ার মতো কোনোকিছু ফেলেও আসেনি। কার্তিক বাঁড়ুজ্জের ঘর থেকে ফেরা মুখে মোহতা তুলে নিয়ে যায় বিনোদকে। তার গোরু, ছাগল, কুঁড়েঘর বাবদ তিন হাজার টাকা। হাতে ধরিয়ে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয় মোহন্ত। আর কোনোদিন এ তল্লাটে ঘেঁষবে না এ প্রতিশ্রুতিও আদায় করে নেয়।

নিজের অতীত কিংবা বর্তমান নিয়ে বিনোদের শোক-দুঃখ নেই। ঘর-সংসারটাকে গুছিয়ে দিতে পারলেই শাস্তি। হাতে লাঙলের বোঁটা আর মুখে ফুলুট—আর কী দরকার। নিজের জীবন বলতে গোনা দিন। মৃত্যু চিন্তাটা বিদেশে টেনে নিয়ে যায় দিঘির উত্তরপাড়ে তাল আর বটের জোড়ালাগা গাছটার নীচে। এক বুক শীতল উত্তুরে হাওয়া বুকের মধ্যে পুরে বিনোদ ফুলুটে বলে ওঠে--

...মরিলে তুলিয়া রেখো তমালেরই ডালে

না পোড়ায়ো রাধার অঙ্গ না ভাসায়ো জলে...

মেলার প্রথম কটা দিন শ্বাস ফেলার সময় থাকে না। তখন কেনার লোকের চেয়ে দেখার লোক বেশি। মেলাতে জিনিসপত্র দেখে গিয়ে গাঁয়ে দরদপ্তর করবে। তারপর দুদিকের লাভ-ক্ষতির হিসেব করে কেনা না-কেনা ঠিক করবে। তবে খদ্দের হল লক্ষ্মী। কিনুক না-কিনুক জিনিসের ভাল-মন বোঝাতে হবে। ছ-দিনের দিন বিনোদ খানিক সময় পায় মেলা দেখার জন্যে। ঠিক মতন মেলা দেখতে হলে। বিকেল থেকে রাত হয়ে যাবে। মেলা ঢোকার মুখে আট আনা দিয়ে ওজন। ওজন ছেড়ে পাঁপড়। পাপড় পেরোতেই মাটির জিনিস। ঘোড়া, হাতি, গোরু সব। পাঁচমুড়ো থেকে এসেছে। তারপর খেলনার দোকান। সাধারণ পুতুলের সঙ্গে পিস্তল, এ কে-৪৭, চলমান ট্রেন। সব অটোমেটিক। পরের ঘর ফাঁকা। এল আই সি-র এজেন্টের ফেস্টুন। সামনে বসার টেবিল আর চায়ের আমন্ত্রণ। তারপর 'ছবি'—সিংহীমুনির অভিশাপে রাজা পরীক্ষিৎ-এর ব্রহ্মতালুতে সর্পদংশন, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, পতি নির্যাতন, বধূহত্যা, এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। কিছু ছেড়ে, শিব কর্তৃক দুর্গার স্তন্য পান— “সমুদ্র মন্থনে তুমি যখন বিষপান করেছিলে, দুর্গাকে ‘জননী’ ‘জননী’ বলে ডেকেছিলে।” শিল্পী স্বপন সুত্রধরের এমন অনেক ‘ছবি’--সবই মাটির। মাঝের খোপে সত্যিকারের রঙিন কিছু ছবি—সলমন খান, মিঠুন, ফারহা, রামকৃষ্ণ, মাধুরী, রাজীব গান্ধি, জুহি চাওলা, জ্যোতি বসু, নেতাজি, বাঘ। ছাপা ছবির গায়ে মিষ্টির দোকান। তারপর গোটা তিরিশেক হাতা-খুন্তির দোকান, কাপড়ের দোকান, খান তিরিশেক মিষ্টির দোকান, নাগরদোলা, বেলুন, বই, ক্যাসেট--কী নেই? মেলার মাঝে সর্বক্ষণ কীর্তন হচ্ছে। খানিক দোকানদানি দেখে, এককান কীর্তন। শুনে, নদীয়ার দিগম্বরী অপেরার পুতুলনাচের তাঁবুর কাছে আসে বিনোদ। ‘সোনাইদিঘি’ হবে একটু পরে। বিড়িটা ধরিয়ে ভেতরে ঢোকে। দু-টান দিয়ে হঠাৎ হাঁ হয়ে যায়। সামনের সাদা-মাথা বুড়ো মানুষটাকে বড়ো চেনা লাগছে। ভাবতে ভাবতে মাথায় পুরোনো মুখটা ভেসে ওঠে--ভবদা। বালসীর ভবদা।

কাছে গিয়ে ঝাপটে ধরে বিনোদ। বুড়ো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। চোখের চশমাটা ঠিক মতন বসিয়ে মুখটা দেখার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে না। ‘কে তুই?’ শেষে জিজ্ঞেসই করে বসে।

‘আমি বিনোদ।’

‘কোন বিনোদ?’

