প্রধানশিক্ষক বাবা নাকি ডাক্তার ঠাকুরদার প্রভাব সেটা তা তারা দুজনের কেউই সেভাবে ভাবেনি বোধহয়।মেয়ে অর্চিতা ডাক্তারি পড়তে শুরু করার কয়েকবছর পর ছেলে তমোঘ্নও সেই ডাক্তারির দিকেই ঝুঁকলো। দুজনেই ডাক্তার হয়ে বেরোল যখন, সব প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজন ধরেই নিল, এরা এবার পাড়ায় একটা নার্সিংহোম খুলবে নিশ্চয়। সে সময়টায় ধীরে ধীরে মফঃস্বলে নার্সিংহোমের বাড় বাড়ন্ত হচ্ছে।
দুজনেই ডাক্তার হলেও দুজনের কেরিয়ারের গ্রাফটা হলো একেবারেই ভিন্নমুখী।
অর্চিতা কয়েকবছরের বড় হবার সুবাদে ভাই তমোঘ্নর কয়েকবছর আগে ডাক্তার হল।স্পেসালাইজেসজন করার সময়ই পাঁচ বছরের সিনিয়র সূর্যর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল।
ছেলে রায়ানের জন্মের বছর তিনেক পর, অর্চিতা তেড়েফুঁড়ে লাগলো আবার; মাইন্ডফুলনেসের সাইকিয়াট্রিস্ট্রের ইন্টারভিউটাও উতরে গেল। বেশ মোটা মাইনেতে জয়েন করল সেখানে। সূর্য ততদিনে আই সার্জেন হিসেবে বেশ খানিকটা পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। বেশ কিছুদিন হায়দ্রাবাদের এল ভি প্রসাদে চাকরি করার পর তিন বন্ধু মিলে কলকাতায় একটা ছোট চোখের হাসপাতাল খুলল। ওরা তিন বন্ধু তখনই বুঝে গেছিল, কলকাতা থেকে যে পরিমান রুগী চোখ দেখাতে দক্ষিণ ভারতের দু তিনটে হাসপাতালে দৌড়ায় তার একটা অংশও যদি ওদের কাছে আসে, তাহলেই ওরা সামলে নিতে পারবে। ডাক্তার হিসেবে কনফিডেন্স আর চিকিৎসার ক্ষমতা দুটোর কোনোটাই সূর্যর বা তার বন্ধুদের কম ছিল না। ঢাকুরিয়ার হাসপাতালটা তরতর করে উন্নতি করল। বছর দশেকের ভিতরেই উত্তর আর দক্ষিণ কলকাতায় আরো দুটো ব্রাঞ্চ হয়েছে ওদের চোখের হাসপাতালের।
তমোঘ্ন অর্চিতার থেকেও অনেক বেশি বাবা ন্যাওটা চিরকাল। ঠিক সেভাবেই প্রধান শিক্ষক বাবার শিক্ষাগুলোকে নিজেরডাক্তারির গাউনের গায়ে জড়িয়ে নিল। অনেকবার অর্চিতার মনে হয়েছে এসব খানিকটা যেন ইচ্ছা করেই তাকে টেক্কা দেবার জন্য। মুখে না বললেও অর্চিতা জানতো ভাই তার থেকে পড়াশোনায় অনেক বেশি ভালো। যখন বুঝতে পারলো দেখনদারি কিছু নয়, সে ছেলে সত্যিই নিজের কেরিয়ারটা বরবাদ করে দিচ্ছে, তখন অনেকবার ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। সে জানতো, যে ধরণের ভালো রেজাল্ট তমোঘ্নর, তাতে সে অনেক ওপরে যেতে পারবে।
লাভ কিছুই হল না।
ধীরে ধীরে তমোঘ্নর চেম্বারে ভিড় উপচে পড়ে। তাতে কি হবে, ফিস তো নেয় পঞ্চাশ টাকা, তাও নাকি অনেকেই দিতে পারে না। খবর সবই এসে পৌঁছায় তার কানে। হাত নিশপিশ করে। মনে হয় ঠাঁটিয়ে দিই একটা।
বাবা মাকেও বলল, ওকে বোঝাও। এত আবেগ নিয়ে কিছুই হয় না। কিন্তু লাভ হলনা। বদলালো না কিছুই। মা যদি বা বলতো, তমো শোন, দিদি কী বলছে। বাবা বলতো, ও বোধহয় আমার বাবার মতো ডাক্তার হবে। তাঁর নামে এখনো লোকে মাথায় হাত ঠেকায়। ঘোড়ায় চড়ে কত দূর দূর যে তিনি রোগী দেখতে যেতেন, রাত বিরেতেও ডাক আসলে। বাড়িতেও কি কম রোগী আসত!
বাবার তখনই কী বিশ্বাস ছেলের ওপর।
অর্চিতা জানে ঠাকুরদার কথা। ছোট থেকে বাবা আর ঠাকুমার মুখে শুনেছে অজস্রবার, এক রাত্তিরে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছিলেন, আর ফেরেননি। পথের মাঝে মুখে ফেনা তুলে ঘোড়াটা পড়ে ছিল। ঘোড়ার মালিক সম্ভবত ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েই মারা গেছিলেন।
অর্চিতার কেরিয়ার গড়ার পরামর্শগুলোতে তমো কিচ্ছু বলতো না, শুধু ফিকফিক হাসতো আর বাবা যখন তাকেই সমর্থন করতো, তখন আড়াল থেকে কলা দেখাতো দিদিকে। বলতো, আর করবি আমার নামে নালিশ?
