সরকারি হাসপাতাল যেমন হয়। জীবন আর মৃত্যু এখানে ট্রাপিজের দড়িতে ভারসাম্য রাখে।
“মা একটা বিস্কুটের প্যাকেট এনে দেব?”
পার্বতী তাকিয়ে দেখেন অনুপম। তাঁর বড় ছেলে। এই অপরিচিত জায়গায় হঠাৎ ঘাড় তুলে তাকিয়ে নিজের গর্ভজাত সন্তানকেই কেমন অচেনা ঠেকে। লম্বায় বাপ-মা’কে ছড়িয়েছে বহুদিন। আড়ে-বহরে সে এখন টগবগে যুবক। ক’দিনের রাতজাগা কালি চোখের তলায় জমা। এটুকু ছাড়া যৌবনের দীপ্তি তার চোখেমুখে।
অনুপম মায়ের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। উত্তরের আশায়।
“জল খাবে মা?”
“অ্যাঁ... জল? না রে জল-টল কিছু খাব না।” পার্বতীর মনে হয়, জল খেলেই যদি তাঁর বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হয়, আর সেই ফাঁকে কেউ ডেকে ওঠে তেষট্টি নম্বর পেশেন্টের লোক কে আছেন, আর অনুপম শুনতে না পায়... তাহলে? তার চেয়ে... থাক।
“একটা বিস্কুট অন্তত খাও মা। সেই সকালে... তুমি তো প্রায় কিছুই খেয়ে বেরোওনি।”
ছেলের সহমর্মিতা ছুঁয়ে যায় কোথায়।
বলেন, “না রে, ওই যে চা খেয়েছি, তখন দুটো বিস্কুট খেয়েছি। খেয়েছি ঠিক। দিলাম যে তোকে... তখন আমিও...”, বলতে বলতেই কে যেন কোন বেড নম্বর ধরে ডাকতে থাকে আর সঙ্গে সঙ্গে উৎকর্ণ হয়ে যায় দুজনেই।
দু’জনেই আলাদা আলাদা করে কান পেতে শোনে, দু’জনেই যে শুনছে, কেউ কাউকে বুঝতে দেয় না। দু’জনেই আড়াল করে রাখে নিজেদের উদ্বেগ। দুজনেই শুনতে পায় অন্য কোনও নাম, অন্য কোনও বেড নম্বর। দু’জনেই শ্বাস ফেলে। নিশ্চিন্ত।
আবার হয়ত নিশ্চিন্ত নয়।
একজন মানুষ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি। আজ বারোদিন হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য এক লড়াই। ডাক্তার বলছেন, তার কিডনি আর তেমন কাজ করছে না, একটা লাংস পুরো অকেজো, একের পর এক মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কয়েকদিনের মধ্যে। একেই পারকিনসনের রোগী। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এবার। কয়েক মাস আগে একবার ডেঙ্গু হয়েছিল। তখন যমে-মানুষে। ক’দিন আগে তাকে যখন নার্সিং হোম থেকে বণ্ড লিখিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়, নার্সিং হোমের ডাক্তারবাবু অনুপমের পিঠে হাত রেখেছিলেন একবার। কোভিড প্রোটোকল সত্ত্বেও।
“জানি, কেন তোমরা বাবাকে নিয়ে যাচ্ছ। কিন্তু হাসপাতাল অবধি পৌঁছতে পারবে কী না... জাস্ট ম্যাটার অফ ফিউ আওয়ার্স...”