‘জামকুঁড়ির।’

বুড়ো হতবাক হয়ে যায়। কেউ বলেছিল মানুষটা দেশান্তর হয়েছে, কেউ বলেছিল পার্টি করতে গিয়ে মরে গেছে। ‘ও তুই।' বিনোদের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে হঠাৎ সজোরে একটা চিমটি কেটে বসে বুড়ো।

‘আ’ করে ওঠে বিনোদ।

‘তালে সত্যিই বেঁচে আছিস’, ভবদা বলে।

দুজনের বন্ধুত্ব বহুকালের। বড়ো ভালো মাটির কাজ করত ভবদা। একসময় একটা পুতুলনাচের দল খুলেছিল। প্রথম পালায় বিনোদই সুর করে দিয়েছিল। সামনে থেকে যাত্রা গান শুনবে বলে ভবদা একটা আড়বাঁশি নিয়ে আসরে ঢুকত। অথচ বাঁশিতে কোনোদিনই ফুঁ দেয়নি ভবদা।

পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে ভবদার বড়ো আনন্দ। এক হাত লাঠিতে ভর দিয়ে অন্য হাত বিনোদের কাঁধে রেখে এগোতে থাকে। তেলেভাজার দোকানের কাছে এসে চারটে চপ কেনে। চানাচুর কেনে দুটাকার। তারপর মেলার বাইরে এসে এক হাঁড়ি ভেতো মদ জোগাড় করে। বিনোদকে ফুলুটটা আনতে বলে দিঘির উত্তরে হাঁড়িটা নিয়ে নেমে যায়।

ঝুপড়ি থেকে ফুলুটটা নিয়ে বেরিয়ে আসে বিনোদ। ভবদা দিঘির কোনদিকে নামল দেখতে চোখ দুটো তোলে। দূরের মানুষমেলা দেখে ঘরে ফিরছে। তাদের ভেতর থেকে ভবদাকে আলাদা করা একটু কঠিন। চোখের জ্যোতি কমে এসেছে। ডুবন্ত সূর্যের চোখেও ছানি। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো জাম, পাকুড়, পলাশগাছগুলোর ডালে-পাতায় অন্ধকারের ছোপ। অন্ধকারের এই রকমফের থেকে আলকাতরা-কালো ভেতো মদের হাঁড়িটিকে চিনে ফেলে বিনোদ। উত্তর দিকের পলাশ গাছের নীচে ভবদার কোল জুড়ে সেটা বসে আছে। ননী চোরার মতন দৈবিক হাসি ভবদার মুখে।

দিঘির পশ্চিম পাড়ে দাঁড়িয়ে ফুলুটে সুর ভরে নেয় বিনোদ। দিঘিতে জল নেই তাই দিঘির মাঝ বরাবর সুরটাকে বয়ে নিয়ে যায়। সুরটা ডাইনে আর বাঁয়ে--বালসী আর পাত্ৰসায়ের বরাবর--আধাআধি ভাগ হয়ে যায়। ফুলুটটি বিনোদের জন্যে দু-সুরের ভেতর দিয়ে পথ বানাতে বানাতে চলে--

