তখন আমি সদ্য কাজ শুরু করেছি।আর জি কর হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন বেশ কিছু রোগী দেখে মনে বেশ একটা বিশ্বাস আসছিল যে চেম্বারে গিয়ে বসব আর হাজারে হাজারে না হোক শয়ে শয়ে রোগী ছুটে আসবে। কিন্ত ব্যাপারটা দেখলাম সোজা নয়।তো এই রকম পরিস্থিতিতে এক বন্ধুর কথায়, বা 'অনুপ্রেরণায়' আমার বাড়ি হাওড়া থেকে সটান হাবড়ায় গিয়ে বসলাম।
অবস্থার বিরাট কিছু উন্নতি না হলেও দু একজন মাঝে মাঝে দয়াপরবশ হয়ে আমাকে দেখা দিচ্ছিলেন। এ রকমই একদিন প্রতিপদের চাঁদের মত এক দম্পতি এসে হাজির। স্বামীর হাতে প্লাস্টিকের প্যাকেটে এক গোছা প্রেসক্রিপশান।
—আর পারা যাচ্ছে না, এবার আমাকে গলায় দড়ি দিতে হবে।ভদ্রলোক কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললেন।
—কেন, কি হয়েছে? বলে ভাবলাম, ভদ্রলোকের কি ভয়ঙ্কর ডিপ্রেশান? কিন্তু ভুল ভাঙল।
—এই যে ইনি ধুয়ে ধুয়ে নিজেও মরছেন এবং আমাকেও মারছেন। বলে ভদ্রমহিলাকে দেখালেন।
জানা গেল ধোয়ার বাতিক গত দশ বছর ধরে। বাচ্চা হবার পরে তাকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে গিয়ে শুরু হয়েছিল। এখন সব কিছু ধুয়ে যাচ্ছেন। জামা কাপড়, চেয়ার টেবিল, থালা বাটি থেকে দরজার হাতল। একবার নাকি আলো পাখার সুইচ ধুয়েছিলেন তাতে করে বাড়ির কাজের মেয়ে হালকা শক খেয়ে তুলকালাম। থানায় ডায়েরি করবে বলে শাসিয়েছিল। ভদ্রমহিলার চিকিৎসা চলছ, কিন্তু রোগ কমলেও সেরে যাচ্ছে না।
এবার রোগটার কথায় আসি। সাধারণ ভাবে শুচিবায়ু নামে পরিচিত। ডাক্তারি ভাষায় অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজর্ডার (OBSESSIVE COMPULSIVE DISORDER) বা সংক্ষেপে OCD।
অবসেশান বলতে বোঝায় একটা বারবার আসা তীব্র চিন্তা যেটা চেষ্টা করেও আটকান যায় না। যেমন বাইরে বেরলে জামা কাপড় নোংরা হয়ে যাচ্ছে। আর কম্পালশান বলতে বোঝায় একটা বার বার করা আচরণ যেটা তাকে অবসেশানের উদবেগ থেকে সাময়িক মুক্তি দেয়। যেমন নোংরা লাগার চিন্তা (অবসেশান), মুক্তি পেতে সব কিছু ধোয়াধুয়ি ( কম্পালশান)। অনেক ক্ষেত্রে অবসেশান যৌনতামূলক বা আগ্রাসী চিন্তার হতে পারে। বারবার অশ্লীল চিন্তা মাথায় আসা, বিশেষ করে এমন জায়গায় যেখানে সেই ব্যক্তির তেমন ভাবনা মাথায় আসার কথা নয়, যেমন মন্দির বা মসজিদে।এছাড়া কারও সাথে যৌন সম্পর্ক করার তীব্র ইচ্ছা। আগ্রাসী চিন্তার মধ্যে কোনো বাচ্চাকে মারধোর করা বা কাউকে হত্যা করার চিন্তাও আসতে পারে। মনে রাখতে হবে এই চিন্তা সে আনতে চায় না কিন্তু এসে যায় এবং তার কাছে যন্ত্রনাদায়ক।
কারও কারও শুধু অবসেশান থাকে, কম্পালশান থাকে না। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও রোগটাকে OCD- ই বলা হয়।
ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বললাম, উনি ভাবেন ওনার এই নোংরা লাগার চিন্তাটা কিছুটা অযৌক্তিক কিছুটা সঠিক।
কিছু রোগী বোঝেন তাদের চিন্তাটা পুরোপুরি অযৌক্তিক, তাদেরকে চিকিৎসা করা সব থেকে সোজা। কিছু রোগী মনে করেন তাদের চিন্তাটা পুরোপুরি সঠিক, এদের চিকিৎসা সব থেকে কঠিন। বাকিদের অবস্থান মাঝামাঝি, যেটা ওই ভদ্রমহিলার। ফলে, ওষুধ দিয়ে বাড়ি পাঠালাম।
মাসখানেক বাদে ওরা আবার এলেন। ভদ্রলোক মহা হৈ চৈ শুরু করে দিলেন।
—জানেন কি করেছে। আগে কাজ থেকে ফিরলে আমাকে দরজা থেকে প্রায় নাঙ্গা হয়ে বাথরুম যেতে হত। ইদানিং সেটা করতে হচ্ছিল না। ভাবলাম ভগবান মুখ তুলে চেয়েছে। কিন্তু সেদিন বাজার থেকে চাল এনেছি, ওনার মনে হল চালে চড়াইপাখির পটি পড়ে আছে। সব চাল সার্ফ দিয়ে ধুয়ে তারপর রেঁধেছে। জামা কাপড়ের বদলে এখন পেটের নাড়িভুঁড়ি কাচছে!
ভদ্রমহিলা অপরাধীর মত মাথা নিচু করে বসে আছেন। এই রোগ এ রকম। কিছু উপসর্গ বাড়ে কিছু কমে। কেউ কেউ সব কিছু বারবার পরীক্ষা করে দেখেন। তালা লাগিয়েছেন কিনা বা গ্যাস বন্ধ করেছেন কিনা দেখার জন্যে রাস্তা থেকে আবার বাড়ি ফিরে আসেন। কেউ কেউ সব কিছু নিখুঁত রাখতে চান। জ্যামিতি মেপে জিনিস গোছাতে গিয়ে এত সময় চলে যায়, আসল কাজই এগোয় না। OCD রোগটা মূলত একটা উদবেগের অসুখ।সাধারণত ২০-২২ বছর বয়সের মধ্যে হয়। আরোগ্য খুব একটা নিশ্চিত নয়। শতকরা ২০-৩০ ভাগ রোগী ভালো হয়ে যায় আর সমপরিমাণ রোগী ক্রমশ খারাপ হয়। বাকিরা বাড়া-কমা নিয়ে জীবন কাটায় যেটা ওই ভদ্রমহিলার ক্ষেত্রে হয়েছিল।
ওরা মাঝে মাঝে আমার কাছে আসতেন উপসর্গ কমা বাড়া নিয়ে। সঙ্গে ভদ্রলোকের সুখ দুঃখের কথা আমাকে শুনতে হত। এই সুখ-দুঃখের কথা শোনা মনোচিকিৎসার এক বড়সড় অঙ্গ।
0 Comments
Post Comment