এপর্যন্ত সব যাহোক ঠিকই চলছিল; সমস্যাটা তৈরী হলো অর্চিতা নতুন চাকরিটা জয়েন করার পর। তমোঘ্ন বারণ করেছিল ওখানে চাকরিটা নিতে কিন্তু এর বেশি কিছু বলেনি।
ঝাঁ চকচকে চাকরি আর মাইনের আকর্ষণ অর্চিতা ছাড়তে পারেনি। বুঝেই উঠতে পারেনি চাকরিটা ছাড়বে কেন? তার আগে কিছুদিন একটা ক্লিনিকে বসে দেখেছে, রোগী প্রায় আসেই না নতুন ডাক্তারের কাছে। সবাই চায় অভিজ্ঞ ডাক্তার; বিশেষত মনের রোগে। অভিজ্ঞ হতে হতে যে কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে।
এর পর থেকেই, ঝগড়া নয়, কথা কাটাকাটি নয় কিন্তু ভাইবোন দুজনে দুজনের কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরে গেল। খানিকটা তিক্ততা এসে জমা হলো সম্পর্কের ঘোলা জলে। তবে দিদির প্রতি টান না থাকলেও ভাগ্নে রায়ানের প্রতি টানেই বোধহয় সম্পর্কটা খানিকটা হলেও টিঁকে থাকলো। মা’ও বেশিদিন থাকতে পারতো না নাতিকে না দেখে।
ছেলে রায়ান ম্যাড্রাস আই আই টিতে এখন ধীরে ধীরে নিজের ডানা মেলছে। বাবা মা দুজনেই ছবি হয়ে দেওয়াল থেকে হাসে। মনে পড়লে এখনো অর্চিতা শিউরে ওঠে, সেদিন তমোঘ্ন রক্ষা না করলে, রায়ানের কী হতো! তাদের দুজনেরই বা কী হতো!
দিদি অর্চিতা অথবা তার বর সূর্যর সঙ্গে তমোঘ্নর সম্পর্কটা ফর্মাল হয়েই থেকে গেল কিন্তু রায়ানের সঙ্গে ব্যাপারটা একেবারে অন্যরকম। রায়ানও ছোট থেকেই মামা বলতে অজ্ঞান।
হঠাৎ একদিন সন্ধেবেলা তমোঘ্ন এলো ঝড়ের মতো, রায়ান তখন টিউশনে।
এলে রায়ানের কাছেই আসে তার মামা; তাই অর্চিতা বলল, রায়ান টিউশনে গেছে।
সে বললো, জানি। তাই এসময় এলাম। দু একটা কথা আছে, জরুরী।
অর্চিতা আরো অবাক হয়। বহুদিন ধরে ভাইবোনে কথাবার্তা প্রায় বন্ধই বলা যায়। মায়ের মাধ্যমেই যেটুকু যা কথা হয় দুজনের। কি বলতে এসেছে তমোঘ্ন, সে বুঝতে পারে না।
ছেলের খবর কিছু রাখিস? ভাই তমোঘ্নর প্রশ্নটাতে চোখ কুঁচকে তাকিয়েছিল সে।
চোখ না কুঁচকে বরং খবর নিয়ে দেখ। জানতে পারবি যে ছেলেগুলো রায়ানের বন্ধু হয়ে উঠছে আজকাল, তাদের প্রায় সবকটাই বখে যাওয়া বড়লোকের ছেলে। অনেকগুলোই ড্রাগ এডিক্ট। মাসীমা এখন নেই। ওর বয়সটা গোলমেলে। ভেবে দেখিস তুই আর সূর্যদা ওর জন্য পয়সা ছাড়াও একটু সময় খরচা করতে পারিস কি না। আমার মনে হচ্ছে এখন সেটাই ওর খুব দরকার। কথাগুলো বলে, যেমন হঠাৎ এসেছিল, সেভাবেই চলে যায়।
তমোঘ্নর মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর থেকে অর্চিতার কিরকম অস্থির লাগে। সে জানতো তমোঘ্ন না জেনে কিছু বলবে না। লক্ষ্য করতে থাকে রায়ানকে, কিন্তু বাড়াবাড়ি করে না। খবরটা সত্যি হলে তার বিপদটাও সে জানত। শনি রবি পেরোলে, দুদিন পরের এক দুপুরে, বিনা নোটিশে বাড়ি আসে। ছেলে তখন স্কুলে, ছেলের ঘর সার্চ করে। হাতে যেসব জিনিশ আসে তাতে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। বরফ ঠান্ডা স্রোত শিঁড়দাড়া দিয়ে নামে। সূর্য তার কয়েকদিন পর সেমিনার থেকে ফিরে এলে, তাকে জানায়। থমকে যায় সে’ও। এরকম পরিস্থিতির জন্য তারা দুজনের কেউই তৈরী ছিল না।
