ডাঁটি দিয়ে পানের পাতায় চুন বোলাতে বোলাতে বিলাস এসব ভাবছিল আর টের পাচ্ছিল মেয়েটার আয়না দেখা। গলায় ঈষৎ সোহাগ ফুটিয়ে সে হাঁক পাড়ল, ‘হ্যাঁ রে প্রীতি!’
প্রীতি ওর আসলি নাম। লাইনে ডাকে, চামেলি। প্রীতি ওরফে চামেলি তাকাতেই ফট্ করে চোখ মারল বিলাস৷ এককালে হরিমতির সঙ্গে তার ভাবসাব ছিল৷ নতুন হনুমান মন্দির কমিটিতে ঢোকা ইস্তক, বিলাস খুল্লমখুল্লা হরিমতি ওরফে লতিকার ঘরে আর ঢোকে না৷ তা বলে আড়ালে-আবডালে মেয়েছেলেদের চোখ মারবে না, এমন কড়ার নেই৷ আপাতত প্রীতি নামক খানকি কর্কশ গলায় অশ্রাব্য গাল দেয় তাকে৷ খ্যাকখ্যাক হাসতে হাসতে বিলাস ভাবে, খানকি নিজে চোখ মেরে খদ্দের ডাকলে ক্ষতি নেই, আর অন্যে মারলে দোষ! পাশে পিন্টুর খেলনার দোকান৷ দিনভর চাবি দেয় এটাসেটা খেলনায়৷ খ্যঁচখোঁচ ক্যাঁচকোঁচ। ওরকমই খ্যাঁচখ্যাঁচে স্বর প্রীতির। বেশ্যার খিস্তি শুনে চা খেতে খেতে সাদা পুলিস কলের পুতুলের মতো ঘুরে তাকায়।
একদিকে মুখ্যমন্ত্রীর গলি৷ অন্যদিকে বেশ্যাপাড়া। মাঝে ফুটপাথ-রাস্তা-ফুটপাথ ছাড়া কালীঘাট মন্দিরের পেল্লায় গেট। ধর্মরাজনীতিনষ্টামি — পিচ, জল আর কাদার মতো মিলেমিশে আছে এইখানে। ফুটপাথ শাসন করছে সাদা সাদা কলপুতুল৷ প্যান্ডাল বাঁচাচ্ছে, না মন্ত্রীসান্ত্রী না মন্দির— তারাই জানে। কাদের থেকে বাঁচাচ্ছে, সেইটা বরং স্পষ্ট তাদের হম্বিতম্বিতে। বেবুশ্য, বাটপাড় বা বেয়াদব বাদানুবাদ দেখলেই কড়কে দিচ্ছে৷ এই মুহূর্তে সাদা কলপুতুল প্রীতির দিকে এগোয়।
প্রীতি ওরফে চামেলি চপের দোকানের রোয়াকে স্বপ্না ওরফে চুমকির পাশে দাঁড়ায়৷ কিন্তু কথা হল, আয়না। প্রীতির আয়না দেখা হল না ভাল করে। পার্স থেকে অগত্যা ফেসপাউডারের ডিবে বের করে চামেলি ওরফে প্রীতি। ডিবের ঢাকনিতে খুদে একটা আয়না লাগানো। প্যান্ডেলে হুকিং মেরেছে আজ লোডসেডিং। সাজগোজ উতরেছে কিনা, তা অন্ধকার ঘরের আয়নায় দেখে নেওয়া হয়নি প্রীতির।
স্বপ্না জিগ্যেস করে, ‘বিলাস কী করেচে রে?’
‘চোক মারল মাইরি!’
‘আ আপদ! বিনি পয়সায় ফুটানি!’
‘অন্ধকারে মেয়েকে কোথায় রেখে এলি, স্বপ্না?’
