পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

উত্তরহীন প্রশ্ন মুণ্ডহীন ধরের মত, গণতন্ত্রে চলে তা?

  • 23 May, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 471 view(s)
  • লিখেছেন : শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
যে কোনও সমস্যার মোকাবিলা গণরাজনীতি দিয়ে করতে হবে। কারণ অস্ত্র শুধু অস্ত্র আর হত্যাকে ডেকে আনে। যে দোষে আমি অন্যকে দায়ী করব, তা আমি নিজে করতে পারি না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যেটুকু আছে তাকে শক্তিশালী করতে হবে লড়ে, পথের লড়াই থেকে আইনী লড়াই নানাকিছু দিয়ে। বাড়াতে হবে তাকে। আবার শাসকদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে হবে। তারা মানবাধিকারকে যতই সঙ্কুচিত করার চেষ্টা করুক না কেন, একই পদ্ধতিতে তাদের সঙ্গেও লড়তে হবে।

ধরা যাক কেউ একজন খুন করেছে বলে অভিযোগ। আইনের কাজ কী সেক্ষেত্রে? প্রথম কাজটা হল তাকে ধরা, তারপরে বা তার আগে থেকে চলা তদন্তে প্রমাণ সংগ্রহ করে দেখানো যে খুনটা সে-ই করেছে। নাহলে যাকে ইচ্ছে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে বলা চলে। এবং এই যে খুন করেছে প্রমাণ করার বিষয়টা সেটা হয় আদালতে। সেখানেও নানা ধাপ আছে। নিম্ন থেকে ধাপে ধাপে যেতে যেতে সুপ্রিম কোর্ট অবধিও যাওয়া যায় একটি মামলা নিয়ে। বিচার চেয়ে। এমন কেন?

কারণ যেভাবে বিশ্বে তথাকথিত আধুনিককালে সংবিধানগুলো রচিত হয়েছে তাতে চেষ্টা করা হয়েছে যথাসম্ভব যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত যাতে হওয়া যায়, তার। হ্যাঁ, আইনের নানা ইন্টারপ্রিটেশন হয়। বিচারক থেকে উকিল সবার উপরে নির্ভর করে কী প্রমাণিত হবে, কেমন করে প্রমাণিত হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো। মানুষের জীবন এবং সমাজ শুধু গাণতিক নয়, তার অযুত সম্ভাবনা। অতএব আপনি এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের সঙ্গেও সহমত না হতে পারেন, কিন্তু তারপরে আর কিছু করতে পারবেন না।

এইটা সীমাবদ্ধতা বুর্জোয়া বা বুর্জোয়া ধাঁচের গণতন্ত্রের। বুর্জোয়া বা আধা বুর্জোয়া আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাতে সকলের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কিন্তু খানিক অধিকার পাওয়া গিয়েছে। ঠাট্টার মত শোনালেও, বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, আইনের চোখে সবাই সমান, এটা একটা পাওনা। সেই পাওনাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করে না-গেলে সংবিধান থেকে বিচারে উদ্ভূত ন্যায়, সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্বল হলে, সামান্য এই অধিকারটুকুও থাকে না। রাষ্ট্রশাসকেরা তখন চূড়ান্ত স্বৈরাচারীর আচরণ করতে দ্বিধা করে না।

এই প্রেক্ষিতে যে কোনো অতি-আইনী হত্যা, এনকাউন্টারের নামে, বিচার্য। মাওবাদীরা মানে না আমাদের সংবিধান। তারা অস্ত্র ব্যবহার করে, খুনও করে। তাদের রাজনীতি সশস্ত্র রাজনীতি। সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করাই মুখ্য উদ্দেশ্য, তার জন্য তারা ভোট নয় অস্ত্রের উপরে নির্ভর করে। তাদের সমালোচনা ভোটব্যবস্থা ঠিক নেই (আসলে মানুষকে বাঁধা দলগুলোর মধ্যে থেকেই কাউকে নির্বাচন করতে হয় সে তারা যতই দুর্নীতিগ্রস্ত ইত্যাদি হোক না কেন) এবং রাষ্ট্র সশস্ত্র সংগঠন। সে-ও অস্ত্রের সাহায্যেই আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করে (পুলিশ ইত্যাদি) এবং রাষ্ট্রসীমাও রক্ষা করে ( সৈন্যাদি দিয়ে)। অতএব তার সঙ্গে লড়াই একমাত্র এই পথেই হওয়া সম্ভব।

আপনি একমত এর সঙ্গে? আমি নই। না, বাস্তবতাকে অস্বীকার করছি না। ভোটব্যবস্থায় খুঁত ছিলো, এখন তো নির্বাচন কমিশনারও রাষ্ট্রশাসক বেছে নিচ্ছে। আরো খারাপ হচ্ছে। রাষ্ট্র সশস্ত্র। এমনকী সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলোও অস্ত্রের ব্যবহার করে। কাজেই সব কিছু দারুণ চলছে, এমনটা আমি ভাবি না।

