পাতান আলি হাসে সে কথা শুনে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে, ' বইয়ের জন্যি আমি টাকা কোথা পাবো? '
'তোমাকে ভাবতে হবে না। সে আমি বুঝব।'....
বলে কথাটা শীষ মহঃ।
সে সব কতদিনের কথা। পাতান আলি বাঁশের মাচানে বসে ভাবছিল সে কথা। মনটা কেন যে কোথাও লাগছে না। সাঁকোয়া গ্রামে ওর মন আর বসছে না। সে পালাতে চাইছে। মনের পাখি বড়ই ছটফট করছে। রঘুনাথ পুর, আমতলা। এ সব যেন ওর কাছে একটি নাম শুধুই। এর মধ্যে পাতান নেই। সংসার বলতে তার চারটি সন্তান। তাদের বউ। আগের মতো তারা কেউ এখন খোঁজ নেয় না। নিরক্ষর চারণ কবির যেদিন বউ বিনা চিকিৎসাতে মারা গেল সেদিন থেকেই পাতান আলি ঘরে থাকে না। বন- জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়ায়। মনে মনে ছড়া কাটে। হাঁ করে জলঙ্গী নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মতোই একা জলঙ্গী নদী। কখনও সখনও চলে যায় জগাইপুর।সেখানে আছে সাড়ে সাতশো বছরের পুরনো বৌদ্ধ মঠ। জয়দেবের আমলের। এখানে এক সময় বৌদ্ধের বাস ছিল। এখন ভাঙা কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়।
এ এলাকাতে চারণ কবি পাতান আলিকে এক ডাকে সবাই চেনে। কত মানুষ সাঁঝের বেলা ডেকে তার ছড়া শোনে। তার বদলে দু'- এক পেয়ালা চা মেলে। বিড়িও। এখন ওর এ সব আর ভালো লাগে না। কেউ ডাকলে সাড়া দেয় না। নিজ মনে শুধু কথা বলে---
"দেখরে ভবের মাঝে
মানুষ কজন মেলে?"
আজ তার মন সত্যিই খারাপ। বাঁশের মাচানের ওপর পাতান আলি শুয়ে পড়ল। কেমন কুয়াশা মিশানো সন্ধে নেমে আসছে। এ দিকটায় তেমন কেউ আসে নাকো। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। পাতান আলি মাঝে মাঝে এখানে রাত কাটায়। আজ তার এখানেই থাকতে মন করছে।
"বাপ,শুয়ে পড়লি? মাঠে যাবি না? তোর হাতের ছোঁয়া চায় মাটি। ফসল। ওঠ বাপ। "
.......ওর ঘুম টুটে যায়। এ কার গলা শুনলো? এ যে আহসান আলি মামুজানের গলা। যে মানুষটি কবিতা লিখত। আর পাতান আলিকে শোনাত। এই সৈয়দ আহসান আলি অনাথ পাতানকে জায়গা দিয়েছিল। তখন রঘুনাথপুর ছিল গাছগাছালিতে ঘেরা।আমবাগান, বেতবন,আখের খেত, জলঙ্গী নদী সব মিলিয়ে যেন একটা ছবি। কবি সৈয়দ আহসান আলির মনে ধরা পড়ে এই ছবিগুলো কবিতা রূপে। তার একমাত্র শ্রোতা এই নিরক্ষর পাতান আলি। পায়ের কাছে বসে সন্ধের সময় শুনতো আহসান আলির কবিতা। যেন গুরুর মনের তরঙ্গ ঢেউ তোলে শিষ্যের অন্তরে। তাই তারও মনে দানা বাঁধতে থাকে ছড়া। মাঠে চাষ দিতে দিতে সে গুন গুন করে আহসান আলি সাহেবের সুর দেওয়া গান গাইত। তার দু'- চারখানি গীতিকাব্য প্রকাশ হয়--- 'গজলে রোওশো্ন','এ জীবন গীতিময়','অবকাশ জীবনে', 'প্রভাত জীবন'। আরও অনেক লেখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে গেল। যেন পাতান আলি তার কথা মনে রেখেছে শুধু । ওর ঘুম টুটতেই চারপাশ খুঁজতে থাকে তার মনের মানুষটিকে।
'মামু, তুমি কুথা গো! আমার দুনিয়া খালি হয়ে গেল মামু!'
মাচানে বসে পাতান আলি কাঁদতে থাকে। রঘুনাথ পুরে গভীর রাত নেমে আসে। দূরে কোথায় একটা রাতচোরা পাখি ডেকে উঠল। আজ তার কিছুই খাওয়া হয়নি। ভুখ তার পেটে নয়। ভুখ তার মনে। আজ তার সঙ্গে দুটো মনের কথা বলবার যে লোক নেই। তার ছড়া এখন বনের পাখ-পাখালি শোনে। মাঠের আলে আলে একা একা ঘুরে বেড়ায়। বাতাসে ছড়িয়ে দেয় ছড়া। ভেসে যায় দূর দেশে। পাতান উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে নদীর ওপারে। তার আহসান মামুকে খোঁজে। ওর বউ মারা যাওয়াতে সে আরও বেশি একলা হয়ে গেছে।
রাত বাড়তে থাকে। একা বসে থাকে মাচানে পাতান আলি। অনেক দিন পর আবার গুন গুন করতে থাকে তার মনের মানুষ আহসান আলির গান। যে গানে পাগল হয়েছে তার মন। তার মনের জ্বালা কেউ বোঝেনি। দূরে কোথায় একটা রাতচোরা পাখি ডেকে উঠল। মাচানে একা বসে থাকে পাতান আলি। রাতের জোনাকিরা পাতান আলির সঙ্গে জেগে থাকে।
দুই.