‘ইস্কুলে গেল জামা নিতে।’
‘আমার ছেলেও।’
ইস্কুল মানে একটা এমনিই যাহোক দুকামরা। সন্ধেবেলা বাচ্চাদের পড়ায়। নাচগান শেখায়। সেলাইফোঁড়াই, রোববার ফুটবল৷ বাচ্চাদের বেড়াতে নিয়ে যায়। বাচ্চাগুলো দু-তিন ঘণ্টা ভাল ভাল কথা শোনে। হরলিক্স খায়। কম কী? পুজোয় জামাও দেবে ওখানে কারা যেন এবার।
একটা গাড়ি গড়িয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। খদ্দেরের আশায় চুমকি-চামেলি বেঁকেচুরে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল, স্টিয়ারিং ধরা লোকটা নেহাতই জড়োসড়ো ড্রাইভার। ড্রাইভারশুদ্ধু গাড়ি হাঁকিয়ে এপাড়ার খদ্দের আসে না। প্রাইভেট গাড়ির বা ক্যাব ড্রাইভার নিজেই খদ্দের হলে, কখনও কখনও গাড়ি চড়ে আসে বটে। কিন্তু এর অস্বস্তি বলে দিচ্ছে, এ খদ্দের নয়৷ পালাতে পারলে বাঁচে। চুমকি-চামেলিকে এড়াতে লোকটা কাচ তুলে দেয়।
‘আ আপদ! জাত চলে গেল গো!’ স্বপ্না বলে।
প্রীতি কিছু বলে না। গাড়ির কাচে আয়না দেখে। বিলাসের আয়না ঢিল মেরে ভাঙবে একদিন। গাড়ির কাচ দেখে প্রীতি চুল ঠিক করে। ছলাকলা মক্সো করে। আরেকটা আয়না মনে প’ড়ে যায় তার। গোলাপি প্লাস্টিকের ফ্রেমঘেরা ছোট আয়নাটা, যাতে ঢলঢলে শান্ত মুখ দেখা যেত। অনেকদিন পর তার ঠাকুর দেখতে ইচ্ছে জাগে।
স্বপ্না গাড়ির আড়ালে ঢাকা পড়তে চায় না। প্রীতির সঙ্গে প্রতিযোগিতাও চায় না। বললে বলতেই পারত, কিন্তু বলে না—’আমার জায়গায় দাঁড়ালি কেন মাগী?’ আপাতত সে খানিক দূরে সরে গেছে। সেও চুল ঠিক করে নিচ্ছে। তারও আছে নিজস্ব আয়না। তার আয়না ভাঙা রাস্তার খাঁজে জমা বৃষ্টির জল।
সাদা পুলিস বিলাসের দোকান থেকে সিগারেট ধরাল। মাপছে চুমকির বুক। মাপছে চামেলির কোমরের খাঁজ। বিলাস বোঝে, কিছু একটা ঘটবে। দশ নয় আট সাত ছয়….
২.
বিলাসের আয়নায় এখন পুলিসের ছায়া।
মেজবাবু অভীক লস্কর আয়নায় দেখছিল নিজের বুকের খাঁচা। ‘গালটা কাকে দিল মাগী?’ বিলাসকে জিজ্ঞাসা করেছিল সে। বিলাস ভাজা-মাছ-উল্টে-না-খাওয়া মুখ করে বলেছিল, ‘কে জানে! ওদের কি মুখের ঠিক আছে? আমাকে না আপনাকে… কাকে যে বলল!’
বুকের খাঁচা চুপসে গেল অভীক লস্করের। উর্দি না থাকলে তাও মানা যেত। উর্দিওয়ালাকে খিস্তি! এত সাহস হবে কি? চারপাশ দেখে নেয় লস্কর। কতজন শুনে থাকতে পারে? পান দোকানীটা ছাড়া আর কে কে? ওই যে খেলনা দোকানের পাকা ছোঁড়াটা, সেও কি শুনেছে? হুই যে চপের গুমটি, শুনেছে কী? এই যে একটা ক্যাব ক্যাঁচ করে থামল এখনই, তার ড্রাইভার শুনল কি? লস্করের কপালে ভাঁজ পড়ে। গোঁফ ঝুলে পড়ে তার। পুলিস জিপের ড্রাইভারও কি তবে…!
হাতে-গরম সবক না শেখালে, পুলিসত্ব তো বটেই, পৌরুষও বাকি থাকবে না। আয়না ভ্যাঙায় লস্করকে। আয়না কি জেনে ফেলেছে, মেজোবাবু রোজ থ্রেট খায় বড়বাবুর কাছে? আয়না কি জেনে ফেলেছে, প্রোমোশন আটকে আছে তার? মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে ডিউটি যে নিয়েছে, তারও কারণ আছে। এদিকে দামি লোকজন আসে। প্রোমোশনের তদ্বির করা যাবে। খানকিদের গাল শুনতে তো সে আসেনি! ওরকম কতজনকে সে….
