পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সংরক্ষণ বনাম কর্তার ভূত ১

  • 13 August, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1074 view(s)
  • লিখেছেন : নির্মাল্য দাশগুপ্ত
বাংলাদেশে সংরক্ষণ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরে, এই দেশের সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয়েছে বিতর্ক, বাংলাদেশ পারলে, আমাদের দেশে হবে না কেন। আরজিকর হাসপাতালের নৃশংস ঘটনাতেও কেউ কেউ সংরক্ষণের বিষয়টিকে সামনে এনেছেন। এই সংরক্ষণ নিয়ে বহু মানুষের বহু ভুল ধারণা আছে, সেই সমস্ত বিতর্ককে তিন পর্বে ধরার চেষ্টা করলেন নির্মাল্য দাশগুপ্ত। আজ প্রথম পর্ব।

বাংলাদেশে কোটা অবলুপ্ত হবার পর, ভারতে সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘বাংলাদেশ পারল, আমরা কবে পারব’, ‘সংরক্ষণের জন্য মেধার অবনমন হচ্ছে, দেশ রসাতলে যাচ্ছে’, বা কাল্পনিক অঙ্কুর মাণ্ডির গল্প ঘুরে বেড়াচ্ছে নতুন করে। এবার যারা সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার ভাবে সংরক্ষণের বিরোধী, তাঁরাও জানেন, সংরক্ষণ ব্যাপারটা এমন ভারতীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এমন জায়গায় গেছে, এটা এখন কোন রাজনৈতিক দলের সাধ্য নেই এটা তোলার। ফলে রাজনৈতিক ভাবে রাস্তায় নেমে হচ্ছে, তা সংরক্ষণ তোলার জন্য নয়, হচ্ছে নতুন করে সংরক্ষণ পাবার জন্য, যেমন জাঠ, প্যাটেল বা মারাঠারা তাদের জন্য সংরক্ষণ চায়। আর এই মনে হলেই, নিজেকে অন্যান্য অনগ্রসর জাতি (OBC) হিসেবে সংরক্ষণ চাইবার দাবী, এর কুফল অবশ্যই আছে। কারণ, নব্যদের সংরক্ষণের ফলে ঐতিহাসিক ভাবে OBC-র অন্তর্ভুক্ত জাতিদের সুযোগ কমে, আর অসংরক্ষিত জনগণের মনে সংরক্ষণ একটি ভুয়ো ব্যাবস্থা বলেই প্রতিভাত হয়। সংরক্ষণের বিরোধীদের সঙ্গে কথা বললে, অনেকগুলো মত, কখনো সেগুলো পরস্পর বিরোধীও, শোনা যায়। এঁদের সবাই যে প্রকট জাতিবিদ্বেষী তা নয়, অনেকেই দেখেছি সহমর্মী। আবার কেউ অবচেতনে জাতিবিদ্বেষী, বিশেষ ক্ষেত্রে ফুটে ওঠে। যেমন, সেদিন একজন তথাকথিত প্রগতিশীল, মহাপণ্ডিত কুলীন ব্রাহ্মণ এবং প্রকাশ্যে তীব্র বিজেপি-বিরোধী ব্যক্তিকে দেখলাম, এত ঘনঘন রেল দুর্ঘটনার পেছনে তাঁর মতে, প্রাথমিক কারণ হল কোটায় অদক্ষ লোকেদের নিযুক্তি। সামগ্রিক ভাবে গত কুড়ি বছরে বহু বাদানুবাদে জড়িয়ে আমার মনে হয়েছে, সংরক্ষণ বিরোধীরা প্রায় সবাই ‘ইকুয়ালিটি’-র পক্ষে, উল্টোদিকে সংরক্ষণের সমর্থকরা ‘ইকুইয়িটি’-র পক্ষে। এদুটোর বাংলা পরিভাষা আপাতত