পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

না

  • 12 October, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 544 view(s)
  • লিখেছেন : দেবতোষ দাশ
বাঁদিকের গাল আর কান পেঁচিয়ে পেল্লাই চড়টা পড়তেই মাথা কেমন ঝাঁ-ঝাঁ করে ওঠে প্রত্যুষার। চারপাশ চক্রাকারে ঘোরে। ভিক্টর আগে তবলা বাজাত, খুব খরখরে ও শক্ত করতল। ও কেবল গালে মারে না, গাল-কান নিয়ে মারে। ডানহাতের পুরো পাঞ্জা যখন আছড়ে পড়ে প্রত্যুষার বাঁ গাল আর কানের মধ্যবর্তী পেলবতায়, কয়েক মুহূর্তের জন্য সাড় চলে যায় তার।

ভিক্টর কিন্তু থামে না, পরপর খান তিনেক চড় না-কষিয়ে ও শান্ত হতে পারে না। বস্তুত এই মার শুরু হয়েছে গতকাল রাত থেকে। নাহ্‌, মদ-টদ ভিক্টর খায় না, বউকে মারতে ওকে মদের দোহাই দিতে হয় না। বছর দু’য়েক বিয়ে হয়েছে ওদের, মারের ইতিহাসও ততদিনই। শিলং-এ মধুচন্দ্রিমার সময়েই প্রত্যুষা বুঝে গিয়েছিল স্বামী তার মারকুটে। হোটেলে এক বয়-এর সঙ্গে মারামারি করে বিতাড়িত হল হোটেল থেকে, অন্য হোটেলে গিয়ে ঘটনার জন্য প্রত্যুষা ‘কী দরকার ছিল ঝামেলা করার’ মতো নির্বিষ বিরক্তি প্রকাশ করতেই ক্ষেপে গিয়েছিল। প্রথম চড় সেদিনই মেরেছিল ভিক্টর। ভঙ্গি একই, খরখরে করতল, গাল-কান পেঁচিয়ে তীব্র আস্ফালন। তবে সেদিন পরপর তিনটে মারেনি, প্রথম দিন একটাই যথেষ্ট মনে করেছিল সম্ভবত।

 

খবরের কাগজে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখে ওদের বিয়ের আয়োজন। কল্যাণীর তপোবন ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ভিক্টর মুখোপাধ্যায়ের নজরকাড়া প্রোফাইল দেখে কোন বাপ-মায়ের না পছন্দ হয়! দেখতে–শুনতেও খোলতাই। প্রত্যুষাও সুশ্রী। ফিজিওলজিতে মাস্টার্স করে কলকাতায় সেন্ট্রাল বোর্ডের একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াত। কল্যাণী থেকে ট্রেন ধরে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে স্কুলে হাজিরা দেওয়া প্রায়-অসম্ভব, চাকরি ছাড়ে প্রত্যুষা। ভিক্টর ছাড়তে বাধ্য করে বললে কোনও অসত্য বলা হয় না। অন্য স্কুলে দুপুরের শিফটে চাকরি পেলেও প্রবল আপত্তি ছিল ভিক্টরের, এমনকী কল্যাণীর একটি স্কুলে ডাক পেলেও ওর অনাগ্রহে যোগ দিতে পারেনি প্রত্যুষা। বাবা-মাকে গোপন করেছে সবকিছু এমন নয়, এমনকী শিলং-এ চড়ের কথাও বলেছে, কিন্তু সব শুনে তাদের ওই নীরবতা ও শূন্য দৃষ্টি কয়েকবার দেখে পরবর্তীতে আর কোনও ঘটনাতেই রা কাড়েনি সে। একটু মেজাজি বই আর কিছু নয়, শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে উজ্জ্বল ভিক্টরের খুঁত বলতে এটুকুই। বরং ভিক্টরের মা একদিন নিচু গলায় প্রত্যুষাকে বলেছিলেন, ‘ওই বাপের অমন ছেলেই তো হবে! আমি কিছু বলতে পারিনি, তোমরা আজকালকার মেয়ে, চুপ থেকো না!’ ওরা কলকাতায় থাকেন, ওদের বিরক্ত করে না প্রত্যুষা। গত পুজোয় কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছে ওরা দু’জন, সামান্য কথা-কাটাকাটিতেই ভিক্টরের চড়, মায়ের সামনেই, তখন ছেলের আড়ালে বৌমাকে বলেছিলেন শাশুড়ি।

