# কিন্তু এটাতো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ঔরঙ্গজেব তার নিজের তিন ভাইকে হত্যা করেছেন, বৃদ্ধ পিতাকে গৃহবন্দী করেছেন, এগুলোকে তো সমর্থন করা যায় না। তিনি অত্যাচারী ছিলেন সে কথা অস্বীকার করবো কিভাবে? বিজেপি আরএসএস বলছে বলেই সেটার বিরোধিতা করবো?
তোমাকে বরং আমাদের বাংলার ঠাকুরের কথা শোনাই --
"রাজ ধর্মে ভ্রাতৃ ধর্ম, বন্ধু ধর্ম নাই
আছে শুধু জয় ধর্ম।"
কথাগুলো দূর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন। আমাদের ঠাকুরের লেখা গান্ধারীর আবেদন কবিতা। আর এই কথারই প্রতিধ্বনি শুনতে পাবে একটি ইংরেজি প্রবাদ বাক্যে Kingship knows no kinship. তার মানে সমস্যাটা ঔরঙ্গজেব নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে সমস্ত শাসকের ক্ষেত্রেই কম-বেশি এটা সত্য। অশোক বিম্বিসার অজাতশত্রু আলাউদ্দিন খলজি এরা কেউ এই তালিকার বাইরে নয়। শিবাজী নিজেও তো একজন সামান্য মারাঠা সর্দারের সন্তান হয়ে, একে একে বিভিন্ন সর্দারদের বশীভূত করে, চন্দ্র রাও মোরেকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে, নিজের ক্ষমতা বাড়িয়েছিলেন। তিনি নিজেকে মারাঠাদের নেতা বলে দাবি করেছিলেন। এমনকি পরবর্তী সময়ে রাজা রামের পত্নী তারা বাঈ এর সাথে শম্ভাজি পুত্র শাহুর দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ মারাঠা ভূমিকে কম রক্তাক্ত করেনি।
রাজতন্ত্রের এক অনুষঙ্গ হলো রাজপ্রাসাদ ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের প্রথম পছন্দ। স্বাভাবিক ভাবেই তাকে ষড়যন্ত্র করতে হয় না। কান্দাহার অভিযানে চরম ব্যর্থ হয়েও দারাশিকো সম্রাটের প্রথম পছন্দ। এরপরও সম্রাট তার পুত্র সুজা ও মুরাদকে কান্দাহার অভিযানে পাঠিয়েছিলেন। আবার ব্যর্থ অভিযান। মোট চারটি অভিযান হয়েছিল। অথচ একমাত্র ঔরঙ্গজেব কান্দাহার অভিযানে বলা যায় সফল হয়েছিলেন। শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য অভিযানেও সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। এমন সফল একজন পুত্র, অথচ উত্তরাধিকারের প্যানেলে তার নাম সকলের শেষে। অতএব ষড়যন্ত্র ছাড়া তার কিবা করার আছে। জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ সমস্যা ছাড়াও রাজ পরিবারে জটিল বৈবাহিক সম্পর্ক, কোন রাণীর পুত্র রাজা হলে সেই রাণীর পিত্রালয়ের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে, অনেক সমীকরণ চলে।