পুলিস হয়ে গেলে একবার, থাকতে হয় সদা সতর্ক। পুলিসের মাথায় চড়ে যদি আমজনতা নাচে, পুলিস তবে পুলিস কীসে? ঢি ঢি পড়ে যাবে থানায়। ডিমোশনও হতে পারে। একটু আগে লস্করেরও অবশ্য, প্রীতির মতোই, মনে পড়ছিল ছেলেবেলা। পুজো। মেলা। হাওয়া চরকি। যত সব ছেলেমানুষি ব্যাপার, যারা বুকের খাঁচার ইঞ্চিমাপ বা গোঁফের পুরুত্বের তোয়াক্কা করে না। লস্কর জানতে পারে না, কোনো এক অলৌকিক মুহূর্তে তার আর একটা খানকির শৈশবচিন্তা এক সুতোয় বাঁধা পড়েছিল।
আপাতত আয়নার লস্কর গোঁফে তা দেয়। শ্বাস টেনে খাঁচা চওড়া করে। গলা ঝেড়ে ব্যারিটোন জাগিয়ে তোলে। লাঠি ঠোকে পান দোকানের টিনের দেওয়ালে তিন বার। আয়না দিয়েই লস্কর দ্যাখে, পিছনে কাচ তুলে দিল সদ্য থামা সেই ক্যাবের ড্রাইভার। নিশ্চয় ব্যাটা ভয় পেয়েছে। পুলিসকে ভয় পেতেই হবে। আয়নাই লস্করকে সাহস জোগায়। বলে, জ্জিও! এগিয়ে যাও। আয়নাতে বেশ্যা দুটোকেও দেখা যাচ্ছে। পুলিস দেখে ওদের মুখও ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে কি?
লস্কর ঘুরে দাঁড়ায়।
৩.
কাঁচ তোলা গাড়ির ভিতর দম বন্ধ লাগছিল প্রতাপের। তার উপর ফ্রন্ট মিরর তাকে তাড়া করছে। পাড়াটাও৷ খেপ খাটা ড্রাইভার প্রতাপ শুধু জানে, কত ঘণ্টার খেপ। খেপ কোথায় খাটতে হবে, সে খবর আগে থেকে জানানোর নিয়ম নেই। এ পাড়া জানলে সে আসত কি?
মালপত্র আর তিনটে লোক। একটা ছেলে, দুটো মেয়ে। থুড়ি। একটা মেয়ে৷ অন্যটা মেয়ের মতো কিছু। সে প্রতাপের পাশটিতে বসেছিল। হেঁড়ে গলা৷ রোমশ গা। শাড়ি পরেছে। মাগীপনা করছিল বহুত। হিজড়া নাকি কে জনে! এরকম চিজ আগে দেখেনি প্রতাপ। হিজড়ার মতো প্রাণিটা ইংরিজি বলছিল ফটরফটর। তাই প্রতাপ ওকে মেয়েই মেনে নিয়েছিল শেষমেশ। প্রতাপের ফুফির গলাও খানিক পুরুষালি ছিল৷ সেরকমই হয়ত। হিজড়া কি আর ইংরেজি বলে?
পুজোর আগে দানখয়রাত, বড়লোকের খেয়াল। তা বলে এই পাড়া? প্রতাপ বিহার থেকে এসেছে বছর দুই। রাস্তাঘাট পুরোপুরি সড়গড় হয়নি। মোড়ের মাথায় প্রথম লাল-শাড়িকে দেখার আগে পর্যন্ত সে বোঝেনি গন্তব্যের মাহাত্ম্য। তারপর লাল-নীল-হলুদ….কত! কত! মুখগুলো একই রকম। একই ভাবে চোখ আর ভ্রুতে ঘন কালো তুলি বোলানো। একই লাল বা ক্যাটক্যাটে গোলাপি লিপস্টিক।
তখন থেকে গা-টা গুলোচ্ছে। ওরা বোঁচকাবুচকি নামিয়ে চলে যাওয়ার পর, প্রতাপ একা হয়ে গেল। অস্বস্তিটা পেয়ে বসল। গাড়ি নিয়ে খানিক দূরে অপেক্ষা করছিল সে। ভাবল, চা খেলে অস্বস্তিটা কমবে। মামুরা চা খাচ্ছে। ওর ভাঁড় আসতে দেরি হচ্ছিল তাই। প্রতাপ মাইন্ড করেনি। মামুরা বিরূপ হলে দোকানির কপালে শনি নাচবে, এ কি আর সে জানে না?
ওদের বোধহয় কাজ হয়ে এসেছে। ফোনে ডেকে পাঠাল ড্রাইভারকে। চায়ে তড়িঘড়ি চুমুক দিয়ে, প্রতাপ তাই ফিরেছে সেইখানে, যেখানে ওদের নামিয়েছিল। দুটো মেয়েছেলে এখন সেখানে রোয়াক দখল করেছে। প্রতাপ ওদের দেখে কাচ তুলে দিয়েছিল। তারপরই ফ্রন্ট মিররে চোখ পড়ে গেল।
হিজড়ের মতো দেখতে অথচ ইংরেজি বলা প্রাণিটা আয়নার কথা বলছিল পিছন ঘুরে, বন্ধুদের। বলছিল, সে আয়না খুব ভালবাসে। সাজগোজও৷ আর কী বলছিল, প্রতাপ তা বোঝেনি৷ অথচ প্রতাপ আয়নায় চাইতে পারছে না৷ আয়নায় নাছোড় একুশ বছরের এক ছেলে। একুশ বছর বলল, রাস্তার মাগী দুটোর চোখে বোধহয় রগড়। কিংবা সন্দেহ। কিংবা ঘৃণা। হয়ত রাগ। বা রক্ত!