 

ভিক্টরকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা দু’একবার ভাবেনি তা নয়, কলকাতায় গিয়ে স্কুলে ঠিক একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারবে ও জানে, কিন্তু কেন যে ও চলে যেতে পারেনি, জানে না। অতটা সাহস কি ও কুলিয়ে উঠতে পারে না? তাই-ই হবে সম্ভবত। কিন্তু কীসের ভয়? একা থাকার ভয়, একা-একা এই বিশাল পৃথিবীকে যুঝবার ভয়? ঘরে একজন ভিক্টর, বাইরে হাজার হাজার, এইটাই কি তার ভয়? এই বিভ্রান্তি নিয়েই কাটিয়ে দিল দু-দু’টো বছর। প্রতি বছর নিয়ম করে ও আর ভিক্টর বেড়াতে যায়, একবার গরমের ছুটিতে, আর একবার পুজোয়। প্রতি মাসেই শাড়ি-জামা-সালোয়ারের পাশাপাশি বছরে খান দুই-তিন দশ-বারো হাজারের শাড়ি কিনে দেয় ভিক্টর। ফি বছর গয়নাও। হেন কোনও ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট বাজারে আছে অথচ ওদের নেই, অসম্ভব। প্রত্যুষারও দুটো স্মার্টফোন, একটা অ্যান্ড্রয়েড, অন্যটা আইওএস। এই তো গত মাসে ট্যাবটা বদলে দিল, আরও দামি একটা নিয়ে এসে ওকে চুমু খেয়ে বলল, পুরনোটা ফেলে দাও, এটা ইউজ করো! কিন্তু ওর মতের বিরুদ্ধে কথা বললেই অন্য ভিক্টর!

 

আজও পরপর তিনটে চড়ই কষাল ভিক্টর। দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না প্রত্যুষা। লাট খেয়ে পড়ল মেঝেয়। খাবার টেবিল থেকে উঠে, এঁটো হাতেই, ভিক্টর ওর গলাটা ধরে হিড়হিড় করে টেনে ওর শরীরটা ঠেলে দিল সোফায়। তারপর খাওয়ার টেবিল থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে ঝপাস ছুঁড়ে দেয় ওর মুখে। জলের ঝাপটায় প্রত্যুষা কেবল চোখ চেয়ে দেখে কত শান্ত, নির্মল ভিক্টরের চোখ। ওই শান্ত চোখ দেখলে সারা শরীরে শীতল একটা কম্পন চারিয়ে যায় তার, ভুলে যায় ঢোক গিলতেও। কেবল ভয়জনিত একটা হিক্কায় থেকে থেকে কেঁপে ওঠে সে। কাল রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত মেরেছে। কেন কাল রাতে মার শুরু করল, আজ আর মনে পড়ে না তার। তাকে মারতে ভিক্টরের কারণ লাগে না।

 

