পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ছায়াপথ

  • 24 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 924 view(s)
  • লিখেছেন : অঞ্জনা রেজ ভট্টাচার্য
স্বামী কেন আসামী । অসাধারণ পালা । সুযোগ জীবনে একবারই আসে । এখনও যারা টিক্যাট কাটেন নাই তাড়াতাড়ি আসেন ।আগামী চৌঠা মাঘ । রাত্রি দশ ঘটিকায় । কলীবাড়ির মাঠে । শীঘ্র শীঘ্র আসেন । মঞ্জুরী অপেরার নবতম যাত্রাপালা । কলকাতার সাড়া জাগানো যাত্রা । সারারাত্রি ব্যাপী…..।

আর একটা কথা সবাই শোনেন , আমাদের তরুন সঙ্ঘের রজত জয়ন্তী । তাই সেরা যাত্রাপালার সঙ্গে জলযোগেরও আয়োজন আছে । টিক্যাট কাটলেই কুপন দেওয়া হইবে । অনুষ্ঠান শ্যাষ হইলে মিষ্টির প্যাকেট …..। আসন সংখ্যা সীমিত । শিঘ্র শিঘ্র আসেন …… । লাল নীল রংবেরং পোস্টারে মোড়া রিকশোটি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে ।


ফুলডুংরি ছোট গ্রাম । এক্কেবারে দেশের সীমান্তে । এখানকার বেশীর ভাগ লোকই বাংলাদেশী । চাষবাস করে দিন আনে দিন খায় । অভাব অভিযোগ এদের নিত্য সঙ্গী । তবুও এদের প্রাণ আছে । আছে সারল্য মাখা হাসি । আর মনের অনাবিল আনন্দ । দেখতে দেখতে পথের দু'পাশে ভিড় জমে । একসময় গ্রামের ছেলে বুড়ো সবার হাতে হাতে হয় টিকিটের হত বদল ।
দশ বারো বছরের শিবু । রোগা লিকলিকে । বুকের পাঁজর ক'খানা গোনা যায়। ছুটতে ছুটতে ঘরের দিকে আসে । একটু ছুটেই হাঁপাতে থাকে । ঊঠোনে দাদুকে দেখতে পায় । চ্যালা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বেড়া বাঁধছে । হাঁপাতে হাঁপাতে বলে - দাদু ও দাদু শুনতাছ আমাগো এইখানে যাত্রা আইসে । তুমি টিক্যাট কাইটবা না ? দাদু . কোঁচর থেকে একটা বিড়ি বার করে বলে - যা তরে শিবু , একটুখানি আখার থিক্যা গরম আঙ্গার আইনা দে । দ্যখ ত রে লাকড়ি জ্বলত্যাসে কিনা ? বিড়িটা ধরামু ।
- হ দিমু অনে । কিন্তু অগে কও টিক্যাট কাইটবা না ?
- কাটুম কি দিয়া ? ট্যাকা কই ? খাওন জোটে না , আবার যাত্রা !
- দাদু আমি কিস্যু শুনুম না , যাত্রা কিন্তু দ্যাখমুই দ্যাখুম ।
- আইছ্যা আইছ্যা হইব খন । তরে এক ফাঁক দিয়া ঢুকাইয়া দিমু অনে । এখানে আমার অনেক পুরান ছাত্র রইসে , অসুবিধা হইব না । খুব ছোটবেলা অনেকে আমার কাছে লেখাপড়া করতে আইতো ।
অগত্যা মহাদেবকে শিবুর সঙ্গে যেতে হয় । এলুমিনিয়ামের টোলপরা বাটিতে কিছু খাবার ফেলেই শিবু আনন্দে আত্মহারা হয়ে হাঁটা দেয় ।
- দেরি হইয়া গেলে বহনের জায়গা পামু না ।
- আরে দাদুভাই অনেক দেরি আছে ।আমি কি তর মত লাফাইয়া লাফাইয়া যাইতে পারি ?



শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে । পথে বেরিয়ে মালুম হয় মহাদেবের । কালো ছেঁড়া শালে মাথা থেকে হাঁটু অব্দি মোড়া । নিচে খাটো ধুতি । পা দুটো ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপছে । ধুলো মাখা পা টেনে টেনে চলছে মহাদেব । আর খালি পায়ে লাফাতে লাফাতে আগে আগে চলেছে শিবু । গায়ে পুরোনো ধূসর রং-এ আলোয়ান । পেছন ছেঁড়া হাফ প্যান্টের নিচে সরু সরু পা দুটো যেন হাড় কাঁপানো শীতকে অনায়াসে ব্যাঙ্গ করে চলেছে ।


দূরত্ব অনেকটাই । কিছুটা গিয়ে থমকে দাঁড়ায় শিবু । দাদু অনেক পিছিয়ে । বয়সের ভারে চোখেও কম দেখে । শিবু হাঁক পাড়ে - কী হইলো দাদু , অত পিছাইয়া পরলা ক্যান ?
টেনে টেনে মহাদেব বলে - দাদুভাইরে , পথ যে শ্যাষ হয় না । বাতের ব্যাথায় আর হাঁটতে পারি না ।
- একটু খাড়াও দাদু । আমি ধইরা আনতেছি ।
- না দাদুভাই , একটুখানি বইয়া লই । ঠান্ডায় আমার পাও তো জড়াইয়া যাইতেছে । আর না জিরাইয়া হাঁটতে পারুম না ।
শিবুর হয়েছে জ্বালা । শিবুর আর তর সয় না । দাদুকে ফেলে একাও যেতে পারেনা । গ্রামের অনেকের সঙ্গেই একে একে দেখা হয় । সবাই সাহায্য করতে চায় । কেউ কেউ বলে - ওঠেন খুড়া ধইরা লইয়া যাইতেছি ।
- না না ধরনের কোনও প্রয়োজন নাই । আমি একাই পারুম'খন । কিছুক্ষণ জিরাইয়া লই। তোমরা আগাও দেখি ।
এ'ভাবেই কিছুক্ষণ বসে , কিছুক্ষণ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে বেতো রোগী মহাদেব একসময় কালীবাড়ি মাঠে পৌঁছয় , তখন যাত্রা প্রায় শুরুর মুখে । সবাই যে যার আসনে বসে পড়েছে । গেটের কাছে ভিড়টা খুব বেশি নয় , ছাড়া ছাড়া । পাতলা ত্রিপলের ভিতরটা বাইরে থেকে ছায়া ছায়া দেখা যায় । শিবুর চোখ তখন যাত্রার গেটে । আনন্দে নেচে ওঠে শিবুর কচি কলাপাতার মত নরম মনটা। মনের সব দুঃখ কষ্টকে সেই মুহূতে ঝেড়ে ফেলে খুশিতে ডগমগ হয়ে গেট দিয়ে ঢুকতে যায় । বাধা পায় গেটে দাঁড়ানো স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে ।





কাকুতি মিনতি করেও মহাদেব আর শিবু যাত্রার আসরে বিনা টিকিটে ঢোকার অনুমতি পায় না । তা ছাড়া মহাদেবের ভাবনাটাও ভুল ছিল । পুরোনো ছাত্ররা তো ওখানে ছিলই না বরং মহাদেবের চেনার তুলনায় অচেনাই অনেক বেশি ছিল । কারণ একটাই । এ বছর রজত জয়ন্তী । তাই দু'চারটে গ্রাম নয় , আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের লোকেরা এখানে অংশ গ্রহণ করেছিল । ফলে যতদূর সম্ভব নিয়মের কড়াকড়ি ।

মাঠের এক কোণে ঠাঁই হয় মহাদেব আর শিবুর । সামনে ত্রিপল ঘের। যাত্রার আসর । পাতলা ত্রিপলের মধ্য দিয়ে ছায়া ছায়া যাত্রা অনুষ্ঠান দেখা যায় । শিবু সেদিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে । মহাদেব শিবুকে কাছে টানে । মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে - দুঃখ করস ক্যান দাদু ? আগে যদি জানতাম , এতটা কড়াকড়ি হইব , তাইলে তর লিগা কোন না কোনও ব্যবস্থা করতাম । তবে এক কাম কর । যদি আমার কথা শোনস যাত্রা দেখা তর হইব ।