চাকরির অতি ব্যাস্ততায়, যাতায়াত আর রোগীর চাপে বাড়ি ফিরতে দেরী হওয়াটা তখন নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু একজন পেশেন্ট বাড়ির ছোট্ট ক্লিনিকটাতেও আসে। সময়ের চাকা জীবনটাকে নিয়ে ছুটছে আর টুকরো টুকরো তাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। সব কিছুর মধ্যে টাকার রূপোলী প্রলেপ তখন এক বিরাট শান্তি।ভেবে নিয়েছিল জীবনটা বেশ স্মুদ। স্ট্রাগলিং পিরিয়ড কাটিয়ে সে আর সূর্য দুজনেই তখন খানিকটা ভেসে উঠেছে। রায়ান তাদের একমাত্র সন্তান, স্বাভাবিকভাবেই তাকে সময় দিতে না পারার অভাবটা তারা দুজনেই পুরিয়ে দিত দামি জিনিসপত্র দিয়ে। শুরুটা লেগো ইত্যাদিতে হলেও, রায়ান ততদিনে বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেছে, ছোটবেলার মতো মা! মা! করাটা বন্ধ হয়ে গেছে। খেলনাও বদলে গেছে ভিডিও গেমে। শাশুড়ি যতদিন ছিলেন, খানিকটা নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু তিনি চলে যাবার পরেই বোধহয় অনেক বেশি একাকিত্ব গ্রাস করেছিল ছেলেটাকে।
ঘর সংসারের ভার পুরোটাই অসীমাদি তুলে নিয়েছিল নিজের হাতে। শাশুড়ির কাছ থেকেই সে সব খুঁটিনাটি শিখে নিয়েছে। অর্চিতাও বিশ্বাসী লোক পেয়ে নিশ্চিন্ত ছিল।
রায়ানেরও তাদের প্রতি নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে কমে এল, চোদ্দ বছরেই সে যেন এক ম্যাচিওর মানুষ। মা, বাবার অতিরিক্ত ব্যস্ততা নিয়ে তার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। মাইন্ডফুলনেসের ক্লিনিক থেকে ফিরেই রোজ সবার আগে ছেলের ঘরে ছুটে যেত। হয়তো মনের মধ্যে কাজ করতো এক অপরাধবোধ। ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা হাই, বাই, গুডমর্নিং, গুডনাইট এ আটকে যাচ্ছিল। চেষ্টা করেও এগোতে পারত না। রায়ান ততদিনে নিজের চারিদিকে একটা পাঁচিল তুলে দিয়েছে।
তমোঘ্নর নজরে ভাগ্যিস এসেছিল কিছু ঘুণপোকা, তাই আটকানো গেছিল চোরা স্রোত। না হলে নিঃশব্দে ঘটে যেত মারাত্মক বিপদ।
সব কিছু পূর্বাপর চিন্তা করে, সিদ্ধান্ত নিল, চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসেই কিছু করার। মাইন্ডফুলনেসে ততদিনে সে অনেকটা উপরে উঠে গেছে। রোগী টানতে তার নামটা জরুরী তালিকায় চলে গেছে ডঃ মজুমদারের কাছে। বুঝতে পারেনি ডঃ মজুমদারের হাতে তৈরী তাকে অত সহজে রেহাই দেবেন না তিনি। ওনার ক্ষমতার আন্দাজ আগেই সে পেয়েছে কয়েকবার, জলে বাস করে তাই কুমিরের সঙ্গে বিরোধিতা করার সাহস অর্চিতার ছিল না। অগত্যা কনসালট্যান্ট হিসেবে নাম থাকল সেখানেও।
মাইন্ডফুলনেসের অভিজ্ঞতাটা তার কাজে লাগল। পেশেন্টদের হাতে নিজের ঠিকানা আর ফোন নম্বর লেখা কার্ড ধরিয়ে দিল। তার ‘মাইন্ড ইস আ ভিবজিওর’ গড়ে উঠতে শুরু করল। অজস্র পেশেন্ট ডিল করতে করতে ততদিনে সে জেনে ফেলেছে সমাজের আধি ব্যাধি অনেক। অজস্র ছেলেমেয়ে বিভিন্ন রকমারি নেশার কবলে পড়ে যাচ্ছে। সফল এবং বিত্তবান বাবা মায়েদের অভাব নেই চারিদিকে। বাবা মা বিত্তবান না হলে কি হয় এসব নেশাড়ু ছেলেমেয়ের চিকিৎসা তাও সে ততদিনে দেখে ফেলেছে। কত যে মেধাবী ছেলেমেয়ে ঝরে যেত এভাবে। পয়সাওয়ালা বাবা মায়ের অভাব সময়ের। সময়কে ভাগ করায়। গরীবের একটাই অভাব সেটা পয়সার।
শুধু জানতে পারেনি তাদের ছেলে রায়ানের ক্ষেত্রেও একই হচ্ছিল। এতখানি বিপদের সময়ে ভাগ্নেকে সামলানোর দায়িত্বও অনেকটাই নিল তার মামা তমোঘ্ন। তারই এক বন্ধুর রিহ্যাবেসে থাকল কিছুদিন।
টাকার পাহাড়ে ভাগ্নের বড় হওয়াটা কোনোদিনই সে খুব একটা পছন্দ করতো না। মাঝে মধ্যে এসে সে’ই রায়ানকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেত। সেই অসময়ের দিনগুলোতে ছেলেটাকে আগলে রাখল। অর্চিতা যেন তখনো, ভাবতেই পারছিল না রায়ান ড্রাগ পেডলিং এ ভিড়ে যাচ্ছিল। আলো কি এভাবেই অন্ধকারে মিশে যায়!সেসময় ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা খানিকটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছিল।