তুই লো ধনী রাজার ঝিয়ারি

লাজের মাথা খেয়ে হলি রাখাল পিয়ারি

কালো শশীবাজায় বাঁশি মনের দুকূলে

পোড়ামুখী তুই তো গোকুলে।

যমুনায় দুকুল ছাপানো জল ছিল, কদমের ডালে গাছ-উজাড় পাতা ছিল। নীল বহমান স্রোতে কৃষ্ণের বাঁশির সুর অনুভূম প্রবাহিত হয়ে যেত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, একনগর থেকে আর একনগরে। ডাননের চাটান বুকে জলের ফোঁটাটি নেই। গাছগাছালির ডালেও পাতার সমারোহ নেই। বিনোদকে তাই ফুলুটের সুরটাকে বাতাস বরাবর পাঠাতে হয়। বাতাসে মিলিয়ে দিতে মাথার অনেক খানি ওপর দিয়ে বইয়ে দিতে হয়। তাতে শ্বাসে বাড়তি বাতাস লাগে। ওলনের সুরফুস ফুসটাতে হাপরের মতন দ্রুত সঙ্কোচন-প্রসারণ ঘটায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাপরের চামড়া আলগা হয়ে আসে। শ্বাসে টান পড়ে। যে ফুসফুস এক সময় ক্ল্যারিওনেট, ব্যাগপাইপ আর সানাইয়ের শূন্য বুকে সুর ভরে দিত, তাতে এখন বায়ু-বাড়ন্ত। কিন্তু বুকে সুর থাকলে কে তাকে আটকায়! বাতাসে ছড়ানো হাজার সুরকে সে দু-হাত দিয়ে টেনে আনে।

ভবদা দোলে। খানিক সুরের মাদকতায়, খানিক মদে! মদের হাঁড়ির গায়ে আঙুলের টোকায় তাল দেয়। সাদা গোঁফ আর দাড়িতে লেগে থাকা মদের ফোঁটাগুলোকে মাঘের ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে বাঁ চেটো দিয়ে মোছে দেয় ভবদা। তারপর হাঁড়িটা বিনোদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘শেষে নকশাল হয়ে গেলিরে, বিনু!’

বিনোদ একটু হেসে হাঁড়িটা মুখের ওপর তোলে। হাঁড়ির ওজন দেখে বোঝে ভবদা এর ভেতরে অনেকখানি সাবাড় করে দিয়েছে।

‘তা ভালই করেছিস। কিষ্ট বাঁশি বাজিয়েছে, যুদ্দেও গেছে’, ভবদা বলে। বিনোদ কথার খেইটা ধরতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই হদিশ করতে পারে না। ভবদা বলে চলে, ‘তুই চলে যাবার পরে কত পেটাপিটি হল। অস্থলে তখন মোহন্তদের কি দাপট! পোথম পোথম হাতাহাতি, পরে লাঠালাঠি। শেষে বন্দুকও বার হল।’

বিনোদ ইতিহাসে প্রবেশ করে। স্মৃতির শেকড়ে টান।

ভবদা বলে চলে—‘থানা-পুলিশ-কোট। সারা পাত্রসায়ের থানা জুড়ে আগুন। তবে জামকুঁড়িকে সামলানো মুশকিল। মোহন্তরা তখন মরণ কামড় দিচ্ছে। রাজার পুরুত রাজা হলে যা হয়!’

মুখে হাঁড়ির শেষ ফোটাটি ঢেলে নেয় বিনোদ। তারপর শীতের হাওয়াটাকে পলাশ গাছের গুঁড়িতে খানিক আড়াল করে কান দুটো চাদরে ঢাকে। দূরে মেলা তলায় জেনারেটরের আলো জ্বলে উঠেছে। কারো-বা গ্যাসলাইট। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে ভবদা বলে, বর্ধমানে বড়ো মোহন্ত খুন হতে জামকুঁড়ি ঠান্ডা হয়ে গেল। রাতারাতি তিন-চারশ বিঘের মালিকানা ছেড়ে মোহন্তরা চলে গেল। কোথা গেল কে জানে! কেউ বলে বর্ধমান, কেউ বলে কলকাতা। কেউ আবার বলে নিজেদের দেশ উত্তরপ্রদেশে।’

বিনোদ অবাক হয়ে জন্মভূমির বৃত্তান্ত শোনে। তার হতবাক হতে তখনো বাকি। ভবদা বলে চলে, ‘তুই বর্ধমানে গিয়ে নকশাল হয়ে গেলি। তুই চাষিদের কথা বলতে গেলি বড়ো মোহন্তকে আর সে কিনা বন্দুক ঘুরিয়ে ধরল তোর দিকে। হ্যাঁরে কেমন করে মারলি বড়ো মোহন্তকে।’ ভবদার চোখে অবাক বিস্ময়। 'তোর বন্দুক কি দো-নলা?’

