পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

প্লাস্টিক সভ্যতা

  • 11 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 2008 view(s)
  • লিখেছেন : অংশুমান দাশ
এই তৈলকে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া ইহা হইতে এক মহান অজেয় অমর বস্তু বানাইবে মনুষ্যকুল, যাহা প্রকৃতিতে কোনওদিন ছিল না। convenience-এর ইহাই চূড়ান্ত ধাপ - তাহাকে বলিবে প্লাস্টিক। এই প্লাস্টিক যদিও হঠাৎ করিয়াই আবিস্কৃত হইবে বিংশ শতকের শুরুতে – কিন্তু তাহার গুনাবলী দেখি মানুষ চমৎকৃত হইবে। এই প্লাস্টিক মাটির তলায় পুঁতিলে ক্ষয় হয়না – টুকরো টুকরো হইয়া সর্বত্র এমনভাবে মিশিয়া যায় যে আমারও ক্ষমতা নাই সেই সব জায়গায় পৌঁছাইবার – শরীরের স্নেহ পদার্থে, মাতৃদুগ্ধে – প্লাস্টিক কোথায় থাকিবে না! প্লাস্টিক সস্তা, নরম অথচ শক্ত, ক্ষীণকায় অথচ বৃহদাকার। কিভাবে প্লাস্টিক আমাদের ক্ষতি করিবে, সেই সংক্রান্ত একটি আলোচনা

অতঃপর কৃষ্ণ অর্জুনের কাতর অবস্থা দেখিয়া বলিলেন – ভ্রাতঃ, নিরাশ হইও না। তুমি এখন ইহাদের না মারিলেও মনুষ্যকুল অদূর ভবিষ্যতে ধ্বংস হইবেই। সুতরাং তুমি এখন তীর চালাইয়া মারো কি না মারো কিছুই আসে যায়না। ইহারা আপন পদে আপনিই কুঠার চালাইয়া, আপনার ধ্বংসের কারণ হইবে।

অর্জুন কহিলেন – সে কী প্রভু! কেন?

ব্রাদার, কলিকালের শেষার্দ্ধে convenience নামক এক বিশেষ চাহিদার উদ্ভাবন হবে। এবং তাহাই এই মনুষ্যকুলের ধ্বংসের প্রধান কারণ হইবে।

অর্জুন সারা জীবন তীর চালাইয়া ফিরিয়াছেন। পঠন পাঠনের সময় পান নাই। এই খটোমটো শব্দ বুঝিতে পারিলেন না। বলিলেন – এই কন...whatever বস্তুটি কী?

বঙ্গভাষায় ইহাকে সুবিধা, সুখ, স্বাচ্ছ্ন্দ্য আদি বলিতে পার, তবে তাহা বলিলে সকল কথা বোঝানো যায় না। এই ধর তোমাকে হস্তিনাপুর হইতে বারনাবাত যাইতে হইবে – তাহার জন্য তোমার লোকলস্কর হস্তি অশ্ব সকল মিলিয়া হ্যাঁচোর প্যাঁচোর করিয়া যাইতে পনেরো দিনের ধাক্কা। মানুষ এমন শকট বানাইবে যাহা তোমাকে হুশ করিয়া লইয়া যাইবে – এমন কি সারথিরও প্রয়োজন নাই। মুদ্রা থাকিলে তোমার পরিবারে তোমার পঞ্চ ভ্রাতা, পাঞ্চালী, সুভদ্রা সকলের জন্য আলাদা আলাদা শকট ক্রয় করিতে পারো। এমনকী আকাশপথে পুষ্পক রথের ন্যায় উড়িবে এমন শকটও আবিষ্কার হইবে – এবং রাজকোষ থেকে স্বর্নমুদ্রা লইয়া যুধিষ্ঠির নিজের জন্যও এমন একটি মহামূল্যবান শকট কিনিতে পারেন।

অর্জুন কহিলেন – Damn good! তাহাতে সমস্যা কী?