# কিন্তু তিনি রাষ্ট্রনীতিতে বহু কিছু গোঁড়া ইসলামী নীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। তিনি বিধর্মী দের ওপর জিজিয়া কর চালু করেছিলেন। দরবারে নাচ গান মদ্যপান বিলাসব্যসন বন্ধ করেছিলেন। কারণ এগুলি শরীয়ত বিরোধী। এমন কি মুঘল যুগের বড় বড় চিত্রশালা সেগুলিও বন্ধ হয়েছিল। এক কথায় গোঁড়া মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা, এটা তো সমর্থনযোগ্য নয়।
দেখো তোমার কথাগুলো তথ্যগতভাবে সত্যি। কিন্তু এর পেছনে দুটো যুক্তি কাজ করে থাকতে পারে। প্রথমত পিতা শাহজাহান যুবরাজ হিসেবে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পলাতক। বালক পুত্র ঔরঙ্গজেবকে তিনি এক মৌলবীর আশ্রয়ে রেখে যান। ফলতঃ ঔরঙ্গজেবের শিক্ষা দীক্ষা মূলগতভাবে ইসলামিক নীতি কথার দ্বারা চালিত। এবার ভাবো এমন একজন মানুষ যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, দেখছেন তীব্র জায়গিরদারী সংকট, মনসবদারদের মধ্যে আর্থিক দুর্নীতি, স্বজন পোষন, তিনি দেখছেন সামান্য কিছু মনসবদারের হাতে (৪৪৫ জন) ভূ-সম্পত্তি জায়গীরের ৬২ শতাংশ কেন্দ্রীভূত। আর বৃহৎ সংখ্যক (৭৫৫৫ জন) মনসবদারের হাতে ৩৮ শতাংশ জায়গীর ন্যস্ত। এক বিরাট সংখ্যক জায়গীরহীন মনসবদার সৃষ্টি হয়েছে। তারা প্রতিদিন দরবারে এসে জায়গীর দাবি করছেন। এক কথায় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নৈরাজ্য চলছিল। তার চোখে সত্য অসত্য, ন্যায় অন্যায়ের মাপকাঠি হবে খুব স্বাভাবিকভাবেই ধর্ম। এ যুগের অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক সংকটটি তার চোখে নৈতিকতার সংকট হিসেবে ধরা পড়বেই। পার্থিব জগতের সংকট থেকে নৈতিকতার সংকট আসে। এই সত্যটি তার দর্পণে প্রতিবিম্বিত হলো বিপরীতভাবে। প্রতিবিম্বে ডান দিক যেমন বাঁদিক হয়ে যায়। নৈতিকতার সংকটের কারণেই পার্থিব জগতের সংকট। এটাই ঘটে থাকতে পারে।
ঔরঙ্গজেবের সময়টা হল মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থানের কাল নয়, বরং অবতরণের কাল। চতুর্দিকে সংকট এই সময় সাম্রাজ্যকে কঠোর হাতে নেতৃত্ব দিতে হবে সম্রাটের চোখে নৈতিকতার উৎস শরীয়ত অতএব দরবারে যা কিছু শরীয়ত বিরোধী আচরণ সেগুলি নিষিদ্ধ হবে সেটাই স্বাভাবিক। দরবারে কোনরকম নেশা করা যাবে না, সাম্রাজ্যে গাঁজা ভাঙ এসবের চাষ হবে না, দরবারে মদ্যপান বাইজি নিয়ে ফুর্তি হবে না, দরবারী আনন্দানুষ্ঠান (পার্টি) নিষিদ্ধ, সাদামাটা জীবন যাপন করতে হবে। এগুলো তো সংকটকালের দাওয়াই, রাষ্ট্রের ব্যয় সংকোচের নির্দেশ। অবশ্যই শরীয়ত অনুসারী। আর বিধর্মীদের যেমন জিজিয়া দিতে হতো, তেমনি বৃদ্ধ শিশু অসমর্থ্য প্রতিবন্ধী এরা জিজিয়া থেকে ছাড় পেত। সর্বোপরি মুসলমানদের দিতে হতো জাকৎ বলে একটি কর। এই জাকৎ এর পরিমাণ জিজিয়া থেকে অনেক বেশি ছিল।
# তাহলে তুমি মানছো ঔরঙ্গজেব গোঁড়া শরিয়তের বিধান দেশে প্রশাসনে দরবারে চালু করেছিলেন? তুমি আবার দ্বিতীয় কোন যুক্তির কথা বলছো?