রক্ত প্রচুর বেরিয়েছিল। সে রক্ত কোনো মতে প্রতাপ অন্ধঘরে বন্ধ রেখেছিল বিশ বছর। মনোহরের সঙ্গে সে বেশ্যাপাড়ায় গেছিল প্রথমবার। গাঁ থেকে ট্রেনে করে শহরে নেমেছিল দুই জন। দসেরায় খুব আলো। খুব জৌলুশ। দুই কিশোরের শরীর-খোঁজা প্রথম অভিযান।
যাকে মনে ধরেছিল, তার চোখদুটো বলির আগের ছাগলের মতো ভীত। হয়ত সেজন্যই মনে ধরেছিল। মেয়েটা বাধা দেয়নি। ওরও প্রথম বার। রক্ত বেরিয়েছিল খুব। ছাগলছানাটি জ্ঞান হারিয়েছিল।
ওই বয়সের একটি বাচ্চা এখন প্রতাপের আছে। রক্ত দেখে একুশ বছর পালিয়েছিল টাকা মিটিয়ে৷ বমি পাচ্ছিল। রক্তের একটা আঁশটে গন্ধ আছে। আর কখনও বেশ্যাপাড়ায় যায়নি প্রতাপ। বদ্ধ গাড়িতে এক্ষণে তার বমিভাব ফিরে আসছে। ফ্রন্ট মিররটা তাড়া করছে।
৪.
আয়নার সামনে জামা গায়ে ফেলে মাপ দেখে নিচ্ছিল রোশনি৷ প্রথমে তাকে ফ্রক দিচ্ছিল ওরা। বারো বছর পর্যন্ত মেয়েরা ফ্রক পাচ্ছে। তার উপরে সালোয়ার আর কুর্তি। রোশনির এখন বারো। তাকে দেখে নতুন দিদি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘গায়ে হবে না। কুর্তি বের করো।’
ওরা জামা দিতে এসেছে। আগে ওদের দেখেনি রোশনি কখনও। পুরোনো দিদি জানে, গতরে বাড়লেও রোশনি আসলে ছেলেমানুষ৷ চু কিতকিত ভালবাসে। আর ছোটা ভীম। পুরোনো দিদি হাসল৷ ‘রোশনি, তুই তো বড় হয়ে গেলি, অ্যাঁ! যা, পরের লাইনে দাঁড়া।’
তারপর পনের ষোলোর লাইনে দাঁড়িয়েছিল রোশনি। বাহারি ফ্রকের বদলে পেয়েছিল জুঁইফুল ছোপ কটন কুর্তি৷ আর লেগিংস। পাশের ঘরে উনিশ কুড়ির দিদিরা সেলাই শেখে। ওরা ফটাফট আল্টার করে হাত মক্সো করছিল৷ রোশনির পেয়ারের বন্ধু যূথী বায়না ধরেছিল, কুর্তি তারও চাই, ফ্রক নয়। পুরানো দিদি তাকে ধমক দিচ্ছিল। অল্টার করতে দেওয়ার আগে, গায়ে জামা ফেলে দেখে নিচ্ছিল রোশনি, কতটা মারতে হবে। রোশনির প্রথম কুর্তি৷ রোশনি দেখছিল, সে বড় হয়েছে। তার বুক ঠেলে বেরিয়ে আসছে স্তন। রোশনিকে দেখে মা কী বলবে এবার?
