মন্বন্তরের কথা অবিনাশ জানে। পড়েছে বই-পত্রে। হাজার-হাজার মানুষ মরেছে, হারিয়েছে আর হ্যাঁ, বিক্রিও হয়েছে। দাদুর কথা মনে পড়ে অবিনাশের। বাবার বাবা। এক দিদির কথা ভেবে কাঁদত খুব। মানুষ কখনও বিক্রি হতে পারে? অবিনাশ ভয় পেত। ওকেও কি কেউ বিক্রি করে দেবে? সেই দিদি নাকি আগলে রাখত দাদুকে। সেই ছোটবেলায়। এক্কা-দোক্কা খেলত ভাইকে নিয়ে। আম বা জামরুল পেলে গুঁজে দিত ভাইয়ের হাতে। সেই বাড়িটার কথাও বলত দাদু। উঠোনের সেই এক্কা-দোক্কার কোট, নিমগাছ, চালতা। গাছভরা আমের মুকুল, ঘ্রাণ। পুকুর, পুকুরে মাছরাঙার ঝুপ। দাদু যেন তখনও সেই উঠোনেই। নিমের ছায়া মাথায় নিয়ে এক-পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে একটা করে কোট পার হওয়া। ঝোপের আড়াল থেকে একটা কোনও পাখি তখন কুব—কুব—কুব ডেকেই যাচ্ছে। মা বলত, ‘তোর দাদুর সেই দিদি তো বিক্রি হয়েছিল খিদের জ্বালায়। অনেকগুলি পেটের খিদে। না খেতে পেয়ে তখন তো মরছে সবাই, মরেছে তোর সেই দাদুর এক ভাইও। শেষমেশ তোর দাদুর বাবা কোনও উপায় না পেয়ে— ।’ দাদুর কাছে জানতে চাইত অবিনাশ, ‘দেখা হয়নি আর?’ এক একদিন রাতে বিছানায় শুয়ে দাদুর সেই দিদিকে দেখতেও পেত যেন। যেন উঠোনের সেই এক্কা-দোক্কার কোট, নিমগাছ, চালতা। আমের মুকুলের ঘ্রাণ। পুকুর, পুকুরে মাছরাঙার ঝুপ। কোন ঝোপের আড়াল থেকে একটা কোনও পাখি তখন ডেকেই যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেও কত দিন সেই ডাক শুনেছে অবিনাশ। কুব-কুব-কুব।
দাদু যেমন আগলে রাখত অবিনাশকে, অবিনাশও। দাদুর গল্প শুনত হাঁ করে, বলত, ‘বড় হয়ে একদিন ঠিক তোমার দিদিকে খঁজে আনব দেখো।’ দাদুর লাঠি হাতে নিয়ে অবিনাশ বলত, ‘তোমার বোনকে যে-ই নিয়ে থাকুক তোমার এই লাঠি দিয়ে আমি— ।’ ছেলেবেলায় দাদু-দিদাদের প্রতি এমন আবেগ-ভালবাসা থাকে সবারই। এরপর তুমি যত বড় হতে থাকলে তত তোমার দাদু-দিদারা সব কোথায় চলে যেতে থাকবে, সেখনে চলে আসবে তোমার কত কেউ। আসবে তোমার প্রেমিকা বা প্রেমিক। আসবে তোমার সন্তান-সন্ততি। এবার একদিন হঠাৎ করেই সেই দাদু বা দিদার মৃত্যুর খবর পেলে আর ভুস করে হয়তো ছেলেবেলার সেই সব আবেগের কথা জেগে উঠল। বা আরও পরে অন্য কোনও সময় তেমন কোনও প্রসঙ্গ এলে মনে করলে, আরে দাদুর মৃত্যুর এখন কত বছর যেন? এই যেমন আজই। লোকটার মুখে জেলা মেদিনীপুর আর গ্রাম ভগবানপুর শুনে মনে পড়ল কত কথা। এমনকী হারিয়ে যাওয়া দাদুর সেই দিদির কথাও। আসলে শুধুমাত্র হারিয়ে গেলে হয়তো মনে নাও থাকতে পারত, ব্যাপারটা যেহেতু ছিল বিক্রী, মানে পেটের জ্বালায় মেয়ে বিক্রী, অবিনাশ তাই এত দিন পরেও মনে করতে পারল। কিন্তু এত সব কথা এতদিন কীভাবে ভুলে থাকল সে? দাদুর সেই দিদি নাকি বুঝতেই পারেনি কিছু। বিয়ের নাম করে— । মায়ের কথায়, তখন তো আট-নয় বয়সেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সব মেয়ের। দশ-বারো হলে তো বদনামে পাড়া মাথায় উঠত। দাদুর সেই দিদির নামটা কী যেন? স্কুলে পড়ার দিনগুলি ছাড়িয়ে আসার পর সব কেন ভুলে গেল অবিনাশ? মা মনে রেখেছে? মনে থাকবে? জিজ্ঞেস করবে মাকে? কিন্তু এখন কী দিয়ে কথা শুরু করবে এই অমল ত্রিপাঠী নামের লোকটাকে? কেমন ছিল সেই না-খেতে পাওয়ার দিনগুলি বা সেই দিনটার সেই ঝড়-বৃষ্টির বিবরণ।
অমল ত্রিপাঠীকে ঘিরে তাঁর নাতি-নাতবউ-ছেলে। একেবারে ছোটরা নিশ্চিত নাতিদের ছেলেপিলেই হবে। ভদ্রলোক বললেন, কাল রাতে তো আপনার সঙ্গেই মেলার মাঠে— ? ঘাড় নাড়ল অবিনাশ। বলল, মেলার মাইকে আপনার কথা শুনে আপনাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল খুব। হাসলেন ভদ্রলোক। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কোন বাড়িতে উঠলেন? কোলকাতা থেকে এসেছেন তো?
