পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

হরিপদ এবং রাগ

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 205 view(s)
  • লিখেছেন : শ্যামলী আচার্য
“সূর্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, শুনেছিস?” “অ্যাঁ! সে কি রে! কে করল?” “আরে যে করেছে সে কী সুস্থ?” “ভাই, এই গরমে একটা সুস্থ লোকের নাম বল। আর পারা যাচ্ছে না।”

সকাল সাড়ে সাতটায় চায়ের দোকানে এমন আলোচনা কানে আসে।     

হরিপদ এই সময় চরম ব্যস্ত। সকালে যারা হাঁটতে বেরোয়, তারা যাবার পথে এবং ফেরার রাস্তায় ওর কাছে আসে। ফলে ওর দ্রুত হাত চালাতে হয়।

       একটা দুধ দিয়ে, একটা দুধ ছাড়া চিনি সহ, একটা আদা দিয়ে লাল চা, একটা দুধ চিনি ছাড়া প্লেন... সব মনে রাখা এবং হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া। কারও ভাঁড়, কারও কাচের গ্লাস, কেউ কাগজের কাপ। অবিশ্বাস্য গতি। দ্রুত বদলে নেওয়া।

       এই সময়ে খবরের কাগজ পড়ার লোক প্রচুর। তাঁরা কাগজ পড়তে পড়তে দেশের হালচাল নিয়ে গম্ভীর আলোচনা করে, তর্ক করে, হরিপদ সব শোনে। নিজের অবস্থানগত একটা তুলনাও করে মনে মনে। 

       দেশ বিদেশ পাড়া পাশের বাড়ি এমনকি মঙ্গলগ্রহের কিংবা চাঁদে যাওয়ার পথ নিয়ে এখানে প্রতিদিন গুরুগম্ভীর আলোচনা। টি-টুয়েন্টি ম্যাচের মাঠ নির্বাচন থেকে ইউরো কাপের নেদারল্যাণ্ড টিমের ফুটবলার নির্বাচন এখানে অক্লেশে হয়। হরিপদ সব কানে নেয় এবং নির্ভুল মনে রাখে।

       হরিপদ’র পাকা মাথা। সে কিচ্ছু ভোলে না। একবার যা শুনবে, একবার যা পড়বে, সব সে ছবির মতো পর পর সাজিয়ে রাখে মাথার মধ্যে। ছেলেবেলা এই স্মৃতিশক্তির জোরে সে ক্লাসে উঠে দাঁড়িয়ে সব পড়া গড়গড় করে বলে দিত। কিন্তু লেখার সময় সব তালগোল। এমন হয় এক-এক জনের। বীরেনবাবু বলেছিল। বীরেনবাবু মাস্টারমশাই মানুষ। সব জানে। সে বলেছিল, ‘তোমার মধ্যে গ্রে ম্যাটার বেশি, কিন্তু প্রয়োগ করতে পারছ না। দক্ষতা, মানে স্কিল তৈরি হয় প্র্যাকটিস থেকে।’ আরও কী কী সব বলেছিল। হরিপদ শুনেছে কিন্তু মানে বোঝেনি বলে মনে রাখেনি।

       আজকাল মনে রাখতে রাখতে খুব রাগ পেয়ে বসছে হরিপদকে। দেখুন, আপনাদের মনে হতে পারে, হরিপদ’র রাগ হচ্ছে তাতে আমার-আপনার কী? হ্যাঁ ঠিকই। হরিপদ হল হরিপদ। চায়ের দোকানে চা বানায়, ফুটপাথে দোকান। ভাঙাচোরা বাঁশ দরমা টিনের ঠেকনা দেওয়া এক চিলতে সংস্থান। একটু দূরের বস্তিতে তার ছোট্ট সংসার। বুড়ো হয়ে যাওয়া মা ঘর পাহারায়, বউ উঁচু ফ্ল্যাটে বাসন মাজতে যায়, ছোট ছেলেটা কর্পোরেশনের ইস্কুলে পড়ে, আর বড় হয়ে যাওয়া মেয়েটা পড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরের কাজে হাত লাগায়, অবসরে হাত আয়নায় নিজের মুখ দেখে। ইলেকট্রিকের কাজ জানা ভোম্বল ওকে সাইকেলে বসিয়ে একদিন অনেকদূর নিয়ে গিয়েছিল। ভোম্বলের মুখে ‘আই লাভ ইউ’ শুনে ওর গা শিরশির করে। চুমু খাওয়া হয়নি বলে দুজনেরই শরীর আনচান করছে। সিনেমাহলের অন্ধকারে ঘন হয়ে বসতে যতটা পয়সা লাগে, সেটা আপাতত ওদের হাতে নেই। কিন্তু আপনারা জানেন, এসব কাজে খুব একটা সময় লাগে না, শুধু একটু ফুরসত আর ঝুপসি অন্ধকার পেলেই হল।

