পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এক নিঃসঙ্গ পথিক ঃ মৌলানা আজাদ

  • 11 November, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 481 view(s)
  • লিখেছেন : হাসিবুর রহমান
নারী শিক্ষার বিষয়ে আরও কথা বলতে গিয়ে আজাদ যুক্তি দেন যে, বিষয়টি দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ; প্রথমত, স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে শিক্ষা নারীর জন্মগত অধিকার । দ্বিতীয়ত, তাদের শিক্ষা তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করার প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করে তুলবে।তাঁর ধারণা ছিল - শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিগুলি বাস্তবায়িত হলে দেশের আপামর মানুষের জন্য সার্বিক শিক্ষার দরজা প্রসারিত হবে। আজকে তাঁর জন্মতিথি। তিনি আজও বেঁচে আছেন অগণিত ভারতবাসীর মননে।

(এক)

মৌলানা আজাদ 'ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম' এর এক স্থানে দুঃখ করে লিখেছেন, তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিল স্বেচ্ছায় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে সরে আসা। হয়তো দেশভাগ এড়াতে নেহরু বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন। কারণ দেশভাগের প্রাক্কালে  শেষ অবধি জিন্নাহও নিমরাজি হয়ে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা মেনে নিয়েছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত আশা করেছিলেন সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান আর বেশি দূরে নয়। কিন্তু ইতিহাসের দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায় তখনও অপেক্ষায় ছিল। ঠিক সেই সময়ে বোম্বাইয়ের (আধুনিক মুম্বাই) ১০ জুলাই সাংবাদিক সম্মেলনে জওহরলাল তাঁর দুর্ভাগ্যজনক ঘোষণাটি করে বসলেন। গণপরিষদে যোগ দেওয়া ছাড়া কংগ্রেস আর কিছুই মেনে নেয়নি- কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে এ কথা বলে  জিন্নাহর হাতে জওহর একটি সুবর্ণ সুযোগ তুলে দিলেন।

স্বাধীনতার দিন ঘোষণা যত এগিয়ে আসছিলো ততোই কংগ্রেসের প্রথম সারির দুই নেতার অবস্থানও আর গোপন ছিল না। মৌলানা লিখেছেন, "প্যাটেলকে আজ জিন্নার চেয়েও দ্বিজাতিতত্ত্বের বড় সমর্থক হতে দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। দেশভাগের পতাকা জিন্নাহ তুলে থাকলেও তার প্রকৃত পতাকাবাহক এখন প্যাটেল।”