করছিনা, জটিলতা বাড়বে বলে। ‘ইকুয়ালিটি’-র সমর্থকরা মনে করেন, সবাই এক জায়গা থেকে শুরু করছে, তাই সবার সমান সুযোগ পাওয়া উচিৎ, উল্টোদিকে ‘ইকুইয়িটি’-র পক্ষের লোকেরা মনে করেন, সবাই এক জায়গা থেকে শুরু করছেনা, ফলে যারা পিছিয়ে আছে, তাদেরকে বেশী সুযোগ দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, তারপর ‘ইকুয়ালিটি’ কথা বলা যাবে। তৃতীয় একটি মত আছে, যে পঁচাত্তর বছরের ‘ইকুয়িটি’র সুযোগ কি যথেষ্ট নয়, যদি স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর যথেষ্ট না হয়, তাহলে কত বছর লাগবে, ইকুয়ালিটির জন্য? এবার এই তিন ধরণের মতামতেরই নিজস্ব অনুধাবন আছ ও যুক্তি আছে, সবার যে বড় কথা নিজস্ব স্বার্থও আছে, যেটা এক্ষেত্রে রাশিবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা যায় Confounding Effect। ফলে, সংরক্ষণকে সম্যকভাবে বিচার করতে গেলে, আমাদের নিজস্ব অনুধাবন ও উপলব্ধির বদলে তথ্য ও পরিসংখ্যানের দিকে মূল দৃষ্টি দিতে হবে, নৈব্যক্তিক ভাবে। প্রথম দলের মধ্যে, স্ববিরোধও দেখা যায় অনেকের। যেমন, তাঁরা মেধার অবনমন হিসেবে সংরক্ষণের তীব্র বিরোধী, কিন্তু তাঁরাই আবার আর্থসামাজিকের বদলে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে সংরক্ষণের কথা বলেন। তখন মেধার কথা তাঁরা বেমালুম ভুলে মেরে দেন! প্রথম দলের কেউ আবার ‘আমি ৬০% নম্বর পেয়ে অমুক কোর্সে পেলামনা, অমুক খালি কোটার জোরে ৫০% পেয়ে সুযোগ পেয়ে গেল’! বলে বিলাপ করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সংরক্ষণ না থাকলেও ৬০% পেয়েও সে সুযোগ পেত কিনা, কারণ অসংরক্ষিত ক্ষেত্রে হয়তো কাট-অফ হত ৬৫%, বা তার আগে হয়তো হাজার খানেক ছাত্রছাত্রী আছে, সেটা তার বিবেচ্য নয়, আমি পেলাম না, ও কেন পেল, সেটাই তার বিলাপের কারণ, ক্ষোভের কারণ। এবার এগুলো সরাসরি তাঁদের ব্যক্তিগত হতাশার জায়গা, সেগুলো নিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কান্নাকাটি করতে পারেন, পরস্পরকে সান্ত্বনা দিতে পারেন, রাগ দেখাতে পারেন,  কিন্তু সেগুলো ঠিক যুক্তিতর্কের ব্যাপার নয়। এই আলোচনায় আমরা চেষ্টা করব তথ্যের ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সংরক্ষণ বিরোধীদের প্রচলিত মতগুলোকে আলোচনা করতে। সেখানে কী উচিৎ, অনুচিত ইত্যাদি নিয়ে নিজের মত চাপানো কোন অর্থ নেই, কারণ ঔচিত্য, ন্যায়বুদ্ধি ব্যক্তি বিশেষে বদলায়, আর ব্যক্তিগত স্বার্থও যেহেতু থাকে।

 

সংরক্ষণ কী সবর্ণদের চাকরি পাবার ক্ষেত্রে বাধা স্বরূপ?