আজ সকালে স্নান করে খেতে বসে পমফ্রেট মাছে অতিরক্ত মশলার কাঁচা গন্ধ পেয়ে ক্ষেপে উঠেছে ফের। নিজেই বলে পমফ্রেট মাছ মাখা-মাখা পেঁয়াজ ঝাল হবে, কিন্তু মশলা উনিশ-বিশ হলে, রাগে কাঁপবে। আজ রাগে গরগর করে বলছিল, ‘আরও কষাতে হয় মশলা! কবে আর শিখবে! নিশ্চয়ই ফের গুঁড়ো মশলা এনেছ! শিলে বাটো, গতরটা নাড়াও একটু!’ দোষের মধ্যে প্রত্যুষা মাথা নিচু করে, প্রত্যুত্তরে বলেছিল, ‘আজ খেয়ে নাও, ফ্রিজে আরও মাছ আছে, কাল বাটা মশলা দিয়ে করে দেব।’ ব্যস, যেন ঘৃতাহুতি, মুহূর্তের মধ্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরপর তিনটে চড়। অপমান, ঘেন্না, শরীরের ব্যথায় সারারাত প্রায়-নির্ঘুম ছিল, তাছাড়া পিরিয়ডস্‌-এর আজ দ্বিতীয় দিন, তিনটে চড়ের ধাক্কা সামলাতে পারল না প্রত্যুষা, পা মুড়ে পড়ে গেল মেঝেয়।

 

জলের ঝাপটায় চোখ মেলে, হিক্কা তুলতে তুলতে প্রত্যুষা দেখে, শান্ত ভিক্টর হাতমুখ ধুয়ে, ছিক-ছিক করে বডি-স্প্রে সারা গায়ে ছড়িয়ে, জামা-প্যান্ট পরে, হাট করে দরজা খুলে চলে যায় কলেজে। স্কুটির আওয়াজ পায় প্রত্যুষা। নড়ে বসে সোফায়। ভিক্টর ধারেকাছে কোথাও না-থাকলে, আজকাল খেয়াল করেছে সে, শরীরে শক্তি সঞ্চার হয় তার। অতটা ভয় আর থাকে না। বস্তুত বিয়ের এই দু’বছর পরে ভিক্টরের এই মারকুটে চেহারাকে তীব্র ভয় করে প্রত্যুষা। আতঙ্ক। বড্ড লাগে যে! অমন কর্কশ, কঠিন পাঞ্জার চড় গতকাল রাত থেকে অন্তত খান দশেক মেরেছে! বেশিও হতে পারে। লাথিও মেরেছে গতরাতে! লাথির কথা মনে পড়তেই টনটন করে ওঠে পাঁজর, আজ সকালে চড়ের ঠ্যালায় ভুলেই গিয়েছিল পাঁজরব্যথার কথা! ব্যথা করছে বুকেও! ডানবুকটা ধরে এমন মুচড়ে দিয়েছিল, যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে যাবে মনে হয়েছিল! কিন্তু হয়নি, বিশাল খাটের এককোণায় পড়েছিল সারারাত। মাঝেমাঝে কেঁপে কেঁপে উঠেছিল ওই বুঝি নতুন করে ফের মারতে শুরু করবে ভিক্টর, কিন্তু ওর হালকা নাক ডাকার আওয়াজ পেতেই বিছানা ছেড়ে উঠে যায়, গিয়ে বসে লিভিং রুমের সোফায়। জাগ্রত অবস্থায়, মারমুখী অবস্থায় ভিক্টরের সামনে থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে মার দ্বিগুণ করে দেয় ভিক্টর। ফলত ওর মারের অপেক্ষায় অথবা শান্ত হওয়ার, ওর কাছাকাছিই পড়ে থাকে ও।

 

সোফা থেকে কোনওরকমে উঠে টয়লেটে যায়। প্যাড বদলায়। তারপর শোওয়ার ঘরে এসে দাঁড়ায় আয়নার সামনে। নিজেকে দেখে। বাঁদিকের গালটা লাল হয়ে আছে এখনও। মুখ ফিরিয়ে নেয়। আজকাল আয়নার দিকে তাকাতে ভালো লাগে না। লিভিং রুমে গিয়ে ফোনটা তোলে সোফা থেকে। টেক্সট করে – কাল রাত থেকে মারছে! কেন একেবারে মেরে ফেলছে নারে!