আজাদ আগেই সতর্ক করেছিলেন লীগের জোরাজুরিতে কংগ্রেস নতি স্বীকার করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না - দেশভাগের দায় ঘাড়ে চাপবে। কথা ছিল জীবন থাকতে গান্ধীজী দেশভাগ হতে দেবেন না। আজাদও ভেবেছিলেন গান্ধীজীর মতো বিশ্বস্ত অভিভাবক তো এখনও মরে যাননি। পাটনা থেকে গান্ধীজি দিল্লি ফিরলে আজাদ বিলম্ব না করে তাঁর সঙ্গে দেখা করে দেশভাগ নিয়ে তাঁর দৃঢ় মনোভাবের কথা ব্যক্ত করলেন। তিনি অসহায়ের মতো বাপুজিকে জানালেন - এখন তিনিই একমাত্র ভরসা। মাত্র দু'দিন পরে প্যাটেলের সঙ্গে গান্ধীজীর নিভৃতে দু'ঘণ্টা কথা হয়। আজাদ লিখেছেন, "কী হয়েছিল জানি না কিন্তু গান্ধীজী আর আগের মানুষ নেই।" তবে কথা সত্যি - গান্ধীজী এমন মানুষও নন যে, দেশ ভাগের পক্ষে তিনি মত দিতে পারেন। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার প্যাটেলের মত, পক্ষের যুক্তি তাঁকে আছন্ন করে রেখেছিল। এসব ঘটনা দেখে বস্তুত তাঁর মাথায় যেন একটা আকাশ ভেঙে পড়ছিল। এই বিভাজন আজাদের কাছে মৃত্যু যন্ত্রণা থেকেও ভীষণ বেদনাময় ছিল। অত:পর মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে  আজাদের দেখা হলে তিনি বলেন, গান্ধীজিকে রাজী করানো গেলে এখনো দেশভাগ ঠেকানো যেতে পারে। কিন্তু এসব শুনে নেহেরু, প্যাটেল দু'জনেই রে..রে করে উঠলেন। আজাদ লিখেছেন,
"গান্ধীজী পাটনায় যাওয়ার আগে আমি তাঁকে শেষ বারের মত আর্জি জানালাম। এমন কিছু করা হোক যাতে বর্তমান অবস্থা দু'বছরের মত জিইয়ে রাখা যায়। ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে ভারতীয়দের হাতে তো এসেই গেছে; এখন বিধিমত হস্তান্তর যদি দু'বছরের মত ঠেকিয়ে রাখা যায়, তাহলে কংগ্রেস আর লীগ নিজেদের মধ্যে ততদিনে বোঝাপড়ায় আসার সুযোগ পাবে। মাস কয়েক আগে গান্ধীজী নিজেই এই  মর্মে এক প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং আমি তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম যে, জাতির ইতিহাসে দু'বছর এমন কিছু দীর্ঘ সময় নয়। আমরা যদি দুটো বছর অপেক্ষা করি, তার মধ্যে মুসলিম লীগ রফা করতে বাধ্য হবে। আমি এটা বুঝেছিলাম যে, এখনই যদি হেস্তনেস্ত করা হয়, তাহলে দেশভাগ অনিবার্য; কিন্তু দু'এক এর বছর পর এর চেয়ে ভালো কোনো সমাধান বার করা যেতে পারে। গান্ধীজী আমার প্রস্তাব নাকচ করলেন না বটে, তবে তার মধ্যে খুব একটা উৎসাহের লক্ষণও দেখতে পেলাম না। ইতিমধ্যে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগের নিজস্ব প্রস্তাবেরও মুসাবিদা করে ফেলেছিলেন।" দুঃসময়ের সেই দিনগুলিতে শেষ পর্যন্ত কেউই তাঁর পাশে ছিলেন না। তাঁর চোখের সামনে কফিনের শেষ পেরেকটা  মারা হয়ে গেল। কার্যত তিনি একা, এক অসীম শূন্যতা। তাই একদা তাঁর কণ্ঠস্বরে ভেসে উঠেছে - "In religion, in literature, in politics, in everyday thought, wherever I have to go, I have to go alone. On no path can I go with the caravans of the day...Whichever way I walk, I get so far ahead of the (caravan) that when I turn to look back, I see nothing but the dust of the way, and even that is the dust raised by the speed of my own passage."

(দুই)

স্বাধীনতার মধ্যরাতের সেই আনন্দ-বেদনার বিরল মুহূর্তকে নেহরু 'নিয়তির সঙ্গে অভিসার' বলে ধরে নিয়েছিলেন।ভোরের আলো ফুটতেই সদ্য বিভক্ত দু'দেশে শুধু রক্তেরই বন্যা। এক মহা দুর্দৈব।আজাদের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি সংকটে মুখোমুখি হলো দু'দেশের সংখ্যালঘু মানুষজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁরা না চাইলেও দেশভাগের শিকার। রাতারাতি মানচিত্রের বদল ঘটলেও মানুষের পরিবেশ, প্রতিবেশ, সংস্কৃতি বদলানো যায় না। মহম্মদ আলি জিন্নাহর মতো তুখোড় রাজনীতিবিদ মুসলিম জাতি মুসলিম জাতি সত্তার 'ধুয়ো' তুলে অবশিষ্ট ভারতীয় মুসলিমদের সর্বনাশ করেছেন সচেতনভাবে। সবচেয়ে বেশি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এক শ্রেণীর লীগের সমর্থক যারা পাকিস্তান দাবিতে সোচ্চার হয়েও এখন তাঁরা এদেশের মাটিতেই জান মাল নিয়ে পড়ে আছেন। বিষয় সম্পদ ছেড়ে অজানা পাকিস্তানের যাওয়া দূরস্থ! এখন তাঁদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর অস্থির সময়ে তাঁদের সম্পত্তি রক্ষা তো দূরের কথা শুধু নিজের জীবনটুকু বাঁচাতে হাজারে হাজারে মানুষ মৌলানার দুয়ারে করজোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর যখন ভারতের মুসলমানরা প্রতিপদে বুঝতে পারলেন যে মৌলানা আজাদ এতদিন মুসলমানদের স্বার্থেই পাকিস্তানের তীব্র বিরোধিতা করেছেন তখন। কিন্তু ইতিহাসের কী পরিহাস  তাঁরাই আবার জীবন রক্ষার্থে মৌলানা আজাদের শরনাপন্ন বাধ্য হলেন। কাতারে কাতারে মানুষ প্রাণের ভয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। কে কাকে রক্ষা করবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসাম্প্রদায়িক গরিমা আজ আর নেই। নেহরু, আজাদ তাঁদের ওপরও ভরসা রাখতে পারেন নি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু ঢেউ দিল্লি সন্নিহিত এলাকায় আছড়ে পড়ছিল। একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায় - এসব কিছুর দায় জিন্নাহ কোন যুক্তিতেই এড়িয়ে যেতে পারেন না। ক্ষতিটা বেশি হয়েছিল  উভয় দেশের সংখ্যালঘু জনজীবনে। পাকিস্তান আন্দোলন ভারতীয় মুসলমানদের বৃহৎ অংশ আচ্ছন্ন যেমন ছিল, তেমনি দেশভাগের বিরোধী  একটা অংশ নিতান্ত কম ছিল না।জিন্নাহর রাজনৈতিক  ভুলের মাশুল গুনতে হয়েছিল এসব মানুষদের। তাঁদের আর কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল না। সংখ্যালঘু মুসলিমদের অসহায় পরিস্থিতির লক্ষ্য করে মৌলানার সাহেবের পক্ষে নির্বাক দর্শকের মতো অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছেন আর্ত মুখগুলির দিকে চেয়ে। এ বিষয়ে একটা কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