হ্যাঁ সেটাই বলছি। একদল গবেষক মনে করেন আসলে ঔরঙ্গজেব রাজকোষের ব্যয় সংকোচের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু অভিজাত ও সাধারণ মানুষ যাতে সেগুলি স্বেচ্ছায় অনুসরণ করেন, তার জন্য অনুশাসন গুলির সঙ্গে শরিয়তের সম্পর্ক জুড়ে দিয়েছিলেন। যদিও আমি সেটা মনে করি না। আজকের আধুনিক শাসকরা যেমন নানা প্রকার ব্যয় সংকোচের উপদেশ দেন জনতাকে, অথচ নিজেরা বিলাসবহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত থাকেন, ঔরঙ্গজেব তেমন ছিলেন না। তিনি নিজে সাধারণ ফকিরের মত জীবন যাপন করতেন। মানুষ তাকে বলতো জিন্দাপীর। তিনি নিজেই ব্যয় সংকোচের দৃষ্টান্ত হয়েছিলেন। হাদিসের সেই কাহিনী কে নিশ্চয়ই মনে রেখেছিলেন -- হজরত মুহাম্মদ এক শিশুকে মিষ্টি খেতে বারণ করার আগে এক সপ্তাহ নিজে মিষ্টি খাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি গোঁড়া ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু আজকের শাসকদের মতো ভন্ড ধার্মিক নন। ঠিক সেই কারণে সংকট কালেও তিনি ৫০ বছর রাজত্ব করেছিলেন।
এই কারণেই তো বার্ণিয়ের রচনায় জানা যায়, ঔরঙ্গজেব তাঁর গৃহ শিক্ষক কে বলছেন -- "আপনি আমাকে যা শিখিয়েছিলেন, শাসন ক্ষমতায় এসে দেখা যাচ্ছে সেগুলো কিছুই কাজে লাগছে না।" কখনো ভেবে দেখেছো, আকবরের যুগ সাম্রাজ্যের শুরুর যুগ। হিন্দুস্থানের মানচিত্রটা ভাবো। উর্বর সমৃদ্ধ বিরাটায়তন জমি। যত দক্ষিণ এ নামবে জমির পরিমাণ ততই কমবে, উর্বরতা কমবে, দিল্লি থেকে দূরত্ব বাড়বে। তদুপরি দুর্গম বিন্ধ্য পর্বত ও অরণ্য। আকবর মূলত উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। সূচনায় প্রশাসক মনসবদারের সংখ্যা কম, উর্বর সমৃদ্ধ জমির পরিমাণ বেশি। আকবর দেদার জায়গীর বিলি করলেন। বিরাট বিরাট জায়গীর। কালে কালে সাম্রাজ্যের বয়স ও আয়তন বাড়লো, মনসবদারের সংখ্যা বাড়লো। কিন্তু জায়গীর সেই হারে বাড়লো না। প্রথম ব্যাচে বালতি উপুড় করে খাওয়ালেন উদার মুক্তমনা বাদশাহ। আর শেষ ব্যাচে ভাঁড়ার শূন্য। ঔরঙ্গজেব অনুদার? এনায়েত খাঁকে ঔরঙ্গজেব বলছেন -- কেয়া করেগা, এক আনার (একটি বেদানা), শত বিমার (একশ' জন অসুস্থ)। ইনিংস বাঁচানোর ব্যাটিং করছেন ঔরঙ্গজেব। এক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ঔরঙ্গজেব।
# তুমি বলছো প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু এটা তো মানতে হবে যে, তার সুদীর্ঘ কাল ব্যাপী দাক্ষিণাত্য অভিযানের ফলে মুঘল সাম্রাজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সম্রাট নিজে উপস্থিত না থেকে, অন্যকে দায়িত্ব দিয়ে ফিরে যেতে পারতেন। প্রায় ১৮ বছর ব্যাপী এই অভিযান। এটা কি খুব বোকামির পরিচয় না?
শোনো, প্রথমতঃ মনে রাখতে হবে, মারাঠা অর্থনীতি ছিল লুঠতরাজ নির্ভর। মুঘল জায়গীর থেকে রাজস্বের অংশ চৌথ ও সরদেশমুখী হিসেবে আদায় করতো। দুর্নীতি গ্রস্ত মনসবদাররা মারাঠাদের বাধা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের দাবি মিটিয়ে দিত। যেহেতু যুদ্ধ এড়ানো গেল, তাই তারা সৈন্য বাহিনী কম পোষণ করতো। এক কথায় শত্রুর সাথে আপোষ রফা চলতো। সম্রাট সফল যুদ্ধ অভিযান চালিয়ে যেই ফিরে আসতন -- বামুন গেল ঘর, তো লাঙল তুলে ধর। আবার মারাঠাদের সঙ্গে আপোষ রফা। সেই কারণে ঔরঙ্গজেব কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। নিজে দায়িত্ব নিয়ে মারাঠাদের নিকেশ করেছেন। শম্ভাজী রাজারাম শাহু সকল কে পরাজিত ও বন্দী করেন। মারাঠা সমস্যাকে সম্পূর্ণভাবে সমাধান করে তিনি দিল্লি ফেরেন।
# তোমার কি মনে হয় না মারাঠা সমস্যাকে ঔরঙ্গজেব অহেতুক বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছেন? তার এই দীর্ঘ দাক্ষিণাত্য অভিযান সাম্রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছিল। মারাঠারা কি সত্যি খুব বিপদজনক ছিল?
