পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নিট কেলেঙ্কারি: চলমান শিক্ষা দুর্নীতির নতুন অধ্যায়

  • 13 June, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 986 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন কল্যাণ মৌলিক
আমরা ইদানিং কালে বাংলার শিক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। চিন্তিত হওয়ার মতো বিষয় বলেই চিন্তিত, কিন্তু আমাদের প্রচলিত গণমাধ্যমগুলো কি আরো যে বড় দুর্নীতি হয়েছে, সারা দেশ জুড়ে, সেই নিট কেলেঙ্কারি নিয়ে কম চিন্তিত? অথচ, এই যাঁরা আজকে দুর্নীতির সাহায্য নিয়ে আগামী দিনে চিকিৎসক হবেন, তাঁরাই তো আগামীদিনে আমার আপনার চিকিৎসা করবেন? তাহলে এই নিট নিয়ে কথা বলছি না কেন আমরা? কেন রাস্তায় নামছি না?

৪ ঠা জুন,সারা দেশ যখন লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মাতোয়ারা,তখন হবু চিকিৎসকদের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে আরেকটি বড়ো মাপের দুর্নীতি সংঘটিত হল।শিক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতি এদেশে নতুন কথা নয়।আমরা মেডিকেল পরীক্ষা নিয়ে মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম দুর্নীতি দেখেছি,উত্তরপ্রদেশ সাম্প্রতিক সময়ে চাকরি সংক্রান্ত পিএসসি পরীক্ষা দুর্নীতির কারণে বাতিল হয়েছে,এ রাজ্যে স্কুল শিক্ষকদের নিয়োগের প্রশ্নে স্কুল সার্ভিস কমিশনের সীমাহীন দুর্নীতি আজ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে গভীর সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। মেডিকেল নিট (ন্যাশানাল এলিজিবিলিটি কাম এনট্রান্স টেস্ট)  পরীক্ষার দুর্নীতি সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।শুধু পার্থক্য হল এসএসসি পরীক্ষায় দুর্নীতি নিয়ে যে গণরোষ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি,নিটের বেলায় তার সিকিভাগও দেখা যাচ্ছে না।

নিট পরীক্ষার দিন স্থির হয়েছিল ৫ মে,পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব ন্যাশানাল টেস্টিং এজেন্সি( এনটিএ)। সাম্প্রতিক সময়ে সমস্ত কেন্দ্রীয় পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব এই সংগঠনের হাতেই ন্যাস্ত।দেশের ৭০০ টি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার আশায় ২৪ লক্ষ পরীক্ষার্থী নিট পরীক্ষায় অংশ নেয়। দেশের মধ্যে ৫৭১ টি এবং দেশের বাইরে ১৪ টি পরীক্ষাকেন্দ্র খোলা হয়।এবারে পরীক্ষা শুরুর আগে থেকেই অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ উঠতে থাকে যা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে ফল প্রকাশের পর।বিশেষ করে পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা বহু জায়গায় রাস্তায় নামেন,আদালতে একাধিক মামলা হয়। এমনকি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার দাবি ওঠে। নিট পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগের বহুমাত্রিকতা বোঝার জন্য আমরা বিষয়গুলিকে পয়েন্ট আকারে ভাগ করতে পারি।

# এবারে নিট পরীক্ষার দু দিন আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এমনকি প্রশ্নের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে থাকে। ন্যাশানাল টেস্টিং এজেন্সি বিষয়টিকে অসম্ভব বললেও টাইমস অব ইন্ডিয়া সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে অন্তত তিনটে এই ধরনের খবর প্রকাশিত হয়। সবচেয়ে বড় কথা  বিহারের ইকোনমিক অফেন্স ইউনিট পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক সহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এক একটি প্রশ্ন পত্র কেনাবেচা হয়েছে।

#এবারে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে 'গ্রেস মার্কস'। ১,৫৬৩ জন পরীক্ষার্থীকে গ্রেস মার্কস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কি কারণে দেওয়া হয়েছে এবং কত নাম্বার দেওয়া হয়েছে-- সেই বিষয়টা যথেষ্ট গোলমেলে। পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর পাঞ্জাব,হরিয়ানা,দিল্লি ও ছত্তিসগড়ের কিছু পরীক্ষার্থী হাইকোর্টে এক আবেদনে বলেন যে পরীক্ষা হলে বিভিন্ন কারণে ( একটি কারণ হল ভুল প্রশ্নপত্র দেওয়া/ কেউ আবার দেরিতে পরীক্ষা শুরু হওয়ার অভিযোগ করেছেন) তাদের সময় নষ্ট হয়েছে। এনটিএ তখন ২০১৮ সালের সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়কে মাপকাঠি মেনে ( যদিও সেটা নিটের মত পেন অ্যান্ড পেপার টেস্ট ছিল না) এই পরীক্ষার্থীদের গ্রেস মার্কস দেয়।ফিজিক্সওয়ালা নামে এক শিক্ষা পোর্টালের অলখ পান্ডে আদালতে অভিযোগ করেছেন এই পরীক্ষার্থীদের গড়ে ৮০-১০০ নাম্বার গ্রেস দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সম্পূর্ণ মেধা তালিকাটাই বদলে গেছে। এনটিএ এখন পর্যন্ত গ্রেস দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও নাম্বারের বিষয়ে মৌনব্রত পালন করছে।