“যা ভাগ্যে আছে... দেখি একবার।”
ডাক্তারকে এটুকুই বলে অনুপম। এটুকুই এখন পার্বতীও বলে। যা ভাগ্যে আছে। কার ভাগ্য, পার্বতী অনুপম অরূপম না অবিনাশ...।
অনুপম এখনও ছেলেমানুষ। সদ্য এম এ পাশ করা একটি ছেলেকে প্রাপ্তবয়স্ক বলা যায় না। অন্তত জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো বাবার সাম্প্রতিক চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে ভাবার জন্য যতটা পরিণত হওয়া দরকার, ততখানি জীবন সে দেখেনি। রোগ-ব্যাধি জ্বর জ্বালায় বিপর্যস্ত এক প্রায়-অথর্ব বাবাকে সে জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুধুমাত্র একটি জীবিত প্রাণী বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বাবা আছেন। চুপচাপ। বাবা একটা চেয়ারে বসে থাকেন। টিভি দেখেন। বা তাকিয়ে থাকেন টিভির দিকে। টেবিলে বসে নিজে হাত দিয়ে খান। এলোমেলো ছড়িয়েছিটিয়ে। একটু অগোছালো সব। টলমল করে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে যান। সারাদিনে বিভিন্ন সময়ে সতেরোটা ওষুধ। মাঝেমধ্যে ওরা বলে, সাবধানে। সামলে চলো।
এটুকুই একজন মানুষের অস্তিত্ব। তার এত বছরের বেঁচে থাকা।
অনুপম তেইশ, অরূপম উনিশ। দুই ভাইয়ের এখন কেরিয়ার নিয়ে উড়ান দেবার সময়। এই সময় টাকার অভাবে মরণাপন্ন বাবাকে ভেন্টিলেশনে না দিয়ে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া মানে তার মৃত্যু ত্বরাণ্বিত করা— নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ বার বার অপ্রিয় বাস্তব মনে করিয়ে দিয়েছে তেইশ বছরের যুবককে। সে শুনেছে। বিচলিত হয়নি। অনুপম জানে, তাদের আর টাকা নেই। যা কিছু জমানো পুঁজি ছিল একে একে সব গেছে। তার বাবা আজ প্রায় চোদ্দ বছর ধরে শয্যাশায়ী। পর পর দুটি সেরিব্রাল অ্যাটাক তাকে পক্ষাঘাতে অসাড় করেনি ঠিকই, কিন্তু প্রাণস্পন্দন বলতে যা বোঝায়, সেই স্বাভাবিক জীবনের ওঠাপড়াতেও আর ফিরিয়ে দেয়নি।
মায়ের প্রাইভেট কোম্পানির সামান্য চাকরি ভরসা ছিল। লকডাউনে সেটিও গেল। অনুপমের বাবা অবিনাশের এককালে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির একটি গোল্ড মেডেল, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পাওয়া কাঁড়ি কাঁড়ি নম্বর, ফার্ম থেকে আয় হওয়া রাশি রাশি টাকা তার অনেক আগেই অর্থহীন হয়ে গেছে। একের পর এক ঝড় আসে, আর কখনও বাড়ির চাল, কখনও ঘরের ভিত আলগা হয়। পার্বতী পাহাড়ের মতো সহ্যশক্তি আর মনের জোর দিয়ে দুটি ছেলেকে সব ঝড় থেকে আগলে রাখেন। অনুপম আর অরূপম-- ওদের দুটি ভাইয়ের গায়ে যেন আঁচ না লাগে।
নার্সিন হোমের ডাক্তারের বলা ‘ফিউ আওয়ার্স’ থেকে আজ কতগুলো দিন পেরিয়ে চলে গেল। হিসেব রাখতেও আর ভালো লাগে না। যন্ত্রে নলে ওষুধে আচ্ছন্ন একটি মানুষ। সাড়া নেই। তবু তিনি আছেন।
চারদিন আগে ডাক্তার বলেছেন, “ওয়েট অ্যাণ্ড প্রে।”
পার্বতী কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।
“ডাক্তার কী বললেন রে? ওয়েট? কীসের জন্য ওয়েট করতে বলল?”
অনুপম চুপ করে থাকে। ও নিজেও জানে না ডাক্তার কী প্রার্থনা করতে বললেন, কীসের জন্য অপেক্ষা। মৃত্যুর, না জীবনের?