অর্চিতার নিজের সেন্টারটা অল্পদিনেই বেশ বড় হয়েছে। আরো দুজন কাউন্সিলার জয়েন করেছেন। রিসেপসনের মেয়েটা আর সে নিজে ছাড়া সেন্টারটা গত কয়েক বছরে খোল নলচে বদলে ফেলেছে বলা যায়।
ছেলেমেয়েগুলো আর তাদের বাবা মায়ের সঙ্গে কথোপকথন। ওদের সমস্যার কাছাকাছি পৌঁছে, সমস্যা নির্দিষ্ট করে কাউন্সেলিং। খুব অল্প ক্ষেত্রেই ওষুধ প্রয়োগ করে সে। ওষুধ ব্যবহার না করে সুস্থ করে তোলাটা সম্ভবত আরেকটু সাফল্য যোগ করেছে তার মুকুটে। ইদানীং ওর কাছে কাউন্সেলিং করাবার জন্য যে কোনো সেশনের প্রায় তিন মাস আগে বুকিং করাতে হয়।মুর্ছা পাওয়া ফুলগুলো জেগে ওঠে যখন, অর্চিতার মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। অর্চিতার মনে হয় রঙে ভরে দিচ্ছে মানুষের মনের সাদা কালো হয়ে যাওয়া ক্যানভাস। অনেক ভেবে নিজের সেন্টারের নাম রেখেছিল ভিবজিওর। সেটাকেই সার্থক হতে দেখছে রোজ।
প্রথমদিকে ফিস কমাবার অনেক অনুরোধ এসেছে, কিন্তু সে কাজটা ও করে না। করলে চোরা স্রোত আটকাতে পারবে না সেটা সে জানে। এ ব্যাপারে সূর্যর সঙ্গেও আলোচনা করে দেখেছে, তারো একই মত। অজস্র ভাবনার সাত রঙে স্নান করতে করতে সে রবিবারের লাঞ্চ করে। সপ্তাহের একমাত্র ছুটির দিনে অসীমাদির হাতের রান্না তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে সে। অসীমাদি সব রবিবার মনে করে ওর প্রিয় পদগুলো রান্না করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।
খাওয়া প্রায় হয়ে এসেছে, এমন সময়ে জবা’দিকে ঢুকতে দেখে অর্চিতা বেশ অবাক হয়। জবা’ দি ওদের পরিবারের বহু পুরনো কাজের মানুষ।আয়া ছাড়াও মায়ের শেষ দুবছরের সঙ্গী ছিল। অসম্ভব সেবা যত্নে মাকে দেখে রেখেছিল সে সময়। সেরিব্রাল অ্যাটাকে বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙ্গে যাবার পর, চব্বিশ ঘন্টা দেখাশোনার জন্য যখন সেরকম বিশ্বস্ত আর সহানুভূতিশীল কাউকেই যোগাড় করতে পারছিল না সে, কোত্থেকে যেন জবা’দিকে নিয়ে এসেছিল ভাই তমোঘ্ন। অর্চিতা জবা’দিকে দেখে ভাবতেই পারে নি জবা’দি এতটা বয়সেও মাকে এইভাবে দেখে রাখবে।
হঠাৎ একটা স্ট্রোকে মা চলে যাবার পর সবথেকে বেশি কষ্ট পেয়েছিল সম্ভবত জবা’দি। জবা’দির কান্না থামাতে পারছিল না ওরা কেউ। কিন্তু তারপর থেকে জবা’দি সেই যে চলে যায় আর আসেনি কখনো। তার নিজের পাওনাগন্ডা নিতেও না। তাই জবা’দিকে দেখে বেশ অবাক হয় সে।
-জবা দি তুমি! এতদিন পর? এদিকে এসেছিলে বুঝি…।
জবা’দি কিছু বলার আগেই ঘরে ঢোকে ওর ভাই তমোঘ্ন। বলে, আমি জবা’দিকে নিয়ে এসেছি। জবা’দি নাতির জন্য এসেছে তোর কাছে।
অর্চিতা অবাক হয়? চোখ দিয়েই প্রশ্ন করে। তমোঘ্ন আবার বলে, কি গো জবাদি বলো।
-ছেলেটা তো পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল, সে তো তুমি জানো দিদি। সে ছেলের ডেনরাইট না কিসের নেশা হয়েছে। আস্তে আস্তে ঝিম ধরে যাচ্ছে। তুমি নাকি এসবের চিকিচ্ছে জানো। ছোড়দাই নিয়ে এলো তোমার কাছে। আমতা আমতা করে বলে জবা দি।
-বেশ তো। নিয়ে এসো নাতিকে। দেখি একবার। থেমে থেমেই বলে অর্চিতা।
জবাদির মুখটা উজ্জ্বল হাসিতে ভরে যায়।
তমোঘ্নই আবার বলে, এক্ষুণি এত খুশি হবার দরকার নেই জবাদি। খরচের অঙ্কটা আগে জেনে নাও।
-কিরে বল!