বিনোদের চোখে নেশার ঘোর। সে ফুলুটটাকে কাল্পনিক বন্দুক বানাতে চায়। কিন্তু ফুলুটের সুরকে কেমন করে গুলির আওয়াজে রূপান্তর ঘটাবে বুঝতে পারে না। নিরুপায় বিনোদ কোলে ফুলুট রেখে কাল্পনিক ব্যাগ পাইপটা তুলে নেয়। ব্যাগপাইপে এক সঙ্গে তিন৬তিনখানা গুলি বের হলেও কোনোটাই মোহন্তের গায়েলা গেনা।সবগুলোই ঘরের টুঙিতে গিয়ে ঘা মারে। কাল্পনিক সানাইটাকে তুলে নেয় বিনদো! কিন্তু সানাই কোন কর্মে লাগবে! সানাই হচ্ছে রিভলবার অথচ মোহন্ত মারা যাবে দোনলা বন্দুকেরগুলিতে। নিরুপায় বিনোদ ঘোর অন্ধকারের বুক চিরে হাঁড়িটাকে ছুঁড়ে দেয়। খানিক দূরের একটা গাছের গুঁড়িতে লেগে ‘ফটাস’ শব্দে হাঁড়িটা ফেটে যায়। আনন্দে লাফিয়ে ওঠে ভবদা, ‘মাথাটা ফুটে গেচে-- ফটাস্। ফট-ফট-ফটাস।ফট-ফট-ফটাস্।’

গুলিটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পাঠাতে পেরে বিনোদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। কোমরে চাদর বেঁধে অন্ধকার প্রান্তরে কয়েক পাক নেচে নেয়। বিয়েবাড়ির নাচিয়েদের বহুকাল নাচ শিখিয়েছে বিনোদ। এখনও সবেরতে মন চল নেই কিন্তু বিনোদের পায়ে ছন্দটা ধরা আছে। সেই ছন্দ পাথেকে কোমর, কোমর থেকে হাত অবদি ছড়িয়ে নেয়। বিনোদ নেচে ওঠে গানের তালে তালে--

ধীরে ধীরে বোল মেরে পায়লকে ঘুংরি।

চম্‌চম্‌ কা রাজ কৈ জানে না...

বন্ধুত্ব অন্তরের জিনিস। দুই বন্ধুর এতকাল পরে দেখা, আনন্দের জোয়ার আসে। কিন্তু ভবদার শরীরে আর সেজোর নেই। বাতের রসে শরীরটা টইটম্বুর। বিনোদকে থামাতে ভবদা লাঠি ঠোকে—‘থাম্ মাস্টার থাম। রসে অত পাক দিস্‌নি। গেঁজে উঠবেরে বিনে, থাম।’

বিনোদকে থামতেই হত। বেনা চাউরির ঝোপ থেকে রক্ষা পেতে গিয়ে সে কোঙাগাছের ওপর গিয়ে পড়েছে। ভবদার ক্ষমতা নেই বিনোদকে তুলে আনে। ইচ্ছেও নেই কারণ তুললেই আবার নাচবে। তার চেয়ে বিনোদ যেখানে আছে থাক। সামনে বসে বরং একটু গল্প জমানো ভাল।

ভবদা বলে, ‘মানুষের বড়ো উপকার করলি রে বিনে। মোহন্তরা চলে গেল। যার হাল তার জমি হয়ে গেল। রাজরাজেশ্বরীর পুজোর জন্যে বিঘেয় এক মাপ ধান মেপে দিলেই হল।’

‘আমার জমিগুলো কে পেল?’

বালসী থেকে ডোমপাটি বেশখানিক দূর। টুকরো জমির মালিকানার ইতিহাস ভবদার জানার কথা নয়। কিন্তু যার বন্দুকের গুলিতে বর্ধমানের মোহন্ত মরে, জামকুঁড়ির মোহন্তরা রাজত্ব ছেড়ে পালায়, তার জমি হস্তান্তর হওয়া উচিত নয়। তার উচিত্য বোধ থেকে ভবদা বলে, ‘সে জমি পড়ে আছে, চলে যা, তোকে দিয়ে দিবে।’

‘কে দিবে?’

‘নেতাদের কাছে চলে যা।’

‘কে নেতা?'

‘হারান, বংশী, নারান।’

‘ঘর কোতা?’

‘বাড়াবনে হারান, মজুরডাঙে নারান, তেলিসাহেরে বংশী।’

‘আমাকে চিনবে?’

‘চিনবেনি মানে!’

‘কী বলব?’

