অন্যান্য দিনের মতো গতকালও আপিসে ঢুকতেই অভিকদা হাসিমুখে স্যানিটাইজারের বোতল হাতে উঠে দাঁড়ালেন। প্রতিদিনই তার গ্রামের বাড়ির গল্প, শহরের মতো তাদের কোভিড সংক্রমনের কোন ঘটনা বা তা নিয়ে ভয় না থাকা, ভিড়ে ঠাসা ট্রেন থেকে স্টেশানে নেমে বন্ধুদের টিপ্পনির ভয়ে সেখানেই মুখ থেকে মাস্ক খুলে পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়া এমন ধারা নানান বিষয় নিয়ে গল্পগাছা শেষ হলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াই। কিন্তু গতকাল অভিকদা (নাম পরিবর্তিত) খানিক অনুযোগের স্বরেই বললেন – ‘আপনি স্কুল খোলার ব্যাপারে লেখালেখি করছেন দিদি কিন্তু এতোদিন আমাদের এলাকায় করোনা ছিল না। এখন বাচ্চাদের হচ্ছে। ঘরে ঘরে বাচ্চারা সব জ্বরে পড়ে আছে।অনেকেই বলছিল অফিসে গিয়ে বলিস যিনি খবরের কাগজে লেখেন’। এমন সিঁদুরে মেঘের ভয় যে আমার ছিল না তা নয়। চারিদিকে তৃতীয় ঢেউয়ে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে গনমাধ্যম জুড়ে যা সব দামামা বেজে চলেছে যে এই ধরনের রিউমার ছড়ানোটিও স্বাভাবিক। জানতে চাইলাম – ‘কি করে বুঝলেন যে বাচ্চাদের করোনা হয়েছে। কোথায় টেষ্ট করাতে যাচ্ছেন আপনাদের এলাকার মানুষ?’। প্রশ্ন শুনেই নির্বিকারে উত্তর দিলেন ‘টেষ্ট? কই শুনিনি তো যে কেউ টেষ্ট করিয়েছে’। মনে মনে বললাম বোঝ ঠ্যালা। স্কুল খোলার ব্যাপারে এমন কত যে ঠ্যালা সামলাতে হবে! গত ১৮ মাস জুড়ে যিনি ধারাবাহিকভাবে বলে এলেন গ্রামে এসব কিছু হচ্ছে না আজ কেবলমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে তার মনে হচ্ছে ঘরে ঘরে শিশুরা কোভিড আক্রান্ত! অথচ অন্যান্য সময় গ্রামে কাজ করতে গিয়ে এসময় প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে বাচ্চা বড় সবাইকে জ্বরে পড়ে থাকতে দেখেছি, গ্রামীন ডাক্তারবাবুদের হিমসিম অবস্থা দেখেছি।
গতবছর স্কুল খোলা প্রসঙ্গে গনমাধ্যমে একটি অনুষ্ঠানের পরই শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত কয়েকজন বন্ধু বলছিলেন –‘স্কুল খোলার পক্ষে তুই সওয়াল করলি বটে কিন্তু এমন একটা প্লাটফর্মে তোর বলা উচিত ছিল যে স্কুল খুলতে হলে সরকারকে তিনমাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। রাজ্যের সমস্ত স্কুলগুলিকে স্যানিটাইজ করতে হবে। তাছাড়া বাচ্চারা কি সামাজিক দূরত্ব পালন করবে? স্কুল খুলে দিলেই তো হলো না’। কথায় কথা বাড়ে তাই মনে মনে বললাম এটা কি স্কুল না-খোলার পক্ষে যুক্তি? রাজ্যের বহু স্কুলে কোভিড রুগীদের থাকার কারনে স্কুলবাড়ি স্যানিটাইজ করার কাজটি অত্যন্ত জরুরী এবং সেদিন পর্যন্ত আমাদের কাছে এমন কোন খবর ছিল না যে সরকার এব্যাপারে উদাসীন। যদি সে ব্যাপারে সরকারের কোন ধরনের উদাসীনতা দেখা যায় আমাদের থেকেও বেশী সোচ্চার হওয়া উচিত শিক্ষক শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষক সংগঠনগুলির। একথা ঠিক স্কুল খোলার আগে কিছু ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে হবে। শুধুমাত্র স্কুল ব্লিডিং স্যানিটাইজ করা নয় দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরে বহুক্ষেত্রে মেরামতি করারও প্রয়োজন হতে পারে।