এরাজ্যের মানুষ দুভাগে বিভক্ত। একদিকে বহু মানুষ মোদী শাসনে অতিষ্ট হয়ে প্রচণ্ড বিজেপি বিরোধী, তাঁরা আসন্ন ২৪এর ভোটে বিজেপিকে হারাতে মরীয়া। অন্যরা মমতা শাসনে বিরক্ত হয়ে প্রচণ্ড মমতা বিরোধী এবং মমতাকে হারাতে মরীয়া। কিন্তু গোটা বিষয়টা অতখানি সিধেসাধা নয়। সিপিআইএম এবং তার সঙ্গিসাথীরা তো বটেই, এমনকি বহু মানুষ আছেন বিভিন্ন কারণে যারা সিপিআইএমের বিরোধী হলেও অনেক বেশি মমতা বিরোধী। তাঁরাও কি সিপিআইএমের র মতোই মমতাকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দেবেন? সিপিআইএম তো মুখে বলে, আমরা বিজেপি ও মমতা দুপক্ষকেই পরাস্ত করতে চাই। এখানেই লুকিয়ে আছে আসল রহস্য এবং অসত্য ভাষণ। রাজ্য সিপিআইএম নেতৃত্বকে জাতীয় রাজনীতি ও পার্টি কংগ্রেসের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এমনটা বলতে হলেও, ওটা মনের কথা নয়। মনের প্রকৃত কথা হচ্ছে, বিজেপির চেয়েও মমতা অনেক বড় শত্রু, তাই মমতাকে হারানো অনেক বেশি জরুরি। সে কারণেই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে অর্থাৎ মোদীকে দিয়ে মমতাকে হটাতে ২৪এর ভোটে মোদীকে জেতাতে ও মমতাকে হারাতে চায়। ঠিক যেমনটা ২০২১ এর ভোটে সিপিআইএম চেষ্টা করেছিল যত রকম ভাবে সম্ভব। নির্মমভাবে ব্যর্থ এবং তার ফল হলো শুন্য, ভোট পার্সেন্টেজ নেমে গেল ৫% এরও নিচে, যা প্রায় অবিশ্বাস্য। সেটা কিভাবে সম্ভব, একটু তলিয়ে ভাবলেই তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ক্রমশঃ পরিষ্কার হয়েছে যে, পঞ্চায়েত ভোটকে উপলক্ষ্য করে কেন্দ্র জমি তৈরি করছে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির। কারণ পঞ্চায়েত নয়, আসল লক্ষ্য লোকসভা ভোট এবং কেন্দ্রের ক্ষমতায় আবার ফেরা। দেশের সর্বত্র তো ৩৫৬ ধারা জারি করা যাবেনা। আর বাংলায় হিংসা ও সংঘর্ষের ঘটনা এবং এতগুলো মৃত্যু অবশ্যই যুৎসই অজুহাত। কিন্তু সংঘর্ষ বাঁধানো তো কোন কঠিন কাজ নয়, আর এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ২০১৮র মতো আদপে একতরফা তো নয়ই বরং বিরোধীরা এখন অনেক বেশি মারমুখী। ফলে কৌশল কার্য্যকর করতে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে আছে কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি। দুঃখের বিষয়, অন্ধ মমতা বিরোধিতার কারণে সিপিআইএম বা কংগ্রেসও বিজেপির এই সর্বনেশে খেলায় সামিল হয়েছে। অবশ্য বিরোধী শক্তির জোট INDIA গঠিত হবার পরে পরিবর্তিত পরিস্থিততে যদি মোদীর পরাজয়ের সম্ভাবনা প্রবল হয় তাহলে সিপিআইএম নেতৃত্ব তখন অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য হবেন।