দেখো এই প্রশ্নের সহজ উত্তরে বলব মারাঠারা কখনোই সুসংগঠিত একটি জাতি হিসেবে হিন্দুস্তানের শাসক হয়ে ওঠার পরিকল্পনা করেনি। এমন ইচ্ছাও তাদের ছিল না। প্রথম বাজিরাও ও বালাজি-বাজিরাও তো দিল্লি সম্রাট বাহাদুর শাহ কে কার্যত মুঠোয় এনে ফেলেও, নিজেরা দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেনি। অধ্যাপক জগদীশ নারায়ণ সরকার, গবেষক সারদেশাই এরা তো মারাঠাদের এই শাসন কার্যের দায়িত্ব নেওয়ার অনিহাকে রীতিমত সমালোচনা করেছেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে ও বলা যায় হিন্দুস্থানের রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, একমাত্র মারাঠারা সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারত। কিন্তু মারাঠা শক্তি অপরের হাতে তামুক খেতেই বেশি আগ্রহী। নিজেদের রাজস্ব ব্যবস্থা নয়, অন্যের রাজস্ব থেকে লুটপাট চালানো এদের লক্ষ্য। ফলে মারাঠারা ঔরঙ্গজেবের মাথাব্যথার কারণ নয়। এমনকি সরাসরি লড়াইয়ে দিলির খান, জয়সিংহ, এদের কাছে শিবাজী পরাস্ত হয়েছিলেন, বন্দিও হয়েছিলেন। আসলে ঔরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ আকবর পিতা ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পালিয়ে গিয়ে দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের কাছে আশ্রয় নেন। এর ফলে এবার কিন্তু মারাঠা শক্তি মুঘল সিংহাসনের নিরাপত্তার প্রশ্নে সাথে জড়িয়ে যায়। ফলে ঔরঙ্গজেবকে ফাইট টু ফিনিশ নীতি গ্রহণ করতে হয়।
# কিন্তু ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে যে মন্দির ভাঙ্গার কাহিনী আছে সেগুলো কি সবটাই বাজে কথা? সেগুলোকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায়? বহু হিন্দু মন্দির তার সময় ধ্বংস হয়েছিল, এটা তো সত্যি।
দেখো আমি তোমাকে এর জবাবে এটা বলবো না যে, ১৬৭২ সালের অমুক মন্দিরের নির্মাণ করিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। এটা বলবো না, কোন কোন মন্দিরের জন্য জমি দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। মন্দির পরিচালনার জন্য জায়গীর দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। এগুলো বলা অর্থহীন, কারণ আমি দশটা মন্দির নির্মাণ বলবো, তুমি দশটা মন্দির ভাঙ্গার কথা বলবে। যে যার যুক্তিতে ও বিশ্বাসে অনড় থেকে যাবো। আমি বরং একটু অন্য কথা বলি। ধরো, এই যে আমেরিকার আফগান যুদ্ধ বা ইরাক যুদ্ধ হলো, আমরা কিন্তু শুনেছি অসংখ্য স্কুলের ওপর মিসাইল হানা হয়েছে। হাসপাতালে, এম্বুলেন্সে, খাদ্যের গুদামে, রকেট হানা হয়েছে। মার্কিন সরকার জবাবে কি যুক্তি দিয়েছে? বলেছে এম্বুলেন্স হাসপাতাল বিদ্যালয়ের আড়ালে সেখানকার বিদ্রোহী জঙ্গি