পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ধর্মের নামে শোষণ: এটাই কুম্ভ মেলার ন্যারেটিভ

  • 24 February, 2025
  • 1 Comment(s)
  • 654 view(s)
  • লিখেছেন : সৌমি জানা
কুম্ভমেলার ন্যারেটিভ বিশেষভাবে বিপজ্জনক কারণ এটি সরকারের সংবিধানগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাকে ঢাকতে সাহায্য করে। বেকারত্ব, ক্ষুধা এবং বৈষম্যের মতো সমস্যাগুলি সমাধানের পরিবর্তে, রাষ্ট্র ধর্মীয় আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলিকে প্রচার করে, যা তার নিষ্ক্রিয়তার জন্য একটি ধোঁয়াশা হিসাবে কাজ করে। এভাবে এটি সংবিধানে নিহিত ন্যায়, স্বাধীনতা এবং সমতার মূলনীতিগুলিকে ক্ষয় করে।

কুম্ভ মেলা, বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশগুলির মধ্যে একটি, যা ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে উদযাপিত হয়। কিন্তু এই বিশাল আয়োজনের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা—যা মানবাধিকারের হরণ, শোষণ এবং সংবিধানের মূল্যবোধকে ধর্ম ও রাজনীতির নামে ব্যবহার করার চিত্রকে উন্মোচিত করে। কুম্ভ মেলার ন্যারেটিভ শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা বলে না; এটি একটি হাতিয়ার, যা সিস্টেমিক ব্যর্থতাগুলিকে ঢাকতে এবং বিভাজনের রাজনীতি চালিয়ে যেতে ব্যবহৃত হয়। আমরা সবাই জানি বোধহয় একাউন্টে ১৫ লাখ, বছরে ১ লক্ষ চাকরি তো দূর, মোদি জমানায় ভারতবর্ষ বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৭টি দেশের মধ্যে ১০৫ নম্বরে নেমেছে ভারত। গুরুতর' ক্ষুধা সমস্যাযুক্ত দেশের তালিকায় রয়েছে ভারত। এখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার ২.৯ শতাংশ এবং অপুষ্টির হার প্রায় ১৩.৭ শতাংশ। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত দেশের নদী, প্রকৃতি, মাটি, জঙ্গল সহ প্রাকৃতিক সম্পদগুলিকে মা, দেবী আখ্যা দিয়ে চলছে তার নিরন্তর নিষ্পেষণ ঠিক ভারতবর্ষের নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের মতোই। যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হলো গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স। ১৪৬টি দেশের মধ্যে যে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইন্ডেক্স তৈরির জন্য তাতে ভারত রয়েছে ১২৯ তম স্থানে অর্থাৎ একদম নিচে থেকে ১৮ নম্বর স্থানে রয়েছে ভারত। ২০২১ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ১৫৬ টি দেশের মধ্যে শেষের দিক থেকে ১৭ নম্বর স্থানে! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সূচক নির্ধারণ করা হয় লিঙ্গভিত্তিক অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সুযোগ, শিক্ষাগত অর্জন, স্বাস্থ্য এবং বেঁচে থাকা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উপরে ভিত্তি করে। আর সেখানেই মোদী জমানায় বহু ঢাকঢোল পেটানো নারী শক্তি সশক্তিকরণের দগদগে রূপ খুব স্পষ্টত বেরিয়ে এসেছে।রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে তিন জন মহিলার দুই জন বিনা পয়সায় খেটে মরেন। এখানেই শেষ নয়, এই রিপোর্ট বা প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা আছে এইভাবে চলতে থাকলে ১৪০ কোটির নাগরিক ও অর্থনীতির ভারতবর্ষতে ২০২৪ সালে লিঙ্গ ব্যবধান আরও বেড়ে ৬৪.১ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এই বৈষম্য ঘুচতে ১৩৪ বছরও যথেষ্ট নয় বলেও দাবি করেছে এই রিপোর্ট।