আলাউদ্দীনকে দেখাল অবিনাশ।
‘কোন বাড়ি আপনাদের?’
একই গ্রামের লোক হওয়া সত্বেও আলাউদ্দীনকে চিনতে পারছেন না ভদ্রলোক। এখানে অবিনাশ বা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা সবাইই ওঁর বয়সের অর্ধেকের কি তিনভাগের এক ভাগেরও কম হওয়া সত্ত্বেও উনি কিন্তু তুই বা তুমি ব্যবহার করছেন না। আপনি। আলাউদ্দীন ওর আব্বার নাম বললে ঘাড় নাড়লেন ত্রিপাঠীবাবু।
‘ওরা বলছে একশ’ আট, বা ভোটার লিস্টেও একশ’ আট, আমার বয়স কিন্তু আরও বেশিও হতে পারে।’
অবিনাশ এই এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেল। জিজ্ঞেস করল, ‘বড় ছেলের বয়স?’
ঘরের মধ্য থেকে একজন কেউ বলে উঠল, ‘আমার এটা পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন।’ অর্থাৎ ওঁর বড়ছেলেই।
বাইরে বাতাসের শব্দ উঠল তালগাছে। যেন গা-মোড়ামুড়ি করছে কেউ। যেন এই কেউ গড়িয়ে পড়বে। উত্তরের বাতাস। ত্রিপাঠিবাবু বললেন, ‘শীত যেতে যেতেও যাচ্ছেনা কিছুতেই।’
হঠাৎ করেই মনে হল, বড় ছেলে পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হলে ভদ্রলোকের একশ’ আট কেমন অস্বাভাবিক না? বিশেষ করে সে যুগে যেখানে ছেলেদের আঠারো-উনিশেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। একটা বয়স পর্যন্ত লোকে কেমন বয়স কমায়, আর শেষ বয়সে এসে কেমন বাড়াবার নেশা দেখ? তার উপর বলছে, ওঁর সত্যিকারের বয়স নাকি আরও বেশিই হবে।
লোকটার দেশ বলল, মেদিনীপুর। গ্রাম ভগবানপুর। অবিনাশ একটু চমকে উঠেই যেন শুনতে চাইল ভাল করে। বলল, ভগবানপুর? উনি বললেন, হ্যাঁ থানাও। হ্যাঁ, ভগবানপুরই তো। এবার মনে পড়ছে। অবিনাশ বলল, আমার দাদুরও মানে আমাদের দেশও ছিল নাকি ওখানেই। লোকটা বা ওর বাড়ির লোক অবিনাশের কথাটাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না, বা খেয়াল করেনি হয়তো। আবিনাশ ফের বলল, আমার দাদুর বাড়িও ছিল কিন্তু ভগবানপুরেই, নাম— । লোকটার ছেলেদের হয়তো চেনার কথা নয়, কিন্তু লোকটা? অবশ্য বয়সের জন্য ভুলে যাওয়া তো হতে পারে, একশ’ আট বছর বয়সে যে ঠিক করে কথা বলতে পারছে তাইই যথেষ্ট। ।
বয়স নিয়ে লোকটার নিজের বা ওঁর পরিবারেরও গর্ব আছে খুব। এমনকী আলাউদ্দীনদেরও, বা এই দ্বীপের সবারই। এই বয়সেও লোকটা হেঁটে সেই মেলার মাঠে যেতে চায়। এমনকী হাঁটে রোজই। কিন্তু একটি লোকের বড় ছেলের বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হলে লোকটার বয়স কত আর হতে পারে? আশি—পঁচাশি—নব্বই। কিন্তু সেটা ছিল কম বয়সেই বিয়ের যুগ। তখনকার হিসেবে খুব বেশি বয়সে বা পঁচিশে বিয়ে হলেও লোকটার বয়স জোর হলে আশি। তেতাল্লিশের মন্বন্তর মানে আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগেকার ঘটনা, আর এটা মনে রাখলে লোকটার সবে জন্ম হয়েছে মাত্র। মন্বন্তরের কথা মনে থাকার কথাই নয়। বড়জোর পরে শুনেছে কিছু বাবা-কাকাদের কাছ থেকে।
ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আলাউদ্দীনের কাছে পরদিনের প্ল্যানটা জানতে চাইল অবিনাশ। মানে কোথায় যাবে, বা— । আলাউদ্দীনের কথায়, চাইলে কলস ক্যাম্প যেতে পারেন, আবার ওদিকে আছে কুমীর প্রকল্পের ভাগবতপুর। কলস ক্যাম্প বলতে গেলে মোহনাতেই, এই টাইমে ঢেউ হবে। ওর কথায়, শহরের লোক হওয়ায় অবিনাশ ঘাবড়ে যেতে পারে। বলল, চারপাশে জঙ্গল আর নদীতে ঢেউ— দুইয়ে মিলে বেশ আতঙ্কই তৈরি হয় অনেকের মনে। ‘আপনি বরং— ।’ বলে ও পাথরপ্রতিমা হয়ে ভাগবতপুরের কথাই বলল। ওদিকে একটা জায়গায় সাত-সাতটা নদী মিলেছে। বলল, স্পষ্ট দেখতে পাবেন আপনি, তা ছাড়া নদীর পাড়ে কুমীরও। অবিনাশ এবার সেই অমল ত্রিপাঠীর কথা তুলল। কার্তিক এর মধ্যেই স্টার্ট দিয়েছে ওর মোটর ভ্যানে। সামনে মসজিদ।
‘ফাইভ পর্যন্ত পড়া একটা মানুষ কী সুন্দর কথা বলল না? এখনকার বিএ পাশ একটি ছেলেও— ।’
একেবারে মোহনার খুবই ছোট এই দ্বীপ ‘কে’-প্লটের গ্রাম দুটোমাত্রই। পূর্ব আর পশ্চিম শ্রীপতিনগর। মাঝখান দিয়ে খাল গেছে একটা। আলাউদ্দীনের কথায়, ওটা আসলে নদীই, জোয়ার-ভাটা খেলত ওর ছোটবেলায়। পরে বাঁধা হয়েছে লকগেট দিয়ে। ভরা কোটালে আশপাশ ভাসিয়ে দিত। কুমীর উঠে আসত। বলল, ‘কাল ভোরে আমরা ওই লকগেটের পাশ দিয়েই যাব। যাব একেবারে বাঁধের উপর দিয়েই, পূর্ণিমার এখনও দিন তিনেক বাকি, তবু জোয়ারের জল দেখবেন কেমন শোঁ-শোঁ শব্দ তুলে আছড়ে পড়বে আমাদের গায়ে।’
কী মনে হল, অবিনাশ বলল, ‘তোদের গ্রামে এই বয়স্ক লোকেরা কি নিজেদের মতো করেই হিসেব করে বয়সের? মানে, যার যা মনে হল—।’
‘তার মানে ত্রিপাঠীবাবুর বয়সটা আপনি বানানো ভাবছেন?’
‘মেলার মাইকে একশ’ আট শুনে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। আর তুইও বললি, এখানে সবাই সেই মেদিনীপুরের, এসেছে আকালের যুগে। লোকটার কাছ থেকে সেই সব দিনগুলির কথা শোনার ইচ্ছে হল। দাদুর কথা মনে পড়ল। ভালবাসত খুব আমাকে। এর বড় ছেলের বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হলে, ত্রিপাঠীবাবুর তো বড়জোর জন্ম হয়েছে তখন, মন্বন্তরের কথা মনে থাকার কথাই নয়। আছে তোদের এখানে আর কেউ, মানে সেই পঁচাত্তর বছর আগেকার দুর্ভিক্ষের কথা বলতে পারবে— ।’
‘আপনি জিজ্ঞেস করতে পারতেন তো ত্রিপাঠীবাবুকে, হয়ত বলতে পারত।’
‘অন্যের মুখে শোনা কথাই বলত, তা দিয়ে দরকার নেই তো আমার। আমি চাই যারা একেবারে নিজের চোখে— । আমার দাদুর মতো। দাদুও সেই ভগবানপুর গ্রামেরই, আমি তো বললামও সে কথা, তোদের মোড়লমশাই দেখি গ্রাহ্যই করল না।’
ভ্যানের কার্তিক বলল, চা খাবেন তো? বাজারে থামি তাহলে— ।
আলাউদ্দীনের অসন্তোষের কারণ আমি বুঝি। লোকটার বয়স এদের সবার কাছেই খুব গর্বের। বললাম, যার বড় ছেলের বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন তাঁর বয়স একশ’ আট হওয়াটা কেমন বাড়াবাড়ি না? পঁচাত্তর কি আশি হোক, তাই বলে একশ’ আট? চা বানানোর লোকটি, মালিকই হবে দোকানের, কেউ একজন এক প্যাকেট বিড়ি চেয়ে তাড়া দেওয়ায় ধমকে উঠে বলল, ‘দুটোই হাত তো আমার, না কী’। লোকটাকে কেউ মনিদা বলে ডেকে পান দিতে বলল একটা। বিড়ির প্যাকেট বের করতে করতে আলাউদ্দীনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দুধ না লিকার?’ অবিনাশ কিছু বলার আগেই কার্তিক বলে দিল, ‘লিকার, লিকার— চিনি কম।’ ছোট্ট একটু জায়গায় আড়াআড়ি দুটো বেঞ্চ। আট-দশ জন বসে। বিড়ির ধোঁয়া। সোলার লাইট। পাশে বসা দাড়িওয়ালা একজন জিজ্ঞেস করল, ‘অমল ত্রিপাঠী?’