       হরিপদ সব জানে। আর রেগে যায়। ভেবেছিল মেয়েটা ভাল করে পড়বে, লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কেবল লিপিস্টিক ঘষে, নোখপালিশ লাগায়। সাজুনি আর ঢলানি হাবভাব। গরিবের ঘরে এসব বিলাসিতা পোষায়?

       মেয়ে পালটা মুখঝামটা দেয়।

       “ইঃ ইল্লি আর কি! একটা মুবাইল কিনে দ্যাও, তারপর ওই পড়ালিখা করব’খানে।”

       “মুবাইল কীসে লাগবে তোর?”

       “আহা! সব তো অ্যাকন অনলাইন। মুবাইল ছাড়া ইস্কুলে পড়া হয় না।”

       হরিপদ নির্বিরোধী। চুপ করে যায়। ওর আর ওর বউয়ের দুটো টেপা ফোন। একটা লাল, একটা কালো। শুধু ফোন করে আর ফোন ধরে। কাজের কথা। ওর মধ্যে আর কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই। মাস ফুরনোর আগেই ফোনের পয়সা ফুরিয়ে যায়। তখন ফোন এলে ধরে। মেয়ের ওসব সস্তা ফোনে চলবে না। তার বড় ফোন চাই। ছবিছাবা দেখা যাবে। 

       কিন্তু ওর খুব রাগ হয়।

       রাগ হয় সবজিওলার ওপর। বলে কিনা বেগুন একশো টাকা কিলো। মরণ! দুটো বেগুন একটু পুড়িয়ে কাঁচা তেল আর কাঁচা প্যাঁজ মেখে জুত করে সবাই মিলে একথালা ভাত খাওয়া যেত...। সে-ও নাকি ছোঁয়া যাবে না! হলদে হয়ে যাওয়া পাকা পটলও তিরিশ টাকার নিচে দেবে না। শাক ডাল আনাজ কারও দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সামান্য আলু, তা-ও সোনার মতো দাম। মগের মুল্লুক পেয়েছে সব। রাগের চোটে বেলা সাড়ে বারোটার সময় খানিক কলমীশাক আর শুটকো রাঙা আলু নিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। ঘরে এসে দেখে ছেলেটা কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে। ঠোঁটের কোন দিয়ে লালা গড়িয়ে তেলচিটে বালিশ ভিজছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখে গা গরম। আজও ইস্কুল কামাই।

       ছেলেটার মাথা ভাল। কিন্তু বড় দুর্বল। খুব ভোগে। আগে চিন্তা হ’ত। এখন রাগ হয়। সকলের ছেলেপুলে হাট্টাকাট্টা সুস্থ। শুধু ওর ছেলেটাই ভুগছে।

       সুরমা ফিরল। চার বাড়ি বাসন মাজে। একবাড়িতে ঘর মোছে। লাঠির ডগায় ভিজে ন্যাতা দিয়ে বুলিয়ে নেওয়া। তেমন খাটনি নয়। কিন্তু বাসনে হ্যাপা আছে। এখন সব কাচের। একটা ভাঙলেই চরম ঝামেলা। বউদিদের সেটের বাসন নষ্ট হলে চিল্লিয়ে পাড়া মাথায় করবে। আজও তেমন একটা ঝামেলার দিন। চায়ের পটের ঢাকনা ভেঙেছে। ইস্টিলের কলের গায়ে ঠোকা লাগলে ভাঙবে তো বটেই। আর সুরমা কি ইচ্ছে করে ভেঙেছে নাকি! হড়হড়ে সাবানে হাতটা পিছলে গেল বলেই তো। মেজাজ খিঁচড়ে সুরমা ঘরে এসে দেখে কলমীশাক আর মিষ্টি আলু রাখা। তার কান্না পায়। আর হরিপদর রাগ।

       হরিপদর মা কেবল অভিযোগ করে। চোখে ছানি, রাতে সব ঝাপসা লাগে। ইদিকে হাঁপের টান আর বাতের ব্যথা দুটো নিয়ে জেরবার। “বিনে চিকিচ্ছেতেই তোরা আমারে মেরে ফেলবি বাবা!” এই একটি বাক্য শুনলে আগে অপরাধবোধ হোত। এখন ...। 