কেউ সরাসরি বলেন, আমি উচ্চবর্ণ, সংরক্ষণ থাকায় আমার সুযোগ কমে যাচ্ছে, আমি সেজন্যে বিরোধী। এটা সরাসরি কথা, সৎ ভাষণ। দেশের দুর্গতি, মেধার অবনমন ইত্যাদি মোড়কে বলা নেই। কিন্তু যদি অঙ্ক কষা হয়, তাহলে দেখা যাবে আসলে সংরক্ষিত ও অসংরক্ষিতের মধ্যে প্রতিযোগিতায় চাকরি পাবার সম্ভাবনায় খুব সামান্যই ফারাক থাকে, সংরক্ষণ জেনারেলদের পেটে লাথি মারছে, সেরকম নয়। এর কারণ চাকরি সীমিত, তাই গাণিতিক সম্ভাবনায় (Probability) কারোরই খুব বেশী সুযোগ নেই, তাই বিরাট কিছু ফারাকও হয়না। আবার চাকরির প্রাচুর্য্য থাকলে এই ক্ষোভ তৈরিও হতনা। সংরক্ষণের ফলে ST/SC/OBC প্রচুর সুযোগ পাচ্ছে এটা একটা পারসেপশান বা ব্যোমকেশ বক্সীর ভাষায় ‘ধোঁকার টাটি’! কেন? আমাদের মন দিয়ে অঙ্কটা বুঝতে হবে। একটু বিরক্তিকর, কিন্তু না কষলে ব্যাপারটা বোঝা যাবেনা।