# গ্রেস সংক্রান্ত জটিলতা এখানেই শেষ হল না। প্রশ্নপত্রের ফিজিক্স অংশে একটা প্রশ্ন ছিল যার দুটো অপশন সঠিক। এখন নিট পরীক্ষার নিয়ম হল একটি প্রশ্ন কেউ সঠিক উত্তর দিলে চার নম্বর পাবে, কিন্তু উত্তরটা ভুল হলে চার নম্বর তো যাবেই, তার সঙ্গে এক নাম্বার ভুলের কারণে কাটা হবে। এখন যারা দুটো উত্তরের যে কোন একটার উত্তর দিয়েছিল তারা পুরো নম্বর পেল। কিন্তু যারা সেই প্রশ্নটির জটিলতা উপলব্ধি করে সেই প্রশ্নটি ছেড়ে দিয়ে এসেছিল তারা নাম্বারটা পেল না। এক্ষেত্রে পরীক্ষার স্বাভাবিক নিয়ম হল প্রশ্নপত্রে ভুল থাকলে সমস্ত পরীক্ষার্থী  গ্রেস মার্কস পাবে। কিন্তু এনটিএ সেটা না করার ফলে প্রচুর পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হল।

# মেধা তালিকাতেও দুর্নীতির ছবি স্পষ্ট। এতদিন সর্বভারতীয় তালিকায় প্রথম স্থান পেত দু থেকেতিন জন। এবার প্রথম স্থানে রয়েছে একসঙ্গে ৬৭ জন। আবার হরিয়ানার ঝাঁঝড়ে একটি নির্দিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে ৭ জনের নাম তালিকায় রয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানের ক্ষেত্রে আরো বেশি হাস্যকর অবস্থা। নিট পরীক্ষায় ১৮০ টি প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে দিলে সর্বোচ্চ নাম্বার হবে ৭২০।কেউ যদি একটা প্রশ্নের উত্তর ভুল দেয় তবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হবে ৭১৫। আর যদি একটা ছেড়ে দেয় তবে নাম্বার হবে ৭১৬।অথচ নিটের মেধাতালিকায় দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারী পেয়েছে যথাক্রমে ৭১৯ ও ৭১৮। এই নাম্বার গাণিতিক পদ্ধতিতে অসম্ভব।

# ন্যাশানাল টেস্টিং এজেন্সি এই দুর্নীতি ও অসঙ্গতি গুলোর সাথে প্রথম থেকেই পরিচিত ছিল। তারা বিষয়গুলোর সমাধান না করে অন্যভাবে ব্যাপারটাকে গুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে। বিজ্ঞপ্তি ছিল ১৪ জুন ফল প্রকাশিত হবে। রাতারাতি বিষয়টা পরিবর্তন করে ৪ জুন ফল প্রকাশ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল লোকসভা ফলের দিন নিটের ফল প্রকাশিত হলে বিতর্কটা সেভাবে হবে না। যদিও এই অসাধু পরিকল্পনা সেভাবে কাজে লাগে নি।

নিট পরীক্ষায় এই পর্বত প্রমাণ দুর্নীতি পরীক্ষার্থীদের মানসিক ভাবে ভয়ঙ্কর ভাবে চাপে ফেলে দিয়েছে। তামিলনাড়ুতে ইতিমধ্যে ১৪ জন পরিক্ষার্থী  আত্মহত্যা করেছে। অন্যান্যবার কেউ ৭২০ নাম্বারের মধ্যে ৬৫০ পেলে নিশ্চিত ভাবে মেধা তালিকায় ১০,০০০ র‍্যাঙ্ক করত। এবার সেই পরীক্ষার্থীর র‍্যাঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৩০,০০০। সর্বোচ্চ আদালত পরীক্ষার ফলাফল ও কাউন্সিলিং  এর  ক্ষেত্রে কোন স্থগিতাদেশ না দিলেও পরীক্ষায় যে অস্বচ্ছতা হয়েছে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই অবস্থায় আদালতের উচিত যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিষয়টির ফয়সালা করা কারণ ২৪ লক্ষ পরীক্ষার্থীর জীবন আজ অনিশ্চিত।

নিট পরীক্ষা আরো বৃহত্তর সংকটের ছবি আমাদের সামনে উপস্থিত করে। সাম্প্রতিক সময়ে পরীক্ষা ব্যবস্থা ও দুর্নীতি সমার্থক হয়ে উঠেছে। এটা কোন একটি রাজ্য বা অঞ্চলের বিষয় নয়। চাকরির পরীক্ষা হোক বা সর্ব ভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা হোক-- পয়সার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত হচ্ছে  গরীব বাড়ির ছেলেমেয়েরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কোচিং সেন্টারগুলোর ভূমিকাও এই বিষয়ে সন্দেহজনক। বঞ্চিতরা আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন, দীর্ঘসূত্রতার কারণে আদালতেও কোন ফয়সালা হচ্ছে না। এমনিতেই বেকারি সর্বোচ্চ অবস্থায়, তার পরে একের পর এক দুর্নীতি আজকের তরুণ প্রজন্মকে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। শুধু আদালতের মুখাপেক্ষী না হয়ে রাস্তায় নামা আজ সময়ের দাবি।

শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকার, এই নিট পরীক্ষার দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলা চলাকালীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে জানিয়েছে, যে যাঁদের গ্রেস নম্বর দেওয়া হয়েছে, তাঁদের আবার পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বিষয়টা তো শুধু আরো একবার পরীক্ষা নিলে সমাধান হবে না, বিরোধী দলগুলোর উচিৎ এই নিয়ে রাস্তার আন্দোলন সংগঠিত করা।

https://x.com/arvindgunasekar/status/1801122499696152619

 

 

 

0 Comments

Post Comment