কুম্ভ মেলার ন্যারেটিভের কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের গরিব ও প্রান্তিক মানুষের শোষণ। দিনের পর দিন কাজ না পাওয়া, খাবার জোগাড় করতে না পারা মানুষদের বোঝানো হয় যে তাদের "পাপের" জন্যই তারা সবকিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের বলা হয়, কুম্ভে স্নান করলে তাদের পাপ মোচন হবে এবং মুক্তি মিলবে। এই ন্যারেটিভ শুধুমাত্র ভ্রান্তই নয়, এটি অত্যন্ত শোষণমূলক এবং ধর্মের আফিম মাথায় ঢুকিয়ে দেশের সংবিধান, দেশের নাগরিক হিসেবে ন্যূনতম নাগরিক অধিকার সব কিছু ভুলিয়ে গণ হিস্টিরিয়া তৈরি করার যেখানে মানুষ সুকুমার রায়ের কলের পুতুলের মত শুধুই ' পুণ্যের ' পিছনে দৌড়ায়, অধিকার আদায় ভুলে। গুজরাট, গোধরা থেকে এটাই বিজেপি মডেল যে এই সিস্টেমিক দারিদ্র্য ও বৈষম্যের দায় ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দিয়ে রাষ্ট্র ও তার নীতিগুলিকে দায়মুক্ত করে।

বাস্তবতা হল, এই সম্প্রদায়গুলির বঞ্চনার কারণ তাদের কর্ম নয়, বরং সরকারের ভুল নীতি এবং এমন একটি ব্যবস্থা যা ধনীদের প্রাধান্য দেয়। দারিদ্র্যকে একটি নৈতিক ব্যর্থতা হিসাবে চিহ্নিত করে, শাসকগোষ্ঠী শোষণের চক্রকে অব্যাহত রাখে, যাতে প্রান্তিক মানুষরা মিথ্যা আশার জালে আটকা পড়ে থাকেন।
প্রহসন খুব স্পষ্ট। মানুষের চোখে ঠুলি পরানোর এত উদ্যোগ কেন তাও স্পষ্ট। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে খাদ্যে মাত্র ২.০৫ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে ৷ এই পরিমাণ চলতি অর্থবর্ষ থেকেও অনেক কম ৷ চলতি অর্থবর্ষে বরাদ্দ ২.১২ লক্ষ কোটি টাকা ৷ খাদ্য ভর্তুকি খাতের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রেও কমেছে ভর্তুকি ৷ ২০২৪-২৫ অর্থ বর্ষে সারের দামে ১.৬৪ লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকি ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী ৷ চলতি অর্থবর্ষে এই ভর্তুকির পরিমাণ ১.৮৯ লক্ষ কোটি টাকা ৷ বলা যায় প্রায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকা কম বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে ৷ ভারত কৃষি ভিত্তিক দেশ ৷ সেই পরিস্থিতি কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণ সার ৷ সেখানে সারেই ভর্তুকি কমানো হয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ১.৮ শতাংশ। যদি আমরা আমাদের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার জন্য মোট বাজেটের পরিমাণ গণনা করি, তবে এটি জনপ্রতি মাত্র ৬৩৮ টাকার সুবিধা দেবে। এবং পরিসংখ্যান বলছে ভারত স্বাস্থ্য সূচকে সবচেয়ে পিছিয়ে। তাহলে দেশের বুনিয়াদি ভিত্তি শিক্ষা স্বাস্থ্য খাদ্য, সংবিধান অনুযায়ীও ভারতীয় নাগরিকদের যা ন্যূনতম অধিকার সেগুলো সব একে একে ধ্বংস করছে মোদি সরকার। কাজেই ধর্ম, বিভাজন, পাপ পূণ্যই তো দস্তুর হবে।
ভারতের সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে সমতা, মর্যাদা এবং শোষণ থেকে মুক্তির অধিকার প্রদান করে। কিন্তু কুম্ভ মেলা এবং অনুরূপ ধর্মীয় আয়োজনের ন্যারেটিভ প্রায়শই এই মৌলিক অধিকারগুলিকে ক্ষুণ্ন করে। গরিব মানুষদের শুধুমাত্র মৌলিক প্রয়োজনীয়তা থেকেই বঞ্চিত করা হয় না, তাদের অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়। তাদের বলা হয় যে তাদের কষ্ট অনিবার্য এবং তাদের একমাত্র আশা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা বা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ব্যবস্থাগত পরিবর্তন আনা নয়। পরিবর্তে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে।