ধরা যাক, ক’দিন আগেই উত্তরপ্রদেশে ৬০,২৪৪ কনস্টেবল পোস্টের জন ৪৮ লাখ আবেদন জমা পড়েছে। এই মুহুর্তে তথ্য নেই, তবে আমরা ধরে নিতে পারি, উত্তর প্রদেশের জাতিবিন্যাস অনুযায়ী এই ক্ষেত্রে কম বেশি আবেদন জমা পড়েছে। তাহলে এই ৪৮ লক্ষের ২৪ লক্ষ হল OBC (৫০%), ১০ লাখ হল তপশিলী জাতি (২০%), আর বাকি ১৪ লাখ অসংরক্ষিত (৩০%)। এবার মধ্যে অসংরক্ষিত ২৪,১০২ আসন আর অর্থনৈতিক দুর্বল উচ্চবর্ণের জন্য ৬,০২৪ আসন। তাহলে উচ্চবর্ণের জন্য রইল ত্রিশ হাজারের মত আসন (২৪,১০২ ৬,০২৪), তাহলে উচ্চবর্ণের প্রার্থীর জন্য কনস্টেবল হবার সম্ভাবনা ২%, অর্থাৎ ১০০ জনে ২ জন উচ্চবর্ণের প্রার্থী এই চাকরি পেতে পারে। OBC-র জন্য রইল নিজেদের ১৬,২৫৪ টা সিট এবং অসংরক্ষিত ২৪,১০২ আসন অর্থাৎ মোট চল্লিশ হাজার মত। তাহলে একজন OBC প্রার্থীর চাকরি পাবার সম্ভাবনা ১.৭% ,  একই হিসেবে একজন তপশিলী জাতির সম্ভাবনা ৩.৭%। অর্থাৎ OBC প্রার্থীর সম্ভাবনা উচ্চবর্ণের প্রার্থীর চেয়ে আসলে কম। আর একজন দলিতের পাবার সম্ভাবনা উচ্চবর্ণের চেয়ে বেশি, যদিও সেটা দ্বিগুণও নয়। অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশে ১০০ জন উচ্চবর্ণের প্রার্থীর মধ্যে ২ জন নির্বাচিত হতে পারে, আর দলিত প্রার্থীর ক্ষেত্রে ৪ জন। কিন্তু অসংরক্ষিত আসন বাদ দিলে, যেখানে কাট-অফ বেশি, সেখানে আসলে দলিতদের সম্ভাবনা মাত্র ১%-র একটু বেশি। এবার যদি সংরক্ষণ উঠে যায়, তাহলে একজন উচ্চবর্ণের প্রার্থীর চাকরি পাবার সম্ভাবনা হবে, ১.২৫% অর্থাৎ সংরক্ষণ থাকলে ২% থেকে নেমে আসছে ১.২৫%-এ। এবার সংরক্ষণ বিরোধীরা বলবেন, কিন্তু মেধাবীরাই এক্ষেত্রে পাবেন, মানে উচ্চবর্ণরাই পাবেন, (কনস্টেবলের চাকরিতে মেধার ভূমিকা আমি জানিনা, তাও ধরে নিচ্ছি কনস্টেবলের চাকরিতেও মেধা অপরিহার্য্য), সেক্ষেত্রেও তাঁদের সম্ভাবনা ২% থেকে মাত্র ৪% বাড়ছে, যদি আমরা সব OBC, তপশিলী জাতি, উপজাতির কেউ পাবেনা ধরেনি। যদিও বাস্তবে সেটা অসম্ভব, এবং তখন কাট-অফও বদলে যাবে। তাও ১০০ জনে ৯৬ জনই ব্যর্থ মনোরথ হয়েই ফিরবে সাধারণ শ্রেণীর। জাতিগত যে অনুপাত ধরে অঙ্কটা দেখালাম, সেটা নিজের মত বাস্তবসম্মত অনুপাতে আবার গণনা করতে পারেন, খুব হেরফের পাবেননা। এই এটা গেল নীচুতলার চাকরির হিসেব, যেখানে নিয়োগের সংখ্যা বেশি, সেখানকার অবস্থা। এবার সর্ব্বোচ্চ চাকরির ক্ষেত্রে যাই, UPSC, আজকাল স্বপ্নের চাকরি, সিনেমা হচ্ছে, সিরিজ হচ্ছে। এ পরীক্ষায় সাফল্যের হার মাত্র ০.০৭৮%, এ বছর ১০১৬ টি পদের জন্য পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখের বেশি। অর্থাৎ, প্রতি হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে কোনক্রমে ১ জন UPSC চক্রবূহ্য ভেদ করবে সংরক্ষণ না থাকলে। ১০১৬-র মধ্যে ৪৬২ জন জেনারেল আর দরিদ্র হিসেবে (৩৪৭ ১১৫) UPSC উত্তীর্ণ হয়েছেন। সেক্ষেত্রে মোট পরীক্ষার্থীর ১৩ লাখের মধ্যে জেনারেল কত তার তথ্য পেলামনা, তবে পুরনো হিসেবে সাড়ে ছলাখ সাধারণ পরীক্ষার্থী ধরলে (২০০৪-৫ সালে আর্দ্ধেক ছিল জেনারেল ক্যাটাগরি), সাফল্যের হার দাঁড়ায় ০.০৭১%। অর্থাৎ, অত্যন্ত নগণ্য ফারাক। এবার সবর্ণরা বলতে পারেন, ওরা বেশি বয়সের সুযোগ পায়, আমরা পাইনা। কিন্তু তাতে মূল চাকুরিপ্রার্থীর সংখ্যার হেরফের না হলে, চাকরি পাবার সম্ভাবনা কিছু বদলাবেনা। খালি ও কেন আমার চেয়ে তিনবার বেশি দিতে পারবে, এই বিলাপটুকু ছাড়া, কোন একটি চাকরির পরীক্ষায় এর চেয়ে বেশি কিছু ব্যত্যয় হবেনা। একটা কথা ভারতের সরকারি চাকরি যাঁরা পেতে চান, তাঁদের মনে রাখতেই হবে, চাকরি আর পরীক্ষার্থীর সংখ্যার মধ্যে এতগুণ ফারাক, যে চাকরির প্রস্তুতি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সংরক্ষণ সব সেখানে সম্ভাবনার অঙ্কে গৌণ হয়ে যায়। তাও এই পরীক্ষাগুলোয়  কোন দুর্নীতি ও বৈষম্য হয়না ধরে নিয়েই অঙ্কগুলো বললাম।

 

SC/ST/OBC কি সব চাকরি খেয়ে নিল?