সেই দাড়িওয়ালা লোকটা, প্রথমে বুঝতে পারেনি অবিনাশ, নিজেও বয়স্ক লোকই একজন। বলল, অমল ত্রিপাঠীর প্রথম বউ তো সুইসাইড করেছিল গলায় দড়ি দিয়ে। না, লোকটা নিজে দেখেনি, দেখার কথাও নয়, তাঁর বয়স আশিতে পড়বে সামনের বর্ষায়। তবে সে জানে অনেক কিছুই ত্রিপাঠীবাবুকে নিয়ে। ত্রিপাঠীবাবু নাকি ভিক্ষে করত প্রথম জীবনে। দুই বিয়ে। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে ভগবানপুর থানা ভাঙতে গিয়েছিল কংগ্রেসিদের দলে ভিড়ে। বড়লোক হল তো দুর্গাপুরের অধিকারীদের দয়ায়।
‘ওইটুকু একটা মেয়ে সুইসাইড— গলায় দড়ি দিয়ে? আপনাদের বাবা-কাকাদের কেউ দেখেছিল সেই মেয়েকে?’
না, সেই প্রথম বউ এখানে দেখেনি কেউ কোনও দিন। মরেছিল তাহলে ত্রিপাঠীবাবু কে-প্লটে আসার আগেই। বা সেই মেয়ে হয়তো লাটের জঙ্গলের কথা শুনে আসতেই চায়নি ত্রিপাঠীবাবুর সঙ্গে। দাড়িওয়ালা লোকটার কথায়, সে নিজেও ভগবানপুরের, মানে ওর দেশ। ত্রিপাঠীবাবুর পরের বিয়ে তো এখানেই, মানে কে-প্লটের বয়স্করা নিমন্ত্রণ খেয়েছে। ত্রিপাঠীবাবুর সব সন্তানই দ্বিতীয় পক্ষের, সবাই বেঁচেও নেই অবশ্য। ওঁর বড় মেয়ে নাকি মরেছে কলেরায়, আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে, কুড়ি-বাইশ বছর বয়সে।
পূর্ণিমার আর দিন দুয়েক বাকি মাত্র। আকাশে প্রায় আস্ত একটা চাঁদ। আলাউদ্দীন বলে দিয়েছে বাইরে বের হলে বাঁধের দিকটাতে সাবধান, যাবেন। না, বাঘের ভয় নেই, তবে বাঘরোল খুব বাঁধের জঙ্গলে। বাঘরোল, সাপ। আর শীতকাল ছাড়াও এদিকে কুয়াশা থাকে কিন্তু।
আকাশ একেবারে ঢেলে আলো দিচ্ছে। আলো আর কুয়াশা এখন মাখামাখি। ডাল-পাতার নড়ে ওঠাকে তুমি কারও চলে যাওয়া বলে ভাববে। আবার সত্যিকারের কারও হেঁটে যাওয়াকেও তুমি হয়ত বিভ্রম বলে হয়ত ওড়াবে। রহমানদের বাড়ির দিক থেকে শব্দ আসছে না কীসের? কচকচ-কচকচ। তবে কি গোয়ালের গোরুগুলির কিছু? হয়তো না ঘুমিয়ে জাবর কাটছে বিকেলের খাবারের। বাড়ির বা পাড়ার কেউই জেগে নেই এখন। বাঁধের ওপারের নদীতে ভটভট শব্দ। কোনও ট্রলার হবে। হয়ত সাগরে যাচ্ছে। যাচ্ছে, না কি দাঁড়িয়েই আছে। যেন এই রাতে কুয়াশায় ডুবে অপেক্ষা করছে অবিনাশের জন্য। যেন তাকে বলবে কিছু। মাটির রাস্তার গায়ে হলুদের উপর ডালপাতার হালকা কালো নকশা। একটা মেয়ে না? হালকা, রোগা-পাতলা। পরনে ফ্রক একটা, মাথায় ফিতে। চেনা লাগছে না? কী নাম যেন? খড়ের চালার ঘর। এক্কা-দোক্কা খেলছে মেয়েটি। এক-পায়ে এক-একটা লাফের সঙ্গে ফ্রকটি উড়ছে হাওয়ায়। সঙ্গে আর দু’জন। একটি ছেলেও। খালি গা, ডুরি ভরা প্যান্ট। এটা কী পাখি ডাকল যেন? কুবকুব-কুবকুব। ঝপ শব্দ হল কোথায়, নির্ঘাত মাছরাঙা। পেছনে পুকুর। ডানদিকে ওটা চালতা গাছই। চালতা গাছ ছাড়িয়ে খড়ের চালা একটা, বাইরে উনুন। এ সময় ধোঁয়া হয় খুব। নির্ঘাত কাঁচা কাঠ। আর সেই ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে। জল বেরিয়ে আসে। অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ চোখ খুলতে পারে না অবিনাশ।
প্ল্যান পাল্টে দিল অবিনাশ। আলাউদ্দীনকে বলল, ‘সেই অমল ত্রিপাঠীর বাড়িতেই চল তো আর একবার।’
‘অন্য কোথাও কিন্তু যাওয়া যাবে না আর। ভেবেছিলাম সপ্তমুখী হয়ে ভাগবতপুর— ।’
‘সে না হয় পরে আর একদিন।’
আলাউদ্দীন বলল, ‘ত্রিপাঠীবাবুদের ঘরের সামনের রাস্তায় কাদা হবে কিন্তু! কাল রাতে হালকা বৃষ্টি হল যে টের পাননি? ওঠেননি একবারও? বাইরে যাননি?’
