রাহুল গান্ধী সম্বন্ধে একবার একটা হালকা খবর শোনা গেছিল যে, '২৪এর ভোটের ফলে সুযোগ এলেও রাহুল প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসবেন না। যদি সত্যিই এমনটা হয়, তবে তা হবে রাহুল গান্ধী ও দেশের পক্ষে এক উজ্জ্বল ঘটনা। এবং এমনটা ঘটা আদৌ অসম্ভব কিছু নয়। অতীতে রাহুলের মা সোনিয়া গান্ধীও এমনটাই ঘটিয়ে ছিলেন ২০০৪এর ভোটের পরে। অনেক অনুনয় বিনয়, চাপাচাপি ও ক্ষোভ বিক্ষোভের পরেও সোনিয়া তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং তারই ফলে ঘটে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংয়ের পিএম আসন লাভ।
কন্যাকুমারিকা থেকে কাশ্মীর, প্রায় পাঁচ মাসের এই দীর্ঘ যাত্রা রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক উপলব্ধির ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। দেশ তথা দেশের মানুষকে চিনতে, জানতে সাহায্য করেছে। এই দীর্ঘ যাত্রার ফলে যে অভিজ্ঞতা রাহুল লাভ করেছেন, তা অমূল্য। মানুষের ভালোবাসার উত্তাপ তাঁকে শুদ্ধ করেছে, দায়িত্ববান করেছে, অভিজ্ঞ হতে সাহায্য করেছে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে বার্তালাপের ফলে জানতে ও বুঝতে পেরেছেন, মানুষের সমস্যা ও তার সমাধানের উপায়। যে কোন রাষ্ট্রনেতার জন্য যা এক অমূল্য সম্পদ।
আসন্ন নির্বাচনে মোদীকে পরাজিত করাই রাহুলের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জকে সফল করার মূলমন্ত্র হচ্ছে বিরোধী ঐক্য। সেই ঐক্য সঠিকরূপে গড়তে পারলেই মোদীর পরাজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু সেই ঐক্য গড়ার কাজটিই সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন। তবে কঠিন হলেও তা অসম্ভব নয়।
আমরা জানি, অতীতে কংগ্রেস দলের ব্যর্থতার কারণেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক দল সমুহ গড়ে উঠে স্থানীয় মানুষের প্রত্যাশা পূরণে। ফলে বহু রাজ্যেই কংগ্রেস আজ বেশ দুর্বল এবং সেই স্থান দখল করেছে আঞ্চলিক দল সমুহ। এরাজ্যে যেমন কংগ্রেস ভেঙে সেই জায়গা নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তেমনি বহু পূর্বেই উড়িষ্যায় বিজু জনতা দল, অন্ধ্রে রেড্ডি কংগ্রেস, তেলেঙ্গানায় বি(টি নয়) আর এস। তেমনি মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস ভেঙে এনসিপি গঠিত হওয়ায় কংগ্রেস দুর্বল হয়েছে। দিল্লীতে ও পাঞ্জাবে কংগ্রেসের পরিবর্তে ক্ষমতায় এসেছে আপ। কিন্তু এতদসত্বেও রাজস্থানে, ছত্তিশগড়ে, হিমাচলে ক্ষমতায় আছে কংগ্রেস এবং সদ্য সাড়াজাগানো কর্ণাটক ভোটও বিপুলভাবে জিতেছে কংগ্রেস। এখনও মধ্যপ্রদেশে, গুজরাটে, উত্তরাখন্ডে, হরিয়ানায়, আসামে, গোয়ায় বিজেপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস এবং কেরলেও সিপিএমের সঙ্গে সমানে টক্কর দিচ্ছে কংগ্রেস।
এমতাবস্থায় মোদীকে পরাস্ত করতে হলে কংগ্রেসকে কমবেশি ১৫০টি আসন পেতেই হবে এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দল সমূহকেও পেতে হবে নূন্যতম ১৫০ আসন। তবেই সম্ভব হবে একটি স্থায়ী বিকল্প সরকার গঠন। কিন্তু স্রেফ সংখ্যার জোরে সরকারের সাফল্য আসে না। সাফল্য নির্ভর করে সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণে বেশ কিছু নির্দিষ্ট জনমুখী কর্মসূচি রূপায়ণের উপরেই।
সেজন্যই প্রয়োজন একটি ক্ষমতাবান উপদেষ্টামন্ডলীর, যাঁরা নিয়মিত বসে পর্যালোচনা করবেন যে, সরকার সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে কিনা অথবা কর্মসূচি রূপায়ণের পথে কোনরূপ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কিনা। আর একটি বিষয় হচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধ। সেজন্য প্রয়োজন লোকপাল ব্যবস্থার কার্যকরী প্রয়োগ, স্রেফ লোক দেখানো নয়, যেমনটি আমরা বর্তমান অভিজ্ঞতায় দেখছি।