সেনারা ঘাঁটি গেঁড়েছিল। লক্ষ্য করবে ঔরঙ্গজেবের আমলে বেশ কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয়েছে। সেগুলো রাজপুত বিদ্রোহের সময় বা কোনো আঞ্চলিক বিদ্রোহ বা যুদ্ধ বা অসন্তোষের সময়। এ যুগেও তো অমৃতসর স্বর্ণ মন্দিরে অপারেশন ব্লুস্টার হল। কোন যুক্তিতে? সেখানে খালিস্তান পন্থীরা ঘাঁটি গেঁড়েছে এই যুক্তিতে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, কুযুক্তি, অজুহাত, যাই হোক, ধর্মীয় স্থানগুলো ছিল বিদ্রোহীদের নৈতিক শক্তি ও কৌশলগত ঘাঁটি। ফলে সেগুলো কখনো কখনো আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু এটা কোন
সাধারণ চিত্র ছিল না।
দ্বিতীয় বিষয় মনে রেখো, কোন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে পরাভূত করার পর বিজয়ের স্মারক হিসেবে তাদের সবচেয়ে পবিত্র আইকন ধর্মস্থানকে ধ্বংস করে বিজয়কে জাহির করা হয়। তৃতীয় বিষয় হলো সে যুগে নির্মাণ শিল্প সামগ্রী প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হতো না। ফলে একটিকে ভেঙে তার সামগ্রী দিয়ে অপর একটি করা হতো। আর স্বাভাবিকভাবেই সেক্ষেত্রে ভাঙার তালিকায় নিজের নির্মাণটি নয়, অপরের নির্মাণ অগ্রাধিকার পেত। মনে রেখো মূলত পাথর কেটে তাই দিয়ে নির্মাণ। এতো পাথর কাটার কারিগরি কৌশল তখন অধরা। আর চতুর্থ বিষয় হলো ধর্মস্থানে অঢেল ধন সম্পদ লুট করা। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি মন্দির বলো মসজিদ বলো বৌদ্ধস্তূপ বলো এগুলি ভাঙার পেছনে নানা বিধ কারণ ও যুক্তি কাজ করেছে। কাজী নজরুলের কবিতাটা স্মরণ করো :
"কোথা চেঙ্গিস গজনী মামুদ কোথায় কালাপাহাড়,
ভেঙে ফেলো ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার।
খোদার দুয়ারে কে কপাট দেয়, কে দেয় সেখানে তালা ,
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা। হায়রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়।
মানুষেরে ঘৃণা করি, ও কারা, কোরান বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি ।
ও মুখ হইতে কিতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,
যে মানুষ আনিলো গ্রন্থ কিতাব সেই মানুষেরে মেরে
পূজিছো গ্রন্থ? ভন্ডের দল। মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি, মানুষ কোনো।"
এই আহ্বানের কারণ কি? তিনি লিখছেন :
"ওই মন্দির মসজিদে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুৎ লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।" এও তো মন্দির মসজিদ ধর্মস্থান ধ্বংসের আহ্বান।জানো ফরাসি বিপ্লবের সময় বিদ্রোহী জনতা চার্চ, মঠ, এসব আক্রমণ করেছে। লুট করেছে। কারণ সেগুলো রাজা অভিজাত ও যাজকের ঘাঁটি। বঞ্চনা ও পীড়নের কেন্দ্র। এই জনতা কিন্তু নিজেরাও খ্রীষ্টান। ধর্মস্থান আক্রমণের নানান দিক ভেবে দেখা প্রয়োজন।