ত্রিপাঠীবাবু আজ একাই। ঘরে নয়, বাইরে বাঁধানো পুকুরঘাটে। আলাউদ্দীন বলল, ‘কী দাদু ঘরের লোকজন গেল কোথায় সবাই?’ ভদ্রলোক যেন শুনতেই পাননি কিছু। হয়ত বয়সের জন্যই। অবিনাশ বলল, ‘আবার আসতে হল, বুঝলেন? বিয়াল্লিশের আন্দোলনে আপনি নাকি কংগ্রেসিদের সঙ্গে থানা ভাঙতে— ।’
এবার আলাউদ্দীন বলে উঠল, ‘ও দাদু তোমার নাকি দুই বিয়ে?’ আলাউদ্দীনের কথা শেষ হতে না হতেই দুই নাতবউ, এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে, বাড়ি ঢুকল। আর আমাদের দেখেই সটান পুকুরপাড়ে। ওদের একজন বলে উঠল, ‘ও দাদু তোমার চম্পার কথা বল?’
আলাউদ্দীন বলল, ‘কিছুই তো দেখাতে পারলাম না আপনাকে, আপনি শুধু ওই ত্রিপাঠীবাবু আর মেলা করেই গেলেন।’ অবিনাশ ওর স্কুলের চাকরির কথা তুলল। নিয়মকানুন খুবই কড়া এখন। পরে আবার আসার কথা জানিয়ে নৌকার কথা জানতে চাইল। নৌকা মানে ভটভটি।
‘ভোর ক’টায় ছাড়ে যেন?’
দ্বীপ এলাকায় আসার এই এক ঝামেলা। ভোর ভোর বেরোতে না পারলে বসে থাক পরের দিনের জন্য। আলাউদ্দীন বলল, ‘ভোর কোথায়, এটা আপনাদের শহর নয় কিন্তু, এখানে দিন শুরু হয় রোদ ওঠার আগেই।’ ভটভটির টাইম বলল সকাল সাড়ে ছ’টা আর সাতটা।
বিয়াল্লিশের আন্দোলনের কিন্তু খুব ভালই বর্ণনা দিলেন ভদ্রলোক। অমল ত্রিপাঠী। এই বয়সে এত টাটকা স্মৃতি। থানার ছাদে ক’টা পুলিশ বসে ছিল, বা তখনকার কংগ্রেসি নেতার নাম, বা আন্দোলনের নেতা সুশীল ধাড়া— । তারপর দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের কথাও বললেন নিঁখুত বর্ণনা করে। কীভাবে মানুষ খিদের জন্য শাক-পাতা-লতা— । কীভাবে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বা ঘরে শুয়ে বসে থেকে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে, কীভাবে মরে যাচ্ছিল মানুষ। বা নিজের ঘরের বউ-মেয়েদের— । অবিনাশ এ সময় জানতে চেয়েছিল, ‘তখন কি চম্পার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে আপনার?’
‘তখন মানে আকালের বছরের কথা বলছেন?’