সৎ মায়ের মদের ব্যবসা। দাদা গাঁজার প্যাকেট বেচে। এপাড়ায় নয়দশের ছেলেমেয়েও নেশা করে। রোশনিও তলিয়ে যেত ধুনকিতে। সন্ধে স্কুলের দিদি হাত ধরে ফেলেছিল তার আগে৷ নাম লেখানো থাকলেও, সকালের স্কুলে যেত না রোশনি৷ পড়া না পারলে দিদিমণি ওর পাড়ার নাম তুলত৷ ওদের পাড়ায় কারও পড়াশোনা হয় না নাকি।
সন্ধে স্কুলে আসতে শুরু করায়, মা বাওয়াল দিয়েছিল খুব। কিছুতেই মিশতে দেবে না ওদের সঙ্গে। এই কি পড়াশোনার বয়স? মাত্র এক বছরের বড় দাদা রোজকারে ঢুকেছে। রোশনি বরং রোজকারের পথ দেখুক। ইস্কুলে এসে দাদা ঝামেলা করেছিল। সৎ দাদা৷ যাকে কাঁখে নিয়ে এসেছিল সৎ মা। একই খাটে শোয়। মাঝে মাঝে রাতের বেলা তার হাত রোশনির গায়ে কিলবিল করে। দিদিমণিকে মারতে গেছিল দাদা। দিদিমণি পুলিশ ডেকেছিল।
রোশনির পরিবার এখনও গেরস্ত। বাবা শয্যাশায়ী। ফ্যালফ্যাল করে চায়, যখন মা বলে, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে হোক, যেভাবে হোক, রোজকার করে আন।’ রোশনি দেখছে এখন নিজেকে। অবাধ্য বুকে জামা ফেলে দেখছে। মা কী বলবে কুর্তি-লেগিংস পরা রোশনিকে দেখলে? রাস্তায় দাঁড়াতে বলবে কি?
৫.
রোশনি সরে যেতেই আয়নায় মৃন্ময়ীর ছায়া পড়ে। মৃন্ময়ী সত্যিই আয়না ভালবাসে। যেমনটা সে গাড়িতে আসতে আসতে বলছিল অয়ন আর সুহানিকে। সন্ধের ইস্কুলে জামাকাপড় দিতে এসেছে তারা। মৃন্ময়ী অ্যাক্টিভিস্ট মহলে পরিচিত নাম এখন। অন্যরকম দেখতে মানুষ৷ ভাল বক্তা। ইংরেজি ভাষা আর লিঙ্গরাজনীতির তত্ত্বজ্ঞান, দুয়েই তার দখল আছে। এ কমিউনিটিতে তার মতো আর কেউ নেই বলা চলে৷ আঁতেল-মাত্রেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়। ‘মুসলমান বন্ধু’র মতো ‘ট্রান্স বন্ধু’ও অহংকারের ধন। মৃন্ময়ীর গর্ব আছে হালকা, নিজেকে নিয়ে।
এখন আয়নায় মৃন্ময়ীর দীঘল ছায়া। তার উচ্চতা সাধারণ মেয়েদের চেয়ে বেশ খানিক বেশি৷ মেয়েদের চেয়েও পরিপাটি তার শাড়ি পরার ধরন। চুড়ি, দুল, সব নিখুঁত। সে বুক টান করে দাঁড়ায়, যাতে স্তনের রেখা স্পষ্ট হয়।
সকাল থেকে অনেকখানি সময় তার আয়নার সাথে কাটে। প্রথমে দাড়ি কামানো। লেজার ট্রিটমেন্টের পরেও যে কটা দাড়ি ওঠে। তারপর ময়শ্চারাইজার মেখে পেলব হয়ে ওঠার পালা। একে একে কমপ্যাক্ট, পাউডার। মুখের আকার স্পষ্ট করতে কন্টরিং। শেষে কাজল লিপস্টিক। ঘেন্নার শিশ্ন চেপেচুপ সে অন্তর্বাস পরে। এই যে মেয়েটা সরে গেল এখনই, সদ্যোন্নত বুক নিয়ে কী যে করবে, ভেবে পাচ্ছে না সে। অথচ মৃন্ময়ী প্রতি সকালে বক্ষ সাজায়। নকল বুক ঠোসে। তার উপর প্যাডেড ব্রা। তার উপর কাঁচুলি। তারপর সায়া। শাড়ি। আয়না হেসে ওঠে।
ঐ মেয়েটার বয়সে মনে মনে কতবার যে সে বুক চেয়েছে বান্ধবীদের মতো! কোএড স্কুল ছিল। ইংরেজি মিডিয়াম। ছেলেরা একবার লেডিজ টয়লেটে ঢুকিয়ে ছিটকিনি দিয়ে দিল। অথচ শাস্তি হল তারই৷ বন্ধু বলতে মেয়েরাই ছিল। আর ছিল আয়না। কেউই যখন তার ভিতর সত্ত্বাকে মানতে চাইত না, তখন শুধু আয়নাই আস্কারা দিত। আয়না ফেরাত না লিপস্টিক-কাজল মাখা আহ্লাদী, মেয়েলি মুখকে। আয়না থেকে মায়ের টিপখানা তুলে সে কপালে পরে নিত।