 

বার্তা পাঠাবার সময়টুকুই কেবল অতিবাহিত, মুহূর্তে বেজে ওঠে ফোন।

 

‘ওই গুদমারানিকে তুই আর কত সহ্য করবি? খিস্তি তো তোকে মারতে হয়!’

 

হোক রাগত, বর্ণালীর কণ্ঠস্বর শুনেই হু-হু করে কেঁদে ফেলে প্রত্যুষা। কোনও কথা বলতে পারে না। কেবল কাঁদে, হিক্কা তোলে, হিক্কা তুলতে তুলতে কাঁদে। বর্ণালী রাগে ফেটে পড়েও প্রত্যুষার অমন কান্না শুনে চুপ করে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর সামলে নিয়ে প্রত্যুষা বলে,

 

‘আমি ভয় পাই, কোথায় যাবো – কোথায় থাকবো – ’

‘জাহান্নামে যাবি – এর থেকে ঢের ভালো জায়গা!’

‘আমি পারবো না!’

‘তা’লে গাঁড়েগুদে লাথ খেয়ে পড়ে থাক ওই চুতমারানির ঘরে – আমায় জানাস কেন!’

‘তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই বর্ণ!’

‘তাহলে বোকাচোদা আমার কথা শুনতে হবে – পালটা ক্যালাতে হবে ওই অধ্যাপকচোদকে, পারবি?’

‘উফ, তোর ওই এক কথা! আমি ওই দানবটাকে মারব! তারপর তো আমায় খুন করে দেবে!’

‘দিক না! তুই তো চাস খুন হতে!’

 

জবাবে কিছু বলে না প্রত্যুষা। সামান্য বিরতি নিয়ে বর্ণালী বলে,

 

‘খুনের আর বাকি কী আছে! তোকে তো মেরেই রেখে দিয়েছে একপ্রকার, তুই কি আদৌ বেঁচে আছিস! প্রত্যুষা ব্যানার্জি বহুদিন আগে মরে চোদু হয়ে গেছে! তুই এখন প্রঁত্যুষাঁর ভূঁত!’

 

নাক টানতে টানতে হেসে ফেলে প্রত্যুষা। বর্ণালীর বলা শেষ হয় না।

 

‘এই যে সক্কাল সক্কাল বালবিচি বলে আমার কয়েল গরম করে দিলি, আজ সারাদিন প্রত্যেকটা পুরুষের বাচ্চার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব! অপমান করব!’

‘ভিক্টরের দায় সকলের ওপর চাপাবি কেন!’

‘পোলিটিক্যাল কারেক্টনেস চুদিও না ঢ্যামনা, আমি ওসব মানি না! স-ব ক’টা শালা – বিতানও ছাড় পাবে না!’

‘উফ্‌ বিতান তো ভালো ছেলে – যাঃ, তোকে আর কিছু বলব না!’

‘তুই ভিক্টরের বিরুদ্ধে কিছু করছিস না দেখে আমার মটকা আরও গরম হচ্ছে, এর জন্য ভিক্টর যতটা দায়ী, তুই আরও বেশি!’

 

নিশ্চুপ প্রত্যুষা। প্রতিবার ঘটনা ঘটার পর ফোনে কথা হবে বর্ণালীর সঙ্গে, তারপর পুনরাবৃত্তি, শেষে কিছু-করার প্রশ্নে গিয়ে তার আর কিছু বলার থাকবে না। কী করবে সে ভিক্টরের বিরুদ্ধে, সে তো নিজেই জানে না।

 

‘আসলে কী বলত, তোদের মতো মেয়েরা, তোরাই সংখ্যায় বেশি, পাল্টা কারোকে মারতে পারবি না! তোদের ব্রেন পারমিট করে না! আট-দশ কেজির একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে পারবি, চার কেজির লেহেঙ্গা নাচিয়ে বিয়েবাড়ি চষে ফেলতে পারবি কিন্তু একটা কেজি খানেকের চ্যালা কাঠ তুলে পালটা ক্যালাতে পারবি না! কেন পারবি না? কীসে আটকাচ্ছে? শক্তিতে? নাহ্‌, আটকাচ্ছে মানসিকতায়! মেন্টাল প্যাটার্নটাই এমন, তোদের ভাবনার ত্রিসীমানায় আসতে পারছে না পাল্টা মারের কথা!’ 