 

সংরক্ষণ বিরোধীদের এত গেল গেল রবের পরেও, ২০২১ সালে কেন্দ্রের সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া অনুযায়ী তথ্যানুযায়ী, ১৯ টি মন্ত্রকে ১,২৩,১৫৫ কর্মীর ১৫.৩৪% তপশীলি জাতি, ৬.১৮%  তপশীলি উপজাতি আর ১৭.৫% OBC। অর্থাৎ, সংখ্যায় এই তিন শ্রেণীর চেয়ে কম হলেও, উচ্চবর্ণরা ৬০% র বেশি পদ ধরে রেখেছে। খালি তাই নয়, ২০১১ সালের হিসেবে ১৭% তপশীলি জাতি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীর মধ্যে আবার ৬০% ই ছিল সাফাই কর্মী ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী। অর্থাৎ, মধ্যবিত্ত ঘরের উচ্চবর্ণের কাঙ্খিত চাকরিতে দলিতদের উপস্থিতি খুবই কম ১৫%-র ৪০%, অর্থাৎ মাত্র ৬% মোট প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির কর্মী হিসেবে। অথচ এর পরেও কত ক্ষোভ, সব সংরক্ষণ নিয়ে গেল। আমার এক সহপাঠী আছে, যে ব্রাহ্মণ এবং অত্যন্ত সাধারণ রেজাল্টের দিক থেকে। সে নেট ফেলোশিপ ছাড়াই লেকচারসাশিপ পেয়ে পিএইচডি করেছে, সেটাও খুব উচ্চমানের নয়। মানে রেজাল্ট ও গবেষণা দুইয়ের কোনটাতেই তার ‘মেধার’ স্ফুরণ দেখা যায়নি! সে অনেকবার কলেজ সার্ভিস কমিশান দিয়েছে, কিন্তু হয়নি। আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে কলেজ ইউনিভার্সিটি মিলিয়ে ছ’জন সবর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রফেসার বা বিজ্ঞানী হয়েছে, তফশীলী জাতির ও OBC একজন করে। ছয়জন সবর্ণ যে অধ্যাপনা করছে, সেই নিয়ে তার ক্ষোভ নেই, তার ক্ষোভ বাকি দুজন কেন হল! অথচ বাকি দুজনের সামগ্রিক গবেষণার অভিজ্ঞতা ও মান, তার চেয়ে অনেক ভাল। কিন্তু তার মাথায় ঢুকে আছে, সে সংরক্ষণের জন্যেই অধ্যাপনা পেলনা। সব ‘ওরাই’ নিয়ে চলে গেল। এ একা নয়, এরকম বহু লোকই তাদের জীবনে ব্যর্থতার জন্য সংরক্ষণকে দায়ী করে। তাদের জন্য একবার আমরা তাহলে উচ্চশিক্ষায় সবর্ণের প্রতিনিধিত্ব দেখি খতিয়ে।  

 