এই ন্যারেটিভ বিশেষভাবে বিপজ্জনক কারণ এটি সরকারের সংবিধানগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাকে ঢাকতে সাহায্য করে। বেকারত্ব, ক্ষুধা এবং বৈষম্যের মতো সমস্যাগুলি সমাধানের পরিবর্তে, রাষ্ট্র ধর্মীয় আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলিকে প্রচার করে, যা তার নিষ্ক্রিয়তার জন্য একটি ধোঁয়াশা হিসাবে কাজ করে। এভাবে এটি সংবিধানে নিহিত ন্যায়, স্বাধীনতা এবং সমতার মূলনীতিগুলিকে ক্ষয় করে।

কুম্ভ মেলার ন্যারেটিভ হল ধর্মকে নির্বাচনী লাভের জন্য ব্যবহার করার বৃহত্তর রাজনৈতিক কৌশলের একটি প্রতিফলন। হিন্দুদের অন্যান্য সম্প্রদায়, বিশেষত মুসলমানদের দ্বারা হুমকির মুখে আছে বলে প্রচার করে, শাসক দল একটি বিভাজনমূলক ন্যারেটিভ তৈরি করেছে, যা এক সম্প্রদায়কে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। এই ন্যারেটিভ শুধুমাত্র প্রকৃত সমস্যাগুলি থেকে মনোযোগ সরায় না, এটি ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতিকেও উৎসাহিত করে।

যারা ইতিমধ্যেই বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে, তাদের বলা হয় যে তাদের সমস্যার কারণ "অন্য সম্প্রদায়"। এটি একটি বিভ্রান্তিকর বার্তা, যা ব্যবস্থাগত ব্যর্থতাগুলিকে ঢাকতে এবং একটি বিভাজনমূলক এজেন্ডা চালিয়ে যেতে সাহায্য করে। কাজেই এই মুহূর্তে অবশ্যম্ভাবীভাবে পাল্টা ন্যারেটিভের প্রয়োজন।
রামমন্দিরের উদ্বোধনের পরেও বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি, তার প্রধান কারণ ছিল একটি পাল্টা ন্যারেটিভ, যা সেই সময়ে সামনে আনা হয়েছিল। এই ন্যারেটিভে বলা হয়েছিল যে বিজেপি এককভাবে ক্ষমতায় এলে সংবিধান বদলে ফেলবে। মানুষের রায়ে ক্ষমতায় এসে মানুষেরই নাগরিকত্ব কেড়ে নেবে এখনও যদি আমরা একটি নতুন পাল্টা ন্যারেটিভ সামনে না আনতে পারি, যা এই বার্তা দেবে যে আমাদের বঞ্চনার জন্য মুসলমানেরা নয় বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নয়, বরং সরকারের নীতিগুলি দায়ী, তাহলে এই শোষণ ও বিভাজনের চক্র চলতেই থাকবে। আমাদের কাজ না পাওয়া, বেকারত্বের জন্য আমাদের করা পাপ নয়, বরং সরকারের ধনতান্ত্রিক নীতি দায়ী। এই সত্যকে সামনে নিয়ে এসে রাস্তায় নামা এখন সময়ের দাবি।

1 Comments

শরদিন্দু বিশ্বাস

24 February, 2025

অনবদ্য লেখা। সংগ্রামী অভিনন্দন

Post Comment