এই শীর্ণ, ঋজু, পাথুরে দৃঢ় মানুষটি জীবনে কখনও আপন কর্তব্য থেকে দূরে সরে আসেননি। তাঁর মনে হয়েছিল সমস্ত অপমান, অবজ্ঞা লাঞ্ছনা উপেক্ষা করে তাঁকে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বক্তা হিসেবে মৌলানা আবুল কালাম অদ্বিতীয় ছিলেন। ইতিহাস সচেতন, উদার, যুক্তিনিষ্ঠ মৌলানা আজাদ যখন উর্দুতে ভাষণ দিতেন তখন শ্রোতাদের মনে হত যেন ভাষার যাদুতে দর্শকদের তিনি সাহিত্যের পুষ্পবনে নিয়ে গিয়েছেন। ১৯৪৮ মাসের অক্টোবরে মুসলিমদের অভয় দিতে লখনৌ ও দিল্লির জামা মসজিদে ঐতিহাসিক বক্তব্য রাখেন। ইতিহাস থেকে কিভাবে শিক্ষা নিতে হয় প্রতিটি বাক্যের পরতে পরতে তিনি বুঝিয়ে দেন। একটা জাতি ও গোষ্ঠীর জন্য এই শিক্ষা ভবিষ্যতের স্মরণীয় হয়ে থাকবে।তিনি বলেন, "সম্রাট শাজাহানের তৈরি এই ঐতিহাসিক মসজিদের বিশাল জনতার সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়া আমার কাছে নতুন কোনো বিষয় নয়। ইতিপূর্বে যখন আপনাদের মুখগুলো আত্মবিশ্বাসে উজ্জ্বল ছিল আর মনে ছিল শান্তি তখন আমি আপনাদের সামনে ভাষণ দিয়েছি।....এখন আপনাদের মুখে বিষণ্ণতা, সন্দেহ আর.. উদ্বেগের কালো ছায়া দেখছি। আপনাদের হৃদয়ের নিঃসঙ্গতা অনুভব করছি...মনে আছে আমি আপনাদের ডাক দিয়েছিলাম তাই আপনারা আমার জিভ কেটে নিয়েছিলেন; আমি হাতে কলম তুলে নিয়েছিলাম, আপনারা আমার হাতটা কেটে নিয়েছিলেন; আমি আপনাদের সঙ্গে হাঁটতে চেয়েছিলাম, এগুতে চেয়েছিলাম, আপনারা আমার পা ভেঙ্গে দিয়েছেন; আমি হামাগুড়ি দিয়ে চলতে চেয়েছি আপনারা আমার পিঠ ভেঙে দিয়েছেন।..আমার ডাক উপেক্ষা করেছেন তাই নয়, আপনারা সেই প্রত্যাখ্যান আর অবহেলার পুরোনো ঐতিহ্য মেনে সত্যের ডাককে অবজ্ঞা করেছেন।...ফল তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। আজ সেই ভয়ই আপনাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে.. আমি আপনাদের বলেছিলাম যে দ্বিজাতি তত্ত্ব আমাদের বিশ্বাস, পথের মাঝে মৃত্যু ঘন্টা। আমি জোর দিয়ে সেই তত্ত্ব ছাড়তে বলেছিলাম.. কারণ সেই তত্ত্ব যে স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে তা দ্রুত টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যেতে বাধ্য। কিন্তু আপনারা আমার কথা শোনেননি..। ভেবে দেখেননি যে, আপনাদের সুবিধে করে দেবার জন্য সময় তার পথ বদল করবে না।...যাঁদের  সমর্থনের অপেক্ষায় নির্ভর করেছিলেন তাঁরা আপনাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এখন আপনাদের অভিধানে ভাগ্যের অর্থটা একটু আলাদা।...একবার তাকিয়ে দেখুন, এই মসজিদের আজান বারান্দাগুলো ঝুঁকে পড়ে আপনাদের জিজ্ঞাসা করছে, আপনাদের ইতিহাসের পাতাগুলো আপনারা কোথায় হারিয়ে ফেলেছেন?...এই তো সেদিন নির্ভয়ে যমুনার তীরে ওজু করেছেন.. আর আজ আপনাদের রক্ত দিয়ে গড়ে তোলা সেই শহরেই বাস করতে ভয় পাচ্ছেন!..বন্ধুরা আমার, আপনাদের এখন নিজেদের আমূল পালটে ফেলতে হবে।.. "