# মানছি নানা দিক আছে। কিন্তু কথাটা হল ঔরঙ্গজেব রাজপুতদের প্রতি অনুদার ছিলেন, এটা কি মিথ্যা? তুমিই তো বললে, তার সময়ে রাজপুতরা বিদ্রোহ করেছিল, কেন? যে রাজপুতরা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের নির্ভরযোগ্য মিত্র।
তোমার প্রশ্ন যথার্থ। আমি তোমাকে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারতাম, যদি রাজপুতদের প্রতি ঔরঙ্গজেব অনুদার হবেন, তাহলে কোন বুদ্ধিতে তিনি রাজা জয়সিংহ কে পাঠিয়েছিলেন দাক্ষিণাত্যে শিবাজীর বিরুদ্ধে অভিযানে? তিনি তো ভাবতেই পারতেন শত্রু শিবাজীর সাথে জয় সিংহ জোট বেঁধে মুঘলদের ক্ষতি করবেন। তিনি তা ভাবেননি, আর রাজা জয় সিংহও ঔরঙ্গজেবের আস্থা বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেন। শিবাজী কে পরাজিত করে বন্দী করে দরবারে নিয়ে আসেন। এই ঘটনা কি রাজপুতদের প্রতি ঔরঙ্গজেবের আস্থা প্রমাণ করে না? বিদ্রোহের ঘটনা ছিল অনভিপ্রেত, ভুল বোঝাবুঝি। সেটা স্বতন্ত্র আলোচনা।
আবার ভাবো আকবরের সময়ে একমাত্র রাজা মানসিংহ ছিলেন সাত হাজারী মনসবদার। মুঘল রাজ পরিবারের বাইরে কেউ পাঁচ হাজারের উর্ধ্বে মনসবদার হতে পারতেন না। মনে রাখতে হবে, মান সিংহ ছিলেন সম্রাট আকবরের শ্যালক ও যোধা বাঈয়ের ভ্রাতা। আর ঔরঙ্গজেবের সময় মির্জা রাজা জয়সিংহ, যশবন্ত সিংহ ছিলেন সাত হাজারী মনসবদার। এরা কেউ ঔরঙ্গজেবের পারিবারিক আত্মীয় নন। এটা কি অনুদারতার নমুনা? মনে রাখতে হবে আকবরের যুগে মনসবদারের সংখ্যা ছিল আড়াই থেকে তিন হাজারের মধ্যে আর সাম্রাজ্য ছিল উত্তর ভারতে। স্বভাবতই উত্তর ভারতের প্রধান যোদ্ধা জাতি রাজপুতরা ছিল মনসবদারদের মধ্যে বিরাট অংশ। প্রায় ২৪ শতাংশ। ঔরঙ্গজেবের সময় সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ হয় দক্ষিন ভারতে। মোট মনসবদারের সংখ্যা প্রায় আট হাজার। এ সময় রাজপুতদের অংশ ছিল ১৮ শতাংশ। শতাংশের হিসেবে নিশ্চিতভাবে কম। কিন্তু ৩০০০ এর ২৪ শতাংশ আর আট হাজারের ১৮ শতাংশ প্রমাণ করে ঔরঙ্গজেবের যুগেও রাজপুত মনসবদারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। দক্ষিণী মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শতাংশের হিসেবে রাজপুদের হার কমেছিল, সংখ্যা নয়।
# কথাটা ঠিকই ৩০০০ এর চব্বিশ শতাংশ অর্থাৎ ৭২০ জন। আর আট হাজারের ১৮ শতাংশ অর্থাৎ ১৪৪০ জন। সেদিক থেকে ঠিক দ্বিগুণ। এটা সম্পূর্ণই পরিসংখ্যানের মার প্যাঁচ। তাহলে একটা কথা বল, আজকের বিজেপি আরএসএস-এর কথা ছেড়ে দাও, আমরা তো বহু আগে থেকেই ঔরঙ্গজেব কে একজন খারাপ শাসক হিসেবে ইতিহাসে চিনে এসেছি। এটা কেন?