‘এগুলো অবাস্তব কথা বর্ণ! উল্টে কারুকে মারার কথা কখনও ভাবিনি – ছোটবেলাতেও না!’                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                     

‘পারবি কী করে! ব্রেইন-এ সেট করা প্যাটার্ন তোদের বিপদে পড়লে মারার অনুমতি দেয় না! আজ বর মারছে, কাল অন্য কেউ মারবে! মলেস্ট করবে! রেপ করবে! গোটা পৃথিবীটাই তো মলেস্টার আর রেপিস্টে ভর্তি! রিক্লেইম দ্য নাইট চুদিয়ে আর কী হবে! কেউ মারলে তোরা প্রথমেই দু’হাত বুকে জড়িয়ে, বসে পড়বি মাটিতে, যাতে কেউ তোদের বুকে বা গুদে হাত দিতে না-পারে। পিঠে বোম মারলেও আপত্তি নেই, পাঁজর ভেঙে দিল - তো ভি আচ্ছা,  কিন্তু বুক আর গুদে হাত পড়লে সাংঘাতিক কাণ্ড – পবিত্র শালগ্রাম শিলায় হাত পড়ে গেছে – এগুলো আসলে তোদের মাথায় প্রোগ্রামিং করে সেট করানো হয়েছে- ’

‘সবার দ্বারা ভায়োলেন্স হয় না বর্ণ!’

‘ওরে চোদনা, এটা একতরফা ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা – কমব্যাট! কমব্যাট মানে কেবল মারা নয়, মার খাওয়াও শিখতে হয় – তুই পাল্টা মারলে পুরুষ আরও ভায়োলেন্ট হবে, আরও মারবে – সেই মার কীভাবে নিবি শরীরে জানতে হয় – এন্ডিওরেন্স বাড়াতে হয়!’

‘বিয়েটা কি যুদ্ধ নাকি! এসব কী বলছিস বর্ণ!’

‘এই হিংস্র, নিষ্ঠুর পৃথিবীতে যুদ্ধ করেই বাঁচতে হবে বাওয়া, শুধু মার খেয়ে-খেয়ে চোখমুখ ফুলিয়ে বন্ধুর কাছে বালের ন্যাকাপনা করাটা জীবন নয়!’

‘আমি রাখছি, এইসব কথা আমি শুনতে চাই না!’

‘হ্যাঁ রাখ! এইসব ন্যাকামি শুনলে আমার গা চিড়বিড় করে!’

 

ফোন রেখে সোফায় চুপচাপ বসে থাকে প্রত্যুষা। বর্ণালী সেই স্কুলবেলার বন্ধু, বরাবরই ডাকাবুকো, খিস্তিবাজ। মুখ তো নয় যেন নর্দমা কিন্তু ওর কথাগুলো মনে যে একটা জোর দেয়, অস্বীকার করবে কেমন করে! 

 

শাওয়ারের তলায় দাঁড়ায়। হাপুস ভেজে কিন্তু শান্ত হয় না মন। ফোন বাজছে। বাজুক। ঘুলঘুলি দিয়ে দেখে নিমগাছ। অনেক গভীরে ওর শেকড়। কচি নিমপাতার তিরতির কাঁপুনির ফাঁক দিয়ে আকাশ। বেজে-বেজে বন্ধ হয়ে যায় ফোন।

 

