আবারও অঘটন কাতার বিশ্বকাপে। সুয়ারেজ, নেইমারের পর কাতার বিশ্বকাপে লড়াই শেষ হয়ে গেল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোরও। মরক্কোর কাছে হেরে গিয়ে শেষ আট থেকে বিদায় নিল পর্তুগাল আর সেইসঙ্গে শেষ হয়ে গেল সি আর সেভেনের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নও। খেলোয়াড় হিসাবে বিশ্বকাপ জয় আর সম্ভব হল না সি আর সেভেনের। ইউসেবিও, লুই ফিগো, ডেকোদের মত ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আর পেপেরও বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। তবে পর্তুগালকে হারিয়ে শেষ চারে পৌছে ইতিহাস গড়ে ফেলল মরক্কো। ক্যামেরুন, সেনেগাল, ঘানা যা পারেনি ২০২২-এর কাতার বিশ্বকাপে সেটাই করে দেখালো মরক্কো। ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম আফ্রিকার দেশ হিসাবে শেষ চারে পৌছালো মরক্কো। ইতিপূর্বে কোনও বিশ্বকাপের মূলপর্বেই প্রথম রাউন্ডের বাধা টপকাতে পারেনি মরক্কো, আর এবার সেই মরক্কোই এশিয়ার মাটিতে অশ্বমেধের ঘোড়ার মত ছুটছে। এখনও পর্যন্ত এই বিশ্বকাপে একমাত্র কান্ডার বিরুদ্ধে একটি গোল খাওয়া ছাড়া আর কোনও গোল হজম করেনি মরক্কো। সেমি-ফাইনালে পৌছানোর পথে তারা গ্রুপের খেলায় গোলশূন্য ড্র করেছে বিগত বিশ্বকাপের রানার্স ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে। পরাজিত করে বিশ্বকাপ থেকে তারা একে একে ছিটকে দিয়েছে-কানাডা, বেলজিয়াম, স্পেন এবং পর্তুগালের মত দলকে। তাই কোনওভাবেই আর মরক্কোকে হাল্কাভাবে নেওয়া যাচ্ছে না। অসাধারণ দলগত ঐক্যের আর লড়াকু মেজাজের পরিচয় দিয়ে মরক্কো বিশ্বকাপের শেষ চারে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিয়েছে। কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই যেন দলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রয়েছেন, অধিনায়ক রোমান সেইসের নেতৃত্বে মরক্কোর রক্ষণভাগ যেন নিশ্ছিদ্র-দুর্ভেদ্য দুর্গ হয়ে রয়েছে। পর্তুগালের বিরুদ্ধে প্রথমার্ধে লড়াকু মেজাজেই খেলা শুরু করেছিল মরক্কো। ম্যাচের ৪২ মিনিটে উঁচু করে ভাসানো সেন্টারে ইউসেফ এল নেসিরি বিরাট লাফ দিয়ে মাথা ছোঁয়ানটাই খেলায় চূড়ান্ত পার্থক্য গড়ে দিল। নেসিরির ওই লাফ যেন মরক্কোর বিশ্বকাপের শেষ চারে পৌছে ইতিহাস সৃষ্টির দ্যোতক। অবশ্য পর্তুগালের গোলরক্ষক আর নেসিরির ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলা পর্তুগিজ ডিফেন্ডার দুজনেই শূন্যে বলের গতি প্রকৃতি বুঝতে ভুল করলেন। এই গোলটি হওয়ার পর থেকেই পর্তুগাল চেপে ধরে মরক্কোকে। কিন্তু মরক্কোর গোলের দরজা কিছুতেই খুলতে পারেনি পর্তুগিজরা। এদিনও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে রিজার্ভ বেঞ্চে রেখেই শুরু করেছিল পর্তুগাল। দ্বিতীয়ার্ধে সি আর সেভেন মাঠে নামলেও খেলায় কোনও ছাপই ফেলতে পারেননি। অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন পেপে আর মরক্কোর রক্ষণভাগে বারবার আক্রমণ শানিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারিগর যিনি তিনি হলেন ব্রুনো ফার্নান্ডেজ। বি এফ এইট বারবার আঘাত হানলেন, মরক্কোর রক্ষণভাগকে ব্যতিব্যস্ত করে দিলেন, দুর্ভেদ্য গোলরক্ষক বোনোকেও পরাস্ত করলেন কিন্তু ভাগ্য তাকে গোল পেতে দিল না। একবার তার শট বারে লাগল, অন্য দু’বার গোলপোস্ট প্রতিহত করে দিল তাকে। এছাড়া রাফায়েল লিয়াও পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসাবে নেমে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ম্যাচের শেষের দিকে মরক্কোর চেড্ডিরা লাল-কার্ড দেখে বেরিয়ে যাওয়ার পরও দশজনের মরক্কো রক্ষণও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে রুখে দিল একের পর এক আছড়ে পরা পর্তুগিজ আক্রমণকে। রোনাল্ডো বিশ্বকাপের আসর থেকে চিরবিদায় নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন, সেই কান্নায় যে আবেগ ছিল তার ছিঁটেফোটাও কিন্তু আজকের খেলায় রোনাল্ডোর খেলার মধ্যে ছিল না। যতক্ষণ তিনি মাঠে ছিলেন মরক্কোর দুই ডিফেন্ডারের পুলিশম্যান মার্কিং-এর মাঝে নিস্তেজ হয়েই ছিলেন।
মরক্কোর প্রতিপক্ষ হিসাবে শেষ চারে উঠে এল ফ্রান্স। ব্রিটনির যুদ্ধে তারা হারিয়ে দিল তাদের চিরাচরিত প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডকে। লড়াই হল তীব্র কিন্তু শেষ হাসি হাসল ফরাসিরাই। কিলিয়ান এমবাপে আর অলিভার জিরোউয়ের পাশে বহুদিন বাদে ঝলমল করতে দেখা গেল আতোয়াঁ গ্রিজম্যানকে যিনি বিশ্বকাপে ফ্রান্সের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল এসিস্টের রেকর্ডের অধিকারী। সেই সঙ্গে দারুণ সঙ্গ দিলেন রাইট উইঙ্গার ডেমবেলে। তবে ফ্রান্সের প্রথম গোলটি এল ম্যাচের ১৭ মিনিটে চৌয়ামেনির নেওয়া দুর্দান্ত মাটি ঘেঁষা শট থেকে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই ইংল্যান্ড আক্রমণের চাপ বাড়ায় এবং এই চৌয়ামেনিই তাদের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে সাকাকে ট্র্যাপ করে ফেলে দিলে সেই ক্ষেত্রে পাওয়া পেনাল্টি থেকে গোল করে ইংল্যান্ডকে সমতায় ফেরান তাদের অধিনায়ক হ্যারি কেন। ফ্রান্স দ্বিতীয়বার ম্যাচে এগিয়ে যায় ৭৭ মিনিটে যখন উঁচু সেন্টারে হেড করে বল ইংল্যান্দের জালে জড়িয়ে দেন অলিভার জিরোউ। তার কিছু পরেই আবার ম্যাচের দ্বিতীয় পেনাল্টি পায় ইংল্যান্ড। প্রথম পেনাল্টি থেকে গোল করে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোল স্কোরার হিসাবে ওয়েন রুনির রেকর্ড ছুঁয়ে ফেললেও এই দ্বিতীয় পেনাল্টি থেকে ম্যাচে দ্বিতীয়বারের জন্য সমতা ফেরাতে ব্যর্থ হল হ্যারি কেন। কেনের শট বারপোস্টের অনেক ওপর দিয়ে উড়ে বেরিয়ে যায়। এরপর আর ইংরেজদের কোনও সুযোগ দেয়নি ফরাসিরা। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ মরক্কো। রাজনৈতিকভাবে মরক্কো একসময় ফরাসি উপনিবেশ ছিল, রাজনৈতিকভাবে বলা হত ফ্রেঞ্চ প্রোটেকটরেট। ১৯০৭ থেকে ১৯৩৪-এর মধ্যে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ ছড়িয়ে পড়ে মরক্কোতে। ১৯৫৫ সালের ৬ই নভেম্বর থেকে মরক্কোর স্বাধীনতার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে এসে তারা ফরাসি শাসনের প্রভাব মুক্ত হয়। সেই দুই দেশের মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর কাতারের মাটিতে বিশ্বকাপের আসরে অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় সেমিফাইনাল। নিঃসন্দেহে এই ম্যাচের ফেভারিট বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স কিন্তু মরক্কো এই বিশ্বকাপে অনেক হিসাবেই পাল্টে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা তাদের হারানোর আর কিছু নেই। ইতিহাস তারা তৈরি করেই ফেলেছে, সেই ইতিহাসকে আরও গৌরবোজ্জ্বল করতে চাইবে তারা, অন্যদিকে নিজেদের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তকমা ধরে রাখতে ফ্রান্সও কোনও কসুর বাদ রাখবে না, তাই শেষ চারের লড়াইও যে রুদ্ধশ্বাস হবে তা আর আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না।