সেবার ইস্কুলে শাস্তি হল, ছেলে হয়ে মেয়েদের টয়লেটে ঢোকায়। ঢুকতে চায়নি। ঠেলতে ঠেলতে ঢোকানো হয়েছিল। তারপর ছিটকিনি। আসলে প্রথমে ছেলেরা শাস্তি দিয়েছিল সহ-ছেলেকে, ছেলে হতে অস্বীকার যাওয়ায়। তারপর শাস্তি দিয়েছিল প্রিন্সিপাল। দুই শাস্তির মাঝের সময়টা ছিল আয়নাসময়। টয়লেটে তখন কোনো মেয়ে ছিল না। বন্ধ টয়লেটের দেওয়ালেও আয়না ছিল। আয়না থাকলে সে আর একা কই? তখন তার বাস্তব, তার স্বপ্নের মুখোমুখি হয়। স্বপ্নের গালে হাত বুলিয়ে দেয় সে। ভারি ভাল লাগে। পূর্ব অপমান মনে থাকে না। সম্ভাব্য অপমানও গায়ে লাগে না।
তাই সুহানিকে সে বলছিল, আয়না সে খুব ভালবাসে। পাশের ড্রাইভার লোকটা অবাক চোখে তাকাচ্ছিল। লোকটা ওকে হিজড়ে ভাবছে। হিজড়ে আর ট্রান্সের তফাত ড্রাইভার তো ছার, কত শিক্ষিত লোক জানে না! ড্রাইভার দেহাতি। ইংরেজি ভাষাকে সমীহ করে বলেই ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশি করে ইংরেজি বলছিল সে। প্রতিপত্তিতে ড্রাইভারের সঙ্গে তার তুলনাই হয় না। তবু, ড্রাইভারকেও যেন বোঝানো দরকার, সে যে-সে নয়। কেন নিজেকে প্রমাণ করার এত তাড়না মৃন্ময়ীর?
সেদিন মেট্রোয় সামনে পুলিস তার বুক টিপে দেখেছিল, আসল না নকল? মৃন্ময়ীর মুখে কথা সরেনি৷ সাউথপয়েন্টে পড়া মৃন্ময়ীর বুক টিপে দেওয়া যায়? গবেষণারত মৃন্ময়ীকে বলা যায়, ‘আসল না নকল?’ সুহানি বলেছিল, যায়, যায়। বুক আসল জানলেও, আলবাৎ যায়। রোজ টিপে দেওয়া হয়। তখন আয়নার সামনে দাঁড়াতে সুহানির নাকি লজ্জা হয়। যেন এক মাংসের পুঁটুলি চেয়ে আছে।
মৃন্ময়ী বোঝেনি। লজ্জা হবে কেন? আয়না তো ভাল। আয়নাই তো স্বীকৃতিই দেয় আশৈশব—
তুমি তা, যা তুমি হতে চাও। প্রেমিক ছেড়ে চলে যায় যখন, তখনও আয়না বলে, তুমি সুন্দর। আয়না কি সুহানিকে বলেনি কখনো তুমি তা, যা তুমি হতে চাও? তুমি মাংসের তালমাত্র নও? বলেনি একথা?
৬.
সুহানি একটা ধাঁধা বুঝতে চাইছিল। সে বিএইচইউতে পড়ে। কলকাতায় ফিরেছে পুজোয়। অয়ন আর মৃন্ময়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ওরা দেখা করেছিল যাদবপুর কফি হাউজে। জিনিসপত্র জমা করেছিল। তারপর গাড়ি বুক হয়েছিল। সুহানি ছটফটে। এক্ষুণি কিছু একটা ওলটপালট বদল চায় সে। জগৎসংসার তার মনের মতো নয় বলে দিবারাত্র কষ্ট পায়। লোকজন তার মনোমতো আচরণ না করলে কষ্ট দ্বিগুণ হয়। যেমন, সে বলছিল, বেনারসে গঙ্গায় নাও বায় যে মাল্লারা, তারা কেন হিন্দুত্ববাদীদের ভোট দেবে? কোনো যুক্তি আছে? ওরা তো নিচু জাত! উচ্চবর্ণ তাদের মেরেছে ধরেছে চিরকাল। তার উপর, এখন পেটে লাথি মারছে সরকার। মেশিন ভুটভুটি ছেড়েছে, ডিঙি নাওয়ের ব্যবসা চৌপাট। তাও ওদেরই ভোট! চায় কি ব্যাটাগুলো? না খেয়ে মরতে? যেই ওদের সর্দারকে মঞ্চে ডেকে মালা পরাল নেতারা, পাশে বসাল, অমনি পালটি মারল! আরে, বাসি মালায় কি পেট ভরবে? রাগে গরগর করছিল সে। একই কাণ্ড ডোম পাড়ায়। ডোমরাজার ফোটো বেরোলো কি।বেরোলো না প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, ডোম পাড়ায় পুরো ভোট চলে গেল উচ্চবর্ণের ঝাঁপিতে। ভাবা যায়!