ঠিকে কাজের লোক বাসন মেজে চলে যায়। কাফতান গলিয়ে, ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে একটা হাত খোপা করে গুঁজে দেয় লম্বা চুলের কাঁটা। তারপর খেতে বসে। পমফ্রেটের গা-মাখা ঝাল দিয়ে ভাত মেখে মুখে পোরে। কিন্তু গিলতে পারে না। ভাত মাখতে মাখতে থেমে যায় আঙুলগুলোও। টপটপ করে ভাতের থালায় পড়ে জল। চোখের জল। নোনতা অশ্রুবিন্দু মেখেই গলাধঃকরণ করে ভাত।

 

খাওয়া শেষ করে সিঙ্ক-এ রাখে বাসন-কোসন। মেয়েটা ফের আসবে চারটে নাগাদ। এখন একটা বাজে। সামনেই পড়ে আছে অসহনীয় এক ঘুঘুদুপুর। সোফায় গা এলিয়ে ফের হাতে তুলে নেয় ফোন। বর্ণালীর মিসড কল। ভয়েস মেসেজ।          

 

‘আসলে কী জানিস, তোরা কোনওদিন সত্যিসত্যি গুছিয়ে মার খেয়েছিস কিনা সন্দেহ! পেটে-মুখে লাথি বা নাক পেঁচিয়ে ঘুঁষি খেয়েছিস? ঘুঁষিটা মুখে আছড়ে পড়ার পর কানে একটা কুঁ-ই-ই-ই-ই শব্দ হতে-হতে কীভাবে চারদিক অন্ধকার হয়ে যেতে থাকে - পেটে একটা সপাট লাথি পড়লে ডায়াফ্রামের কাছ থেকে একটা দলা মতো উঠে এসে গলা থেকে মুখে ঠেলে ওঠে এমনভাবে হাঁ করতে ইচ্ছে করে, আর হাঁ করলেই দেখা যায়, ওটা এক দলা রক্ত! এইগুলো এক্সপিরিয়েন্স করেছিস! করলে, হয় পালটা মারের ইচ্ছে তৈরি হত, হতই, অথবা ওই নরক ছেড়ে পালাতিস! (সামান্য বিরতি নিয়ে গলা নামিয়ে) নিজেকে ঠকাস না প্রত্যুষা! একতরফা মার সহ্য করা জাস্ট অপরাধ! তুই যদি না-পারিস বলিস, আমি আর বিতান গিয়ে শুয়োরের বাচ্চাকে একদিন কেলিয়ে আসব!’

 

দুপুর গড়িয়ে বিকেল পেরিয়ে সন্ধে নামে। আশ্বিনের সন্ধে গুঁড়ি মেরে হঠাৎ নেমে আসে, আততায়ীর মতো। আবছা অন্ধকার চরাচরের দখল নিতেই ফের সন্ত্রস্ত হয় প্রত্যুষা। ভিক্টরের আসার সময় হয়ে গিয়েছে। আর গড়ানো চলবে না বিছানায়। উঠে রান্নাঘরের দিকে যায়।

 

কিছুক্ষণ পর বেজে ওঠে দরজাঘন্টি। হাসিমুখ ভিক্টরের, হাতে তেলে-ভেজা খাবারের মোড়ক। ভিক্টরের শান্ত চোখ, মুখের বিভাস দেখে ছ্যাঁৎ করে ওঠে ভিতরটা। এই সুবোধ লোকটাই মুহূর্তে চরম হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। নাহ্‌, মর্জিমেজাজ ভালোই আছে এবেলা, হাত-মুখ ধুয়ে খাবার-দাবার খেয়ে নেয়। সোফায় বসে চা খায় আয়েশ করে। তারপর ল্যাপটপ নিয়ে পড়ার টেবিলে যাওয়ার আগে গভীর চুম্বন করে প্রত্যুষাকে। প্রথমে নির্লিপ্ত থাকলেও পরে সাড়া দেয় সে-ও।

 