অঙ্কটার সম্পর্কে ধারণা পেতেই জবাদির মুখটা কিরকম কালো হয়ে যায়। বলে, ছেলের সঙ্গে কথা বলে দেখি।জবাদি বেরিয়ে যায়। এরপর তমোঘ্ন যেভাবে কথা বলে, সেভাবেই চালিয়ে যায় ওর বক্তৃতা।
-সাতরঙ দিয়ে ছবি আঁকছিস, ফুল ফুটিয়ে সমাজ সংশোধন করছিস। নিজের টাকার প্রতি লোভের রঙটা একটু সংশোধন করতে পারলি না এত দিনেও! জবা’দি মায়ের জন্য কি করেছে আশা করি ভুলে যাসনি। মা চলে যাবার পর মাইনের টাকাটাও নিতে আসেনি বলেই আমার মনে পড়ছে। তুই অবশ্য মারাত্মক ব্যস্ত ডাক্তার সব ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক! ভুলে যেতে পারাটা সব থেকে ভালো। নাহলে অন্যের জীবনে রামধনু দেখাবি কী করে!
-তমোঘ্ন…।
এরপর সে যেন ফেটে পড়ে। অনেক বেশি জোরে বলে ওঠে, গলা তুলিস না দিদি। তুই বরং একটু লজ্জা পাওয়া প্র্যাকটিস কর। তুই জানিস আমার কথাগুলো কতটা সত্যি। যদি পারিস একটা চেষ্টা করে দেখিস সঠিক রাস্তায় নিজে ফিরে আসতে পারিস কি না…।মনে আছে, বাবা বলতেন, টাকার লোভ আর ড্রাগের নেশায় খুব বেশি পার্থক্য নেই।ব্যাঙ্ক ব্যালান্স আর নেশার ঝিম কোনোদিন পুরো হয় না।তারপর স্বভাবসিদ্ধ বাঁকা হাসিটা উপহার দিয়ে দরজাটা ধড়াম করে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
রায়ানের ব্যাপারে ভাইকে কোনোদিন সামান্য ধন্যবাদটুকুও জানাতে পারেনি। ভয় পেয়েছিল, ধন্যবাদের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। তাবলে এতখানি অপমান ছুঁড়ে দেবে নিজের দিদিকে! কিভাবে বলতে পারল, তুই আসলে একটা হিপোক্র্যাট!
অর্চিতা বসে থাকে। চোখটা ভিজে ওঠে। শুধুই কি টাকার নেশা… তার? আর কিচ্ছু না? যারা সুস্থ হয়…। তারা তাহলে…? অন্ধকার থেকে উঠে ঘরে আলো জ্বালতেও ইচ্ছা করে না তার।ফোনটায় আলো জ্বলে।রায়ান।ফোনটা হাতে নিয়ে অর্চিতা বলে, বেটু কেমন আছিস? পড়াশোনার খুব চাপ না রে? মাকেও ফোন করতে ভুলে যাস আজকাল। ফোন ধরিসও না।
রায়ান সেসব প্রশ্নের ধার দিয়েও যায় না বলে, মা আমরা কলেজ থেকে একটা গ্রুপ হিমাচলে যাচ্ছি। কয়েকদিন হয়ত ফোনে পাবে না।
-হঠাৎ হিমাচল যাচ্ছিস যে? ট্রেকিং?
-উঁহু।
-তাহলে কি সন্ন্যাসী হবার ট্রেনিং নিতে? একমাত্র ছেলে সন্ন্যাসী হলে আমার খুব মুশকিল হবে।
-না মা এখন হিমাচলে ট্রেকিং আর সন্নাসী ট্রেনিং স্কুল দুটোই বন্ধ।
রায়ানের রসিকতায় হেসে ওঠে সে। কেন? সন্ন্যাসীরা সবাই স্ট্রাইকে গেছে নাকি?
হঠাৎ কিরকম সিরিয়াস হয়ে যায় রায়ানের গলাটা, মা তুমি কি নিউজও দেখো না; খবরের কাগজও পড়ো না? ওখানে ফ্লাস ফ্লাডে মানুষ কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে। থাকার জায়গা দূরের কথা। সিমপ্লি খেতে পাচ্ছে না। আমাদের এক ব্যাচমেট হিমাচলি, ওর বাড়ির কারুর খোঁজ পাচ্ছে না আজ চার দিন।
রায়ানের কথার তীব্র শ্লেষটা সোজা এসে আঘাত করে অর্চিতাকে। গার্জিয়ান হবার অধিকারেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, -যা করবি বুঝে করবি। মনে রাখিস অনেক কষ্টে চান্স পেয়েছিস এই কলেজে। জলের মতো টাকা গেছে তোর কোচিং এ, এগুলো ভুলে গেলে কিন্তু...।
মাঝপথে তাকে থামিয়ে দেয় ছেলে। বলে, কিছুই ভুলিনি মা। এটাও ভুলিনি আমি একজন মানুষ, অন্য মানুষের পাশে, দরকারে দাঁড়ানোটা অন্য কোনো দরকারের থেকে কম নয়। সে সব ছাড়ো— মামা এসেছে না? মামাকে একটু দাও তো ফোনটা। দরকার আছে।
-মামা এসেছে সেটাও তুই জানিস? আশ্চর্য তো!