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সত্যি যদি পূজোর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হয় সেক্ষেত্রে সর্বাগ্রে গনমাধ্যম, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।নইলে এধরনের অবান্তর প্রসঙ্গ সামনে এলে সেগুলিই না আবার স্কুল খোলার পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে।গতবছর সেফ হোমের কারনে স্কুল বিল্ডিং ব্যবহারের প্রসঙ্গ ছিল এবছর দুয়ারে সরকারের কারনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হয়েছে বলে ‘সরকার আগে ইসকুল স্যানিটাইজ করার প্ল্যান করুক তারপর ইসকুল খোলার কথা বলুক’ বলে যারা সোচ্চার হচ্ছেন তাদের কাছে জানতে চাইব বাচ্চার হাত ধরে যারা শপিং মলে, রিটেল শপ বা ভিড়ে ঠাসা বাজারে যাচ্ছেন সেগুলি কখন কবে স্যানিটাইজ করা হয়েছে সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছেন কখনো? খোঁজ নেওয়া তো দূরের কথা আমাদের সেকথা মাথাতে এসেছে কখনো? এই সেদিন টিভিতে অনেককেই বলতে শুনছিলাম যে বাচ্চারা স্কুলে গেলে বাড়িতে থাকা প্রবীনদের জন্যও সেটি নিরাপদ নয়। প্রবীনরা যারা একা বা পরিবারের সঙ্গে আছেন তারা বুঝি খুব কোভিড বিধিটিধি মেনে চলেন যে পড়ুয়ারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলেই প্রবীনদের সংক্রমনের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে? নিজের হাতে ব্যঙ্ক, বাজারহাট করা অথবা গৃহকর্মীদের ওপর প্রবীনদের নির্ভরশীলতার কথা যদি ছেড়েও দিই প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমনে গিয়ে মাস্ক খুলে চায়ের দোকানের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে চা খেতে খেতে প্রবীনদের আড্ডা দিতে দেখিনা আমরা? তাতে বুঝি সংক্রমনের ভয় নেই? স্কুল বিল্ডিঙ-এ বুঝি কোভিড ভাইরাসটি ঘাপটি মেরে বসে আছে শিশুরা গেলেই খপ করে ধরবে বলে? শিশুরা যখন জন্মদিনের পার্টিতে যাচ্ছে তখন বুঝি সেখানে ভাইরাসটি মনে করে আজ কারো শরীরে ভর করাকরি নয়, চল ভাই আমরা এখন বন্ধু বন্ধু নেমন্তন্ন খেয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যাই। তাই বোধহয় শিশু প্রবীন পরিবার সবাই নিরাপদে অমুক পার্টি তমুক পার্টিতে গেলেও সেখান থেকে সংক্রমনের সম্ভাবনা আছে সেটিকে নির্বিকারভাবে অস্বীকার করেন? নাকি আপনজন বন্ধু পরিচিত মানেই নিরাপদ? এতো গেল আমাদের এক অংশের অভিভাবক শিক্ষক সাধারন নাগরিকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না-খোলার পক্ষে যুক্তির কথা।