তারপরেও মনে করি, সমস্যাগুলোর মোকাবিলা গণরাজনীতি দিয়ে করতে হবে। কারণ অস্ত্র শুধু অস্ত্র আর হত্যাকে ডেকে আনে। যে দোষে আমি অন্যকে দায়ী করব, তা আমি নিজে করতে পারি না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যেটুকু আছে তাকে শক্তিশালী করতে হবে লড়ে, পথের লড়াই থেকে আইনী লড়াই নানাকিছু দিয়ে। বাড়াতে হবে তাকে। আবার শাসকদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে হবে। তারা মানবাধিকারকে যতই সঙ্কুচিত করার চেষ্টা করুক না কেন, একই পদ্ধতিতে তাদের সঙ্গেও লড়তে হবে। এমন নানা ভাবনা আমার আছে। অনেকের আছে। তাই তাঁরা অস্ত্রের ব্যবহারে একমত নন।

কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র চলে কীসে? সংবিধান মেনে নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সংবিধান মেনে। অর্থাৎ খুন থেকে নানা ক্ষেত্রে সংবিধান যে তদন্ত, বিচার ইত্যাদিকে মান্য করেছে, তাকে মেনে চলার কথা রাষ্ট্রের। তথাকথিত অরাজনৈতিক খুনেরও তদন্ত হলে, বিচার হলে, একদিকে যেমন শাস্তির মাধ্যমে অপরাধীকে সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া যায় (যা মানবিক অধিকারের উনিশ বা বিশ শতকীয় লড়াই-এর গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা) অন্যদিকে কেন এমন অপরাধ সংগঠিত হয় তার কারণ ইত্যাদিও জানা যায়।

জানলে কী হয়? জানলে অবস্থা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ শাসন নিতে পারে। সমাজ এবং রাষ্ট্রের যাতে ভালো হয় তাই এইসকল তথ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রদীপের নীচে থাকা অন্ধকারকে দূর করতে।

একই কথা মাওবাদীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারা সংবিধান মানে না বলে রাষ্ট্রশাসকেরও দায় নেই মানার, এইটা যুক্তি হলে আমরা প্রথমেই সংবিধানকে অসম্মান করছি। কারণ ভারতের নাগরিকদের একাংশ তারা। নাগরিকধের অধিকারের মধ্যে আছে বিচার পাওয়া। যত অপরাধই করুক না কেনো একজনকে বিনা বিচারে, তথ্য-প্রমাণ পেশ না করে রাষ্ট্রশাসক গুলি করে দিতে পারে না। এই অধিকার সংবিধান তাকে দেয়নি।

আরো কথা আছে। আজ যদি একবার সংবিধান না-মেনে অতি-আইনী খুনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, কাল সেই অধিকার যে আমারই বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হবে না তার কি মানে আছে? আমি সংবিধান বিরোধী না-হলেও শাসক বলতেই পারে যে আমার ভাবনা তার বিরুদ্ধে বলে আমি দেশবিরোধী, অতএব হত্যাযোগ্য। কিম্বা কোনো কৈফিয়ৎও সে দেবে না। কারণ আমি বা আমরা আগে মেনে নিয়েছি যা খুশী সে করতে পারে। স্বৈরাচারের চূড়ান্ত দিকে সে এগোবে না এভাবে তার কি ঠিক আছে?

মাওবাদীরা একপাক্ষিক সিজফায়ার ঘোষণা করেছিল। অস্ত্র নামিয়েছিল। কাজেই এনকাউন্টার হচ্ছিল না। এই অবস্থায় সাংবিধানিক কাজ হচ্ছে তাদের গ্রেপ্তার করা, তথ্য-প্রমাণ-তদন্ত সহযোগে বিচার করা। তাতে যা তারা করেছে তার যা শাস্তি হয় এবং সংশোধনেরও যদি অবস্থা থাকে, সেগুলো করা যেতো। কিন্তু তা করা হোলো না। কেন?

সম্ভাবনা হচ্ছে যে বিচার ইত্যাদি চলতে থাকলে মূলনিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমি-পাহাড়-খনিজের দেশজ সম্পদ ইত্যাদি বিষয় কথা চলে আসবে সেখানে। সচরাচর বেশীরভাগ মানুষই যা জানে না, তা জেনে যেতে পারে। জেনে যেতে পারে যে মূলনিবাসীদের যেভাবে হোক উচ্ছেদ করে শাসনের একাংশ চায় সব কিছু মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজির মালিকের হাতে তুলে দিতে। মাওবাদী দমনের নামে এই কাজটাই শাসক করছে, এই কথাগুলোও আলোচিত হতে পারে। তখন তাদের বাধ্য হতে হবে অন্যথাকে প্রমাণ করতে, যা করা খুব কঠিন।

সম্ভাবনা হচ্ছে যে বিচারে আমাদের দেশ প্রাকৃতিক এবং নানা অন্য সম্পদে, এতো লুটের পরেও এতো সম্পদশালী যেখানে সেখানে কেন বেশীরভাগ মানুষ দরিদ্র থাকবে, তার কথাও উঠে আসতে পারে। কারা মানুষের দারিদ্রের জন্য দায়ী তা নিয়েও কথা হবে। আঙুল উঠবে বিশেষ অংশের দিকে।

এমন অনেক সম্ভাবনা আছে। তাই কি সে সবকে পাথর চাপা দিতে এই অতি-আইনী হত্যাকাণ্ড? প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে! এবং আজকের সময়, আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্যই জরুরী, জরুরী আমাদের বেঁচে থাকার জন্য। উত্তরহীন প্রশ্ন মুণ্ডহীন ধরের মত, গণতন্ত্রে তা চলতে পারে না।

         

0 Comments

Post Comment