আগের লেখার সূত্র
সংরক্ষণ বনাম কর্তার ভূত ১
আগের লেখা পড়ে, যে কেউ বলতে পারেন, সংরক্ষণে যখন কারোরই আসলে লাভ হচ্ছেনা অঙ্কের নিয়মে, তাহলে এটা রেখে দেবার কারণ কী? তার কারণ, সরকারি নীতি নির্ধারণে প্রতিনিধিত্ব বা প্রাশাসনিক পদে প্রতিনিধিত্ব। যেমন, উত্তর প্রদেশে যখন কোন আদিবাসী বা দলিতের ওপর ব্রাহ্মণ বা ঠাকুরদের দ্বারা কোন অন্যায় হবে, সেটার বিরুদ্ধে অন্তত সামান্য ব্যবস্থাটুকু যাতে নেওয়া যায়, উচ্চবর্ণের চাপে পুরোটাই না ধামাচাপা পড়ে যায়, সেজন্যেই দলিত বা আদিবাসীদের জন্য কিছু সংখ্যক আসন সংরক্ষিত করা দরকার। বা নিয়োগের ক্ষেত্রেও যে জাতিবিদ্বেষ দেখা যাচ্ছে, সেটা আটকাতেই বোঝা যাছে সংরক্ষণ কত দরকার। সংরক্ষণ থেকেও ৯০% ওপর প্রফেসার যদি সবর্ণ হয়, না থাকলে কী হত দিনের আলোর মত পরিষ্কার। একই কথা বাকি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও। বহু লোকের ধারণা সংরক্ষণ একটা দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্প, না দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের জন্য মনরেগা, বিভিন্ন ভাতা ইত্যাদি আছে, সংরক্ষণ কোন দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্প নয়, এটা সমস্ত জাতির প্রতিনিধিত্ব বণ্টন প্রকল্প। উত্তর প্রদেশে ৩০% জেনারেল (মুসলিমদের অধিকাংশ ও হিন্দু উচ্চবর্ণ মিলিয়ে) হলেও বিহারে জাতিগণনা অনুযায়ী কিন্তু জেনারেল মাত্র ১৫%। উত্তরপ্রদেশেরটা ভাগটা সম্মিলিত ধারণা, বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে, প্রকৃত জাতিগণনা হলে জেনারেলের সংখ্যাটা আরও কমতে পারে। সুতরাং, যাঁরা ভাবছেন গ্রুপ ডি থেকে IAS সর্বত্রই তিনি কোটার জন্য সুযোগ হারাচ্ছেন, অঙ্ক সেকথা কিন্তু বলেনা। ILO রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ৯৭ কোটি লোক কর্মক্ষম (১৫-৬৪ বছর বয়সী), সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে সংগঠিত চাকরি ১৫ কোটি। আর এই ১৫ কোটির মধ্যে ১.৪ কোটি মাত্র কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে সরকারি চাকরি, অর্থাৎ সংগঠিত ক্ষেত্রে মাত্র ৯% সরকারি চাকরি, আর তার মধ্যে আর্ধেক ধরলে মাত্র ৪.৫% চাকরি সংরক্ষণের আওতায়, আর ৯১% বেসরকারি ক্ষেত্র সংরক্ষণের বাইরে। তাহলে ৯৫.৫% সংগঠিত ক্ষেত্রের চাকরিই সংরক্ষণের আওতার বাইরে। সব মিলিয়ে কী বোঝা গেল, সংগঠিত ক্ষেত্রে ৯৫.৫% চাকরিতে সংরক্ষণের কোন ভূমিকা নেই, আর অবশিষ্ট ৪.৫% চাকরিতে সংরক্ষণ থাকলেও জেনারেল ক্যাটাগরির চাকরির পথে তা বাধা নয়। সংরক্ষণ বিরোধিতা যদি আসলে নিজেদের অবচেতনে বা সচেতনে জাতিবিদ্বেষ হয়, তবে অঙ্ক করে দেখাবার পরেও, তার অস্তিত্ব থাকবে। মানে কর্তা গেলেও রবীন্দ্রনাথের কথা মত সেই কর্তার ভূতের অস্তিত্ব, যাকে তাড়ানো অসম্ভব।
সংরক্ষণ কি মেধার পথে বাধা?
