দুদিন আগে ক্যাম্পাসে পাগলা কুকুর ঢুকে পড়ায় গণেশের চাকরিটা নড়বড় করছে। ঘরটার দিকে পড়িমরি করে ছুটল গণেশ। নিঃশব্দ অলিন্দে নিজের বুটের শব্দে নিজের গা’টাই কেমন ছমছম করে উঠল। দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখল ঘরটা হিমঘর হয়ে রয়েছে। গ্রিলহীন খোলা জানলা দিয়ে নিঃশব্দে ঢুকছে ডিসেম্বর। বিশালের বিছানাটা খালি। দুটোর মধ্যে একটা কম্বল এলোমেলো হয়ে পড়ে। অন্যটা গায়েব। বালিশে এখনো মাথার ছাপ। টর্চের আলোকবৃত্ত এবার গিয়ে পড়ল লাগোয়া বাথরুমের দরজায়। ছিটকিনিটা তোলা। ঘরে আরো তিনটে দ্বিতল বিছানায় ছ’টি ছেলে। সবাই ঘুমিয়ে কাদা। এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েও ফিরে এসে জানলাটা বন্ধ করল গণেশ। তারপর সোজা অফিসঘর। সেখানে হিটার চালিয়ে নিদ্রাসমুদ্রে নিমজ্জিত শিফটের হিটলার মদন ছেত্রী।
‘শাব, শাব। বিশাল ফরার ভয়কা সন্।’ টেবিল ঘণ্টির পিলে চমকানো টিং টিং আর গণেশের আর্তনাদ শুনেই সমুদ্রের তলায় স্টিং রের কারেন্ট খেলেন মদন। হোস্টেলের একটা ছেলে পালিয়েছে আর যে সে ছেলে নয়, পালিয়েছে বিশাল!
তিন মাস আগে … মুস্নিয়াং, মেঘালয়
‘কতটা গভীর?’ নাম হাসিনা হলেও, সবসময় হাসি মুখেই প্রশ্ন করে সে। চুপ করে রইল লাক্পা। ‘কী হোল? উত্তর কই?’
‘পঞ্চাশ ফুট।’ লাক্পাও লজ্জার হাসি মুখে মেখে উত্তর দিল।
হাসিনা একটা ভারী পাথর তুলে দশ ফুট বাই দশ ফুট গর্তটার মধ্যে ছুঁড়ে দিল। এক … দুই … তিন … চার … পাঁচ … জলে পড়ার শব্দ এলো — ঝপাং।
ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে, হাসি বজায় রেখে হাসিনা বলল, ‘তুম ঝুট্ বোলা হামসে? ইয়েহ করীব চারসৌ ফিট গহেরা হোগা। তলায় পড়তে পাথরের পাঁচ সেকেন্ড সময় লেগেছে। মুখের কাছে সবুজ ঘাসের বুকেহ্ দেখে তো বুঝতে পারছি এটা এখন কেউ ব্যবহার করে না। কিন্তু ব্যবহার করা হচ্ছে, এরকম কটা আছে আশেপাশে?’
লাক্পার ইচ্ছে করছিল পালিয়ে যাই। কিন্তু মহিলার সঙ্গে তিনজন পুরুষও রয়েছে।
‘এরা পুলিসের লোক?’ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করল লাক্পা।
‘কতবার বলব, না?’
‘আগে দশঠো ছিল। এখন তিন।’
‘গ্রিন ট্রাইবুনাল এগুলো বন্ধ করতে বলেছিল। সাত বছরে পরেও তিনটে খোলা? তাও আবার কোভিডের সময়!’