২০২৩ সালের সংসদে পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, ৪৫ টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে দেখব, ৮৫% প্রফেসার, ৮২% এসোসিয়েট প্রফেসার আর ৫৯% অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসারই সবর্ণ। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৭% প্রফেসারই  সবর্ণ। ৪৫ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮ জন উপাচার্য্যই সবর্ণের। ৮০% র ওপর এসোসিয়েট প্রফেসার, প্রফেসারই, উপাচার্য সবর্ণ, অথচ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় সংরক্ষিত আসনের লোকেদের পদোন্নতিই অনায়াসে হয়। আর সারা ভারতের রাজ্য, কেন্দ্রীয়, বেসরকারি, আধাসরকারী, মুক্ত ইত্যাদি যা যা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেরকম সব মিলিয়ে প্রায় ছয় লাখ অধ্যাপকের মধ্যে SC/ST/OBC মিলিয়ে মাত্র ৩১%। খালি শিক্ষক নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অশিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যেও সবর্ণ ৭০%। এরপর প্রতিনিধিত্বের অভাবের কারণে যদি সংরক্ষিত আসনের জন্য বিজ্ঞাপন বেরোয়, সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিকে ক্ষোভ ঝরে পড়বে, জেনারেলদের জন্য আর কোন চাকরি নেই, সব সংরক্ষিতরা নিয়ে চলে গেল। এবার বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে স্কুলের দিকে তাকালে দেখব, সারা ভারতে ৫৬.৫% শিক্ষক আর ৫৩% অশিক্ষক কর্মচারী অসংরক্ষিত আসনের। অর্থাৎ, কোন চাকরির ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছেনা, যেখানে সংখ্যায় অনেক বেশি হয়েও ও সংরক্ষণ পেয়েও SC/ST/OBC সাধারণ ক্যাটাগরিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। ওপরের প্রতিটি তথ্য কেন্দ্র সরকারের তথ্য। সামান্য খুঁজলেই পেয়ে যাবেন। শুধু তাই না, পাঁচটা প্রথম সারির IIT-র ৯৮% প্রফসার সবর্ণের, ৯০% ওপরে এসোসিয়েট আর এসিস্ট্যান্ট প্রফেসার (2023)। নামজাদা গবেষণা প্রতিষ্ঠান TIFR, IISC, IISER(পুনে) তেও প্রায় একই অবস্থা, বা আরও বেশী। মনে হতে পারে, যেখানে কোটা আছে, সেখানে এরকম কীভাবে হওয়া সম্ভব? তার কারণ, SC/ST/OBC প্রার্থীদের যোগ্যতার প্রতি অবিশ্বাস! ‘যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি’ বলে কাউকে নেওয়া হচ্ছেনা, আর এরকমই চলেছে বছরের পর বছর। এর ফলস্বরূপ, খালি সংরক্ষিত আসনেরই বিজ্ঞাপন বেরোচ্ছে। এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সংরক্ষিত ও অসংরক্ষিত দুদলই; এবং শিক্ষকের অভাবে হয়তো ছাত্রছাত্রীরাও। কারণ যতদিন SC/ST/OBC কোটা পূরণ না হবে, জেনারেলদের জন্য নিয়োগ নতুন করে হবেনা। ইন্টারভিউতে   জাতিবিদ্বেষ যে অত্যন্ত গভীরে সে কথা গত ফ্রেব্রুয়ারী মাসে (২০২৪)  সংসদীয় প্যানেল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যে দেশের IIM, IIT, AIMS র মত প্রতিটি বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানে ইচ্ছাকৃত যোগ্য তপশীলি জাতি উপজাতির লোককে চাকরি দেওয়া হচ্ছেনা; এবং এই প্যানেলে কোন তপশীলি জাতি উপজাতির প্রতিনিধি রাখা হয়না। একই অভিযোগ প্রায়ই ইউপিএসসি ইন্টারভিউর  ক্ষেত্রে শোনা যায়। তপশীলি জাতি উপজাতির ক্ষেত্রে লেখা পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়েও ইন্টারভিউতে কম পেয়ে বাদ গেছে, আবার সবর্ণের ক্ষেত্রে লেখা পরীক্ষায় কম পেয়েও, ইন্টারভিউতে বেশি পেয়ে, সে UPSC উত্তীর্ণ হচ্ছে। এগুলো বহুদিন ধরে  বিভিন্ন দলিত ও আদিবাসী সংগঠন বলে আসছে, তথ্য সহযোগে, কিন্তু তাতে খুব কিছু ফল হয়েছে, তা নয়। তাই, এই অসাম্য ও জাতিবিদ্বেষ আটকাতেও ইন্টারভিউ বোর্ডে তপশীলি জাতি উপজাতির প্রতিনিধির উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয় পর্ব-

সংরক্ষণ বনাম কর্তার ভূত ২

 

তৃতীয় পর্ব-

সংরক্ষণ বনাম কর্তার ভূত ৩

0 Comments

Post Comment