(তিন)

স্বাধীনতার প্রাক্কালে অখণ্ড ভারতের বড়  সমস্যা ছিল সাম্প্রদায়িকতা । মুসলিম লীগ সমস্যাটি ক্রমাগত ঘা দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিল। দেশভাগ এড়াতে মৌলানা আজাদের প্রস্তাব ছিল- সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে শুধু প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও পররাষ্ট্র, বাকি সব বিষয় থাকবে প্রদেশগুলোর হাতে। এভাবে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে তাঁদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ধরে রেখে সর্বভারতীয় সরকারে আলাদা ভূমিকা রাখতে পারবেন। তাঁর এই প্রস্তাব গান্ধীজীসহ শীর্ষ কংগ্রেস নেতৃত্ব সমর্থন করেন। পরবর্তীতে ১৬ই মে ক্যাবিনেট মিশন সেই প্রস্তাব অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহন করে সমগ্র ভারতকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেন, ‘ক’ অংশে পড়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, ‘খ’ অংশে পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বৃটিশ বালুচিস্তান এবং ‘গ’ অংশে বাংলা ও আসাম। এই পরিকল্পনা মুসলিম লীগ মেনে নিলে ভারত-ভাগের প্রধান বাধা সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু বোম্বাইয়ে নেহরুর সাংবাদিক সম্মেলনের সব ভেস্তে যায়।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগকে কোন মূল্যেই মেনে নিতে পারেন নি আজাদ। তিনি বলেছেন, "স্বর্গ থেকে যদি কোন দেবদূত নেমে এসে কুতুব মিনারের মাথায় চড়ে ঘোষণা করে যে, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের বিষয়টি এক মুহূর্তের জন্য যদি তোমরা অগ্রাহ্য কর তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তোমরা স্বরাজ পাবে-তাহলে আমি সেই স্বরাজের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করবো-এবং আমার দাবি থেকে এক ইঞ্চিও নড়বো না।" তিনি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন ভারত-ভাগ ঠেকানোর। তাঁর দৃষ্টিতে - ভারতীয় উপমহাদেশে সংখ্যালঘুরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাঁরা উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে বিভাজিত হয়ে আরো সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। উভয় দেশে চিরকালীন অশান্তি, দাঙ্গায় বিপর্যস্ত হবে। প্রতিরক্ষার খরচ যোগাতে হিমশিম খাবে।ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ জনগণ। তাঁর আশঙ্কা যে ভুল ছিল না আজ প্রমাণিত।

আজাদের লড়াইটা ছিল ঘরে বাইরে ; উভয় অপশক্তির বিরুদ্ধে। জিন্নাহ তাঁকে নানাভাবে প্রলোভিত করার চেষ্টা করেছেন, কখনো নিন্দা সূচক কটুক্তি করেছেন। কিন্তু তিনি নীরবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। দেশ বলতে তিনি বুঝতেন 'পবিত্রভূমি' (আল্লাহর ঘর)।তাকে ভাগ করা যায় না। পরাধীনতার হাত থেকে তাকে মুক্ত করাই দেশবাসীর প্রথম কাজ।