এবার আসি মেধার প্রসঙ্গে। সংরক্ষণ বিরোধীদের আরেকটি অভিযোগ! ব্যাপারটা বেশ মজার! প্রথমতঃ, মেধা একটা বিমূর্ত জিনিস! এর না কোন সংজ্ঞা আছে, না কোন পরিমাপ। কিন্তু আছে ওই ঈশ্বরের অস্তিত্বের মত। যা প্রমাণও করা যায়না, আবার অপ্রমাণও করা যায়না।আমার এক বন্ধু সারা স্কুল জীবনে একেবারে পেছনের দিকে রেজাল্ট করত, স্কুল জীবনে তাকে কেউ মেধাবী বলবেনা। কিন্তু যেই স্কুল শেষ হল, তার আসল মেধা ফুটে বেরোতে লাগল। ফিল্ম নিয়ে পড়ে সে এখন বিরাট প্রতিষ্ঠানের ফিল্ম এডিটিং-র প্রফেসার। এদিকে আমার যে বন্ধুরা প্রথম দিকে ছিল, বেশ অংক, ফিজিক্স পারত, তারা অনেকেই এখন আইটি সেকটরে দিনগত পাপক্ষয় করছে। তাদের এই কাজকে মেধার পরাকাষ্ঠা বলা যায় কিনা, তাও জানিনা! বা, এই যে সরকারি চাকরি এত, যেগুলো বেশির ভাগই খুবই নিত্যনৈমিত্তিক কাজ, সেগুলোতে মেধার কী উতকর্ষ্যতা প্রয়োজন হয়, আমার জানা নেই! এবার তাও তর্কের খাতিরে ধরে নি, মেধা খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এবং ৪.৫% যে সংরক্ষিত চাকরি, সেই পদগুলিতে যাঁরা আছেন, তাঁরা একেবারেই মেধাহীন!এবারে দ্বিতীয় মজাটা! সংরক্ষণ বিরোধীদের দাবী হল, ৯৫.৫%-র মেধার সব সুফল এই ৪.৫%-র জন্য রসাতলে যাচ্ছে। তাঁদের কথা মত, ৯৫.৫% দুধ, আর ৪.৫% হল লেবুর রস। যা দুধকে ছিন্ন করে ছানা বানিয়ে ফেলছে!কথাটা যেকোন সহজ বুদ্ধির মানুষের কাছে অসম্ভব ও হাস্যকর মনে হবে, কিন্তু সংরক্ষণ বিরোধীদের এটাই মহাসত্য মনে হয়। আমার সঙ্গে দশ জন মত SC/ST/OBC বন্ধুবান্ধবও একই প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি করেছে, যাদের কেউ কেউ প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র পরিবার। তাদের অনেকেই ভাল পেপার করেছে, বিদেশে পোস্টডকে গেছে, ভাল কাজ করেছে, কেউ প্রফেসারি করছে। সবর্ন জাতির স্কলারদের তুলনায় তাদের বিরাট কিছু ফারাক তো দেখিনি! কিন্তু তাও গবেষণার জন্য ফেলোশিপ পাওয়া NET উত্তীর্ণ SC/ST/OBC দের পক্ষে পিএইচডি গাইড পাওয়া মুশকিল হত বা এখনো হয়। আমি জানি, কারণ UPA-2 সরকারের আমলে UGC আমাদের ফেলোশিপ আটকে রেখেছিল, ও কারণ দর্শিয়েছিল, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান SC/ST/OBC অনুপাত পিএইচডি-র ক্ষেত্রে অনুসরণ করছেনা, তাই পিএইচডি স্কলারদের কজন জেনারেল, কজন SC/ST/OBC না জানানো পর্যন্ত ফেলোশিপ পাঠানো হবেনা।