আমরা উত্তেজিত হই টিভি দেখে, কারণ মিডিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে, কে কত বেশি গন্ডগোলের সংবাদ দেখাতে পারে। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, ৬১ হাজার বুথের মধ্যে গন্ডগোল হয়েছে মোটামুটি ৫০/৬০ টি বুথে। বাকিগুলোতে এরকম অশান্তি হয়নি। আমরা দেখলাম, বুঝলাম যে কারা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ব্যালট বক্স লুট করছে, ধ্বংস করেছে, জল ঢেলেছে ও জলে ফেলেছে এবং ইতিউতি মিলেছে অজস্র নানারকম ব্যালট পেপার। কিন্তু সব কিছুর জন্যই মিডিয়া দায়ী করছে শাসক দলকে। কম বেশি ছাপ্পা অনেক জায়গাতেই হয়েছে, যার যেখানে শক্তি বেশি সেই অনুযায়ী। বাদুরিয়ায় সিপিআইএমের ছাপ্পা ভোটও প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু সমগ্র অপরাধের জন্য মিডিয়া কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে শুধুমাত্র শাসক দলকে, বিজেপির গোটা চক্রান্তকে আড়াল করতে। ভোটগণনা নিয়ে অসংখ্য গল্প শোনানো হয়েছে, যার কোন প্রমাণ দিতে পারেনি মিডিয়ার একাংশ। আছে শুধুই মুখের কথায় নানাবিধ অভিযোগ। গোটা পর্বে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ একপেশে ও বিজেপির চক্রান্ত সহায়ক। কিন্তু কেন এই চক্রান্ত? আসলে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াতে বিজেপির যে ভোট কমবে, তা তাঁরা বুঝেছিলেন, আর সেই জন্যেই নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকেই কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছিলেন।
কিছুদিন আগেই রাজ্যের বিজেপি নেতারা গিয়ে দফায় দফায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে জেনে এসেছেন এই ভোটে তাদের কতটুকু ও কী করতে হবে, কারণ বাকিটা কেন্দ্র করবে। কেন্দ্র তথা মোদী যথেষ্ট উদ্বিগ্ন, বিরোধী পক্ষের বোঝাপড়ার গতিবিধিতে। দল ভাঙ্গানোর খেলায় এরাজ্যে সম্ভাবনা বিশেষ না থাকায় ৩৫৫/৩৫৬ ধারা জারি করে মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যেই এগোচ্ছে কি মোদী-শাহ? তেমন হলে আগামীদিনে যে লড়াই ও সংঘাতের পরিস্থিতি এরাজ্যে তৈরি হচ্ছে, সেবিষয়ে সবাইকে সবিশেষ সতর্ক ও প্রস্তুত থাকা জরুরি।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আমরা কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে বিশেষ উৎসাহী নয়। আমরা আগ্রহী শুধুমাত্র আগামী ২৪এর ভোট নিয়ে। কিন্তু যাঁরা মনে করেন, মমতা মোদীর চেয়েও খারাপ এবং দেশের পক্ষে অনেক বেশি ক্ষতিকর, তাঁরা অবশ্যই মমতাকে ভোট দেবেন না এবং মোদীকে দেবেন মমতাকে হারাতে। যদিও ২৪এর ভোট হচ্ছে কেন্দ্রের ক্ষমতায় কে বসবে মোদী না অন্য কেউ, তার জন্যই ভোট। এতে মমতার নবান্নে থাকা না থাকার কোন হেরফের হবেনা। সামনে ২৬এর ভোটে সেটা ঠিক হবে। তাও কেন সিপিআইএম বা মমতাকে যাঁরা ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়, তাঁরা মোদীকে জেতাতে ভোট দেবে? কারণ আবার মোদী জিতলে এবার নির্ঘাত ২৬এর আগেই মমতাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে। কারণ ২৪এ মোদী আবার জিতলে তখন বেপরোয়া হয়ে যা খুশি তাই করতে পারে। যে কোন প্রতিবাদে বুলডোজার চালিয়ে দেবার সাহস ও ক্ষমতা দুই অর্জন করবে। তখন সবরকম নিয়ম কানুন, সংবিধান সব কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, গণতন্ত্র চলে যাবে কোমায়।