যথার্থ প্রশ্ন আমার মনে হয় এর একটা প্রধান কারণ ঔরঙ্গজেব হলেন সেই সম্রাট, যিনি রাজ দর্শনকে পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি ফকিরের মত জীবন যাপন করতেন। তিনি রাজকোষ থেকে একটি বেতন নিতেন মাত্র। তিনি মনে করতেন রাজকোষ সম্রাটের পৈত্রিক বা ব্যক্তিগত নয়। আমার শিক্ষক কামরুদ্দীন আহমেদ বলেছিলেন, একবার পারস্যের অতিথিরা ঔরঙ্গজেবের দরবারে আসেন। সম্রাট তাদের প্রশ্ন করেন, তারা রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা নেবেন, নাকি সম্রাটের ব্যক্তিগত অতিথি হবেন। অতিথিরা দ্বিতীয়টি কেই অধিকতর গৌরবের মনে করে সেটি গ্রহণ করেন। যে কদিন অতিথিরা ছিলেন, অতি সাদামাটা খাদ্য পরিবেশিত হয়। খুবই সামান্য কিছু উপহার তাদের দেওয়া হয়। তখন তারা সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে প্রশ্ন করেন, সাম্রাজ্যের আর্থিক অবস্থা কি খুব খারাপ? জবাবে সম্রাট বলেন একটুও না। আপনারা রাষ্ট্রের অতিথি হলে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে আতিথেয়তা পেতেন। কিন্তু আমি একজন বেতনভোগী, রাষ্ট্রের সেবক মাত্র। আমার সামান্য সাধ্য ও সঞ্চয়। তাই দিয়েই আপনাদের আতিথেয়তা করেছি মাত্র। এই রাজ দর্শন শাসকের কাছে অনুসরণযোগ্য হতে পারে না। তাই পশ্চিমী ঐতিহাসিকরাই প্রথম ঔরঙ্গজেব কে ভিলেনের তকমা লাগালেন।
খেয়াল করুন ১৬৮৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নৌবাহিনী ভারতের পশ্চিম উপকূলে বেশ কয়েকটি মুঘল বন্দর অবরোধ করে এবং মুঘল সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে বাধ্য করে। অবরোধটি চট্টগ্রাম, মাদ্রাজ এবং মুম্বাই (বোম্বে) এর মতো প্রধান শহরগুলিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করে, যার ফলে সম্রাট আওরঙ্গজেবের হস্তক্ষেপ ঘটে, যিনি এদেশে কোম্পানির সমস্ত কারখানা দখল করেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করেন। কোম্পানি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল স্যার জোসিয়া চাইল্ড, বিটি প্রমুখেরা। আরও বেশ কিছু মুঘল বাণিজ্য জাহাজ তিনি দখল করেন। কোম্পানিকে যুদ্ধে পরাস্ত করে, এদেশে তাদের বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যের অধিকার দিয়েছিলেন নির্দিষ্ট শর্তের বিনিময়ে। সেই শর্তে নিষিদ্ধ পণ্যদ্রব্যের তালিকা ছিল। মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, যা নিয়ে ব্যবসা করা যাবে না, সেই শর্তে বলা ছিল। অন্যান্য বণিকদের সমান হারে শুল্ক দিয়ে বাণিজ্য করতে হবে। কোন অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া হবে না। বলা ছিল, স্থানীয় শাসনকর্তা নবাবদের অনুমতি সাপেক্ষে বাণিজ্য করতে হবে। এইসব শর্ত ভঙ্গ করার ফলে এদেশ থেকে বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে তারা পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়ে বাণিজ্যিক অধিকার ফিরে পান। একদিকে ভিন্ন রাজ দর্শন, অন্যদিকে পশ্চিমী বণিকদের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা, এইসব দিক বিবেচনা করলে পশ্চিমের শাসকদের চোখে ঔরঙ্গজের একজন ভিলেনের তকমা পাবেন এটাই স্বাভাবিক। যখন বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্র গুলি যে কোনো শর্তে পুঁজির বিনিয়োগ আবাহন করছে, সেই যুগে ইতিহাসের এমন এক শাসক যিনি বিদেশী পুঁজির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন, তিনি তো ভিলেন হবেন। ১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরেই তো ১৭১৭ তে বাদশাহ ফারুকশিয়ারের কাছ থেকে কোম্পানি প্রথম বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে। সেই উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই বয়ে নিয়ে চলেছে পরবর্তী যুগ এবং আরএসএস বিজেপি।
# তার মানে, এটা শুধু আরএসএস বা বিজেপির মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। যে কোনো ক্ষমতাবান রাষ্ট্রশক্তির কাছে, বিশেষত পশ্চিমের ক্ষমতার কাছে ঔরঙ্গজেব ছিলেন বিপদজনক। ঔরঙ্গজেব সহ গোটা মুঘল যুগকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে আসলে ভারতের সবচেয়ে গৌরব জনক যুগ কে অস্বীকার করার অপচেষ্টা। এমন এক যুগ যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভারত হয়েছিল বিশ্বের সমৃদ্ধতম অঞ্চল। মুঘল যুগের পর থেকেই এই গৌরবের অস্তগামিতা শুরু হয়।