যাই হোক, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে তথ্য দিয়ে মেধার ব্যাপারটা আরেকটু খোলসা করা যাক। সবচেয়ে বেশী ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অ্যামেরিকার আইটি সেক্টরে কর্মরত বললে কাদের কথা মনে পড়ে? তেলেগু। অ্যামেরিকায় এখন সাড়ে বারো লাখ তেলেগু। এরা বেশির ভাগই রাজ্যের ছোটখাটো বা মাঝারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করা! মেধার পরাকাষ্ঠার সর্ব্বোচ্চ মিনার IIT-র গ্রাজুয়েট কমই। এবার অন্ধ্র ও তেলেঙ্গনায় ৬০% আসন কিন্তু সংরক্ষিত। তাহলে দুটি সিদ্ধান্ত করা যায়, হয় আইটি সেক্টরে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতে তেমন কোন মেধা লাগেনা!ফলে ‘মেধা নিয়ে গেল, মেধা নিয়ে গেল’ বলে কাগের পেছনে দৌড়নোর কোন দরকার নেই। আর যদি মেধার প্রয়োজন হয়, তবে মেনে নিতে হবে সংরক্ষণ সেখানে বাধা হচ্ছেনা। এবার আসা যাক চিকিৎসার ক্ষেত্রে। ভারতে বিশেষত বাংলার লোক অসুখ বিশুখে কোথায় দৌড়ায়? তামিলনাড়ুতে। ভারতের স্বাস্থ্যপরিষেবার রাজধানী কাকে বলে? চেন্নাই, তামিলনাড়ু। এদিকে তামিলনাড়ুতে তো ৬৯% ডাক্তারি আসনই সংরক্ষিত। তাঁদের তত্ত্ব অনুযায়ী তো এই 'কোটা'র 'মেধাহীন' ডাক্তাররা চিকিৎসাটা খারাপই করবেন! কিন্তু কেন তবু ভিড় তামিলনাড়ুতে? কেন চেন্নাই হেলথকেয়ার হাব? কেন অঙ্গ প্রতিস্থাপনে তামিলনাড়ু এক নম্বরে? কেন সার্জারির রেটে দেশে এক নম্বর তামিলনাড়ুর ইরোদ? এদিকে ‘মেধাহীন’ চিকিৎসকরা তামিলনাড়ুতে গিজগিজ করছে। পশ্চিমবঙ্গে যেখানে প্রতি ১৬৬৫ জন রোগীর জন্য মাত্র একজন ডাক্তার, তামিলনাড়ুতে প্রতি ২৫৩ জন রোগীর একজন ডাক্তার। আবার দেশের প্রতি আটজন ডাক্তারের একজনই তামিলনাড়ুর। মানে সারা দেশের সব বাঘা বাঘা সবর্ণ ডাক্তাররা আসলে তামিলনাড়ুতে ভিড় করে এত পরিষেবা দিছেন, সেটাও বলা যাবেনা। তো, এই এত গাদা গাদা কোটার ডাক্তার, এঁদের মেধাহীনতার জন্য তো গোটা তামিলনাড়ু রাজ্যের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিষেবাই অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় রসাতলে যাওয়া উচিৎ। তাতো হচ্ছেনা, উল্টে নীতি আয়োগের তথ্য অনুযায়ী সামগ্রিক স্বাথ্যসূচক পরিষেবায় তামিলনাড়ু দ্বিতীয়। তাহলে কী ধরব? হয় ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হতে মেধা লাগেনা, নয় সংরক্ষণ মেধার পথে বাধা নয়। ৬৯% কোটার ডাক্তার যখন সাফল্যের সঙ্গে এত রোগীকে সুস্থ করছেন, তাদের কোটা তাদের কার্য্যক্ষেত্রে যে কোন প্রভাব ফেলছেনা, এতো পরিষ্কার! তাই কোটার জন্য মেধার অবনমনও একটি ধারণা মাত্র, তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ তামিলনাড়ু চিকিৎসককুল ও চিকিৎসা ব্যবস্থা।
পরের লেখা পড়ুন।
সংরক্ষণ বনাম কর্তার ভূত ৩