স্কুল খোলার প্রসঙ্গটি সামনে আসতেই আরও কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতার কথাও আমাদের শুনতে হচ্ছে শুনতে হবে। আমাদের পরিচিত কয়েকজন নিজের গাড়িতে করে কলকাতা থেকে উত্তর ও দক্ষিন চব্বিশ পরগনা জেলার কয়েকটি গ্রামে তাদের নিজের নিজের স্কুলে সপ্তাহে একদিন করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন ‘একদিন স্কুল যেতেই টাকার যা শ্রাদ্ধ হচ্ছে, স্কুল খুলে দিলে তো রক্ষে নেই’! মাঝেমাঝে মনে হয় দীর্ঘদিন কর্মস্থলে না যেতে যেতে আমাদেরও কি তবে অভ্যেস হয়ে গেল? সেই কারনেই কি এমন ‘টাকার শ্রাদ্ধ’-এই ধরনের ভাবনা? এই অভ্যেস কাটিয়ে উঠতে সমস্যা হবে না তো? আমাদের রাজ্যে ধাপে ধাপে কোভিড বিধি লাগু হতে দেখছি।এইসব বিধি নিষেধের ফলে লোকাল ট্রেন বন্ধ, পেট্রল ডিজেলের আকাশচুম্বি দাম ও সরকারের ভাড়া না বাড়ানর সিদ্ধান্তে গন পরিবহনের বেহাল অবস্থায় নিত্যযাত্রীদের নাভিশ্বাস অবস্থা। তবু তারা তাদের পেশার কারনেই সেটিকে মুখবুজে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।তাদের পরিবারে শিশু ও প্রবীনরা গনহারে কোভিড আক্রান্ত হচ্ছেন? কিন্তু স্কুলে যাতায়াতের জন্য খরচকে আজকে যাদের ‘টাকার শ্রাদ্ধ’ বলে মনে হচ্ছে পূজোর পর যদি সত্যিই স্কুল খোলে এবং গন পরিবহনের চিত্রটি আজকের মতো হয় শিক্ষকসহ শিক্ষাকর্মীরা সেটি মেনে নেবেন তো? ইতিমধ্যে তারা কেউকেউ বলতে শুরু করেছেন যে এরকম একটা পরিস্থিতিতে সরকার এমন একটি পরিকল্পনা করুক যাতে শিক্ষকরা যে যার নিজের এলাকা বা কাছেপিঠের স্কুলগুলিতে সাময়িক সময়ের জন্য শিক্ষকতা করতে যেতে পারেন! সামনে দাঁড়িয়ে যারা বলছিলেন এসব কথা শুনতে শুনতে নিজের কানের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছিলাম সেদিন! লকডাউন আনলকডাউন শেষে এই কার্যত লকডাউন বা কোভিড বিধিনিষেধ চালু করার সময় মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষনাগুলির মধ্যে ছিল যে বেসরকারী সংস্থা তাদের ৫০ শতাংশ কর্মী নিয়ে অফিস খুলতে পারবে এবং সেক্ষেত্রে কর্মীদের যাতায়াতের দায়িত্ব সংস্থাকে নিতে হবে।আপনি কি মনে করেন সংস্থা তার কর্মীদের যাতায়াতের দায়িত্ব নেয়? ১৪-১৫ হাজারের মাস মাইনের চাকুরিজীবিরা আমার আপনার মতো অনায্য সুবিধেভোগী দাবীটি করলে সেদিনই যে তারা পত্রপাঠ বিদায় করে দেবে সে কি কেউ জানে না? প্রথম প্রথম দল বেঁধে দৈনিক ২০০ টাকার বিনিময়ে যাতায়াত করলেও পেট্রোল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারন দেখিয়ে গাড়িওয়ালা যেদিন ৫০০ টাকা চাইলেন সেদিন ওই সামান্য রোজগার থেকে ‘টাকার শ্রাদ্ধ’ করার অক্ষমতার কারনেই তারা বাসে ট্রেনে বাদুড় ঝোলা হয়েই তো যাতায়াত করছেন। স্টাফ স্পেশাল ট্রেন ও ভীড় বাসে যাতায়াতকারী অভিভাবকদের এমন দৈনন্দিন রুটিনে এদের বাড়ির বাচ্চারা রোজ সংক্রমিত হচ্ছে শুনেছেন কখনো? তবে স্কুলে গেলেই কেন বাচ্চার সংক্রমনের ভয়? যদি কেবলমাত্র ‘সংক্রমনের ভয়’ই স্কুল খোলার একমাত্র