‘এগুলো খোলা না থাকলে, পেটে তালা পড়বে!’ উবু হয়ে ঘাসে হাত বোলাতে বোলাতে বলল লাক্পা।
কথাটা শেষ হয়েছে কি হয় নি, গর্তের ভেতর থেকে এক রাগত কণ্ঠ চিৎকার সহকারে উঠে আসতে লাগল, ‘এই শালা লাক্পা, কোন হারামি পাথর ছুঁড়ল? তোকে বলেছিলাম না বাইরে নজর রাখতে।’
গর্তের বাইরে এসে সেই কণ্ঠ যা অবয়ব ধারণ করল তা দেখে মায়া হোল হাসিনার। অল্পবয়েসি একটি ছেলে। দুয়ারে শীতের মধ্যেও গায়ে ফিনফিনে একটা জামা। কালিঝুলির আড়ালে রং মনে হোল নীল। ফুটিফাটা গামবুট। মাথা আর কানের ওপর দিয়ে একটা লাল কাপড় টানটান করে ফেলে পিছনে গিট্টি মেরে বাঁধা। ডান কানের ওপর কাপড়টির দৃঢ় আলিঙ্গনে জ্বলন্ত টর্চ। এতগুলো লোক দেখেই ছেলেটা থতমত খেয়ে পালাতে গেল। কিন্তু ঢালের গায়ে নুড়ি পাথরে হড়কে ভূপাতিত হোল।
ছেলেটাকে বেরতে দেখে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল হাসিনার। গর্তের মধ্যে ছুঁড়ে দেওয়া পাথর এর মাথায় পড়লে, ফাঁসি না হলেও যাবজ্জীবন নিশ্চিত। হাসিনার কথা সরছে না দেখে আভা ছেত্রী এগিয়ে এলো। এই লড়াইয়ে হাসিনার ছায়াসঙ্গী।
‘নিচে আর কতজন কাজ করছে?’ আভার প্রশ্নে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ছেলেটা।
এভাবেই পূর্ব জয়ন্তীয়া পাহাড়ের বেআইনি কয়লা খনি থেকে হাসিনার হাতে উঠে এসেছিল বিশাল। কয়লা মাখা মুখে চোখদুটো ছিল জ্বলজ্বলে হীরে। অমন ভাস্বর মুখে চোখা চোখা অপভাষা এমন ভঙ্গিতে ফুটে উঠছিল যেন সেটাই স্বাভাবিক। সঙ্গে ছিল হলিউড সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় কুবচনটি। আর কোনও ইংরেজি শব্দ অবশ্য জানা আছে বলে মনে হলো না। বিশালের পেছন পেছন সেদিন হাসিনা, আভা, লাক্পা আর হাসিনার দুই পুরুষ সহকর্মী গর্তের নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেছিল। এই প্রথম ওদের কোনও “র্যাট-হোল” খনিতে পা রাখা।
খনির নিচে আকাশ আর সাদা মেঘের মোজ়াইক। পুকুরের জল কোথা থেকে এলো সেটা বুঝতে আইনস্টাইনের বুদ্ধি লাগে না। পুকুর ঘিরে এঁটেল মাটির জমি আর আলো আঁধারির খেলা। আর সেই জমি ঘিরে দেওয়ালে তিনটে সুরঙ্গ। কোনওটাই নিখুঁত গোলাকার নয়। শুধু একজন মানুষ গলে যাওয়ার মতো তাদের আকার আর আয়তন। বিশালের মতো শ্রমিকের দল সাষ্টাঙ্গ হয়ে ঢুকে পড়ে অজগরের হাঁয়ে। সোজা দাঁড়ানোর প্রশ্নই নেই। কোথাও হামাগুড়ি দিতে পারছে মানে, সেখানে কয়লা এতটাই খোঁড়া হয়ে গেছে যে আর খুঁড়লে সমূহ বিপদ। মাথা দিয়ে ঠেলতে থাকে একটা কাঠের ট্রলি। অনেকটা