‘বলবি বিষ্ট্রপুরের রাজা রঘুনাথ সিংহের সহোদর ভাই দামোদর সিংহ। দামোদর সিং জামকুঁড়ির রাজা। তা দামোদর সিং তোর বাপের বাপ, তার বাপ, তার বাপ...

‘তার বাপের বাপ...’

'এতগুলো বাপ লিয়ে কী করবি?’

‘ঠিক আছে, বাদ দিয়ে দাও।’

‘তা বাপের বাপের বাপের বাপকে ডেকে বলল কাল ভোরে সানাই- এ পোঁ ধরবি। তোর সামনে থাকবে একটা হাতি। এক পোঁয়ে হাতি যতখানা যাবে, রাস্তার দুধারের ততখানি জমি তোর। তুই, তোর ছেলে, তার ছেলে, তার ছেলের ছেলে...’

‘ছেলের ছেলের ছেলে...’

‘ভোগ করবে। তা গোটা রাজ্যির লোক ভেঙে পড়েছে। আগের রাতে তোর বাপের বাপের বাপের বাপের বাপ গোটা রাত জমির বুকে সানাই বাজিয়েছিল। জমির সঙ্গে সহবাস না করলে জমি কি আপন হয়! পাঁচ গাঁয়ের লোক শুনেছিল আগের রাতের সেই মাঠভরা সুর।কী গান বাজিয়েছিল বল দিকি?’

বিনোদ বেউড় বাঁশের গা ধরে উঠে দাঁড়ায়। ফুলুটটা খুঁজতে চেষ্টা করে।সুর তো বুকে, মুখে কেমন করে উত্তর দেয়? উত্তরের অপেক্ষানা করে ভবদা গেয়ে ওঠে--‘মন রে কৃষি কাজ জান না।’ সুরটা হালকা করে ভাসিয়ে দিয়ে ভবদা বলে, ‘দিন-রাতফুলুট-সানাই করলে কৃষিকর্ম জানবে কেমন করে! ডাঙা জমিকে গব্ববতী করবে, সেকি এমনি এমনি হবে! এলেম দরকার। তা পরদিন এমন ভোঁ ধরল, হাতি বিঘে বিঘে জমি পেরিয়ে গেল। সানাই-এর বুকের বাতাসও শেষ হয়ে আসে। ওদিকে বাজনদারের কপালের শিরাগুলো বন-কোয়ের মতন ফুলে উঠেছে।

শরীরটা ফ্যাকাশে মেরে গেছে। সব রক্ত মুখে। লোকজনরা হাততালি মারছিল। দেখতে দেখতে সবাই বোবা হয়ে গেল। মানুষটার যখন সব শ্বাস শেষ হয়ে গেল, লোকে শ্বাস ফেলল। মানুষটা বেশিদিন বাঁচেনি রে। তবে মউজাটা ডোমপাটি নাম পেল। ডোমেরা সে জমি কতকাল ভোগ করেছে। আমার বাপের বাপের বাপও দেখেছে। তা তুই বলবি আমি তাঁর লাতির লাতির লাতির লাতির লাতি।’

‘ছেলের ছেলের ছেলের...’

‘তাই বলবি। বলবি আমি ভাগচাষ লরেছি। পরে নকশাল হয়ে গেচলুম। আবার চাষ করব। ’

‘জমি দিবে?’

‘আলবৎ দিবে।’

‘কবে দিবে?’

‘আজি দিবে?’

‘চল তবে।’

তেড়েফুঁড়ে ওঠে বিনোদ। দেশলাইয়ের আলোতে ফুলুটটি উদ্ধার করে। দুজনে আবার একহাঁড়ি মাল জোগাড় করে বসে। সেটা শেষ করে একটা ট্রাকটারের ডালাতে চেপে বালসীর মোড়ে আসে। নেমে বিনোদকে বুঝিয়ে দেয় জামকুঁড়ি যাওয়ার বাসে কোথা থেকে উঠতে হবে। তারপর ট্রাকটারে চেপে ভবদা বালসী গাঁয়ের ভেতর চলে যায়। বিনোদ গাড়ির জন্যে বসে থাকে।