পার্বতী আনমনা হয়ে যায়। সামনের বছর তাদের পঁচিশ বছর পূর্তি। কয়েক মাস বাকি। বিয়ের পঁচিশ বছর। অসহায়ভাবে দেখে যেতে হয়েছে দিন মাস বছর। বিয়ে। বিয়ে মানে সহবাস, বিয়ে মানে সংসার, বিয়ে মানে ঝগড়া আদর খুনসুটি। বিয়ে মানে মতবিরোধ। বিয়ে মানে সহমত। পার্বতীর কাছে বিয়ে কথাটার আর কোনও অর্থ বা মূল্য অবশিষ্ট নেই। সম্বন্ধ দেখে বিয়ে হয়ে আসা মা-ছেলের সংসারে প্রথম দিন থেকেই বেসুরো বাজে সব। সংসারে আয় প্রচুর, ব্যয় তার চেয়েও বেশি। বেহিসেবি বেপরোয়া চারপাশ। অবিনাশের দুহাতে আয় করে আনা অর্থ জলপ্রপাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পাল্লা দিয়ে ভিড় করেছে স্বার্থান্বেষী আত্মীয়পরিজন। বন্ধু তারা কেউ নয়। বন্ধু হয়ে ওঠার যোগ্যই নয়। বন্ধুত্বের দায় অনেক বেশি। তারা সুযোগসন্ধানী। আত্মীয় বলাও শক্ত। আত্মার বাঁধনই বা ছিল কোথায়?
এই ভিড়ে পার্বতী একা। অনেক দূরে। যেন এক উপগ্রহ। তার কোনও মতামত নেই, তার কোনও চাহিদা নেই, তার কোনও অস্তিত্বই নেই। অথচ তাকেই একদিন সব প্রতিকূলতার সামনে একা এসে দাঁড়াতে হল। সেদিন সকলের মুখের ওপর সশব্দে দরজা বন্ধ করার শুরু। সেদিন প্রথম সেরিব্রাল অ্যাটাকে বিপর্যস্ত অবিনাশ হঠাৎ তাকিয়ে দেখলেন ঘরে দুটি নাবালক সন্তানকে ফেলে রেখে পার্বতী কাজে বেরোনোর তোড়জোর করছে। শেয়ারে টাকা খাটিয়ে অসাধু বন্ধুর পরামর্শে ভুলভাল ব্যবসায়ে লগ্নি করে ততদিনে অবিনাশের সংসারে লক্ষ্মীর ভাঁড়ারে টান পড়েছে।
পার্বতী পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন, কত মানুষ। নানান বয়সের। বৃদ্ধ থেকে শিশু। মহিলা থেকে যুবক, কিশোরী থেকে প্রাপ্তবয়স্ক। নিথর মুখ। কেউ উদাসীন, কেউ ক্লান্ত। বসে বা দাঁড়িয়ে। সকলেই অপেক্ষায়। বেঁচে ফিরে আসা, সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ানো বা শেষের খবর। কতরকম অপেক্ষা। মূল উপজীব্য বেঁচে থাকা। যেভাবেই হোক টিঁকে থাকো। ফিরে এসো আপনজনের বৃত্তে। সেখানে তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।
পার্বতী কেন বসে আছে? কার জন্য? অবিনাশ কি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন? ফিরতে পারবেন?
ডাক্তার আসতে বলেছিলেন, যে কোনও সময় যে কোনও কিছু... আসুন আপনারা... জাস্ট প্রে অ্যাণ্ড ওয়েট।
প্রে করতে গিয়ে সেই কবে থেকেই পার্বতী থমকে যায়। ঠাকুরের আসনে অভ্যস্ত হাতে ফুল বেলপাতা নকুলদানা আর সরু ধোঁয়ার ধূপকাঠির পাশে ‘ভাল রেখো ঠাকুর’ বলে বলে তার শব্দগুলো বাসি কাপড় ছাড়ার মতো অনায়াস হয়ে গেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অবিশ্রান্ত চাহিদার চাকায় পিষে পিষে নিজেও ওই অবিনাশের মতো অসাড় নির্জীব হয়ে পড়েছে কবেই। ছেলেদুটো এর মধ্যেও বেরিয়ে পড়ে অন্য পৃথিবীর খোঁজে। স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটির গণ্ডিতে একজন। অন্যটি সদ্য কলেজ। তাদের সামনে নতুন জগতের ইশারা। তাদের মনে বুজকুড়ি কাটে কত স্বপ্ন। কিছু সম্ভব, কিছু অসম্ভব।
“আমি কিন্তু প্রিপেয়ার্ড মা,” ছোটটি সকালে বলে ফেলে।