কর্মসূচি রূপায়ণের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে পিছিয়ে পরা বা অনুন্নত ব্লককে চিহ্নিত করে বার্ষিক জনসংখ্যা নির্দিষ্ট করা জরুরি এবং ১০০দিনের কাজ এ বিষয়ে অত্যন্ত ফলপ্রসূ পদক্ষেপ হতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে সুসংহত জনমুখী পরিকল্পনার সাথে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধিরও প্রয়োজন আছে।
শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কর্পোরেট সমাজের পদলেহন করা জরুরি নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে শক্তিশালী করতে পারলেই বিনিয়োগ স্বেচ্ছায় আসবে আপন স্বার্থেই। শিল্প বা বিনিয়োগ ভিন্ন বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, এমন ধারণা এখন আর বাস্তব সম্মত কি, বিশেষত আমাদের মতো জনবহুল দেশে। কারণ, আধুনিক শিল্প এখন প্রযুক্তি নির্ভর, যথেষ্ট শ্রমনির্ভর নয়। এখন কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে অনেকটাই সার্ভিস সেক্টরে, যা যথেষ্ট সংগঠিত নয়। ফলে এক্ষেত্রে হায়ার অ্যান্ড ফায়ার এর শিকার হন অনেকেই। এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া ও হস্তক্ষেপ জরুরি।
এছাড়াও গ্রামীণ অর্থনীতিকে স্বনির্ভর বানাতে জেলাস্তরে স্বতন্ত্র বিশেষ পরিকল্পনার প্রয়োজন। কৃষি নির্ভর পেশাকে পরিবারের শিক্ষিত সন্তানরা আর গ্রহণ করতে চান না অনেকটাই অর্থনৈতিক কারণে এবং তারই ফলশ্রুতিতে সামাজিক কারণেও। পাঞ্জাবে কৃষিজমির মালিকরা সম্পন্ন, কিন্তু বাংলায় বিষয়টি ভিন্ন। এর কারণ হতে পরে বাংলার চাষীর জমি বা জোতের পরিমাণ তুলনায় নগন্য এবং সেটা ভূমিসংস্কার এর কারণ কিনা, তা নিয়ে গবেষণালব্ধ উত্তর পেলে বুঝতে সুবিধে হয়। কৃষিক্ষেত্রে জড়িত মানুষদের আর্থিক উন্নতি ভিন্ন গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হতেই পরে না। ফলে সেদিকে দৃষ্টিদান আবশ্যিক।
আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমূল নির্বাচনী সংস্কার এবং মোদী শাসনকালের সাম্প্রদায়িকতার বিষ প্রচার ও প্রসারের অবসান ঘটিয়ে সৌহার্দের পরিস্থিতিকে ফিরিয়ে আনতে লাগাতার বিভিন্ন কার্যক্রমের অনুশীলন চালানো।
নির্বাচনী সংস্কার প্রয়োজন, কারণ নির্বাচনে প্রকৃত জনমত প্রতিফলিত না হলে সংসদীয় গণতন্ত্র নিরর্থক হয়ে যায়। এখন নির্বাচন মানেই অর্থ, পেশীশক্তি ও পোষা মিডিয়ার দুস্প্রভাব। লেভেল প্লেইং গ্রাউন্ড না হলে ভোটে একতরফা সুবিধে ভোগ করে শাসকদল এবং সমস্ত বেনিয়ম দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকে নিরপেক্ষতাহীন নির্বাচন কমিশন। একদা টি এন শেশন তাঁর ক্ষমতা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশনের কেমন সঠিক ভূমিকা হওয়া উচিৎ। বাস্তবে এখন প্রয়োজন স্টেট ফান্ডিং এর মাধ্যমে নির্বাচনকে সাঙ্গ করা, কর্পোরেট ফান্ডিং এর প্রভাব মুক্ত করে। প্রচারের বাড়াবাড়ি সম্পূর্ন বন্ধ করে নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত সামান্য প্রচারের সুযোগের মাধ্যমেই বার্তা দিতে হবে ভোটারদের। মানুষ বিগত পাঁচ বছরে সরকার ও বিরোধীদের ভূমিকা দেখেই সিদ্ধান্ত নেবেন শান্তিপূর্ন পরিবেশে। এভাবে ভোট সাঙ্গ করতে পারলেই মানুষ সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থা ফিরে পাবে, গণতন্ত্র সুরক্ষিত হবে।
উপরোক্ত গোটা বিষয়টিকে বাস্তবায়িত করতে গেলে রাহুল গান্ধীর বিশেষ কার্যকরী ভূমিকার প্রয়োজন। যাত্রা পরবর্তী অধিক অভিজ্ঞ ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন রাহুল গান্ধীর কাছে তা আশা করাও স্বাভাবিক। তিনি যদি সত্যি সত্যিই পিএম এর আসনে না বসেন তবে গোটা বিষয়টির উপর তাঁর প্রভাব অনেকবেশি কার্যকরী হবে। ক্ষমতায় বসার দায় অনেক, সইতে হয়, আপস করতে হয় অনেক বেশি। সেই দায় থেকে মুক্তি পেলে কাজ করা অনেক সহজ হয়। আগামী দিনে এদেশের রাজনীতিতে রাহুলের ভূমিকা হয়তো ইতিহাসে সে কারণেই বিশেষ স্থান করে নেবে এবং আমাদের দেশের রাজনীতি নেবে এক সদর্থক মোড়।