পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

লাগছে, বুক থেকে ত্রিশূল হটাও

  • 14 October, 2021
  • 2 Comment(s)
  • 1887 view(s)
  • লিখেছেন : সুমিত দাশ
২০১১, পুরুলিয়ায় শুরু হল হুদুর দুর্গা স্মরণ। মহিষাসুরকে হত্যা যে আর্য আগ্রাসনেরই প্রতীক, এই আলোচনায় তা নিয়ে আলোকপাতের প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। বরং, অসুর, রাবন, চণ্ড, মুণ্ড, ডাকিনী, যোগিনী, শুম্ভ, নিশুম্ভদের রূপকের আড়ালে ভারতীয় উপমহাদেশের মূলনিবাসীদের দমনের যে পরম্পরা রচিত হয়েছে - তার বিপ্রতীপে আধুনিক সময়কালে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ নতুন করে জন্ম নিচ্ছে। মহিষাসুর বা হুদুর দুর্গার স্মরণসভার আয়োজন গত ১০ বছরে শুধুই বেড়েছে। লিখলেন সুমিত দাশ

(১)

ফেসবুকের মুক্তাঙ্গনে সেজো মাসিমার খুড়তুতো ননদের ছেলে "শিক্ষায় ও চাকরিতে কোটা নিপাত যাক" - পোস্ট করতেই মুহূর্তে সাতশো লাইক আর তিরিশটা শেয়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের 'বিশ্বাস' প্রফেসার রেগে কাঁই। চণ্ডালপদবীধারী ইতিহাসের নানান পথ বেয়ে ক্ষমতা ও অর্থনীতির মূলধারার নিয়ন্ত্রনে পৌঁছে এই পোস্ট তাকে যন্ত্রণা দেয়। অবশ্য যাদবপুরের অধ্যাপিকা আদিবাসী মেরুনা মুর্মুতে বেজায় আপত্তি।

তিন দশক হতে চলল, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাল্গুনী চক্রবর্তীর রোষানলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন লোধা-শবরদের প্রথম স্নাতক চুনি কোটাল। অসুরের শিক্ষার অধিকার নেই। এই বৈষম্যে আজকাল জেএনইউ থেকে যাদবপুর-প্রেসিডেন্সি স্লোগান তুললেও, ক্লাসরুম থেকে পোর্টিকো হয়ে বাসস্ট্যান্ড বা ফেসবুক,- বুলি থামছে না।

(২)