বুড়ো মানুষের বকবকানিতে কারওই খুব একটা আগ্রহ থাকে না। আলাউদ্দীন কখন কোথায় চলে গেছে কে জানে? নাতবউরাও আজ আর চায়ের কথা জানতে চায়নি। ভদ্রলোকের প্রথম বিয়ে হয়েছিল সেই আকালের গায়ে গায়েই। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে থানা দখলের পালা চলছে তখনও। কংগ্রেসিরা সবাইকে ঘর-বাড়ি ছাড়তে বারণ করছে। টেলিগ্রাফের পোস্ট উপরে ফেলা হয়েছে। রাস্তাঘাট বন্ধ। মাঝিদের নৌকা জল থেকে ডাঙায় উঠিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। কাউকে নদী পার করানো চলবে না। মোট কথা কেউ যেন ইংরেজদের ভয়ে এলাকা না ছাড়ে। লোকজন ভাবছে সৈন্য আসবে এবার, গুলিগোলা হবে। যে যে ভাবে পারছে তখন দেশ ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার তালে। এর মধ্যেই আশ্বিনের ঝড় আর বন্যা। ত্রিপাঠীবাবুর কথায়, বাড়িতে তখন ওঁর বাবা-মা-পাঁচ ভাইবোন ছাড়াও কাকা, কাকার পরিবার। সেই কোন কম বয়সে ভিক্ষে করতে করতে দুর্গাপুরের এই অধিকারীবাবুদের বাড়ি চলে আসা, আর অধিকারীবাবুর কথায় ওঁর বাড়িতে কাজে লেগে যাওয়া। মন্দিরের কাজ, পুজো-আচ্চা। এ ছাড়া রান্না। অধিকারীবাবুই বাঁচিয়ে রেখেছেন বলতে গেলে। বাড়ি ফিরতেন ওই মাঝে মধ্যে। বাবার হাতে কিছু টাকা-পয়সা বা চাল-ডাল দিয়ে আসা। বাবার হাতে কিছু টাকা-পয়সা দেবেন বলে অধিকারীবাবুদের দূর্গাপুর থেকে ভগবানপুর এসে সেবার হঠাৎ করেই কংগ্রেসিদের দলে ভিড়ে থানা ঘেরাওয়ে যাওয়া। এরপর? এরপর আর কী? পুলিশের গুলি, সেই থানার ছাদ থেকে। কোনও মতে প্রাণ বাঁচিয়ে ঘরে ফিরে পরদিনই সোজা অধিকারীবাবুর সেই দুর্গাপুরের বাড়ি। না, উনি আর নাকি ফেরেননি সেই গ্রামের বাড়িতে। মাঝেমধ্যে বাবা এসে টাকা-পয়সা নিয়ে যেতেন অধিকারীবাবুর কাছ থেকে।
ঝড়-বন্যার পরপরই চম্পার বাবা এল একদিন। ত্রিপাঠীবাবুর কথায়, লোকটা যে চম্পার বাবা তা তো জানা গেল পরে, তখন আমি জানব কী করে তাকে। দেখা করতে চাইল অধিকারীবাবুর সঙ্গে। হাতে ধরা একটি মেয়ে। ত্রিপাঠীবাবুর কথায়, উনি নাকি জানতে চেয়েছিলেন, বাড়ি কোথায়, মানে আসছেন কোত্থেকে? কে দেখা করতে চায়, বলতে হবে তো গিয়ে। পৈতে ছিল অর্থাৎ লোকটা যে ব্রাহ্মণ তাতে সন্দেহ নেই, তবু— ।
অবিনাশ জানতে চাইল, ভগবানপুর জেনে আপনি চিনতে পারলেন না লোকটাকে?
‘চেষ্টা করলাম খুব মনে করার, আসলে অনেক বছর আগে গ্রাম ছেড়ে চলে আসা তো। মাঝেমধ্যে যেতাম সে তো এক-আধ দিনের জন্য। ’
‘ভগবানপুর শুনে অধিকারীবাবু কিছু জিজ্ঞেস করলেন না আপনাকে, মানে চেনেন কিনা?’
‘না, উনি ব্যস্ত মানুষ, আমার দেশ যে ভগবানপুর তা ঠিক করে বললে, আমারই মনে থাকে না তখন, আর অধিকারীবাবু।’
লোকটার এক ভাই নাকি মরেছে ঝড়ে ঘর চাপা পড়ে। এক দানা চাল নেই। অধিকারীবাবুর কাছে ঝড়-বন্যা আর অভবের কথা বলল। লোকে নাকি শাকপাতা খাচ্ছে। শাকপাতা মানে যা পাচ্ছে হাতের কাছে। লোকটা পা জড়িয়ে ধরল অধিকারীবাবুর। মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, বাঁচান গরীব ব্রাহ্মণকে।
অমল ত্রিপাঠির বয়স তখন ওই আঠাশ-উনত্রিশ। ত্রিপাঠীবাবুর কথায়, আঠাশ-উনত্রিশ শুনে অবাক হবেন না, ভাবছেন ওই বয়সে তো আমার তিন-চার ছেলেমেয়ের বাপ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, ঠিকই, আসলে ভিখারী হলে যা হয়, কোন বাপ তার মেয়ে দেবে বলুন? হ্যাঁ, আমরা কিন্তু আকালের অনেক আগে থেকেই গরীব, খুব ছোটবেলা থেকেই ভিক্ষাবৃত্তি আমার।
অধিকারীবাবু বললেন, বিয়ে করতে হবে তোকে। আমি তো অবাক। বিয়ের কথা কোনও দিন ভাবিইনি আগে। চুপ করে আছি দেখে অধিকারীবাবু ফের বললেন, ব্রাহ্মণের মান বাঁচাতে হবে।
মালিক বলে কথা, শুনতেই হবে অধিকারীবাবু যা বলেন। চম্পা নামের মেয়েটির বয়স তখন মেরেকেটে বারো-তেরো। উপর-নিচ করে একটা গামছার মতো কিছু দিয়ে জড়ানো শরীর। চম্পার বাবার কথায়, খাওয়াতেই পারছি না, বিয়ে আর দেব কীভাবে? না, শুধু বিয়ে দেওয়া নয়, আবদার ছিল কিছু টাকারও। বা আসলে হয়তো টাকারই। অমল ত্রিপাঠীর কথায় তখন হত তো এমনিই। টাকা-পয়সা দিয়ে, কিছু চাল-ডাল দিয়ে লোকটাকে খাইয়েই বিদায় করলেন অধিকারীবাবু। বললেন, ভাবতে হবে না, একেবারে দিন দেখে পুরুত ডেকেই বিয়ে দেব আপনার মেয়ের।
ত্রিপাঠীবাবু নাকি ওঁর বাবা-মা-র কথা তুললেন, বললেন, বাবা-মাকে বলব না? তা-ছাড়া খাওয়াব কী? ত্রিপাঠীবাবুর মালিক সেই অধিকারীবাবুর কথায়, গরীব ব্রাহ্মণ পায়ে পড়েছে, ফেরাব কী করে? বিয়ে তোকে করতেই হবে। বললেন, এখন কে খাওয়াচ্ছে, তোর বাবা-মা না আমি? বললেন, তোকে বরং জমি দিচ্ছি লাটে, গোরু-লাঙ্গল দিচ্ছি, চাষ-আবাদ কর ওখানে গিয়ে।
কিন্তু গ্রামের বয়স্করা যে বলে চম্পাকে আপনি নাকি কে-প্লটে নিয়েই আসেননি কোনও দিন?