লিভিং রুমে কেবল পাখার আওয়াজ, ঘড়ির টিকটিক। এভাবেই বেজে যাবে সাড়ে ন’টা। ভিক্টর পড়াশোনা থেকে উঠে এসে কিছুক্ষণ টিভি দেখবে, এ-চ্যানেল সে-চ্যানেল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। তারপর দশটা নাগাদ খাবে। ইত্যবসরে প্রত্যুষা ফোন ঘাঁটে খাবার টেবিলে বসে। তার আগে যেটুকু দরকার রাতের রান্না সেরে ফেলেছে। খুট করে শব্দ হয় দরজায়। স্টাডির দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ভিক্টর। আজ একটু আগে-আগেই।

 

‘চলো খেয়ে নিই – বেরোতে হবে –’

 

অবাক হয়ে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয় প্রত্যুষা। রাতে আবার কোথায় বেরোবে? কিন্তু জিজ্ঞেস করে না।

 

‘তুমিও যাবে।’

 

ফের চোখ তোলে প্রত্যুষা। কোথায় যেতে চায়? সিনেমা? কিন্তু তার যে একটুও মুড নেই।

 

‘ঋত্বিক সদনের সামনে আজ প্রোগ্রাম আছে। রাতদখলের প্রোগ্রাম। কলেজের সকলেই যাবে।’

 

তারপর এগিয়ে এসে সটান প্রত্যুষার ঠোঁট চুষতে শুরু করে। কানের পেছনে দেয় নখের আঁচড়। ডান হাত দিয়ে বাঁ দিকের বুক মোচড়ায়। টনটনিয়ে ওঠে প্রত্যুষা। গতরাতে সর্বশক্তি দিয়ে বুকটা মুচড়ে দিয়েছিল। যন্ত্রণা এখনও মরেনি। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায় সোফার দিকে।

 

‘আমি যাবো না!’

‘আরে চলো না, সকলে যাচ্ছে! ঘন্টা খানেক থেকে চলে আসব!’

‘নাহ্‌!’

 

দু’বার ‘না’ বলেছে ভিক্টরকে, যে একবারও শুনতে অভ্যস্ত নয়।

 

‘তুমি যাবে!’ বলেই জোরে ধাক্কা মারে প্রত্যুষাকে।

 

প্রত্যুষা দ্রুত উঠে পড়ে ভিক্টরকে ঠেলে চলে যায় রান্নাঘরে। শুরু করে ভাত বাড়তে। পায়ের পাতা থেকে রাগ তখন লেলিহান শিখার মতো মাথায় উঠে গিয়েছে ভিক্টরের। সে লম্বা পা ফেলে রান্নাঘরে গিয়ে প্রত্যুষার চুলের মুঠি ধরে ফের নিয়ে আসে লিভিং রুমে। হিসহিসিয়ে বলে, ‘তুমি যাবে আমার সঙ্গে! গেট রেডি!’ প্রত্যুষা ধীরে ধীরে মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে ভিক্টরের চোখে চোখ রেখে বলে, ‘না।’

 

‘তুমি যাবে’ চিৎকারের সঙ্গে একটা তীব্র ঘুঁষি নেমে আসে নাকের গোড়ায়। মুহূর্তে কানের ভিতর একটা শোঁ-শোঁ আওয়াজ, তীব্র যন্ত্রণায় যেন অজ্ঞান হয়ে যাবে প্রত্যুষা। একটা লাথি এসে পড়ে পেটে, ভিতর থেকে উথলে ওঠে একটা দলা, থুঃ করে ছুঁড়ে দেয় প্রত্যুষা ভিক্টরের দিকে। চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতেও প্রত্যুষা খেয়াল করে, নাহ, রক্ত নয়, এক দলা কফ গিয়ে আটকে যায় ভিক্টরের মুখে। হাত দিয়ে মুছে নিতে গিয়ে ভিক্টর দেখে কিছুটা হাতে আর কিছুটা মুখে ঝুলছে সেই কফের দলা। আড়ে-বহরে রাগ আরও কিছুটা বাড়তে যেটুকু সময়, ‘খানকি মাগী’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভিক্টর। টান মেরে খুলে দেয় ওর শাড়ি ও যাবতীয় আবরণ, নিজেরটুকুও। প্রত্যুষার গলা থেকে অশ্রুতপূর্ব এক স্বর নির্গত হয় – নাঃ! আমার পিরিয়ডস হয়েছে! কিন্তু ভিক্টর পেড়ে ফেলে তাকে। শিশ্নসহ তার প্রতিটি প্রত্যঙ্গ দর্প হেতু খাড়া ও বেগবান।