জামা বিলোনোর পর, এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সুহানি গাড়িতে উঠছিল। হঠাৎ কানে এল ঝটাপটি। পুলিস চেপে ধরেছে এক রঙমাখা মেয়েকে দেওয়ালের সঙ্গে৷ আরেকটা রঙমাখা মেয়ে পুলিসের পা ধরে বলছে, ‘ছেড়ে দিন বাবু।’ বছর বারোর আরও দুটো মেয়ে ছুটে আসছে সন্ধে ইস্কুল থেকে।
যূথী আর রোশনি না? সেই হরিহর আত্মা দুইজন? একজন কুর্তি পেতে অন্যজনও চাইছিল? পা-ধরা মেয়েছেলেটাকে পুলিস লাথি চালাতেই যূথী ডাইভ মারল পুলিসের পায়ে। ‘আমার মাকে মারলে কেন? ছেড়ে দাও!’ পুলিস তখনও চেপে ধরে আছে চামেলি বা প্রীতিকে। বলছে, ‘পুজোগণ্ডার দিনে ভরা বাজারে কেন গালি দিলি?’
প্রীতি বলছে ‘আপনাকে দিইনি।’
‘দিলি কেন?’
‘চোখ মারল।’
‘সতীপনা? উঁউউ?’
পুলিসের থাবা প্রীতির গালে বসে যায়। কর্কশ স্বরে মরিয়া প্রীতি বলে: ‘আবে ছাড়্! গালে দাগ বসলে ব্যবসা হবে না!’
‘বটে!’
নির্লজ্জতায় বাকরুদ্ধ সাদা কলপুতুল হাঁটু দিয়ে ঘুপ করে প্রীতির পেটে লাথায়।
মৃন্ময়ী তেড়ে আসে। অয়ন আর সুহানিও আসে পিছু পিছু৷ মৃন্ময়ীর মুখে ইংরেজি শুনে পুলিসও খানিক ঘাবড়ে যায়। ইংরেজি বলা হিজড়ে সেও দেখেনি। কিন্তু সে দমে না। সুহানি বোঝানোর চেষ্টা করে, ইন্ডিভিজুয়াল দেহব্যবসায়ীকে নির্যাতন করার অধিকার পুলিসের নেই৷ যারা বেশ্যাখানা খুলেছে, চাইলে তাদের ধরুক। ব্যক্তি যৌনকর্মীর বিরুদ্ধে কোনো আইন দেশে নেই। কিন্তু এসব যুক্তিতক্কের ছেঁদো কথা পুলিস অনেক শুনেছে। আইন মেনে কে কবে পুলিস হয়েছে?
অগত্যা মৃন্ময়ী তালি বাজায়। একেবারে হিজড়ে স্টাইলে। এবার সকলে চমকায় একসাথে। প্রলয়ঙ্করী তালি। পিন্টুর কলপুতুল থেমে যায়। বিলাসের চুনের ডাঁটি খসে পড়ে হাত থেকে। মৃন্ময়ী জানে, এরা তালি ভয় পায়। হিজড়ে বা হিজড়ের মতো দেখতে কারও হাতের তালি। সেইসঙ্গে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি৷ শিক্ষা-দীক্ষা-তত্ত্ব আর ইংরেজি ভাষা বিসর্জন দিয়ে মৃন্ময়ী অশ্রাব্য গালাগাল বর্ষণ করতে থাকে তালির তালে তালে। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির উল্টোগলির ফুটপাথ প্রমাদ গনে। প্রমাদ গনে কালীঘাট মন্দিরের গেট। পুলিস নিজের জিপের আড়ালে লুকায়।
স্বপ্নাকে টেনে তোলে বছর বারোর মেয়েদুটো। কিন্তু প্রীতির তলপেটে হাত দিয়ে বসে পড়ে৷ প্রীতিকে গাড়িতে তোলা হয়৷
৭.