কৃষ্ণ স্মিত হাস্যে বলিলেন – ধীরে ব্রাদার ধীরে। সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে আলো জ্বলিয়া উঠিবে – সুইচ টিপিলেই। এমন কি পথে, বিপথে, বাজারে, দোকানে রাত্রিকালে - কেউ কোথাও থাকিবে না, তবুও অনাবশ্যক দিনের আলোর মত নীল সাদা আলো জ্বলিতে থাকিবে। মনুষ্যকুল তাহাতে পুলকিত হইবে। গরম লাগিলে মাথার উপরে ত্রিহস্ত সমৃদ্ধ যন্ত্র বন বন করিয়া ঘুরিয়া উঠিবে, শন শন হাওয়া ছুটিবে। এমন কি প্রখর গরমেও প্রকোষ্ঠ নিমেষে শীতল করিয়া দিতে পারে এমন বাতানুকুল যন্ত্রও আবিষ্কার করিয়া ফেলিবে মানুষ। সুইচ টিপিলেই হইল।

অর্জুন উত্তেজনায় রথের উপরেই নাচিয়া উঠিলেন।

কৃষ্ণ বলিয়া চলিলেন – স্বর্নমুদ্রা থাকিলেই এই সকল বিলাসবহুল দ্রব্য তুমি ক্রয় করিতে পারিবে – ইহাতে তোমার জীবন যাপন মখমলের ন্যায় smooth হইয়া যাইবে। আর এই সকলই সম্ভব হইবে মৃত্তিকার গহ্বরে জমে থাকা তৈল আর কয়লাকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করিয়া।

অর্জুনের চোখ চকচক করিয়া উঠিল – তা ব্রাদার, ওই সুইচ নামক বস্তুটি কিনিতে কত স্বর্নমুদ্রা পড়িবে?

সুইচ তো নিমিত্ত মাত্র ভ্রাতঃ। উহা তাম্রমুদ্রা দিয়াও কিনিতে পারো – উহা কেবল একখানি খটাস করিয়া টিপিবার পুলি মাত্র – উহার দ্বারাই তুমি এই বাস্তব পৃথিবীর যন্ত্রণা হইতে ফটাস করিয়া convenience-এর জগতে আসিয়া পড়িবে। আসল মূল্য তো ওই জগতের। তবে একটা সময় আসিবে স্বর্ণমুদ্রা দিয়াও তুমি ওই সুইচ কিনিতে পারিবে না। কারণ গর্ভস্থ সকল তৈল আর কয়লা শেষ হইয়া যাইবে। আর ওই তৈল কয়লা পোড়ানো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হইয়া পৃথিবীর সকল প্রাণী দেহত্যাগ করিবে। এই convenience-এর লোভে লাগাম টানিবার কথা হাজার হাজার বার বলিবে কেহ কেহ – কিন্তু এই convenience-রাহুর অমোঘ গ্রাস হইতে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনও উপায় মনুষ্যকুল বার করিতে পারিবে না। কারণ এই convenience-এর লোভ দেখাইয়াই বণিককুলের ব্যবসা চলিবে, এবং সকলেই মনে করিবে – আমি আর কতটুকু তৈল খরচ করিতেছি, আসল খরচ তো করিতেছে আমার প্রতিবেশী। ইহার জন্যই এক প্রসিদ্ধ লেখক লিখিবেন – স্নেহ অতি বিষম বস্তু। লোকে তখন বুঝিতে পারিবে না যে উনি আসলে স্নেহ জাতীয় পদার্থ অর্থাৎ তৈলের কথাই বলিতেছেন।

কৃষ্ণের বাক্যবাণে অর্জুন ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গেলেন। আমতা আমতা করিয়া বলিলেন – আহা এমন সুখস্বাচ্ছন্দ্য কপালে সহিবে না?