 

যা-কখনও করেনি ভিক্টর, আজ সেই কাণ্ড করছে! আর পারে না প্রত্যুষা, জ্বলে ওঠে। ডান হাতে একটানে মাথা থেকে খুলে নেয় চুলের কাঁটা, তারপর এক ঝটকায় ভিক্টরকে ছাড়িয়ে নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে গেঁথে দেয় ওর পৌরুষে। অপ্রত্যাশিত আঘাতে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফটায় ভিক্টর। দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে প্রত্যুষা হাতে নেয় নোড়া, তারপর যন্ত্রণাক্লিষ্ট ভিক্টরের পাশে বসে গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে মারে ওর ডান করতলে। একবার নয়, পরপর তিনবার। তারপর সামান্য বিরতি নিয়ে বারবার, যেন গুঁড়ো করে দেবে তবলাচর্চিত কর্কশ ওই পাঞ্জা। ইতোমধ্যে ভিক্টরের ফোন বাজতে বাজতে ক্লান্ত হয়ে স্তব্ধ হয়েছে।

 

অতঃপর রাত ক্রমাগত নিঝুম ও রক্তাক্ত।

 

বাইরে প্রাক-সূর্যোদয়ের আলো। একটা খালি টোটোকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে উঠে পড়ে প্রত্যুষা। চালকের উদ্দেশে বলে – স্টেশন। রাস্তায় শুরু হয়েছে চলাচল। মেসেজ লিখতে গিয়ে শেষমেশ ফোনই করে প্রত্যুষা – একটা পিজি খুঁজে দিবি? যদ্দিন না-পাই তোর বাড়িতে থাকব! আসছি!

 

জবাবে মুখে কোনও কথা জোগায় না বর্ণালীর। হু-হু করে কেবল কাঁদে সে-মেয়ে। ফোন ছাড়ে প্রত্যুষা।

 

ঋত্বিক সদনের সামনে তখনও বেশ কয়েকজন বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে, ওদের মাথায় ব্যান্ড – বিচার চাই! 

 

অকাতরে ঘুমোচ্ছে ভিক্টর। একবার ভেবেছিল নব ঘুরিয়ে গ্যাস চালিয়ে দিয়ে আসবে, উঠে বসে সিগারেট ধরাতে গেলেই – নাহ্‌, পারেনি প্রত্যুষা। গতরাতে চুলের কাঁটাকে শিশ্নভেদী করবে ভেবেছিল, পারেনি প্রত্যুষা। ভেবেছিল নোড়া দিয়ে থেঁতো করে দেবে ভিক্টরের করতল, পারেনি। ভেবেছিল অনেক কিছুই, বস্তুত, বলাৎকাররত ভিক্টরকে বা পরেও সামান্য শারীরিক আঘাতও সে করতে পারেনি। কিন্তু আজ ভোরে দরজাটা খুলতে পেরেছিল।

 

বর্ণালীর মেসেজ ঢোকে – লাবিউ! তিনবার লিখেছে।

 

ঋণ: ৩০ নভেম্বর, ২০১৯ ফেসবুক-এ স্বর্ণালী ইশাক লিখিত একটি পাবলিক পোস্ট-এর কনটেন্ট এই গল্পে ব্যবহৃত হয়েছে। 

 

কভার ছবি - করতোয়া সেনগুপ্ত

 

           

      

 

                        

0 Comments

Post Comment