বলে সে নিজেই মনে মনে খুব অপ্রস্তুত হয়ে যায়। এভাবে বলা যায়? সেই চার বছর বয়স থেকে অরূপম তার বাবাকে অসুস্থই দেখছে, মা’ই একাধারে তাদের বাবা-মা, তবু বাবা তো। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে একবার। মা নিস্পৃহ। মা বা দাদা কেউ খেয়াল করেনি তার কথাটা। বা প্রত্যেকেই মনে মনে একইরকম ভাবছে। শুধু বলছে না।
ছোটটির কলেজ খুলেছে সদ্য। কোভিড-পর্ব কাটিয়ে নতুন কলেজে যাবার আনন্দ উত্তেজনা সে ছাড়তে চায় না কিছুতেই। হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকা মানে জীবন থেকে কত কিছু হারিয়ে যাওয়া... আর সেখানে গিয়েই বা কী হবে? একটা না-ফেরার দেশের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকের জন্য এতটা সময়। সবটাই অপচয়।
তাকে ছাড় দেয় তার মা, তার দাদা।
“তোকে যেতে হবে না। আমি আর মা যাচ্ছি তো।”
“সদর দরজার তালার একটা চাবি মিনুমাসির কাছে থাকবে। আমরা কখন ফিরব...” উদাসীন গলায় বলতে বলতেই পার্বতী সব গোছান। সারাদিনের জন্য গিয়ে বসে থাকা। নাকি গিয়ে আজ আর বেশিক্ষণ বসতে হবে না। একটু পরেই ডাক আসবে, তেষট্টি নম্বর বেডের পেশেন্টের বাড়ির লোক...।
সেই সকাল থেকে বসে আছে পার্বতী। অনুপম এদিক-ওদিক চলে যায়। ডিম-পাঁউরুটি খেয়ে আসে। হয়ত সিগারেটও। অস্থির হয়ে পায়চারি করে। একবার এসে বলে, “চা খাবে মা?”
কেমন অধৈর্য লাগে অনুপমের। দিনগুলো চলে যাচ্ছে। কয়েকটা চাকরির পরীক্ষার ফর্ম ফিল-আপ করেছে। সেগুলো নিয়ে বসতে হবে। টিউশনিতে যাওয়া হচ্ছে না সময়মতো। এভাবে কামাই করলে চাপ আছে। সব কাজ ঘেঁটে যাচ্ছে। বিরক্তিকর।
ঘড়ির কাঁটা এগোয়। সাড়ে চার থেকে এবার পাঁচ দিন হতে চলল। সন্ধে পর্যন্ত ওরা বসে থাকবে। ন’দিন হল আই সি ইউ তে শুয়ে আছে অবিনাশ। ডাক্তার বলেছেন, যে কোনও সময়। ডাক আসবে। আজ ডাক না এলে ওরা আবার কাল আসবে। আবার বসে থাকবে। আর যদি সন্ধে থেকে ভোরের মধ্যে কিছু... তাহলেও সেই কাল সকালে। সরকারি হাসপাতাল তো। জন্ম-মৃত্যুর সময় না থাকলেও হাজিরার সময় নির্দিষ্ট।
ডাকের অপেক্ষায় বসে থাকে পার্বতী। অনুপম দাঁড়ায়, বসে, হাঁটে।
ডাক্তার বলেছেন, ওয়েট অ্যাণ্ড প্রে। দুটো শব্দের হাত থেকেই এবার নিস্তার চায় পার্বতী। অসহ্য কষ্ট পাচ্ছে একজন। তার যন্ত্রণামুক্তির প্রার্থনা করে চলা খুব সহজ তো নয়। একজনের থাকা আর না থাকার মধ্যে যে সূক্ষ্ম সুতোর প্রভেদ, সেখানেই ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে বিবেক।
মৃত্যু কামনা না যন্ত্রণামুক্তি? কোন পথে প্রার্থনা করলে অপরাধবোধ কম হবে? মানুষটা যেন আর কষ্ট না পায়... ভাবতে ভাবতেই আলগোছে যেন মুঠো খুলে ছেড়ে দেওয়া তার হাত... জীবন এই কাজটিও ঘাড়ে ধরে করিয়ে নেবে বোধহয়।
তবু রেহাই চায় ওরা প্রত্যেকে।
তেষট্টি নম্বর বেডও হয়ত নিস্তার চায়। তাকে কেউ জিগ্যেস করেনি।
.............................................................................................................................................
“নবাবী” পত্রিকা ২০২২, বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত