ভারতবর্ষের সাংবিধানিক ইতিহাসে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর এক উল্লেখযোগ্য দিন কারণ ঐ দিন ডঃ বি. আর.আম্বেদকরের নেতৃত্বে গঠিত সংবিধান খসড়া কমিটির দলিলটি সংবিধান সভা আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করে।এই সংবিধান তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি কার্যকরী হয়।এই কারণে আমরা দেখি ১৫ আগস্ট ও ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে সারা দেশ জুড়ে সরকারি অনুষ্ঠানে হিসাবে পালিত হয়। আম আদমির কাছে সংবিধান যেহেতু আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত তাই সেই অর্থে ২৬ নভেম্বরের গুরুত্ব মূলত অ্যাকাডেমিক স্তরে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ২০১৪ সালে দিল্লিতে আচ্ছে দিনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পরে ভারতের রাজনৈতিক বৃত্তে সংবিধান এক বহু চর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছে।সংঘ পরিবারের কর্তাদের সংবিধানের প্রতি ' অপরিসীম আনুগত্য ' ও ' শ্রদ্ধা ', বিশেষ করে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটিকে বদলে তাকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার নিয়মিত ঘোষণা সংবিধান সংক্রান্ত যে কোন সরকারি বক্তব্যকে সন্দেহের বস্তু করে তুলেছে।নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৫ সালে ২৬ নভেম্বর দিনটিকে ' সংবিধান দিবস' হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়।তারপর থেকে প্রতি বছর সংবিধান রক্ষার নাম করে সংঘ পরিবারের সংবিধান ভাবনাকে প্রচারের বিষয়বস্তু করে তোলা হচ্ছে যা এক নতুন মাত্রা পেয়েছে ২০২২ সালে এসে।
এবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন( ইউ জি সি) সংবিধান দিবসকে ' ইন্ডিয়াঃ দি মাদার অব ডেমোক্রেসি' (ভারতঃ লোক তন্ত্র কি জননী) হিসাবে পালন করছে।এই ব্যাপারে তাদের সহায়তা করছে ' ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ '( আই সি এইচ আর)।মূল থিমের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আরো কিছু পরিপূরক থিম নির্দিষ্ট করা হয়েছে-- ' ভারতে বেদের সময় থেকে গণতন্ত্র বহমান', ' ভারতের গণতান্ত্রিক উৎস সমূহের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সমূহ', ' লোকতান্ত্রিক পরম্পরা', ' অশোকের রাজত্বকালে গণরাজ্যের অস্তিত্ব ', ' শ্রুতি,স্মৃতি, মহাকাব্য প্রভৃতি প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নীতিসমূহ', ' প্রাচীন ভারতে রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র ', ' স্থানীয় স্বশাসিত সরকার সমূহের ঐতিহ্য ', ' অর্থশাস্ত্রে প্রতিফলিত গণতান্ত্রিক চিন্তা ও ঐতিহ্য ' ইত্যাদি। এই সমস্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে মঞ্জুরি কমিশন পৃথক পৃথক নোট প্রস্তুত করতে অনুরোধ করেছে আইসিএইচআরকে। ইউ জি সি চেয়ারম্যান এম.জগদীশ কুমার জানিয়েছেন ১৫-৩০ নভেম্বর ৪৫ টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ৪৫ টি ডিমড বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কর্মসূচি পালিত হবে।একই সঙ্গে তিনি সমস্ত রাজ্যপালদের অনুরোধ করেছেন বিভিন্ন রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যাতে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে গণতন্ত্রের জননী সন্ধানের এই প্রচেষ্টা নিয়ে সমস্যা কোথায়?সমস্যা বহুবিধ। ভারতবর্ষ গণতন্ত্রের সূতিকাগার -- এই সিদ্ধান্ত যদি এক ঐতিহাসিক তর্ক- বিতর্ক, প্রমাণ,যুক্তি ভিত্তিক হত তাহলে সমস্যার কারণ ছিল না।কিন্তু এক্ষেত্রে ইউ জি সি প্রথমেই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে তারপর সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে প্রমাণ সাজাবার চেষ্টা করছে।আরও চিন্তার কারণ হল যে সমস্ত বিষয়গুলিকে আমরা ভারতীয় সমাজের পশ্চাৎপদতার কারণ বলে মনে করি সেগুলিকেই গণতন্ত্রের গৌরবময় অভিজ্ঞান বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই বিষয়ে মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে এই কর্মসূচির প্রেক্ষাপটটা বুঝে নেওয়া দরকার।
প্রথমত প্রাচীন ভারতই যে গণতন্ত্রের জননী-- এই বিষয়টি সংঘ পরিবারের মতাদর্শের অংশ।গত বছর থেকেই এই বিষয়টা সরকারি প্রচারের অন্তর্ভুক্ত হয়।২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় বলেন-- ' আমি এমন এক দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি যা গণতন্ত্রের জননী বলে পরিচিত। আমাদের দেশ স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পদার্পণ করতে চলেছে কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরানো...... ভারতের গণতন্ত্র এতটাই শক্তিশালী যে এক শিশু যে একদা তার বাবাকে চায়ের দোকানে সাহায্য করত সে আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আপনাদের সামনে উপস্থিত '। গণতন্ত্রের এহেন অভিনব ব্যাখ্যার সামনে যুক্তিতর্ক দাঁড় করানো সহজ কথা নয়।
দ্বিতীয়ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের সাম্প্রতিক বয়ান যেখানে তিনি সদম্ভে ঘোষনা করেছেন ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে।ইতিহাসের হিন্দুত্ববাদী আখ্যানকে সরকারি ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠা করা সংঘ পরিবারের প্রধান অ্যাজেন্ডা। গণতন্ত্র থেকে বিজ্ঞান, প্লাস্টিক সার্জারি থেকে টেস্ট টিউব বেবি,রকেট সায়েন্স থেকে মিসাইল -- সবকিছুই প্রাচীন ভারতের বেদভিত্তিক সমাজে ছিল,এটাই সেই ইতিহাসের মূল কথা।এই নকশার বাইরে বর্তমান কর্মসূচিটি নয়।
তৃতীয়ত বর্তমান সময়ে সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্টতাকে কাজে লাগিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে এই মতাদর্শের ন্যায্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে।আমরা ভুলে যাইনি আইসিএইচআরের অধিকর্তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল মহাভারতের মহাযুদ্ধের দিনগুলিকে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নির্দিষ্ট করা।সাম্প্রতিক সময়ে আই আই টির জ্যোতিষ বিদ্যা অনুযায়ী ক্যালেন্ডার,জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেওয়া সেই কর্মসূচির বাস্তবায়ন মাত্র। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সেখানকার ' অবাধ্য ' ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগরুক করতে সেখানে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক বসাতে চেয়েছিলেন।সরকারি প্রতিষ্ঠানে গৈরিকীকরণ আজ সম্পূর্ণ তাই ইউজিসির মত প্রতিষ্ঠান এই কর্মসূচি নিতে পারে।
এই কর্মসূচির ভরকেন্দ্রে রয়েছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ কর্তৃক প্রস্তুত এক দলিল।এই দলিল শুধু আমাদের সংবিধান চালিকাশক্তিগুলিকে অস্বীকার করে নি,একই সঙ্গে তা হয়ে উঠেছে সংঘ পরিবার কর্তৃক দীর্ঘ দিন ধরে প্রচারিত হিন্দু রাষ্ট্রের আদর্শবাদের এক সরকারি ইস্তেহার।বলা হয়েছে বহু শতাব্দী ধরে ভারতের গ্রাম সম্প্রদায়গুলি স্বশাসিত ও গণতান্ত্রিক। গ্রাম স্তরে খাপ ও পঞ্চায়েতগুলি সেই আচরিত গণতন্ত্রের সাংগঠনিক রূপ। একই সঙ্গে সুকৌশলে বলা হয়েছে বার বার হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন বহিরাগত আক্রমণকারীরা ভারতে এলেও এই গ্রামীন সমাজ তার অন্তর্গত গণতন্ত্রের কারণে অক্ষত থেকেছে।২০০০ বছর ধরে হিন্দু সংস্কৃতি ও সমাজ সম্পর্কে অজ্ঞ বিদেশিরা ভারত শাসন করলেও হিন্দু সংস্কৃতি সগৌরবে বিরাজমান।গোটা দলিলে ভারত অর্থে হিন্দুকে বোঝানো হয়েছে।এই দলিল শুধু অনৈতিহাসিক শুধু নয়,একই সঙ্গে হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত ব্রাহ্মণ্যবাদ ও তার বিষময় পরিণাম জাতপাত ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে দাবি করেছে।প্রাচীন যুগে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গড়ে ওঠা ধর্ম সংস্কার আন্দোলন, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিকাশ ও গণরাজ্যগুলির প্রতিষ্ঠা যে এক আলাদা ধারা, সেই ইতিহাসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে।ভারতে ইসলাম ধর্মের আগমন,সুলতানি ও মুঘল যুগ এবং সেই সময়কার ভক্তি ও সুফিবাদের সমন্বয়ী সংস্কৃতি গণতন্ত্রের কি রূপ তৈরি করেছিল তা নিয়ে দলিল নীরব। সমাজ বিকাশের নিয়ম মেনে মহাজনপদ থেকে যখন ভারতে সাম্রাজ্যের যুগের সূচনা হচ্ছে তখন রাজতন্ত্রকে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের জন্ম।কিন্তু তাকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করলে তা আমাদের গণতন্ত্র সম্পর্কে এক ভুল ধারনা দেবে।আসলে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রভাবনায় ইসলাম ও মধ্যযুগের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার বা তাকে এক অন্ধকারময় যুগ হিসাবে চিহ্নিত করার যে কৌশল কাজ করে, আলোচ্য দলিলে তাকে সরকারি শিলমোহর দেওয়া হয়েছে।আর আমরা যে সংবিধান রচনা করেছি তাতে এক গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা হল ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের যে বৌদ্ধিক ভাবনা,সাম্য- মৈত্রী - স্বাধীনতার প্রতি যে আকাঙ্খা সংবিধানে সমন্বিত করা হয়েছে তাকে নাকচ করার সচেতন প্রয়াস রয়েছে আই সি এইচ আরের দলিলে।
সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হল সংবিধান দিবস উদযাপন করতে গিয়ে সংবিধান খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান বাবাসাহেব আম্বেদকারের ভাবনাকে নাকচ করে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শকে স্থাপন করতে চাইছে আজকের সরকার।আম্বেদকর যিনি ' অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট' এর মত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছেন,প্রকাশ্যে জাত পাতের দলিল ' মনুস্মৃতি ' পুড়িয়ে দেবার আহ্বান রেখেছেন, সম্ভবত সংবিধানের এই পরিণতির আশঙ্কা করেছিলেন।তিনি বলেছিলেন একটা সময় ভারতে একাধিক গণরাজ্যের অস্তিত্ব ছিল,রাজতন্ত্র থাকলেও তা নিরঙ্কুশ ছিল না।কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদের আগ্রাসনে ভারত তার সেই গণতন্ত্রকে হারিয়েছিল।নতুন সংবিধান আজ আরেক গণতন্ত্রের দ্বারপ্রান্তে আমাদের উপস্থিত করেছে,আমরা আবার তা হারিয়ে ফেলবো না তো? বাবাসাহেব মনে করতেন ধারাবাহিক ও বিশাল নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্টতা নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রের (electroral autocracy) জন্ম দিতে পারে।আম্বেদকর স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন-- ' Bhakti in religion may be a road to the salvation of the soul.But in politics Bhakti or hero- worship is a sure road to degradation and to eventual dictatorship' আজকের ভারতবর্ষে আম্বেদকরের সেই আশঙ্কাকে আমরা সত্যি হতে দেখছি।
শুধু আম্বেদকরকে নাকচ করার মধ্যেই গল্পটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না।স্থাপিত হচ্ছে সংঘ পরিবারের সংবিধান ভাবনা,সাভারকার থেকে হেগড়েওয়ার যার প্রচারক।যারা প্রকাশ্যে ১৯৫০ সালে বলেছিল এই সংবিধানে কোন ভারতীয় উপাদান নেই, মনুস্মৃতির জীবনাদর্শ নেই,আছে শুধু পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ। এই মানুষেরা বিশ্বাস করে কোন অত্যাচারী শাসকের প্রতিরোধে গণতান্ত্রিক লড়াই কিছু মাত্রায় কার্যকরী হলেও তা কখনো ভারতের মত দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হতে পারে না। এই হিন্দুত্ববাদীরা বিশ্বাস করে বর্ণ ব্যবস্থা এক বিজ্ঞান সন্মত জীবনশৈলী যা ভারতের সামাজিক সম্প্রীতিকে অক্ষুন্ন রেখেছে। কোনরকম ভণিতা না করেই তারা বলে ভারতের ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে,' not in equality but in harmony' বর্ণবাদী সেই স্তরীভূত ব্যবস্থা তাদের আদর্শ, যাকে তারা নতুন দিনের সংবিধান বলে চালাতে চাইছে। গণতন্ত্রের জননী সন্ধান সেই নীল নকশার একটা গ্রন্থি মাত্র।