কিছুক্ষণ আগে ভাই তমোঘ্নর শুনিয়ে যাওয়া অপমানজনক কথাগুলো মাথায় ভীমরুলের মতো চক্কর কাটছিল তখনো। ছেলের কথায় সেটা যেন আরো খানিক বেড়ে যায়।
-মামা কিছুদিন হিমাচলে কাজ করেছে তাই, নিজের দরকারেই আমি মামাকে ফোন করেছিলাম। তখনই বলল, আমাদের বাড়িতে ঢুকছে। ফোনটা দাও…।
-সে বেরিয়ে গেছে।
-বেরিয়ে গেছে…?
-হ্যাঁ আমার সঙ্গে খানিক কথা কাটাকাটি হল। ব্যাস।
-আবার…! এবার রায়ানের গলায় বিরক্তিটা বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
-হ্যাঁ! আমিই তো...। অর্চিতার কথা শেষ হবার আগেই ওপাশের বিপ বিপ শব্দ বুঝিয়ে দেয় লাইনটা কেটে গেছে।
রায়ানও যত দিন যাচ্ছে মামাকেই বেশি করে ভরসা করছে যেন। সূর্য বলে, ওটা বেশি নয়। বেহিসেবি। নরানাং মাতুলক্রমঃ কেস।
ফ্ল্যাশ ফ্লাডের এলাকায় ছেলেটা যাচ্ছে শুনে বুকটা কেঁপে ওঠে। এরপর কয়েকবার ফোন করলেও, রায়ান ফোন তোলে না। আজকাল ওর কথাবার্তায় কিরকম এক তাচ্ছিল্য মেশানো থাকে। অথচ তমোঘ্নর সঙ্গে সে ছেলে সব কিছু শেয়ার করে। একটা কাঁটা কিরকম খচ খচ করে।
মাথা খানিক ঠান্ডা হলে, তমোঘ্নকে ফোন করে।ভেবে নেয় বলবে, ঐ ভয়ানক বিপদের মধ্যে যেতে রায়ানকে যেন সে বারণ করে। তমোঘ্নর কথা রায়ান ঠিক শুনবে। তাকেও পায় না। ফোন বেজে বেজে থেমে যায়।হঠাৎ মনে হয় আজ ভাইয়ের সঙ্গে সে নিজেও একটু বেশিই রূঢ় কথা বলে ফেলেছে। মাথাটা এমন গরম হয়ে গেল। যখন হোক খানিক অকারণ জ্ঞান বর্ষণ করে যাবে তাকে। জবা’দিকে নিয়ে কিভাবে শোনালো। অর্চিতা কি জবা’দির জন্য খানিকটা কম পয়সা নিতে পারতো না? সেটা নিয়ে এইভাবে অশান্তি করলো!
চুপচাপ বসে থাকে অন্ধকারে। রবিবার সন্ধ্যাবেলা ক্লিনিক বন্ধ থাকে তাই কেউ আসবেনা।এই একটা দিনই বিশ্রাম তার। জবা’দি এসেছিল বলেই রবিবার বিকেলেও এঘরে ঢুকেছিল সে। আজকের দিনটা কিরকম যেন হয়ে গেল। ভাবছে কাল অফ নিয়ে নেবে। একটা দিন অন্যরা ঠিক ম্যানেজ করে নেবে।
অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে বসেও, একটা একটা করে ভেসে আসতে থাকে তমোঘ্নর বলে যাওয়া কথার টুকরোগুলো...। যেন শব্দভেদী বাণ।
ওদের দামি গাড়ির সামনে এখনো তমোঘ্নর স্কুটার কিভাবে যেন লাখ টাকার হাসি হাসে। সে নিজে অনেকবার ভেবেছে, তার অপরাধবোধটা কিসের? সে তো কাউকে ঠকায়নি। সকলের জীবনবোধ তো কিছুতেই এক হতে পারে না। কাঁটাটা খচ খচ করে।
ডাগতার মেডাম! অর্চিতা অবাক হয়ে যায়। রবিবার তো কোনো পেশেন্ট আসার কথা নয়। তাও একেবারে ওর ঘরে। আজ তো সে পেশেন্ট দেখে না। আজ ক্লিনিক বন্ধ।
-কে?
সামনে এগিয়ে আসে রামকিষেণ! ডাগদার মেডাম! পহচানলেন!