ভেতরে সেঁধিয়ে যেখানে ছুঁচলো হাতুড়ি দিয়ে কয়লা ভাঙতে শুরু করে, সেখানে নাক আর সিলিঙয়ের মধ্যে মাত্র ফুট খানেক ফাঁকে যত না অক্সিজেন তার থেকে বেশী এমন সব গ্যাস, মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যাদের অবদান শূন্য। ছোট বড় কয়লার চাঙড় এসে পড়ে ট্রলিতে। ট্রলি উপচে গেলে বা শ্বাসে টান পড়লে, সেই ট্রলি টানতে টানতে দেহটা বেরিয়ে আসে গর্ত থেকে। দুর্ঘটনা ঘটে গেলে অন্যরা টেনে বার করে। নিষ্প্রাণ দেহ বেরনোটাও বিরল নয়। একেবারেই না বেরনোটাও বিরল নয়। এরপর এতদিনের অসূর্যম্পশ্যা কয়লা গর্তের বাইরে আলোর মুখ দেখে শঙ্কু-আকৃতির বেত-ঝুড়িতে উঠে, মালবাহীর পিঠে চড়ে। গ্রিন ট্রাইবুনালের নির্দেশের আগে মেশিনে করেই ওপরে উঠত। এখন ওঠে মানুষের পিঠে চড়ে কারণ পিঠ শব্দ করে না। বন্ধ্যা খনিটির গর্ভে আজও কয়লার ভ্রূণ রয়ে গেছে কি না সেটা পরখ করতেই সেদিন বিশালের নিচে নামা। ওপরে উঠতেই জীবনটা আর আগের মতো রইল না।
হাসিনা লিংডোদের এনজিওর লড়াইটা বেআইনি কয়লাখনি বা পরিবেশের ওপর তাদের কুপ্রভাবের সঙ্গে নয়। বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে বিভিন্ন কারণে উত্তর-পূর্ব ভারতে শিশু পাচারের সঙ্গে ওঁদের লড়াই। এক সময় এই ইঁদুর-গর্তের কয়লাখনি ঘিরে মানুষ পাচারের যে ব্যবসা গড়ে উঠেছিল, তার সংখ্যাতত্ত্ব নাড়া দেয় হাসিনাকে। তাই যেদিনই সে শুনতে পায় খনিগুলির আবার ঘুম ভাংছে, সেদিনই সে ঠিক করে আড়মোড়া ভাঙ্গার আগেই মানুষ পাচারের গোড়ায় ঘা দিতে হবে। নয়ত কুম্ভকর্ণের কানে “নির্দেওয়াত্বাম”-এর বদলে “নিদ্রাওয়াত্বাম” ঢোকানো মুশকিল হবে।
‘বিশালের বয়স কত?’ বিশালের বাবা বলে নিজের পরিচয় দেওয়া সুশীলকে প্রশ্ন করে হাসিনা। প্রেক্ষাপটে ধুঁকতে থাকা ওদের বেতের ঝুপড়ি। বেতের দরজায় দাঁড়িয়ে ক্ষুদি ক্ষুদি চোখে সব লক্ষ্য করতে থাকা নেপালি মহিলাটি সম্ভবত বিশালের মা। পুরো পরিবারের নেপাল থেকে পাচার হয়ে আসা।
‘১৩ … ১৪ …’। উবু হয়ে বসা সুশীল সংশয়ী কণ্ঠে উত্তর দেয়। একই সঙ্গে পাশ থেকে লাক্পা বলে ওঠে, ’১১ … না না … ১২’।
হাসিনা আর আভা হেসে ওঠে। দরাদরির শেষে খাতায় বয়েস লেখা হয় এগারো।
বিশালের ক্ষতচিহ্নে ভরা হাতদুটো মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসিনা প্রশ্ন করে, ‘কখনও মনে হয়নি এ নিজের পেটের ছেলে, গর্তের ইঁদুর নয়?’ কিছু দূরে ফাঁকা মাঠে ক্রিকেট খেলছে এক দল ছেলে। ‘এই বয়েসে হাতে ব্যাট না ধরিয়ে হাতুড়ি?’