কৃষ্ণ ডানহাত তুলিয়া অর্জুনের মাথায় স্বান্ত্বনাস্বরূপ রাখিলেন - এই তৈলকে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া ইহা হইতে এক মহান অজেয় অমর বস্তু বানাইবে মনুষ্যকুল, যাহা প্রকৃতিতে কোনওদিন ছিল না। convenience-এর ইহাই চূড়ান্ত ধাপ - তাহাকে বলিবে প্লাস্টিক। এই প্লাস্টিক যদিও হঠাৎ করিয়াই আবিস্কৃত হইবে বিংশ শতকের শুরুতে – কিন্তু তাহার গুনাবলী দেখি মানুষ চমৎকৃত হইবে। এই প্লাস্টিক মাটির তলায় পুঁতিলে ক্ষয় হয়না – টুকরো টুকরো হইয়া সর্বত্র এমনভাবে মিশিয়া যায় যে আমারও ক্ষমতা নাই সেই সব জায়গায় পৌঁছাইবার – শরীরের স্নেহ পদার্থে, মাতৃদুগ্ধে – প্লাস্টিক কোথায় থাকিবে না! প্লাস্টিক সস্তা, নরম অথচ শক্ত, ক্ষীণকায় অথচ বৃহদাকার। এই দিয়া তুমি কৃত্রিম হাঁটু হইতে বহন করিবার পাত্র – সকলই বানাইতে পারো।

প্লাস্টিকের গুণগান শুনিয়া অর্জুন শিহরিত হইয়া উঠিলেন – এ তো অতি চমৎকার। আমার তীরসকল প্লাস্টিকের হইলে তাহার এত ঘষা মাজার দরকার হইত না।

কৃষ্ণ চোখ পাকাইয়া বলিলেন - কিন্তু এই প্লাস্টিক পোড়াইলে বিষাক্ত ধোঁয়া, ইহাকে ফেলিয়া দিলে ইহা হইতে ভারী ধাতু মানুষের শরীরে পানীয় জল ও খাদ্য মারফত প্রবেশ করিবে ও মৃত্যুর কারণ হইবে। মনুষ্যকুল যেহেতু বাণিজ্য ও বাজার নির্ভর হইয়া উঠিবে, বাজার হইতে দ্রব্য ক্রয় করিয়া আচ্ছাদন করিবার জন্য অথবা বহন করিবার জন্য প্লাস্টিকের প্যাকেট আবিষ্কার করিবে। যাহাকে ম্লেছ ভাষায় ক্যারিব্যাগ বলিবে – এক একটি বস্তুর জন্য তাহারা এক একটি ক্যারিব্যাগ দাবী করিবে – যেন যত ক্যারিব্যাগ তত অর্গ্যাজম। এবং তাহা ফেলিয়া দিবে – এই ক্যারিব্যাগ অমর হইয়া মানুষের শ্মশান, কবর ও কফিনের সঙ্গী হইবে। ইহাও convenience।

এই সকল শুনিয়া অর্জুনের বিমর্ষভাব কাটিয়া গেল – অর্জুন ধরফর করিয়া উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন – হে শ্যালক, চালাও রথ। সকলের গুষ্টির ষষ্টি পূজা করিয়া তবে থামিব। এই পৃথিবীর মনুষ্যকূলকে ধ্বংস করিয়া তোমার দ্বারা বর্ণিত এই নতুন তৈল নির্ভর প্লাস্টিক সভ্যতায় প্রবেশ করিবার জন্য প্রাণ হাঁকুপাকু করিতেছে। এই সভ্যতা শেষ হইলে তবেই না আমরা ওই সভ্যতায় প্রবেশ করিতে পারিব? জয় convenienceএর জয়।

কৃষ্ণ রথের রশিতে টান দিয়া দাঁত কিড়মিড় করিয়া ম্লেচ্ছ ভাষায় বলিলেন – শালারা কিছুতেই শিখবে না। আমার এতবড় গীতাটা ভোগে গেল!

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হইল।

0 Comments

Post Comment