এই ডাক্তারখানা নির্মল হৃদয়-এর পিছন দিকে। একজন ডাক্তার রোজ বসে। ওষুধ লিখল সে পেট টিপেটুপে। মূলত প্যারাসিটামল ব্যথা কমাতে। ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়নি মনে হয়। তবু যদি পারে, একবার পিজিতে যেন ইউএসজি করে নেয় প্রীতি৷
বাইরে অপেক্ষা করছিল ওরা তিনজন। সিগারেট খাচ্ছিল। একটাই। সবাই মিলে। প্রীতিরও ইচ্ছে হল। বিড়ির প্যাকেট বের করল সে। ধরানোর আগেই, প্রীতির হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাতে-হাতে-ঘুরন্ত সিগারেটটা তারই হাতে তুলে দিল সুহানি৷ ওষুধ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। ওষুধ কিনবে। ফিজ মেটাবে।
প্রীতি একটা ধাক্কা খেল। সিগারেট নয়, যেন অলিম্পিকের মশাল পেল হাতে৷ এমনও নয় যে শেষটান দিয়ে ফেলে দিতে হবে। এরপর ছেলেটা চাইছে। পুরুষালি মেয়েটাও। ব্যথায় নয়, ভাললাগায় প্রীতির চোখ চিকচিক করে। এক টান মেরে সে অয়নকে সিগারেট দেয়।
এখন প্রীতি বসেছিল ড্রাইভারের পাশে। ওরা তিনজন ব্যাকসিটে৷ প্রতাপের অস্বস্তি হচ্ছিল প্রীতির চড়া পারফিউমে। সেই রক্তাক্ত মেয়েটার বয়স কি এখন প্রীতির মতো? প্রীতিই সে নয় তো? তা কী করে হয়? সে মেয়ে তো বিহারে… প্রতাপ আড়চোখে প্রীতিকে দেখছিল। ফ্রন্ট মিররে দেখে নিচ্ছিল পিছনসিটের ওদের।
ছোটবেলায় খেলা ছিল একটা। একজন বলবে— বেল, চামেলি, গুলাব, পাপিতা। বাকিরা চেঁচিয়ে বলবে, পাপিতা। অড ওয়ান আউট। তার পাশের সিটখানি পাপিতার। একটু আগে ইংরেজি-বলা-হিজড়েটা ছিল পাপিতা। এখন ইংরেজি ওদের তিনজনকে এক করেছে। এবার পাপিতা প্রীতি। ভাবখানা এমন, যেন সবাই এক। তবু কি এক? সবাই?
প্রীতিকে ওদের পাড়ায় নামিয়ে দিল গাড়ি। কাচ তুলতে যাবে, এমন সময় সে মেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। কাচ ঠকঠকাল। সুহানির হাত জড়িয়ে ধরল।
‘আমাদের এঁটো ভদ্দরলোকরা খায় না দিদিভাই। ওষুধের ঋণ শোধ করা যায়। এঁটোর ঋণ শোধা যায় না! যখন যেখানে বলবে, কালীঘাটের পঁচিশজন মেয়ে নামিয়ে দেব তোমাদের জন্য।’
ওরা হকচকিয়ে গেল। ধন্যবাদ জানাল। টা টা বাই বাই। ফিরতি পথে আদিগঙ্গার ঘাটে বসল ওরা। নদী মজে গেছে। জলের চিলতে রেখা চোরা আশার মতো জেগে।
কলকাতার ঘাটে বসে সুহানি ভাবছিল বেনারসের অস্সি ঘাটের কথা। ওই ঘাটেই প্যান্ডেল বেঁধে ডোমরাজা আর মাল্লা সর্দারকে মালা পরানো হয়েছিল— খিদের চেয়ে বেশি যে মালার টান।
মানুষ কি কেবলই পেটের দায়ে বাঁচে? শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা চায়? সম্মান দেওয়ার ভানে মানুষ তবে আরো সহজে গলে যায় কেন! জান হাজির করে নিজের, আর নিজের সমষ্টির। বিশেষত সেই মানুষ, অসম্মান যার নিত্য সহচর।
এসব কথা লেখা ছিল না অর্থনৈতিক নির্দিষ্টতাবাদে৷ তাই একে ভুল মনে হয়, বোকামি মনে হয়। মানুষ বোধহয় এমন কিছু চায়, যাতে আয়নায় নিজের চোখে চোখ রাখলে ভাল লাগে। আয়না গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবনে, মৃন্ময়ী বলছিল, না?
সুহানির ধাঁধা মিলে যায়। শুধু খিদে নয়, সম্মানের চাহিদাও মানুষকে দিয়ে অসাধ্য সাধন করাতে পারে, বিশেষত অসম্মানিত মানুষকে দিয়ে। এই যেমন প্রীতি। সোয়া শ মেয়ে হাজির করে দেবে, বলে গেল।
এবার সুহানি কী করবে? অহংবোধের এ অতৃপ্ত পিপাসায় প্রেমের সিঞ্চন দেবে কি? না অতৃপ্তিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধির কারেন্সি করে তুলবে? কী যে ভাবছে সে আলফাল! ভালবাসার সিঞ্চন! যত ভাববাদী চিন্তা-ফিন্তা….দল যদি জানতে পারে, তাহলে হয়ে গেল তার!
আদিগঙ্গার আয়না বড় পঙ্কিল। সুহানি নিজের মুখ দেখতে পায় না।
কভার ছবি- করতোয়া সেনগুপ্ত