‘খনন বন্ধ। ছোটদের কাজ করা বন্ধ। এবার আমাদের শ্বাস নেওয়াটা বন্ধ করে দিন।’ সুশীল উত্তর দেয়।
‘শ্বাস না বন্ধ করে, শ্বাসে কোহলের গন্ধটা বন্ধ করা তো যেতেই পারে। তোমাদের ঝুপড়ি ঘিরে খান ত্রিশেক মদের বোতল। বিশালের পিঠের দাগগুলো খনির দান না তোমাদের মত মাতালদের?’ প্রশ্ন যতই কঠিন হোক, হাসির মোড়কেই করে হাসিনা।
খনন বন্ধের মতো আইনগুলো পুনর্বাসনের দিশা ছাড়াই দুম করে আসে। কোপটা পড়ে মানুষের উপার্জনে। যে উপার্জনে সংসার চলে না, সেই আয়ে ন্যায়পরায়ণতা বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়। একসময় আইনের আওতায় থাকা কাজটাই বেআইনি রূপে পুনর্জন্ম লাভ করে। এসব তত্ত্বের কচকচানিতে না গিয়ে নিজের কাজটা এগিয়ে নিয়ে যায় হাসিনা। বিশালকে শিকড়ে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে এক সুস্থ জীবন উপহার দেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্তে রাজি করায় তার বাবা মাকে।
মুস্নিয়াং থেকে শিলিগুড়ি হয়ে নেপালের মাইতি গ্রামের জার্নিটা সহজ ছিল না। কিন্তু কোথায় কোন কাঠখড় পোড়াতে হয়, এত বছরে জেনে গেছে ওদের এনজিও। অপেক্ষার সময়টা একই লাগে। কিন্তু “কার কাছে দরবার করব?”, সেই প্রশ্নে আর সময় নষ্ট হয় না। বাবা মার সামনে গাড়িতে ওঠার সময় এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি বিশাল। তার বাবা মাও না। শুধু ধরা গলায় লাক্পা একটা গান ধরল। চোখে জল এসে যাওয়ায় গানটা শেষ করতে পারল না। কিংবা অমন গান হয়ত শেষ করতে নেই।
প্রথমবার টাটা সুমোয় বসে খেই হারিয়ে ফেলেছিল বিশাল। একবার ডান, একবার বাম — জানলা পালটে পালটে তার সে কী আনন্দ! নতুন টি-শার্টের বুকে সুপারম্যানের প্রিন্টটা বার বার দেখতে লাগল। প্যান্টের ওপর জাঙ্গিয়া পরা মানুষ তার জীবনে এই প্রথম। হোটেলে গরম জলের ঝর্ণা, চানের পর চুলে নারকোল তেল, স্টেশন ক্যান্টিনের ডালপুরি, ছুক ছুক শব্দে পাশে এসে দাঁড়ান ট্রেন — নিজেকে হঠাৎ মানুষ বলে মনে হতে লাগল বিশালের। ‘এর ওপর শোবো?’ - প্রশ্নটা করেই বাঙ্কে উঠে লাফালাফি শুরু করে দিল সে। হাসিনা বলল, ‘বাঙ্ক পর কুদোগে তো উসকে সাথ গিরোগে।’ চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বিশাল। একটা সময় অন্ধকার কামরার নীল আলো জ্বলে উঠল। দুটো হাত মাথার ওপর তুলে, হাতুড়ি ঠোকার মতো ট্রেনের সিলিং-এ মারতে লাগল। হাসিনা বাঙ্কের ধারে দাঁড়িয়ে ওর হাতটা মুঠোয় ধরে বলল, ‘হাতুড়ির দিন শেষ। এবার তুলি-কলম।’ সারা রাত বিশালের ঘুম এলো না। ট্রেন দুলছে, ঝিক ঝিক শব্দ করছে, স্টেশনে থামলে কারা যেন ‘চায়ে গরম’ বলে হেঁকে উঠছে — কিন্তু ঝুপড়ির সেই বুনো গন্ধটা কই? ঝিল্লির ডাক? বেতের ফুটো দিয়ে দেখতে পাওয়া রাত আকাশের তারাগুলো? কানের পাশে লাগানো টর্চের আলোয় চিক চিক করে ওঠা কয়লা? বুকের মধ্যে সেই কয়লা চাপা পড়ার ভয়?