বিনোদ আসার বেশ খানিক আগে বিষ্ণুপুরের দিকে শেষ বাসটা চলে গেছে। সে বাস এখন তালসাগড়ার কাছাকাছি। কিন্তু বিনোদ ভাবতেই পারেনা তাকে রেখে বাস চলে যেতে পারে। কাজেই ঘণ্টাখানেক সে মনে মনে ডোমপাটির জমিগুলোতে ধান রোয়। সেই ধানের জমি ওলটায়। রাসায়ানিক সার দেয়। পাউনি দেয়। ধান কাটে। ধান ঝাড়ে। ধান বেচে। আলু রোয়। আলু ওপড়ায়। আলু বেচে। পেঁয়াজ রোয়। পেঁয়াজ বেচে। হাতে অনেক টাকা হয়।একদিন জুত করে ঝালঝাল খাসির-মাংস রাঁধে। রগরগে মাংস আর মন-পিয়ারি ভেতো নিয়ে শালগাছের নীচে বসে।

বিনোদের মনগড়া মদ আর মাংস দুটোই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বাস আর আসে না। খানতিনেক লরি ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে। বাসস্ট্যান্ডে এতক্ষণে একটিও লোক জোটেনি দেখে বিনোদের আন্দাজ হয় বাস আজ আর আসবে না।

কিন্তু বাস না এলেও এমন কিছু এসে যায় না। বালসী থেকে জামকুঁড়ি এমন কোনো মথুরা-বৃন্দাবন নয়। আকাশটা অন্ধকার তার পথটা মাতাল-এটাই ঝামেলার তবে এ-গাঁ থেকে ও-গাঁ যাওয়ার মানুষ পথে জুটে যেতে পারে। তখন আলোও মিলবে, কথা বলার মানুষও জুটবে। আর আকাশে চাঁদ না থাকলেও তারা আছে। চাঁদও উঠবে এক সময়। তখন রণপায়ে চলে যাবে কুপোর খাল পেরিয়ে জামকুঁড়ি।

বেরিয়ে পড়ে বিনোদ। টালমাটাল পথ ধরে হাঁটে। হাঁটার কোনো অসুবিধে নেই শুধু কালো গোলমাল করে। কতো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। একবার পাশ দিতে গিয়ে রাস্তায় গা থেকে মাঝখানে চলে গেলো বিনোদ।খুব খিস্তি করল পাঞ্জাবি ড্রাইভার। তবু ভাল, পাঞ্জাবি খিস্তি গায়ে লাগে না। বাংলা হলে হাতাহাতি হয়ে যেত।

কুকুর প্রভুভক্ত প্রাণী এক চিলতে গাঁয়ের একটা কুকুর হঠাৎই বিনোদের মধ্যে তার প্রভুকে খুঁজে পায়। অবাক হয় বিনোদ। অন্ধকারে পথ চলতে কুকুরের ভয় অথচ তিনবার শুঁকে কুকুরটা তার সঙ্গ ধরল। বিনোদ ভাবল এ নিশ্চয় শুঁড়িখানার কুকুর। তার গায়ে মদের গন্ধ পেয়ে পিছু নিয়েছে। বিনোদের মনে পড়ে সাধন ময়রার কুকুরটাকে। গুড়ের জিলেপির গন্ধ পেলে তেলের কড়ার কাছে নাক উঁচু করে থাকত। সঙ্গে কুকুর থাকা ভালো। যুধিষ্ঠিরের মা, ভাই, বউ কেউ স্বর্গে যেতে পারল না। শেষ সঙ্গী ওই কুকুর। কুকুর হচ্ছে ধর্মরাজ। মানুষকে পথ দেখিয়ে স্বর্গে নিয়ে যায়।

মাইল-দেড়েক হাঁটার পর বিনোদের দ্বিতীয় হাঁড়ির নেশা এতক্ষণে ডানা মেলে৷ পথটা ক্রমশ হালকা হয়ে আসে। ওদিকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার দু-পাশের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তখন শুধুই অন্ধকার। শীতের ঠান্ডা বাতাস সুর ভাঁজতে ভাঁজতে উত্তর থেকে দক্ষিনে বয়ে যায়। সেই সুরের আবেশে বিনোদ ফুলুটটা মুখে তুলে নেয়। কিন্তু ফুলুটে গান আসে না। তার চেয়ে পায়ে দুলুনি আসে বেশি। চোখের মণিতে ততক্ষণে কুকুরটা হাতি হয়ে গেছে। বিষ্টুপুরের মল্লরাজা রঘুনাথ সিংহের সহোদর ভাই রাজা দামোদর সিংহের হাতি। হাতির কানে সোনার মাকড়ি, নাকে সোনার নথ, গা চিকন কালো। হাতি চলে, পথ ছাড়। রাজা দামোদর সিংহের হাতি। ফুলুটে ‘সা’-তে পোঁ ধরে বিনোদ। হাতি চলে সামনে, পেছনে ‘সা’ ধরে থাকে বিনোদ। রাস্তার দুপাশের কেয়াগাছ, ইউক্যালিপটাস, জাম, শিমুল, নিম, তাল, বেল—সব তখন মানুষ। কারো মুখে টুঁ শব্দটি নেই। শুধু বাতাসের দোলায় মাথার চুল ওড়ে, খসে পড়ে দু-চারখানা।