ভূমধ্যসাগরের পারের বাজারে পণ্য পৌঁছবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সিরাজ-পতনের নক্সা কার্যকরী তো হলও, এবার দরকার উৎপাদন ও বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ। অতএব চিরস্হায়ী বন্দোবস্ত। লোকজ গাজন, মনসা আর পাঁচালির দেশে নয়া উৎসব জরুরি। উচ্চবর্ণীয় জমিদারের জমিদারিত্ব স্হায়ী ও মহিরুহ করতে দরদালানে দূর্গা এলেন বটে। সিরাজের পতনের পথ ধরে চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের পোক্ত মঞ্চে নীলবিদ্রোহও এল। বর্ষায় জমিতে রোয়া ফসল যখন অঘ্রাণে সোনালি হবার অপেক্ষায়, মাঝে আশ্বিণে বাংলার অন্তজ কৃষক ঢাকের বোলে জমিদারের রায়চৌধুরী উপাধী পাবার আকাঙ্খায় তাল জুড়ে দেবে। তীব্র হল উৎসব। দখলের শতক পেরিয়ে, নীলকরের অত্যাচার আর জমিদারের দরদালানে উৎসব-সমারোহ পার করতে করতে আদমসুমারী জানান দেয়, পুণ্ড্রক্ষত্রিয়, রাজবংশী, চণ্ডাল মানে নমশূদ্র থেকে ধর্মান্তরিত হলেন বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। জমিদারী দরদালানে আশ্বিণের উৎসবের আয়োজন বাড়ার সময় বৃহৎ বাংলার মুসলমানদের ৯০ শতাংশই হলেন নতুন, ধর্মান্তরিত। আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ ভাসার দিনে পরম্পরা নির্মাণ হতে হতে, দরদালানের মাটির প্রতিমায় জুড়ে যাচ্ছে সময়ের কল্পনা, পুরাণের গল্পগাছা। পলাশীর যুদ্ধ অর্থাৎ ১৭৫৭ থেকে ২৬৪ বছর পার করে, আশ্বিনের উৎসবে আজো যুক্ত হচ্ছে কল্পনা। আজো সংঘাত আর আগ্রাসনের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে 'পরম্পরা'। যে পরম্পরার, যে অস্মিতার ত্রিশূল কাঁধে বা বুকে নিয়ে দরদালান টপকে বারোয়ারীর 'সর্বজনীন' ট্যাগলাইনেও রক্তাক্ত মৃত্যুপথযাত্রী মূলনিবাসী এক। পুজোর আগে জিম করে ফিটফাট হওয়া খুড়তুতো ননদের ছেলে অসুরের হাতের গুলিতে হাত রেখে সেলফি তোলার দিনেও জানা হবে না, ধমনিতে প্রবাহমান শোনিতকণা কার, অসুরের, নাকি বর্ণশ্রেষ্ঠের? পশুপতি মাতাহোর তথ্য বলছে, ভাঙা বাংলার পশ্চিমভাগে ব্রাহ্মণের সংখ্যা ২.৮ শতাংশ। কুলীন মানে একসময় সন্তান উৎপাদন ও ভৌগলিক দখলদারী বাড়ানোর রীতি টপকে, দেশভাগে পশ্চিমের বাংলায় সিংহভাগ উচ্চবর্ণের আগমনের পরও ২.৮ বা ৩ শতাংশ ব্রাহ্মণ? যথাযথ তথ্যে পৌঁছনো কঠিন। তবু, দরদালান আর সর্বজনীন বারোয়ারীর বুকফোঁড়া কালো পুরুষটির রক্তাক্ত হবার উৎসবে নিষ্ঠায় বিভোর হলেন সেজো কাকিমা। আর উৎসবের দিনগুলিতে ফেসবুকে বা ক্যুইজের আসরে রাজা কংসনারায়ণ, ভাষ্কর পণ্ডিত, মার্কণ্ডেয় পুরানের নাম বলতে পারায় টপাটপ লাইক আর দশে দশ পায় তার খুড়তুতো ননদের ছোট ছেলে।

(৩)

১৮৭১-৭২, প্রথম জনগণনায় জমিদারী সামলানো উচ্চবর্ণের পিণ্ডি চটকে গেল। সিরাজের পতনের পর ভূগোল, উৎপাদন আর অর্থনীতির দখল নিতে গিয়ে চাপানো লোকাচারের ধর্মকাষ্ঠে বিধর্মী হয়েছে বৃহৎ বাংলার বৃহৎ অংশ। বৌদ্ধ বা শূদ্র করণিক ঘোষ, বোস, দত্ত, গুহ, মিত্রদের কায়েত বানিয়েও সংখ্যাধিখ্যের দেখা নেই। ইতিহাসে ধর্মনিয়ন্ত্রিত রাজনীতিতে দেশভাগের আশঙ্কা বোধহয় তখনই শুরু। ১০০ বছর পর পূর্ববঙ্গের মুক্তি যুদ্ধের মাঝে প্রকাণ্ড যতিচিহ্ন হয়ে থাকা ৪৭, মানে দেশভাগ, অগোচরে জানান দেয় - পরম্পরা আর আগ্রাসনের নামে দরদালানের উৎসব আরো বারোয়ারি হতেহতে ধর্মান্তরিত শূদ্র জন্ম দিয়েছে নতুন দেশ। পশ্চিমের বাংলায় সাবেকি আর থিমের প্যাকেজ কনটেস্টের দিনে - তিলতিল করে বাড়ে ঘৃণা। সংখ্যাগুরু ডিজলাইকে বাড়ে পরিজনের লাইক, পূবের বাংলায় সরকারী সাহায্যে দুর্গাপূজার সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০ হাজার ১১৮। সংখ্যালঘু উচ্চবর্ণের সঙ্গে উৎসব ও পরিচিতি আঁকড়ে থাকে নিম্নবর্ণ। সাম্প্রদায়িকতার ভরা বাজারে দাঙ্গার ফিকির খোঁজে কেউকেউ। জমিদারের শাসন উপকরণ ততদিনে সে রাষ্ট্রের 'সংখ্যালঘু সনাতনী' প্রতীক। তখনও, ত্রিশূলের মুখ চামরা- পেশি ভেদ করে গভীরে নামতে থাকে। গভীরে, আরো আরো গভীরে পশ্চিমের জঙ্গলে, নগরপ্রান্তে ক্রমেই বাড়ে অসুরের স্মরণানুষ্ঠান। নাগরিক বাঙালি হিন্দুর উৎসব ফুরানোর আকুতির দিনে দাশাই নাচ থামিয়ে পরের বছরের নতুন কেন্দ্র খোঁজায় মন দেন আদিবাসী সমাজের মাথারা। সিরাজের পতনের ২৬৪ বছরের মাথায় পশ্চিমের বাংলায় এই আয়োজনের বয়স মাত্র এক দশক।