অমল ত্রিপাঠী চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। বললেন, আপনি জানলেন কোত্থেকে?
কার্তিককে বলে রেখেছে আলাউদ্দীন, সেকেন্ড ভটভটি ধরিয়ে দিতে হবে অবিনাশকে। সেকেন্ড ভটভটি মানে সকাল সাতটা। এত সকালে ওঠার অভ্যাস নেই অবিনাশের। তা ছাড়া রওয়ানা হওয়ার আগে মুখ-হাত ধোয়া বা বাথরুমের কথা ধরলে ওঠা উচিত কিন্তু ছ’টার আগেই। তখন রাত কত কে জানে? মোবাইল চার্জে থাকায় সময় জানার উপায় কোথায় তখন। রাতের দ্বীপটাকে একটু দেখে নেবে ভেবে ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরোল অবিনাশ। আলাউদ্দিন বলে রেখেছে বাঁধের জঙ্গলে বাঘ না থাকলেও বাঘরোল আছে কিন্তু, ওরা নাকি একা মানুষের মুখোমুখি হলে বিপদ তৈরি করতে পারে। কুয়াশা তখন একেবারে ঢেকেই ফেলেছে যেন পৃথিবীটাকে। আকাশের গোটা চাঁদটাই অদৃশ্য। শুধু ঘষা কাচের মধ্যে দিয়ে আসা হালকা আভার মতো কিছু। বাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে একেবারে বামুনঘাট অব্দি গেলে কেমন হয়? সেই পঁচাত্তর বছর আগে লোকটা ওখানেই লাগিয়েছিল নাকি ওর নৌকা। লাঙল, গোরু, কাজের লোক। সেই অধিকারী জীবনটাই পাল্টে দিয়েছিল লোকটার। একটা শব্দ হল না? কেউ ডাকল যেন কাকে। দ্বীপের কুয়াশা বাঁধ টপকে গড়িয়ে নদীর বুক বেয়ে কতদূর ছড়িয়ে গেছে কে জানে? হ্যাঁ, একটা শব্দই। কোনও নৌকা নোঙর করছে। দাওয়ালি দিয়ে বাঁধের জঙ্গল কোপাচ্ছে কেউ। বাঁধে ওঠার রাস্তা তৈরি করছে। কিছু মানুষ যেন কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। অবিনাশ হাঁটতে থাকে। অন্তত চার-পাঁচজনের দল একটা। চেনা লাগছে না একটা গলা? হ্যাঁ, চেনাই তো! এবার খটখট-খটখট শব্দ, একেবারে একটানা। সঙ্গে টুং-টাং। অবিকল গোরুর গলার ঘন্টাই। হ্যাঁ, গোরুই তো একজোড়া। অস্পষ্ট শরীরের কয়েকটি লোক। একজনের কাঁধে লাঙল একটা, আর কজন পেছনেই পড়ে গেছে কিছু। লাঙ্গল কাঁধে লোকটাকে চেনা লাগছে খুব, যেন কোথায় দেখেছে আগে, তা ছাড়া গলার আওয়াজ। কিন্তু একটি মেয়ের থাকার কথা ছিল না? মেয়েটি নেই তো। সেই যে এক বাবা তার মেয়েকে নিয়ে অধিকারীবাবুর বাড়ি— । কোথায় গেল সেই মেয়ে?
‘তুই না বিয়ে করলি, বিয়ে করায় এই লাঙ্গল-গোরু-জমি, আর মেয়েটাকে রেখে এলি কোথায়?’