কুকুরটা বাঁ-দিকের মাঠে নেমে গাঁয়ের পথ ধরে। খাবার মিলবে এ আশায় মানুষটার সঙ্গ নিয়েছিল। এতটা পথ পেরিয়ে এল, তিনটে মাঠ পেরল, দুটো বনপুকুর পেরোল তবু খাবারের খোঁজ নেই। মাঝরাত হতে চলল। পেটের খাবার দিতে পারে না ওদিকে পেছনে ফুলুট মারে। কুকুরটা এতক্ষণ লেজ নাড়তে নাড়তে এসেছে। সে এখন টানটান লেজে অন্য প্রভুর সন্ধানে চলে যায়। কিছু না হোক ভাগাড়ে গেলেও কিছু মিলবে।

বিনোদের ‘পোঁ’ থেমে যায়। রাস্তার ধারে একটা স্টোন চিপসের স্তূপের ওপর বসে বিনোদ। একটা বিড়ি ধরায়। আকাশের তারার দিকে তাকায়। মনে মনে প্রহরের হিসেব করে। মাঝ রাত হয়ে গেছে। খানিক গেলেই ডোমপাটি। আর কয়েকপা হেঁটে দিলেই জামকুঁড়ি। ততক্ষণে চাঁদ উঠেবে। রাত তরল হয়ে যাবে।

বিনোদ ডোমপাটি মৌজায় পৌঁছায়। পা-দুটো আর উঠতে চায় না। বসে পড়ে বিনোদ। আকাশের বুকে তখন কাটা চাঁদ উঁকি মারে। বুকের ভেতর জলের টান। চাঁদের কাক-জ্যোৎস্নায় বিনোদের মাঠপুকুরটা চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। খানিক মাঠ ভেঙে পুকুরের পাড়ে পৌঁছে যায় বিনোদ। তালগাছের মাথায় বাবুই পাখিগুলো প্রহর পেরোনোর ডাক দেয়। সেই ডাক এক গাছ থেকে অন্য গাছে বাহিত হয়। সে ডাকের প্রত্যুত্তর দেয় দূরের কোনো এক পেঁচা, গাছের আড়াল থেকে। ইঁদুর ঘুমের ভেতর অবচেতনে শব্দ করে আবার চুপ করে যায়। নেউলগুলো সামান্য মুখ তুলে আগের মতন স্থির।

জল শিউলির পাতা সরিয়ে এক আঁজলা জল খায় বিনোদ। ঠান্ডা জলে টলটলে দাঁতের গোড়া শিরশির করে ওঠে। কিন্তু বুকের ভেতরটা কাঠ। আর এক আঁজলা জল খায় বিনোদ। বগলে ফুলুটটাকে চেপে ধরে। হাত দুটো মুছে নেয় চাদরে। উঠে আসে পুকুরের পাড়ে। পলাশ গাছটার নীচে বসে। আকাশের দিকে তাকায়। সারা আকাশ জুড়ে তারার বুটি। তারা ছড়ানো সারা মাঠ জুড়ে। কাটা ধানের গোড়ার জলবিন্দুগুলো জ্বলজ্বল করে। আকাশে তারা, মাটিতে তারা। অন্ধকার বলতে আকাশ আর পৃথিবীর মেলের জায়গাটুকুতে। দূর দিগন্তে গাছের মাথায় নেমে এসেছে আকাশ। গাছের শেকড় জড়িয়ে আছে পৃথিবী। পায়ে মাটি আর মাথায় আকাশ নিয়ে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে ঋজু।