(৪)

২০১১, পুরুলিয়ায় শুরু হল হুদুর দুর্গা স্মরণ। মহিষাসুরকে হত্যা যে আর্য আগ্রাসনেরই প্রতীক, এই আলোচনায় তা নিয়ে আলোকপাতের প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। বরং, অসুর, রাবন, চণ্ড, মুণ্ড, ডাকিনী, যোগিনী, শুম্ভ, নিশুম্ভদের রূপকের আড়ালে ভারতীয় উপমহাদেশের মূলনিবাসীদের দমনের যে পরম্পরা রচিত হয়েছে - তার বিপ্রতীপে আধুনিক সময়কালে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ নতুন করে জন্ম নিচ্ছে। মহিষাসুর বা হুদুর দুর্গার স্মরণসভার আয়োজন গত ১০ বছরে শুধুই বেড়েছে। অসুর পদবীর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অপমান, আলোকোজ্জ্বল উৎসবের উল্টোদিকে তাদের পারম্পরিক অপমানের গল্প আলোকপ্রাপ্তরা জানেন বৈকি! শুধু বুক থেকে ত্রিশূল সরানোর দাবি ওঠেনা!

২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সে বছর ৩৫০০-র বেশি স্মরণসভা আয়োজন হয়েছিল। এই ৩ বছরে আরো হাজার দেড়েক বেড়েছে বলে কারো কারো অনুমান। তবে, দিন কয়েক গেলে মোটামুটি সঠিক সংখ্যা পাওয়া সম্ভব।

(৫)

জীবনধারার লোকজ সংস্কৃতিতে আদিবাসী সমাজ স্বাভাবিক প্রকৃতিসাধক। ব্রতে সার্বিক মানবসভ্যতার মঙ্গলকামনার প্রবাহ। জঙ্গল কেটে নগরসভ্যতা নির্মাণের রূপকও ত্রিশূল হয়ে বুক চেপে ধরে হুদুর দুর্গার। শাসকের ইচ্ছায় গাছকাটা হলে শোকে মুহ্যমান হয় যে জনগোষ্ঠী, তাদের সংখ্যা কত? ২০১৯-এ শেষ লোকসভা জিতে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এককোটি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হিন্দুত্বের সরকার নয়া আদমসুমারীর দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে নানান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রকাশে নারাজ। কল্যাণকারী রাষ্ট্রে কোন জাতি পরিচিতির সংখ্যা কত, তাদের জীবন যাত্রার মান কী রকম, আগ্রাসনবাদী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পরিচিতির বাইরে তাদের বিশ্বাস ও যাপন কোথায় কতটা আক্রান্ত - হুদুর দুর্গার স্মরণসভায় যুক্ত হচ্ছে এসব বিষয়ও। নাগরিকপুঞ্জি, এনপিআর আলোচ্য হয়ে উঠছে। আদিবাসী সাঁওতাল, কুর্মি, মুণ্ডা মায় খেরোয়াল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন দলিতরা। শহর কলকাতার প্রান্তে গড়িয়ায় হুদুর দুর্গার স্মরণসভা আয়োজক করছেন পুণ্ড্রক্ষত্রিয়রা। এক দশকে লোকাচার, পরম্পরার নামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোরদার হচ্ছে অসুরের বয়ান। ৯০ বছর পর জনজাতির জনসংখ্যা প্রকাশের দাবি করা তপসিলি জাতি, উপজাতি ও ৫২ শতাংশের অন্যান অনগ্রসর শ্রেণির নাগরিক জানতে চান তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্হান। কল্যাণকারী রাষ্ট্রের কাছে এ এক সহজ সরল দাবি।