আমরা দেখছি, বিরোধী জোটের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে, বড় কোন অঘটন না ঘটলে বোঝাপড়া হবেই। সর্বত্র একের বিরুদ্ধে এক, না হলেও ৪৫০এর মতো আসনে তা হলেই কেল্লা ফতে। বিজেপি খুব ভালো ফল করলেও ১৮০-১৯০এর মধ্যেই থাকবে, ২০০তেও পৌঁছতে পারবেনা। কিন্তু আত্মতুষ্টির কোন জায়গা নেই। কারণ দলটির নাম বিজেপি এবং দলপতির নাম মোদী। শেষমুহূর্তে কি আবার এক জাদু দেখাবেন, কে বলতে পারে? তবে যে কোন ছুতোয় ভোট পিছিয়ে দেবার বা বন্ধ করার একটা মরীয়া চেষ্টা কিন্তু করতেই পারে। তা সত্বেও যতই চেষ্টা করুক এবার কিন্তু সবাই সতর্ক। কারণ সবাই জানে যে, পুনরায় মোদী জিতলে বিপদ সবার, ছোট বড় সব দলের এবং সর্বোপরি দেশের মানুষের। আমাদের কর্তব্য, দেশের সেই বিপদটা সম্বন্ধে সবাইকে অবহিত করা, সচেতন করা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আঞ্চলিক দল সমূহের সবল থাকার সঙ্গেই সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অস্তিত্ব রক্ষা। কংগ্রেস বা বিজেপি, কোন বড় জাতীয় দলই এর স্বপক্ষে নয়। এরা ভাবে, আঞ্চলিক দল মানেই উৎপাত ও স্বার্থের সংঘাত। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণেই বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস দল ভেঙেই বিভিন্ন দলের জন্ম। ফলে একপ্রকারের জ্ঞাতি শত্রুর সম্পর্কীয় সংঘাত থাকাই স্বাভাবিক। যদিও কংগ্রেস এখন যথেষ্ট দুর্বল হয়ে বাস্তবকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু বিজেপি এখন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হয়ে 'এক দেশ - এক দল - এক নেতা'র স্বপ্নে বিভোর, সেখানে আঞ্চলিক দল সমূহের প্রশ্ন নেহাতই অবান্তর। এতদসত্বেও আমাদের সংবিধান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ও আঞ্চলিক দল সমূহের অস্তিত্ব রক্ষা আবশ্যিক।
পরিশেষে বলি, তৃণমূল, সিপিআইএম বা কংগ্রেস কারও অন্ধ সমর্থক না হয়েও কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের নিশ্চিতভাবে বিজেপির বিপক্ষে এবং ২৪এর ভোটে মোদীর পরাজয়কে সুনিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবী। 'একের বিরুদ্ধে এক' লড়াই সর্বত্র হলে মোদীর পরাজয় সুনিশ্চিত, কিন্তু তেমন সম্ভাবনা বাস্তবে বেশ কম। সেকারণেই প্রস্তুত থাকতে হবে বিকল্প সম্ভাবনার জন্য। যদি এমনটা হয় যে, ত্রিমুখী লড়াই হলো অর্থাৎ তৃণমূল, বিজেপি ও সিপিআইএম -কংগ্রেস জোট হলো। তেমন পরিস্থিতি হলে আমরা বিজেপির বিরুদ্ধে যেখানে যে বেশি শক্তিশালী, তাকেই সমর্থন করা যেতে পারে। প্রকৃত রাজনীতি সচেতন মানুষ এই বক্তব্য ও যুক্তিকে সমর্থন করবেন হয়তো। ঘৃণা ও বিদ্বেষের পরিবেশ মুক্ত হয়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ যেন শান্তিতে বাস করতে পারে, গণতন্ত্র ও সংবিধান স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল থেকে দেশকে প্রকৃত উন্নয়নের পথে চালিত করা যায়। দেশরক্ষার মধ্য দিয়ে প্রত্যেকে এভাবেই প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কর্তব্য পালন করা জরুরী।