বসন্তের হাওয়া চপল, শীতের হাওয়া নিথর। শীতে গৃহস্থ সুখে ঘুমোয়। শীতের ফসলে চোরদেরও হতশ্রী সংসারে রূপ ফিরেছে। ঘর সংসারের গায়ে বেশ একটা শ্ৰী। শেয়ালগুলো এক প্রহর আগে চুপ করে গেছে। তেমন ঠান্ডা লাগলে প্রহর শেষে হয় তো আর একবার ডাক দেবে শরীরকে সামান্য উষ্ণ করে নিতে। শুধু ঝিঁঝির একটা কোমল স্বর জেগে আছে বাতাসে। নিথর রাতের ওপর যেন একটা হালকা চাদরের আবরণ। রাতের নিজস্ব স্বরের ওপর ঝিঁঝির সুরের ভাসমান স্তর।

বিনোদ ফুলুটে ফুঁ দেয়--

সা, নিধনিসা, মগ, মধনিসা।

সা, নিধ, মগ, মগরেসা।

সানিধ, সা, ম ধ নি ধ, ম গ রে সা।

বিনোদের চারপাশ জুড়ে এক নিবিড় স্বরবিন্যাস। ফুলুটের বাগেশ্রী বাতাসে মেশে। কালবৈশাখীর শিলাখণ্ড যেমন ধীরে ধীরে দ্রবীভূত হয় খাল-বিল-পুকুরের জলে, বাগেশ্রী মিশে যেতে থাকে মাঘ নিশীথের নিজস্ব স্বরে। স্বরের ঘনত্ব বাড়ে। বায়ু সঞ্চালনের নিজস্ব নিয়মে ভারী বাতাস ধীরে ধীরে প্রবাহিত হতে থাকে শূন্যতার সন্ধানে। সুরেলা বাতাস জমা হতে থাকে তালের ভাসমান শেকড়ের ছিদ্রে, কাঠঠোকরার গহ্বরে, পাকুড়ের কোটরে, ইউক্যালিপটাসের খোলসের ফাঁকে ফাঁকে, বাবুইয়ের বাসায়। ফুলুটের মৃদুমন্দ সুর প্রবাহিত হতে থাকে। পুকুরের জলে বন শিউলির পাতা দোলে। কাটা ধানের মাঠে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বাঁশিতে সুর বাজে। সুর ছড়ায়, সুর প্রবাহিত হয়। ইঁদুরের গর্ত পূর্ণ হয়। শেয়ালের গর্তের আবহে পরিবর্তন ঘটে। প্রকৃতির বুকে হাজার শূন্যতা। সেই শূন্যতা বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে পূর্ণতা পায় প্রকৃতির শ্বাসের আরোহে এবং অবরোহে। প্রকৃতি বিনোদের ফুলুটে স্বর ভরে দেয়। প্রকৃতি বিনোদের ফুলুটে সুর তোলে। সেই সুর প্রকৃতিতে ফিরে আসে রাগের নানান বৈচিত্র্যে। সেই সুর প্রবাহিত হয় দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের শরীরের ওপর দিয়ে। বিনোদ শীতের বাতাস। বিনোদের ফুলুট ডোমপাটির জোত-জমি, গাছপালা, পুকুর-ডোবা। বিনোদের ফুলুটের ভেতর কয়েকশো একরের প্রকৃতি।

প্রহর বদলায়। রাত তরল হয়ে আসে। নিজের সুখদুঃখ গোধূলির হালকা আঁধারের মতো মনের মধ্যে জেগে ওঠে। বিনোদ ক্রমশ প্রকৃতি থেকে সরে যেতে থাকে। বিচ্ছিন্ন হতে থাকে প্রকৃতির সুর থেকে। অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে বিনোদের নিজস্ব স্বরের।

নিঝুম রাতে কে বাঁশি বাজায়।

সুরে বেদনা বাজে গো কোন্‌হিয়া

সুখ স্মৃতি মাঝে সুর মায়া

কত দুখ আসে যেন আলোক ছায়া

নিশীথ রাতে জাগে তারারই সাথে

বিনোদের স্বর প্রকৃতির সুরকে ছাপিয়ে যায়। রাতও ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসে। ওদিকে বিনোদের শরীরে নেশার টান আলগা হয়ে এসেছে। বিনোদ বোঝে জামকুঁড়ি যাওয়া অর্থহীন। ছাব্বিশ-সাতাশ সাল পরে কে চিনবে তাকে? চিনেই-বা কীহবে!

বালসীর পথ ধরে বিনোদ। ডাননে পৌঁছতে পৌঁছতে রোদ উঠে যাবে।

0 Comments

Post Comment