শিবু তাড়াতাড়ি উৎসাহিত হয়ে ওঠে । চোখের জল মুছে দাদুর দিকে তাকায় । দাদু বলে - হ শোন , তুই ঘুইরা বয় । এই যে আমার মত কইরা ।
শিবু তাড়াতাড়ি মহাদেবের মতো মাঠের দিকে পিঠ দিয়ে যাত্রার দিকে মুখ করে বসে । দাদু বলে - তুই চাইয়া থাক যাত্রার দিকে আমি তরে কী হইতাছে না হইতাছে কইতে থাকুম । আমি তো আগে অনেক দ্যাখছি , সব মোটামুটি একরকম । দ্যাখবি তর যাত্রা দ্যাখা হইয়া যাইব ।
- তুমি বাদ দিবা না তো ?
- হ , বাদ দিমু ক্যান ? তর যেমন কথা ।
- তুমি কী কইরা বুঝবা ?
- ক্যান বুঝুম না । ওই তো ভিতরের আলোয় ছায়া ছায়া সব দ্যাখা যাইতেছে । তুই চুপ কইরা বইয়া থাক । আমাগো যাত্রা দ্যাখা কেডা বন্ধ করতে পারে দেখুম খন ।
- শ্যাষ অব্দি কইবা তো ?
- হ হ কমু কমু । যাত্রা যখন শ্যাষ হইব আমাগো দ্যাখাও শ্যাষ হইব । নে নে চুপ কইরা তাকাইয়া থাক । ওই তো বাজনা শুরু হইল , বাজনা থামলেই একটা যুবতী মাইয়া নাচতে নাচতে আইব । দ্যাখ দ্যাখ তাকা ।চক্ষু সরাইস না ।
- হ দাদু , তুমি সত্য কথা কইছ । ওই তো একটা বড় মাইয়্যা নাচতে নামছে ।
- হ শিবু আমার কথা সত্য হইবই । যা যা ওইখানে হইব সব তরে কমু ।




এরপর যাত্রা শুরু হয় । সামাজিক পালা । দাদু ছায়া দেখে দেখে তাতে মনের রং মিলিয়ে একের পর এক ঘটনার ব্যাখ্যা করে । রুদ্ধশ্বাসে গিলতে থাকে শিবু । অপলক ভাবে দাদুর মুখের দিকে একবার আর একবার যাত্রার দিকে তাকাতই কখন যেন রাত ভোর হয় । যাত্রার নায়িকার হাঁটু মুড়ে কান্না থেকে শুরু করে নায়কের কাঠগড়ায় জবানবন্দী পয্যন্ত সব সব উঠে আসে দাদুর গল্পে ।
একসময় যাত্রা হয় শেষ । শেষ হয় শিবুর দেখা কাল্পনিক যাত্রাও । খুশি হয় শিবু ।দাদুকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে । তৃপ্ত মনে চারধারে তাকায় ।সন্ধে বেলার আধপেটা খাবার হজম করে শিবুর পেটে তখন খিদের আগুন জ্বলে ওঠে ।
একে একে সবাই হুড়মুড় করে গেট দিয়ে বেরোচ্ছে । হাসি মুখে , মিষ্টি হাতে । কেউ কেউ প্যাকেট খুলে মিষ্টি খেতে খেতে , আবার কেউ কেউ হাতে দোলাতে দোলাতে বেরোচ্ছে ।
সেদিকে তাকিয়ে শিবু দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলে - দাদু খুব ক্ষুধা পাইছে ।
বড় একটা দীঘশ্বাস বেরোয় মহাদেের বুক থেকে । টেনে টেনে বলে - শিবু যাত্রার তো ছাওয়া আছে । সেই ছাওয়া দ্যাইখা যাত্রা কওয়া যায় । এমন কী মনও ভরানো যায় । কিন্তু ক্ষুধার তো কোনও ছাওয়া নাই দাদুভাই যা দিয়া পেট ভরানো যায়।

0 Comments

Post Comment