'আল হিলাল'এ তিনি এক সময় লিখেছিলেন, "স্মরণ রাখবেন, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা হিন্দুদের পক্ষে স্বদেশ-প্রেমের অন্তর্গত। আর তা মুসলমানের পক্ষে ধর্মীয় 'ফরজ' অর্থাৎ অবশ্য-করণীয় কাজ এবং "আল্লার জন্য প্রচেষ্টার” অন্তর্গত। সত্যের জন্য সংগ্রাম করা এবং মানবকে স্বাধীন ও মুক্ত করা তো ইসলামের শাশ্বত, চিরন্তন 'মিশন'। এখন উঠ, জাগো, আল্লার পথে অগ্রসর হও।"
সকল অর্থে মৌলানা সাহেব ছিলেন স্বাধীনতা দেশপ্রেম ও ঐক্যের প্রতীক। আজাদ ছিলেন সকল ধর্ম, গোত্র এবং সম্প্রদায়ের ঐক্যের ভিত্তিতে গঠিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, পারস্পরিক ধর্মীয় সহাবস্থান নিশ্চিত করে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ভারত অর্জন করা সম্ভব। তাই তিনি, তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক জীবনে এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে সংগ্রাম করে গেছেন। দেশভাগ জনিত  সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারেননি ঠিকই । কিন্তু জীবন থেকে নিরাশাকে দূর করে নতুন স্বপ্নের আশা দেখিয়েছেন এভাবে "একথা সত্য যে, এমন অনেক স্বপ্ন আছে যার শেষ নেই। আবার অনেক স্বপ্ন আছে যা সব সময় সফল হয় না। কিন্তু এই স্বপ্নগুলি আদর্শের ধ্রুবতারার মত সময়ের আকাশে চির ভাস্বর হয়ে থাকে। এগুলি মানুষকে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের কঠিন পথের সন্ধান দেয়।"

(চার)

স্বাধীন ভারতের  প্রথম শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন মৌলানা আজাদ এবং ১৯৫৮র ২২শে ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই পদেই বহাল ছিলেন। তিনি  দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে জন্য আন্তরিক দায়িত্ব প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তাঁর মতো প্রাজ্ঞ মানুষ অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বেহাল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি শক্ত ভিত্তিতে নির্মাণ করেন। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে ,  মাধ্যমিক, উচ্চ শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। ১৯৪৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেন। এছাড়াও  দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স সহ বিভিন্ন শিক্ষা সহযোগী প্রতিষ্ঠান, কারিগরি শিক্ষার জন্য অল-ইন্ডিয়া কাউন্সিলের স্বীকৃতিদান  এবং বহিঃ বিশ্বে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করতে জন্য 'ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন' গঠন নজর সৃষ্টি করেন  ।  নারী শিক্ষার প্রসার তাঁর ভাবনায় যে বিশেষ অগ্রাধিকার পেয়েছিল তা জানা যায় ১৯৪৯ সালে কেন্দ্রীয় সমাবেশের একটি আলোচনায়। তিনি বলেছিলেন, "জাতীয় শিক্ষার কোনও কর্মসূচিই উপযুক্ত হতে পারে না যদি সমাজের অর্ধাংশ  অর্থাৎ নারী সমাজে শিক্ষা ও অগ্রগতির  পূর্ণ প্রসার না ঘটে।"

নারী শিক্ষার বিষয়ে আরও কথা বলতে গিয়ে আজাদ যুক্তি দেন যে, বিষয়টি দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ; প্রথমত, স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে শিক্ষা নারীর জন্মগত অধিকার । দ্বিতীয়ত, তাদের শিক্ষা তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করার প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করে তুলবে।তাঁর ধারণা ছিল - শিক্ষা সংক্রান্ত  নীতিগুলি বাস্তবায়িত হলে দেশের আপামর মানুষের জন্য সার্বিক শিক্ষার দরজা প্রসারিত হবে।
নাগরিকদের নৈতিক  মূল্যবোধের বিকাশের সাথে সাথে মানবসম্পদেরও উন্নয়ন ঘটবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কলা ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটলেও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নিরক্ষর মানুষ আমাদের দেশে বাস করেন ৷ বর্তমানে বিজ্ঞান প্রযুক্তির সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাসে অলীক যোগসূত্র স্থাপন করা বা দেশের ইতিহাসকে বিপথে ঘুরিয়ে যেভাবে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে  তা শুধু লজ্জারই নয়, শঙ্কারও। নেহরু, আজাদ যে নয়া ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার থেকে শত মাইল পিছিয়ে আছি এ কথা বলতে দ্বিধা নেই।

(পাঁচ)

ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাসে ইসলামের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ কখনও পড়শিমনকে হেয় করেনি। মনুষ্য জীবনের সমস্ত পার্থিব পাপাচার  থেকে মুক্ত এক নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ ছিলেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না পেয়েও তিনি স্ব-শিক্ষিত, পান্ডিত্যের  অধিকারী। সমুদ্রের বিপুল জলরাশির মতো তাঁর জ্ঞানের পরিধি। যে কোন জটিলতম সমস্যায় তিনি সুক্ষ্মতম রন্ধ্রে পর্যন্ত পৌঁছবার আশ্চর্য ক্ষমতা রাখতেন। গান্ধীজী বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, “ Maulana is the Emperor of learning. I consider him as a person of the calibre of Plato, Aristotle and Pythagorus.”

শুধু ইসলাম নয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দর্শন, ধর্ম,সংস্কৃতি বিষয়ক তাঁর জ্ঞান-গভীরতা ছিল ঈর্ষণীয়। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন জ্ঞান ও দেশপ্রেমের অপূর্ব সম্মিলন। আজাদ ছিলেন সকল ধর্ম, গোত্র এবং সম্প্রদায়ের ঐক্যের ভিত্তিতে গঠিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, পারস্পরিক ধর্মীয় সহাবস্থান নিশ্চিত করে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ভারত অর্জন করা সম্ভব। তাই তিনি, তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক জীবনে এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯২৩ সালে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে ৩৫ বছরের আজাদ কে  জাতীয় কংগ্রেসের সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি মনোনীত করা হয়। কিন্তু তিনি যে অসীম প্রতিভা নিয়ে পৃথিবী এসেছিলেন, জীবনের কোন সংকটেই তাঁর অপব্যবহার করেননি। তাঁর কলঙ্কহীন জীবনবোধ অনুধাবন করে তাঁরই বন্ধু, সতীর্থ পন্ডিত নেহরু লিখেছেন, "বড় বড় লোক পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু মৌলানার মত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদার অধিকারী নেতা ভারত কেন, দুনিয়ার বুকে আর আসবেন না।তিনি অতীত ও বর্তমানের বিশেষ গুণাবলীর এক মনোজ্ঞ সেতু ছিলেন।...দুনিয়ার সব রাজনীতিবিদদের ভেতরে মৌলানা ছিলেন একজন ব্যতিক্রম। একেবারেই একক ও অনন্য।.. চারিত্রিক স্বভাব দোষ থেকে  সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র ছিলেন।.. এক শালীন ও বিনম্র, নিতান্ত লাজুক ও নিঃসংগপ্রিয় মানুষ।"

নেহরু, প্যাটেলের সঙ্গে রাজনৈতিক কারণে  বহু তর্কাতর্কি হয়েছে কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বে তার কোন ছাপ পড়েনি। তবুও অগনন মানুষের মধ্যে তিনি নিঃসঙ্গ, প্রায় একা। স্ত্রী জুলেখার মৃত্যু, দেশভাগের অবদমিত যন্ত্রণাবোধ তাঁর অন্তরকে নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল। স্বাধীন ভারতে নেহরু ছাড়া রাজনৈতিক সহকর্মীদের খুব একটা সমর্থন পাননি। তবুও একাই দুর্গম পথ হেঁটেছেন  শূন্যের দিকে চেয়ে। আজাদের বন্ধু, সহকর্মী  হুমায়ুন কবীর কয়েকটি বাক্যে তাঁর শূন্যতার  এক অপূর্ব মূল্যায়ন করে লিখেছেন, -"পৃথিবীতে মানুষ যা চায়, মৌলানা আজাদ তার কোনো কিছু থেকেই বঞ্চিত হন নি। বংশগৌরব অর্থ প্রতিষ্ঠা যশ-সব কিছুই তিনি অকুণ্ঠিতভাবে পেয়েছেন, কিন্তু মানুষের দুঃখের জন্য দরদ ও ন্যায়ের প্রতি ঐকান্তিক আগ্রহের ফলে সমস্ত জীবন তাঁর সংগ্রাম ও সাধনার মধ্যেই কেটেছে। অসাধারণ শক্তি ও গুণের অধিকারী হয়েও তাই চিরদিন নিঃসঙ্গ ভাবেই তিনি দিন কাটিয়েছেন।" আজ তাঁর জন্মতিথি। তিনি আজও বেঁচে আছেন অগণিত ভারতবাসীর মননে।

 


 লেখক : প্রাবন্ধিক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক

0 Comments

Post Comment