পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আমার গ্রাম গেরুয়া নয়, আমার গ্রাম রামধনু

  • 07 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1015 view(s)
  • লিখেছেন : মৌমিতা আলম
সব রাতের শেষে ভোর আছে, তাই আজও চাষা আশায় বাঁচে। ঘটনার পরের দিনই আমার ঘরের কাজে ঠিক যোগ দিতে চলে এসেছিলেন সব কাকুরা। যেন আমরা একসাথে ঘর বানাবই, থাকবই একসাথে এটা জানান দিতে।এলাকার মানুষ আর প্রশাসনের উদ্যোগে গঠিত হল শান্তিরক্ষা কমিটি। মিটিং হলো বেশ কয়েকটি। হার না মানা আমার গ্রাম মুছে ফেলে দিতে চাইল সেই অন্ধকার রাতের সেই ক্ষতগুলো। কালী পুজোয় দেখলাম আমার পাশের বাড়ির মুসলমান মেয়েটি গেল মেলা ঘুরতে। আমিও জ্বালালাম আলো। শান্তিরক্ষা কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত হলো রাখী বন্ধন উৎসব।

তিস্তার গাঁ ঘেঁষা ছোট্ট একটি জনপদ, বাকালী। রাজবংশী হিন্দু,ঢাকাইয়া, রাজবংশী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ
পাশাপাশি বাস করে আসছে এযাবৎকাল। গ্রামের পশ্চিমে দুটি বড় মসজিদ, তার পাশে একটি কালীমন্দির আর তিনটিকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে দাতাবাবার কবর। এই দাতা বাবার কবরের ধুপকাঠির গন্ধে এই গ্রামের আত্মার সুভাষ সতেজ চিরকাল। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, এই বাবার কবরে শুয়ে আছে বাকালীর অভিভাবক - হিন্দু, মুসলিম, পুরুষ, নারী সবার।বাকালী আমার নানির বাড়ি। আমার জন্ম এখানে,বেড়ে উঠাও এখানে, এখনও এই গ্রামের গন্ধ আমার বাড়ি শব্দটার প্রতিটি বাঁকে। নানি নেই, কিন্তু খালা, খালুর বাড়ি আমার এখন নিজস্ব বাড়ি।
 গ্রামের আল বেয়ে, তখন আল বলাই চলে, আমি যেতাম আমার স্কুল মায়নাগুড়ি গার্লস। প্রায় ২৩কিমি রাস্তা তখন। প্রথমে তিন কিমি সাইকেলে, তারপর আরও পাঁচ কিমি ভ্যানে, আর তারপর বাকি রাস্তা বাসে। এই যাত্রাপথে রোজ আমার সাথী কোনো মামা, নাহলে মাসি(মামার বাড়ি হওয়ার জন্য বয়সে বড় হলেই মামা আর মহিলা হলে মাসি)। রোজ যেতে আসতে তিনঘন্টা। আর তার সাথে আধ ঘন্টা রোজ যাওয়া আসার রাস্তায় মামা, কাকুদের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করতে। শীতের দিনে অনেকদিন সাইকেলের পথটি পেরোতে রাত হয়ে যেত, আমায় বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিত নিতাই মামা, টুকটুক কাকু, আরও অনেকেই। এই মামা , কাকুদের ধর্ম কি, এ ব্যাপারে কোনোদিন আমি ভাবিনি, শুধু জানতাম এরা আপন। শীতের রাতে যখন একা সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরতাম, আমার ভয় লাগতো না কোনদিন, জানি এই মামারা  বা কাকুরা আছেন।


সাইকেল চালাতে চালাতে রোদে শুকিয়ে যেত ঠোঁট। যে বাড়িতে জল খেতাম সেটাও একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ। শাড়ি পড়তে হত তখন ক্লাস নাইন থেকে। বেশির ভাগ দিন সাইকেলে খুলে যেত শাড়ি, কোনোরকম গুঁজে পৌছাতাম প্রবীর কাকুর বাড়ি। কাকিমা শাড়ি ঠিক করে দিত ।
আমার সব বান্ধবী হিন্দু, আমি একা মুসলিম। আমার নামটাও তেমনি তাই। চাকরিসূত্রে যখন যোগ দিলাম মুর্শিদাবাদে, অনেকেই অনেকদিন অব্দি ভেবেছিলেন আমি বিবাহসূত্রে মুসলিম। এমনকি কলেজ জীবনে যে ছেলেটির প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, সেও বারবার জানতে চেয়েছিল আমি মুসলিম কিনা! আমার নামের জন্য।সেই আমি জোর ধাক্কা খেলাম অক্টোবর এর এক রাতে। আমি তখন আমার বাড়ি বাকালী থেকে, আমার আর একটা বাড়ি মালবাজার এ। রাতে আমার খালার ভয়ার্ত ফোন। আমার বাড়ি থেকে ১০০মিটার দূরে ওয়াক্তিয়া মাদ্রাসায় কয়েকটি পরিচিত মুখ এসে হুমকি দিয়েছে, পাশের পাড়া গোলারবাড়ি তে ভেঙে দেওয়া হয়েছে মসজিদ, তিনজন গুরুতর আহত, আর একটি পাড়া সর্দার পাড়া তে হামলা চালিয়েছে আর এক দল।


কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। চোখের সামনে নাইলি, গোধরা কিংবা মুজফ্ফরনগর ভেসে উঠছিল। অসহনীয় সেই রাতে যেন পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছিল মাটি আর সব স্মৃতি যেন এক লহমায় মিথ্যে মনে হচ্ছিল, যেন আমি মিথ্যে, আমার অস্তিত্ব মিথ্যে, আমার শৈশব মিথ্যে, মিথ্যে আমার চারপাশের লোকগুলো। বাড়ি ফিরতে চাইলাম। খালা না করলেন। তাদের অনুরোধ করতে লাগলাম গ্রাম ছাড়ার জন্য। বললাম জরুরি কাগজগুলো গুছিয়ে নিতে, একটা ব্যাগে, যেন প্রয়োজনে সেটা নিয়ে পালাতে পারে। কিন্তু আমার স্মৃতিগুলো, আমার গ্রামের গন্ধ, আমার প্রতি ইঞ্চি মাটি? খালা আস্বস্ত করলেন, বললেন হয়ত বিক্ষিপ্ত ঘটনা, কিন্তু সেই কথাগুলোর মধ্যে যতটা শক্তি ছিল, তার থেকে বেশি ছিল আমাকে আস্বস্ত করার তাগিদ। সেই রাত সকাল হলো, অনেক ক্ষত বুকে নিয়ে।
সকাল হতেই আবার ফোন, যে আশঙ্কা ঘুমিয়ে ছিল বুকে, তার মুখোমুখি হতে তখনও মন অস্বীকার করছে বারংবার। আর মাথা বলছে এটা বোধহয় হওয়ার এই ছিল।


সেই সকালে কোনো আলো ছিলো না। তবে সকাল হতেই ছুটে এলো যোগেন কাকু; যোগেন রায় যার বাড়ি থেকে আসা দুধে আমি গত ঈদেও সেমই রেঁধেছি। ছুটে এলো চন্দন কাকু। একটু যেন আলো এত আলেয়ার মাঝে।
পুলিশ ক্যাম্প বসলো, টহলদারি। যে রাস্তায় আমাদের টায়ার নিয়ে দৌড়, সেখানে বুটের শব্দ। দাঁড়িয়ে থাকা রাপিড একশন ফোর্সের গাড়িটা যেন চিরে দিচ্ছিল প্রতিটি কোষ।


কিন্তু সব রাতের শেষে ভোর আছে, তাই আজও চাষা আশায় বাঁচে। ঘটনার পরের দিনই আমার ঘরের কাজে ঠিক যোগ দিতে চলে এসেছিলেন সব কাকুরা। যেন আমরা একসাথে ঘর বানাবই, থাকবই একসাথে এটা জানান দিতে।এলাকার মানুষ আর প্রশাসনের উদ্যোগে গঠিত হল শান্তিরক্ষা কমিটি। মিটিং হলো বেশ কয়েকটি।
হার না মানা আমার গ্রাম মুছে ফেলে দিতে চাইল সেই অন্ধকার রাতের সেই ক্ষতগুলো। কালী পুজোয় দেখলাম আমার পাশের বাড়ির মুসলমান মেয়েটি গেল মেলা ঘুরতে। আমিও জ্বালালাম আলো।
শান্তিরক্ষা কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত হলো রাখী বন্ধন উৎসব। সব নেতাদের উপস্থিত মঞ্চ থেকে দূরে বসে
আমি তখন চেনা মুখগুলো খুঁজছি। তখনই কবিতাদি এসে জড়িয়ে ধরলো আমায়। জানিনা কেন চোখের দুকোন বেয়ে বাঁধ ভাঙতে চাইলো। আমি সামলে নিলাম। পাশাপাশি বসে শুনছিলাম নেতা, সমাজকর্মী, আধিকারিক দের ভাষণ। কিন্তু আমার মন ভাষণে ছিল না, মন ছিল ছোট ছোট দৃশ্য গুলোয় আটকে - ললিত কাকুর পাশে বসে খোশ মেজাজে গল্প আমার খালুজির, জ্যোতি দার বারবার ভালমন্দ জিজ্ঞেস করা। শরিয়ত(গুরুতর আহত) এর মাকে এসে জড়িয়ে ধরলেন একজন অভিযুক্তর মা , মাঝে মাঝেই ভেসে আসছিল তীব্র আক্ষেপের সুর। শেষে হাতে হাত, রাখি বন্ধন।


রেখে যাওয়া প্রশ্নগুলো বিধবে বারংবার। কিন্তু আশার কথা প্রশ্নগুলো শুধু অন্ধকার দিয়ে মোড়া ছিল না। কবিতাদির উষ্ণ আলিঙ্গনে যে সত্যি টা ছিল তার গর্ভে আবার আলো জন্মাবে, এই বিশ্বাসটুকুর সম্বল দিয়ে গেল আমাদের । আর এই টুকরো টুকরো আলিঙ্গনে এই প্রত্যয় টুকু ছিল যে, বাংলা পারবে, বাংলা ভালোবাসতে জানে, বাংলা উত্তরপ্রদেশ নয়। অসংখ্য না পাওয়া উত্তরের জমাট কালো মেঘের মাঝে, সূর্য উঠে যখন এক গ্রামবাসী আরেকজন কে বলে, দীপ্ত, উজ্জ্বল ভাষায়, "হামরা সবায় এক, হামার বাপ ঠাকুর্দা এইঠে মিলিমিশি আছিল, হামারও ওমো"
(আমরা সবাই এক, আমাদের বাবা, ঠাকুর্দা এখানে মিলেমিশে ছিল আমরাও থাকবো)
দূরে সন্ধারতি আর আজানের মিলিত সূরে, পাখিরা ঘরে ফিরছিল শিকারি দের হার মানিয়ে। ট্রাক্টরের শব্দ ভেসে আসছিল অবিরাম, মাটি ভেঙে জীবন ফলানোর তোড়জোড়। আমাদেরও ঘরে ফেরার পালা। ঘর যার রং শুধু গেরুয়া নয় , যার রং রামধনু।

0 Comments

Post Comment