-রামকিষেণ তুমি! তুমি এ জায়গা চিনলে কিভাবে? রামকিষেণ হাসে। হাসতে হাসতেই বলে বিটিয়াকে নিয়ে আসলাম ডাগদার মেডাম...! আপনি ওকে দেখবেন বলিয়েছিলেন। এ বিটিয়া...এ...! আগুনে পোড়া বীভৎস একটা শরীর নিয়ে এগিয়ে আসে একটা ষোলো, সতেরো বছরের মেয়ে! রামকিষেণের পিছনে আরো কারা যেন দরজা দিয়ে ঢুকতেই থাকে। ঘরটা একজন একজন করে মাইন্ডফুলনেসের পেশেন্টে ভরে যায়। রামকিষেণের পিছনে সুভদ্র, ওর বাবা পোস্ট অফিসে কাজ করতেন। ছেলেটা পাতার নেশা হলো, তার পিছনে মলয়, চন্দন, সমীর এরা সব কিভাবে আজকেই এখানে এলো …। বেশ মনে আছে এদের কারুর পরিবারই শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা টেনে নিয়ে যেতে পারেনি। বিনা পয়সায় মাইন্ডফুলনেস কারুর মাইন্ড চেক করে না। এ ছিল ওদের নিজেদের বুলি। যদিও পেশেন্ট পার্টিকে মধু মাখিয়েই বলা হত। কিন্তু এরা সবাই কি তাহলে চিকিৎসার বলি? কবে হল এরকম! খবর পায়নি তো! অর্চিতার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে কেন!
ভাবে, আরেকটু সহানুভূতি পেলে এরা হয়তো…। কিন্তু সাহস ছিল না ডঃ মজুমদারের বিরুদ্ধে একটাও কথা বলার।
রামকিষেণ বলে, ইহারা সোব আসলো হামার সোঙ্গে। দেখেন না মেডাম আপনার রোং তুলি দিয়ে পারেন নাকি এদের জীবোনে একটু রোং ভরে দিতে! সোবাই আপনার পেশেন্ট আছিল। দেখেন। দেখেন। কি বীভৎস! ওরা সবাই হাসছে কে—ন? অর্চিতা চীৎকার করে ওঠে। রামকিষেণ হাসতে থাকে...। ভয় পাইলেন নাকি মেডাম। সবাই তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে ওর টেবিলের দিকে। অন্ধকার ক্লিনিকে অর্চিতা তখন প্রচন্ড ঘামতে থাকে। চিৎকার করে বলতে চায়, বিশ্বাস করো রামকিষেণ আমার কিচ্ছু করার ছিল না। ...ডঃ মজুমদার... রামকিষেণ, বিশ্বাস করো...আমি না। আমি কিচ্ছু জানি না।
অসীমাদি কফির কাপ নামানোর ঠক শব্দ হয় টেবিলে। ঘরটা এমন অন্ধকার করে বসেছিলে কেন দিদি! আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। তমো দাদা তো অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেল মনে হল। কার সঙ্গে অত জোরে জোরে কথা বলছিলে? ফোন? তুমি এমন ঘামছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে? কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে অসীমা। এসিটার দিকে তাকায় আবার। দেখে সেটা চলছে আর দিব্য হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে।
অর্চিতার মনে হয় সে এতক্ষণে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে।
ফ্যাঁসফ্যাসে গলায় অর্চিতা বলে, অসীমাদি বসো।
অসীমা অবাক হয়ে তাকায়। দাঁড়িয়ে থাকে। অর্চিতা তাকে বসতে বলছে, নিজের চেম্বারে একথা বিশ্বাস করতে অসীমার একটু সময় লাগে। খানিক পরে বলে, তুমি এখন চলো তো একটু বিশ্রাম নেবে।
তখনো অর্চিতা যেন শুনতে পাচ্ছে রামকিষেণের সেই হা হা করে হাসি।
চেয়ারে বসে সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল? এইটুকু সময়ে ঘুম কিভাবে আসবে? তাহলে…? ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় শিরদাঁড়া দিয়ে আবার।
নিজেকে চট করে সামলে নিয়ে অসীমাদিকে বলে, তুমি যাও আমি আসছি।
অসীমাদির সব দিকে খেয়াল থাকে। ওর চান, খাওয়া থেকে কফি। বাড়ির সব খুঁটিনাটি স-ব। কোনো কিছুর জন্যেই কোনোদিন মনে করে কিছু বলে দিতে হয় না।যে সময়ে যেটা দরকার সব হাজির হয়ে যায়। আজ একটু যেন লজ্জা করেতার, চিরকাল এই সমস্ত জিনিষকে স্বাভাবিক পাওনা হিসেবেই নিয়েছে কিন্তু নিজে কি কোনোদিন অসীমাদির কোনো প্রয়োজন মাথায় রেখেছে? মাস গেলে টাকা দেওয়াটাই যথেষ্ট মনে করেছে। জিজ্ঞাসাও করেনি কিছু।
এই প্রথম অসীমাদির জন্য এভাবে ভাবতে পেরে কেমন যেন ভালো লাগছে তার। সে বেশ অবাক হয়।তমোঘ্নর কথা মতো সে কি লজ্জা পাওয়া প্র্যাকটিস করছে! ছি! ছি কিসব ভাবছে! সে কি সত্যিই এত হীন নাকি!