ভাতগুলোর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল পাতান আলি। কত দিন হল সে দুপুরে খায় না। শীষ মহঃ আজ তার পাতান ভাইকে ধরে আনে মাচান থেকে। পাতান আলি মাচানে একা বসে ছিল।পাতান আলিকে ডেকে এনে নূরজাহানকে বলে খেতে দিতে। নূরজাহান হল সৈয়দ আহসান আলি সাহেবের বউমা। ছেলে শীষ মহঃ।পাতান আলিকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে নূর জাহান বলে, 'ভাই, ভাত খান। বসে আছেন কেন? কত দিন আমার হাতে খান না। আর সকালেও আর আসেন না এ দিকে? কি হয়েছে আপনার?'
পাতান আলির দু'চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মুখে কোনো কথা বলতে পারে না। এ বাড়ির সাথে তার আত্মিক যোগ। এখানেই সে বড় হয়েছে। কত স্মৃতি। কত ভালো লাগা সময়। সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ওর আর মন বসে না। কখনও সখনও আহসান আলির লেখা গান মনে পড়ে পাতানের। তখন মানুষটির জন্য ওর মন পুড়ে যায়। তার মনের কথা মাঠ, বন, বনের গাছকে শোনায়। বুনে চলে মনের জালে ছড়া। কে শুনবে তার ছড়া? পাতান নিজের বুকে পুষে রাখে সব কথা। কেউ তাকে বোঝে না।
'ভাত মুখে দেন ভাই।' নূরজাহান বলে কথাটা।
পাতান ভাত নাড়ে চাড়ে। বসে থাকে। ওর বেটার বউরা কেউ এমন আদর যত্ন করে খেতে দেয় না। নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার ওর চোখের কোণ ভিজে ওঠে। দূরে কোথায় একটা দোয়েল ডাকছে। ওর মনে আবার ছড়া এসে ভিড় করছে। ও এক সময় ভাত খায়। তবে ওর যতটা খিদে পেয়েছে কিন্তু ততটা খেতে পারল না। ওর পেটের খিদে কবেই মরে গেছে না খেয়ে খেয়ে। মানুষটা শুকিয়ে গেছে কাটা গাছের মতো। মনের ভেতর শুধু আজকাল কি যেন একটা ডেকেই চলেছে। তাই তো ও বেশি চুপচাপ থাকে। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আর কাউকে ছড়া শোনায় না। মাঠে-ঘাটে একা একা ঘুরে বেড়ায়। ও যেন কাউকে খুঁজে ফিরে। তার দেখা পেলেই যেন ও শান্ত হবে।
'ভাই, ভাত কটা খেয়ে নিলে না? সবই যে পাতে পড়ে থাকল।' নূরজাহান জানতে চায়।
'খেলিম তো। আর খেতি পারছি না। এবার আমাকে যেতি হবে। '
'কোথায় যাবা ভাই, এখানে একটু বসো। কতদিন তোমার ছড়া শুনি না।'
'সে ছড়া কবেই হারিয়ে গেছি। আহসান মামু যেদিন দুনিয়া ছাড়ি গেছি সেদিন থেকি ছড়াও হারিয়ে গেছি। ও সব আর মনে আসি না।'
পাতান আলি কথাটা বলতে বলতে কেমন অন্য মনস্ক হয়ে যায়।
দোয়েলটা ডেকেই চলেছে দুপুর কে খান খান করে। একমুঠো বেলা ফুরিয়ে এলো। পাতান আর বসে থাকে না। রঘুনাথপুরের আমবাগান দিয়ে হাঁটতে থাকে। নূরজাহান বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাতান আলির চলে যাওয়া দেখতে থাকে। দোয়েল ডাকছে। বেলা শেষ হয়ে আসছে একটু একটু করে।
তিন.
কবির কোনো ঘর থাকে না। তেমনি পাতান আলিরও কোনো ঘর ছিল না। যদিও বা ঘর ছিল, সে ঘরে সে বাস করতে পারেনি কখনও। জীবনের পথ একদিন শেষ হয়। মনের কথা একদিন বুকেই চাপা থাকে। তা কখনও আর কথা হয়ে বাহির হয় না। তেমনি পাতান আলিরও তাই হয়েছে। সে আর কথা বলতে পারে না। তার ছড়ার পান্ডুলিপি তার বুকের ভেতরেই থেকে গেল। একদিন মানুষের মুখে মুখে হয়তো তা ফিরবে।কিন্তু মানুষটা বড় একাই থেকে গেল। ওর ছেলেরা একদিন মাচান থেকে তুলে আনে তাদের ঘরে। খাবার এগিয়ে দিয়ে বলে, 'বাবজী, খেয়ি নাও।'
পাতান আলি চুপ করে বসে থাকে। তার আর ভুখ নেই। চোখেও আর তেমন দেখতে পায় না। কেমন এক পাগলের মতো হয়ে গেছে। তার আর কোনো বোধ নেই। বারান্দায় চুপ করে বসে আছে। দুপুর গড়িয়ে যায়। পাতানের সামনে ভাতের থালা পড়ে থাকে। যে ভাতের জন্য সে ছড়া কাটতো। ছেলেদের মুখে অন্ন তুলে দিত। সেই পাতান একমুঠো ভাতের জন্য কোথায় না গেছে।
'বাবজী, খেয়ি নাও।'
পাতান কিছু বলে না। বেলা শেষ হয়ে আসে। পাতান হঠাৎ ঢলে পড়ে বারান্দায়। সবাই ছুটে আসে। পাতানের কোনো সাড়া নেই। এক চিলতে সুখ শুধু ঝুলে থাকে পাতানের দুঠোঁটে