মাইতি গ্রামের বোর্ডিংস্কুল দুই দেশের দুই এনজিওর যৌথ উদ্যোগ। ডাবল-ডেকার বিছানা, মোটা কম্বল, সরু চালের ভাত, ছবি ভর্তি বই, ঘরে সমবয়সী আরো পাঁচ — এক দিনেই সেখানে ভালো লেগে গেল বিশালের। হাসিনা মাস্টারমশাইদের অনুরোধ জানাল, ‘সমবয়সীদের থেকে অনেকটা পিছিয়ে। আপনারা সাহায্য করলে মেকআপ করে নেবে।’ বিচ্ছেদের দিন হাসিনার হাতটা সস্নেহে গালে পড়তেই চোখ উপচে জল এলো বিশালের। ফেরার পথে গাড়ির কাঁচে মাথা হেলিয়ে রাখা হাসিনাকে আভা বলল, ‘কাছের কেউ দূরে গেলে কাঁদতে হয়, অন্তরের এই শিক্ষাটা মেকআপ হয়ে গেল, দিদি।’
সেই বিশাল গায়েব! কথাটা শুনে বিশ্বাস করতে সময় নিল হাসিনা। ছুটে গেল মাইতির হোস্টেলে।
‘গত দুদিন আচরণে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছিলেন?’ হাসিনার প্রশ্নে শিক্ষকরা ঘাড় নাড়লেন। ভুল লোকেদের ভুল প্রশ্ন করলে এরকম ঘাড় নাড়া উত্তরই এসে থাকে।
বিশালের ঘরে ঢুকে এক রুমমেটের পকেটে চকলেটের প্যাকেটটা ঢোকাতেই বুঝল উত্তর বাইরে নয় এই ঘরেই রয়েছে। ‘পড়াশুনো করত না। ছাতে গিয়ে পাঁচিলে উঠে হাঁটত। তিয়ো দেখেরা হামিলাঈ ডর লাগ্যিও। … হোস্টেলে একদিন একটা পাগলা কুকুর ঢুকে পড়েছিল। গণেশজি ভ্যানিশ। একটা চাদর ছুঁড়ে কুকুরটাকে মুড়ে ফেলল বিশাল। তারপর দড়ি দিয়ে মুখটা বেঁধে দিল। … সন্ধ্যে হলেই তাড়াতাড়ি ঘরের আলো নিভিয়ে দিত। আমরা তখনও পড়ছি। ও দুম করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ত। সেই নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে আমাদের সঙ্গে। বার বার বলত এত আলো ভাল্লাগছেনা।’
ঘরে চারটে দ্বিতল খাট। হাসিনা গিয়ে বিশালের বিছানায় চিত হয়ে শুলো। চোখের সামনে ওপরের বাঙ্কের তলাটা। সেখানে কে যেন কালো প্যাস্টেল দিয়ে গাঢ় রং করে রেখেছে। আর জায়গায় জায়গায় স্টিলের গা’টা তোবড়ান। হাতুড়ি ঠোকার দাগ। মুহূর্তে মনের কুয়াশা কেটে গেল।
পানিটাংকি বর্ডার থেকে শিলিগুড়ি ফেরার পথে হাসিনা গম্ভীর হয়ে রয়েছে দেখে মুচকি হেসে প্রশ্ন করল আভা। প্রশ্নের গর্ভেই ছিল উত্তর। ‘দিদি, আপ তো কিন্ডারগার্টেন মেঁ শিক্ষক থে। গোলুমোলু বচ্চোঁ কো ছোড়কর ইয়েহ খতরনাক কাম কিঁউ? পাচারকারী মাফিয়া, নির্লিপ্ত প্রশাসন, নিলাম হয়ে যাওয়া নেতা; ভয় করে না?’
‘করে। হাজার বার পোড়াই, বারবার ফিনিক্সের মতো ছাই ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ায় সেই ভয়। কিন্তু ভয়টাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ভয়কে ভালোবেসে ফেলাটাই বোধহয় সবচেয়ে ভয়ের।’ আকাশের লাল আবীর মুখে মেখে বলল হাসিনা। মনের মধ্যে ভাসছে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের সেই বুনো ফুলের গাছটা। বড় বড় গাছে ঘেরা ঘাসের চাদরে আলো করে ফুটে ছিল মাটির কাছাকাছি। তুলে এনে ওদের এপার্টমেন্টের এক চিলতে ব্যাল্কনির টবে পুঁতেছিল হাসিনা। গাছটা হাসেনি। গাছটা বাঁচেনি। কারণ গাছটার পা ছিল না। বিশাল আর গাছটার মধ্যে হয়ত এটাই একমাত্র তফাৎ।