গতজন্মে দেখা সিনেমার পাতা তখন চোখের সামনে ফড় ফড় করে উড়তে থাকে। মাইন্ডফুলনেসের ক্লিনিক থেকে বেরোচ্ছে একদিন, সেন্টার হেড ড: মজুমদারের ড্রাইভার রামকিষেণ ছুটে এসে ওকে ধরে। তখনো সে বাসে বা শেয়ার ট্যাক্সিতেই বাড়ি ফেরে।রামকিষেণের মেয়েটা সিজোফ্রেনিক। অনেক জায়গায় দেখিয়ে সারেনি। ক্লিনিকে কে যেন তাকে অর্চিতার কথা বলেছে। অর্চিতার স্পেসালাইসেজনের সাবজেক্টও সেটাই ছিল।
মা মরা মেয়েটা ছাড়া রামকিষেণের আর কেউ ছিল না। সংবেদনশীল মনটা তখনো অর্চিতার সঙ্গেই বাস করতো।শুনেছিল রামকিষেণের সব কথা। পরেরদিন ওর কথা মতোই মেয়েকে নিয়ে এসেছিল রামকিষেণ।এটা যে করা যায় না তখনো অর্চিতা জানে না সেটা। তখনো সে জুনিয়র ডাক্তারদের একজন। শহরের এক নম্বর সাইকিয়াট্রিক ইন্সটিটুটে চাকরি পাওয়াটা তখন তার কাছে স্বপ্নকে ছুঁয়ে ফেলার মতো প্রাপ্তি। ওর বস ডঃ সান্ন্যাল বললেন, একথা ওকথায় ঘুরিয়ে দাও ব্যাপারটা। জাস্ট হাটিয়ে দাও। নাহলে ডঃ মজুমদার তোমাকে হাটিয়ে দেবেন। এখনো তোমার চাকরিও পাকা হয়নি। অজান্তে কেস খেয়ে যাবে। ডঃ সান্ন্যাল জুনিয়র ডাক্তারদের খানিকটা হলেও স্নেহ করতেন।
তারপর থেকে রামকিষেণ শত ডাকলেও সে শুনতে পেত না। ব্যস্ততার ভান করাটা ছিল সব থেকে সহজ। একটার পর একটা ট্রেনিং এ তখন সে শিখছিল, সুচারুভাবে কেস হ্যান্ডেল করা। ডঃ মজুমদার নিজে থাকতেন জুনিয়র ডাক্তারদের ট্রেনিং সেশনগুলোতে।
ইনস্টিটিউটে একদিন কে যেন বলল, রামকিষেণের মেয়ে স্টোভ বার্স্ট করে মারা গেছে। এর কয়েকদিন পর রামকিষেন মাইন্ডফুলনেসের স্টোরেই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লো। পুলিশ এলো, বডি নিয়ে গেলো। ডঃ মজুমদার মাথা ঝাঁকিয়ে বার দুয়েক বললেন, সো স্যাড। এরা এত বেশি ইমোশনাল…। নতুন ড্রাইভার জয়েন করলো। সবাই রামকিষেণকে ভুলে গেল।
ভাবতে চেষ্টা করে সেদিন কি ওর একবারও হিপোক্রেটিস ওথ মনে পড়ছিল! একবারও কি মনে পড়েছিল ওদের কলেজের প্রিন্সিপাল ড: হাটির কথা। যিনি বার বার বলতেন, ডাক্তারি একটা চলন। মনে রেখো এটা শুধু পাশ ফেল নয় স্টুডেন্টস। বোঝাতে পারলাম কি! ওঁর নিজের জীবনটাও ছিল সেটারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
রাতভর ঘুম খোঁজে অর্চিতা। মাথায় একরাশ অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে এপাশ ওপাশ করে। লজ্জা করে অসীমাদিকে ডাকতে। মানুষটা সারাদিন অনেক পরিশ্রম করে। ভোরবেলা চোখটা সম্ভবত লেগে এসেছিল, ফোনের শব্দে ঘুমটা ভাঙে। না দেখেই ফোনটা কানে তোলে। ভেসে আসে রায়ানের গলা।
-মামার সঙ্গে কথা হয়েছে মা। ওরা কয়েকজন ডাক্তার কাল দিল্লি এয়ারপোর্টে পৌঁছাচ্ছে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্তর নিয়ে। আমরাও ওদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকব। মামাই বলল তোমাকে ফোন করে নিতে। তুমি নাকি খুব চিন্তা করছ! রাখছি। পরে আবার ফোন করবো। চিন্তা করো না।
চোখের জলে বালিশ ভিজেচ্ছে কেন অর্চিতা তাও ঠিক বুঝতে পারে না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবা মহেন্দ্রনাথ বসে আছেন বারান্দায় তাঁর চেয়ারে। এক এক করে কত কৃতি ছাত্র প্রণাম করে যাচ্ছে তাঁকে। মনে মনে বলে ক্ষমা করো বাবা, ক্ষমা করো। তোমার শিক্ষা আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। তমো সবটাই পেরেছে। মনে হচ্ছে রায়ানও পারবে। এবার থেকে আমি ওদের দেখেই শেখার চেষ্টা করবো। ভুল করলে শুধরে দিও।
উঠে পড়ে অর্চিতা। রাত সাড়ে তিনটে। জবা’দির নম্বরটা ঠিক আছে কোনো পুরনো ডায়রিতে। খুঁজলেই পেয়ে যাবে। সকালেই ফোন করতে হবে। আর একটা দিনও নষ্ট করা যাবে না। কিছুতেই না।
কভার ছবি- করতোয়া সেনগুপ্ত