লোকটাকে চুপ করে থাকতে দেখে অবিনাশ শিওর হয়ে যায় একেবারে। সেই দাড়িওয়ালা লোকটির কথা ঠিক হলে অধিকারীবাবুর দয়াতেই বড়লোক হয়েছে লোকটা। কেন ব্রাহ্মণের মেয়েকে উদ্ধারের কথা বলে মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়াবে ভিখারি টাইপের একটি ছেলের সঙ্গে? মেয়েটিকে তার মানে নিজের কাছে রেখে সেই ভিখারি টাইপের লোককে লাঙ্গল, গোরু, জমি দিয়ে লাটে পাঠিয়েছে।
‘শালা, চম্পা কোথায় বল? কোথায় ফেলে এসেছিস তুই ওকে? গোরু-লাঙ্গল-জমির লোভে মেয়েটিকে একটা বুড়ো ভামের হাতে তুলে দিয়ে আসলি?’
এক্ষুনি দাদুর লাঠিটা হাতে পাবে অবিনাশ, এক্ষুনি— , শুধু মা-র কাছ থেকে নামটা জেনে নিতে হবে একবার। ‘চম্পা, চম্পাই তো? মা, দাদুর সেই দিদি, সেই যে এক্কা-দোক্কা খেলা, সেই যে চালতা আর নিমের ছায়া, সেই যে এক-পায়ে ভর দিয়ে দিয়ে কিতকিত-কিতকিত, সেই যে ঝোপের আড়াল থেকে কোন এক পাখির কুবকুব ডাক, পুকুরের জলে ঝুপ শব্দ, মা মনে পড়ছে তোমার? চম্পা, ভগবানপুরের চম্পাই তো?’
‘বল, তোর সেই অধিকারীর ঘরে কেন বডি ঝুলে রইল চম্পার, চুপ করে আছিস কেন, বল। ওইটুকু একটা মেয়ে নিজের শাড়ি পেঁচিয়ে দড়ি দিল গলায়, আর তুই বিশ্বাস করলি?’
কাউকে ডাকতে হয়নি। নিজের থেকেই ঘুম ভেঙে গেল অবিনাশের। হাতমুখ ধুয়ে বাথরুমের কাজ সেরে সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছে অবিনাশ, অমনি কার্তিকের মোটরভ্যানের ভটভট-ভটভট। কুয়াশায় কিছু দেখতে না পাওয়া গেলেও শব্দ বেশ আগের থেকেই জানান দেয় কিন্তু। ঘাটে গিয়ে আলাউদ্দীন শুনল ফার্স্ট ভটভটি ছাড়ল মাত্র। কুয়াশায় দেখাই যাচ্ছে না কিছু। আর ফার্স্ট ভটভটি না ছাড়লে সেকেন্ডের কথা আসবেই বা কীভাবে? তার মানে আরও একটা সিগারেট, আর এক কাপ চা। নতুন কোনও গল্প। আর সত্যই গল্প আসে। আলাউদ্দীন সেই ত্রিপাঠীবাবুর খবর আনে একটা। মারা গেছে লোকটা। কাল রাতে কেন বাঁধের দিকে গিয়েছিল কে জানে, হয়ত পেচ্ছাব করতে বেরিয়ে কুয়াশায়— । স্ট্রোকই হবে। বা হার্ট অ্যাটাক। ওর নাতিরা নাকি অন্য কিছু বলছে। বলছে, ডেডবডির পাশে পড়ে থাকা লাঠিটা নাকি ওদের দাদুর নয়। সে লাঠি ত্রিপাঠীবাবুর হোক আর নাই হোক একশ’ আট বছরের একটা বুড়োকে তো কেউ আর মার্ডার করতে আসবে না? পড়ে গিয়ে আঘাত লাগায় রক্তও বেরিয়েছে মাথা থেকে। ওই বটগাছের বাঁদিকে লকগেট যাওয়ার রাস্তার পাশে যেখানে একটা ভাঙা লাঙলের ফাল পড়ে আছে, ওখানেই। কবেকার লাঙল কে জানে, কাঠের লাঙল কে আর ব্যবহার করছে এখন? জয়দেব ডাক্তারের কাছ থেকে এইমাত্র শুনে এল আলাউদ্দীন। জয়দেব ডাক্তারকেই ডাক করিয়েছিল ত্রিপাঠীবাবুর নাতিরা। আলাউদ্দীন বলল, ‘ভাগ্য ভাল, যা জানার আপনি জেনে নিয়েছেন কাল, একদিন দেরি হলেই আর— ।’
নৌকা ছাড়ার সময় অবিনাশ হাত নাড়াল আলাউদ্দীন আর কার্তিককে উদ্দেশ্য করে। জেটিতে দাঁড়িয়ে ওরা দুজনেও নাড়িয়েছে নিশ্চিত। কুয়াশার জন্য কেউই অবশ্য কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। ভটভটি স্টার্ট দিয়েছে মাত্র। ‘আবার আসবেন কিন্তু— ।’ বা এই রকম কিছুই। বা অবিনাশও যেন এই রকম কোনও কথাই— । সে যে যাই বলুক, নৌকার ভটভট-ভটভট ধ্বনি থেকে কোনও কথা বা অন্য কোনও শব্দকেই তখন আর আলাদা করার যাচ্ছে না।