অন্তরায় হয়ে থাকে তবে সর্বাগ্রে মানসিক বাধা বা ভয়গুলিকে আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রত্যেকবার যাত্রী পরিবহনের পর ট্রেন বাস স্যানিটাইজ করা হয়, কিংবা অফিস বিল্ডিং? ভীড়ে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে যারা যাতায়াত করছেন তারা কি সবসময় নিয়ম মেনে মাস্ক পরেন? আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি কোভিড আক্রান্ত নন এমন কথা কি আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি? এর তুলনায় স্কুল চত্বর ১০০ শতাংশ নিরাপদ মনে হয় না? আমাদের গ্রামেগঞ্জের বাচ্চারা দিনভর একসাথে মাঠেঘাটে খেলাধুলা করছে। সাবান দিয়ে হাত না ধুয়ে সামনে পাওয়া টিউবয়েল থেকে জল খাচ্ছে। এদের জন্য স্কুলে কি আলাদা কোন বিপদ অপেক্ষা করছে বলে মনে হয়? একবার ভাবুন তো আর্থিক স্বচ্ছলতা থেকে আমাদের মনে যে সিকিউরিটির সেন্স তার দ্বারা চালিত হয়ে স্কুল বন্ধ রাখার পক্ষে সওয়াল করলে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের কি আমরা তাদের অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি না? আমদের বাচ্চারা তো নানানভাবে বিদ্যাচর্চার মধ্যে আছে। আদুর গায়ে দিনরাত খেলে বেড়ান শিশুরা কিংবা কৃষি জমি ও গৃহস্থালির কাজ সামলানো আমাদের অষ্টম নবম শ্রেণীর পড়ুয়াদের বইখাতার সাথে সংস্রবটুকুও যে ক্ষীন হয়ে গেছে সে তো কেবল গত ১৮ মাস জুড়ে স্কুল বন্ধ থাকার কারনেই? পঠনপাঠনের সাথে ক্ষীন হয়ে আসা সম্পর্ক স্কুলে না যাওয়ার অভ্যেস ভবিষ্যত শিক্ষার জন্য বিপদের কারন হবে না তো?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন দীর্ঘ অনুপস্থিতির অভিজ্ঞতাটি তো গুরু শিষ্য উভয়ের জন্যই প্রথম। সেই কারনেই হয়তো এক অংশের গুরুমশাইদের সংক্রমনের ভয়, অভ্যেস ও মানসিক বাধাগুলি থেকে তারা স্কুল না-খোলার পক্ষে সওয়াল করছেন নিজেদের অসুবিধের প্রসঙ্গ তুলছেন কিন্তু স্কুল খুললে শিষ্যরাও যে বলতে পারে ‘আজ আমার পেট ব্যাথা আমি ইসকুলে যাব না’। এমন করেই হয়তো বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হবার পথগুলিও হয়তো ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে পারে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ১০০ শতাংশ এনরোলমেন্টের কারনেই আজ গ্রামে গ্রামে স্কুল রয়েছে কয়েক লক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন। এইসব নানান দিক বিবেচনা করে স্কুল খোলার পক্ষে আমাদের সোচ্চার হবার সময় কিন্তু এসে গেছে। আমরা আজও যদি নীরব থাকি তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময়সীমা যত দীর্ঘায়িত হবে সংক্রমনের ভয়, কর্মস্থলে না যাওয়ার অভ্যেস, স্কুল ও পঠনপাঠনের সাথে পড়ুয়াদের দূরত্ব যেদিন শাখা প্রশাখা বিস্তার করবে সেদিন শিক্ষা নামক বটবৃক্ষটি নেতিয়ে পড়লে আমরা সে দিনটির জন্য প্রস্তুত তো?