(৬)

শেষমেষ এ লেখা প্রকাশ হতে হতে আসন্ন নবমী নিশি। 'আপার' বা 'জেলারেল কাস্ট'- এর পরিচিতিতে বেঁচেবর্তে থাকা লোকজন বিষন্ন হবেন। চাকরি, শিক্ষায় কোটা বন্ধের দাবিতে লাইক, শেয়ারে মেতে ওঠার আগে কেউকেউ ঘুরে আসবেন বুর্জ খলিফা বা কৃষি আন্দোলনের প্যান্ডেল। বিচিত্র বাংলার অঙ্গে অঙ্গে জন্ম নেবে আস্ত একটা 'আসছে বছর'। পরের বছর হুদুর দুর্গার স্মরণসভা আরো বাড়বে। দাশাই বা ভুরুং নাচের ছন্দে মিশে যাবে লালমাটি, কংক্রিট, পিচ। আসছে আদমসুমারী। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন নামক প্রাতিষ্টানিক ধর্ম পরিচিতির আড়ালে দাবিয়ে রাখা হবে অসুরের আর্তনাদ - "ত্রিশূল তোলো, লাগছে। হাজার হাজার বছর ধরে লাগছে।" নাকি, সংখ্যা প্রকাশের দাবি ছিনিয়ে আনতে পারবে বহু পরিচিতি, বহু সংস্কৃতির ভূমি? বুক থেকে ত্রিশূল সরানোর দাবি পৌঁছাতে পারে শীর্ষ আদালতে, নাকি মানুষের মঙ্গলকামনার চিরাচরিত পথ ধরেই সরে যাবে ত্রিশূল? সরিয়ে দেওয়া হবে মহিষাসুরকে? জানা নেই। শুধু জানা আছে, উৎসব প্রান্তে আজ ঢাক বাজবে জোরে। প্রান্তিক ঢাকি গাঁয়ে ফেরার আগে তাল হবে তীব্র। আজই কোতল হবেন অসুর। 'যেও না নবমী নিশি'-র সুরধ্বনি বিষন্ন হতে হতে রাত গভীর হবে। দাশাই নাচে ক্লান্ত শরীর আরও একবার মেপে নেবে অসুর বধের গ্লানি। পরের দিন বিজয়ার বরণে সেজো মাসিমা খুড়তুতো ননদের সঙ্গে অসুরের মুখেও ঠেলে দেবেন রেডিমেড নাড়ু। বছর ঘুরতে ঘুরতে আরো কিছু পুকুর বুজিয়ে, গাছ কেটে ফ্ল্যাট হবে। মহালয়া পেরিয়ে সেখানেও হবে নবপত্রের আয়োজন। ননদাইয়ের ছেলে কোটা বিরোধিতা করতে করতে থিতু হবে। মধ্যপ্রদেশে, অযোধ্যা পাহাড়ে, শহরতলী, গঞ্জে, মফস্বলে গাছকাটা হবে। বুকে কুড়াল আর ত্রিশূলের আঘাত সয়ে নগর থেকে দূরে যন্ত্রনায় ছটপট করতে করতে সংখ্যা খুঁজবে অসুরের বংশধররা।

2 Comments

Arindam

16 October, 2021

A timely written piece. This should be translated and published.

Md Iqbal Sultan

16 October, 2021

bhalo laglo

Post Comment