       হরিপদ ক্রমশ আরও রেগে যায়। এসব হচ্ছেটা কী! কাঠফাটা চড়া রোদ্দুর খাঁ খাঁ করছে, একফোঁটা বৃষ্টির দেখা নেই, বাজারে সবজির আকাশছোঁওয়া দাম, মেয়েকে গুচ্ছের টাকা দিয়ে দামি ফোন না কিনে দিলে সে গলায় দড়ি দেবার হুমকি দিচ্ছে, মায়ের কেবল অসুখ নিয়ে ঘ্যানঘ্যান, ছেলেটা ভোগে আর ইস্কুল কামাই করে, বউ বাসন ধোয় আর বড়লোকের বাসন ভাঙে বলে মুখনাড়া খায়। এদিকে কারা সব চাঁদে চলে গেল। কোন বড়লোকের ছেলেমেয়ের বিয়েতে কোটি টাকা দিয়ে সোনা-হিরে-জহরতের জামাকাপড় বানানো হল। কাদের বাড়ির টালি ভেঙে পুলিশ ঝুরঝুর করে টাকা বের করতে লাগল। মন্ত্রী-সান্ত্রীরা জেলে যায়, জেল থেকে ফেরে। কোথায় হাসপাতালে মরে গেল একটা মেয়ে-ডাক্তার। তাই নিয়ে দিনরাত মিছিল। চেঁচামেচি। হরিপদ চা বানায় আর গল্প শোনে।

       “এই অন্যায় আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না, বুঝলেন?” হরিপদ বলে। ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করে বলে, কেউ বুঝতে পারে না। কিন্তু সকলেই ধরে নেয়, তাকেই বলা হচ্ছে।

       “ঠিক বলেছ হরিপদ, এর বিরুদ্ধে একটা জনমত গড়ে তোলা দরকার।”

       “যা-ই বলো হরিপদ, মেনে নিতে নিতে আমাদের শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে।”

       “শোনো হরিপদ, আমরা বিক্রি হয়ে গেছি বিক্রি, বুঝলে?”

       “দেশটা ছারখার হয়ে গেল, এত দুর্নীতি, এত ঘুষ... দূর দূর।”

       “এত বেনিয়ম চলছে, কারও কোনও হেলদোল দেখছ?”

       “পচে গেছে, সব পচে গেছে... পুরো সিস্টেমে ঘুণ ধরে গেছে।”

       “অথচ ভোটের সময় দেখো, ঠিক পাঁচশো টাকা গুঁজে দেব, দু-দিনের খোরাকি।”

       “কে জিতল আর কে জেলে গেল, তাতে তোমার-আমার কী?”

       বিভিন্ন কথা ভেসে আসে।

       হরিপদ শুনতে পায় কে বা কারা বিধবা মা’কে বাড়িছাড়া করেছে। নিজের ছেলেরাই করেছে বোধহয়। ছেলেরা এখানে আছে তাই বাড়ির লোভে বাড়িছাড়া করল, বিদেশে থাকলে বুড়ো বাপ-মায়ের খোঁজ নিত না। হরেদরে সব এক। হরিপদর মা শুধুমুদু গোঙায়। কোন সুপুত্তুর তার বাপ-মাকে ভাল রেখেছে দেখাক দিকি একবার।ওরা তো তবু মাকে দু’বেলা দুমুঠো খাওয়াচ্ছে। কোবরেজি তেল এনে বুকে পিঠে মালিশ করছে। ছানি কাটানোর ক্যাম্প হলেই নিয়ে যাবে এবার। লোকে নিজের আলিশান আস্ত বসতবাড়ি ভেঙে সব পায়রার খুপরির মতো ফেলাট বানিয়ে আরামে থাকে, আর হরিপদর বউ-ছেলে-মেয়ে বস্তিতে দেড়খানা ঘরে ঠাঁই হচ্ছে না বলে নিত্য গঞ্জনা।সান্যালদা গোমড়ামুখে চা খায়, হরিপদ বেশ জানে ওর একটাই মেয়ে এক্কেবারে বখে গেছে। কলেজ পড়তে পড়তেই মদ-গাঁজা-সিগারেট, চরম বেয়াড়াপনা করে, কারও কথা শোনে না। এখন বলছে মডেলিং করবে। অতবড় দামড়া মেয়ে সেই কোন বাচ্চাবেলার জামা পরে রাতদুপুরে বাড়ি ফেরে। হরিপদ মনে মনে ভাবে তার মেয়েটা এর চেয়ে কী এমন খারাপ? শুধু তো একটা বড় ফোন চাইছে... আর ছুটকো প্রেম করে একটা। সে আর কে না করে? ওই ভোম্বল ছেলেটাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে কাজকারবার করতে বলে ওর সঙ্গেই পরে বিয়ে দেবে নাহয়। ওই বিশ্বাসদার মেয়ের মতো পালিয়ে বিয়ে করার চেয়ে তো ভাল। পবিত্রবাবু রোজ চা খেতে আসে আর বলে ছেলেটা কিচ্ছু পড়ে না। ইস্কুলে মাস্টাররা পড়ায় না। গুচ্ছের টাকা দিয়ে টিউশনি ক্লাসে পাঠাতে হয়। সেখানেও ফাঁকিবাজি। মন্টির বাবা বলে গেল বিদেশে পড়ানোর জন্য ব্যাংক ধার দিচ্ছে না, বাড়িঘরের কাগজপত্তর জমা রাখতে বলেছে। অনির দাদু বলছে, পড়াশুনো মানেই জলের মতো টাকা খরচ। ইঞ্জিনিয়ার বানাতে খরচ, ডাক্তার বানাতে খরচ, পড়তে খরচ, পড়াতে খরচ, পাশ করতে খরচ। 

হরিপদ ভুরু কুঁচকে শোনে। তার ছেলের ইস্কুলটা ঢের ঢের ভাল। দুপুরে ভাত দেয়, সেদিন সাইকেল দিল, বইপত্তর ফ্রি। মাস্টাররা ডেকে সব বুঝিয়ে দেয়। গুপ্তবাবুর ছেলের চাকরি গেছে। চেঁচামেচি করছিলেন খুব। আট ঘন্টার নামে বারো ঘন্টা আটকে রাখে, গাধার মতো খাটায়, ছেলের বউয়ের কোম্পানি আরও এককাঠি সরেস। ছুটি নিলেই ঝাড়। প্রোমোশান আটকে দিতে তুচ্ছ অজুহাত যথেষ্ট। তারা ঘাড় গুঁজে দিনরাত টাকা কামাচ্ছে।

হরিপদ শুনতে শুনতে ভাবে, তার মানে সে খুব একটা খারাপ নেই।

সবজি বাজারে আগুনের মতো দাম হলে সে বরং নুন লঙ্কা ডলে কচুসেদ্ধ মেখে নেবে। মোটা চালের ভাতটুকু জুটলেই হল। ছেলেটার ইস্কুলের মাস্টাররা বাড়িতে ডেকে দু’চারদিন পড়া বুঝিয়ে দেয়। কই টাকা তো চায় না। জানে, মাথা ভাল, কিন্তু রুগণ ছেলেটার বাপ গরিব। পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ে নিয়ে বখেড়া কার ঘরে নেই? আর বউয়ের কাজ? এক বাড়ি কাজ ছাড়িয়ে দিলে দশ বাড়ি হাঁকডাক করে। আরে বাপু, সৎ মানুষ আর খাটিয়ে মানুষের কাজের অভাব?

হরিপদ’র ক্রমশ রাগ কমে যায়।

যেদিন পুলিশ এসে নোটিস ধরায়, রাস্তা চওড়া হবে, ফুটপাথে আর দোকান করা যাবে না, সেদিনও হরিপদ রেগে যায় না।

সকালেই শুনছিল চৌধুরীবাবুকে প্রোমোটার এসে হুমকি দিয়ে গেছে, বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। কানাঘুষো শুনছে, ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের হাত আছে ওই বাড়ি দখলে। হরিপদ’র তো একচিলতে দোকান। সাইকেল ভ্যানে চড়িয়ে স্যাট করে সব ঘরে নিয়ে যাবে। ওইসব রাস্তা ফুটপাথ হিসেব মিটে গেলে লোকাল থানা আর পার্টি অফিসে কাকে কত খুচরো দিতে হবে, সব জানে হরিপদ।

বড়লোকেরা এত সহজে নিস্তার পায়? যত বেশি বড়লোক, তত বেশি গুনাগার।

এই প্রথম নিজেকে আর গরিব বলে দুঃখ হ’ল না। রাগটাও কমে যাচ্ছে।

 

0 Comments

Post Comment