পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কুত্তার বাচ্চা

  • 19 June, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1736 view(s)
  • লিখেছেন : অরুণ সিরাজ
সর্বনাশ! সকাল সাড়ে আটটা। বিছানা ছেড়ে ধুড়মুড় করে উঠে পড়ল চিকু। অন্যদিন সাড়ে সাতটায় মা জোর করে তুলে দেয়। স্কুলের পুলকার নিয়ে লালাকাকু সোয়া আটটায় চলে আসে। টুথব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে মুখে ঠুসে দিয়ে মা বলে, যাও তাড়াতাড়ি টয়লেট সেরে দুধ খেয়ে নাও। মা ঢুকে যায় কিচেনে। টিফিন বানায়। টিফিন বানানো হয়ে গেলে চিকুর স্কুলের ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দেয়। ব্যাগের ভিতর বই, রুমাল, জলের বোতল, পেনসিল বক্স, পেনসিল বক্সে পেন, পেনসিল, ইরেজার ঠিক আছে কি না, সেই সঙ্গে পেনসিলের অগ্রভাগ সঠিক ভাবে শার্প কিনা তন্ন তন্ন করে সবকিছু মা পরখ করে নেয়।

যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এসব কাজের ফাঁকে ফাঁকে মা চিকুর উদ্দেশে বলে, এবার বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসো। ইউনিফর্ম পরো। স্কুলের আইকার্ডের রংটা চটে গেল কি করে? নামটা পর্যন্ত ঝাপসা হয়ে গেছে।
সেদ্দ ডিমের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কখনও বলে, জুতোটা পালিস করে নাও। নতুন জুতো। কী ছিরি করেছো! স্কুলে পড়ো না যুদ্ধ করো?
ঘুম ঘুম চোখে চিকু মায়ের নির্দেশ পালন করতে থাকে। কখনো গড়িমসি করলে, মা চিকুর কাঁধটা ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়। তারপর পিঠে স্কুল ব্যাগ নিয়ে মায়ের সঙ্গে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায় পুলকারের জন্য। একটু দেরি হলেই ড্রাইভার লালাকাকু জোরে জোরে হর্ণ বাজায়। চিকুকে পুলকারে উঠিয়ে তবেই মায়ের স্বস্তি। শান্তি।
ততক্ষণ চিকুর বাবা শুয়ে থাকে বিছানায়। যেন ছেলেকে স্কুলে পাঠানোটা মায়েরই দায়িত্ব। কিন্তু আজ কী হল মায়ের? ঘুম থেকে উঠছে না। চিকুর ঘরের পাশেই মা-বাবার ঘর। চিকু উঠে গিয়ে তাদের দরজায় ধাক্কা দেয়। ‘মা’ – ‘মা’ – ‘মা’ বলে ডাকে। ভেতর থেকে মা সাড়া দেয়, একটু দাঁড়া বাবু- এই উঠছি।
- সাড়া আটটা বাজছে। পুলকার চলে যাবে। রেগে গিয়ে বলে চিকু।
- একটু অসুবিধায় পড়েছি। আসছি দাঁড়া। লালাকাকুকে একটা ফোন করতে পারবে?
ইতিমধ্যে বাড়ির ফোনের রিং বেজে উঠল। ফোন তুলে বুঝল তার ক্লাসের বন্ধু বিতানের ফোন। বিতান কান্না জড়ানো গলায় বলছে, চিকু- লালাকাকু কি পুলকার নিয়ে চলে গেছে? দ্যাখ না, মা-বাবা কিছুতেই ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না। শুধু ‘উঠছি’ – ‘আসছি’ বলছে, কিন্তু দরজা খুলছে না।
নিজের একই অবস্থা জানিয়ে চিকু ফোন কেটে দেয়। এবার সে মা-বাবার ঘরে জোরে জোরে ধাক্কা মারে। ভেতর থেকে অস্বস্তির মধ্যে সাড়া দেয় মা- বাবা। কিন্তু দরজা খোলে না।
চিকু এবারে ভয় পায়। ফোন করে লালাকাকুকে। দেরি হলে লালকাকুকে ফোন করতে হয় গাড়ির অবস্থান জানার জন্য। লালাকাকু উত্তর দেয়, দেরি হবে চিকু। এক কাজ করো- বাবাকে বলো পারলে আজ যেন তোমাকে বাইকে করে স্কুলে রেখে আসে।
এরকম বেকায়দায় পড়ে মা-বাবার ঘরবন্দি হয়ে থাকার কথা জানিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে ফোন করল অনুকে। ওদিকে অনুরও একই অবস্থা। সে তার মা-বাবার প্রতি রাগে ক্ষোভে যাকে বলে ফায়ার।
আশ্চর্য ব্যাপার, সবার মা-বাবা আজ ঘরবন্দি। জেগে আছে, সাড়া দিচ্ছে কিন্তু ডোর খুলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসছে না কেউ। বিরক্ত লাগছে। ভীষণ রাগ হচ্ছে। অগত্যা অনু চিকুকে বলল, তুই মার্কেট-মোড়ে আয়। আমি বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি।

দুই
চিকুরা যে গঞ্জে থাকে সেই সোনাদহ গঞ্জ ছোট জায়গা। যদিও নাগরিক সুযোগ সুবিধা সব হাতের মুঠোয়। রাস্তাঘাট বেশির ভাগ পিচ, ঢালাই। কোথাও বা মোরাম। ছোট বড় মাপের অনেক পুকুর ছিল। কোনো কোনো পুকুরের জল মানুষ পান করতো। রান্না হতো। পুকুর জলে ভাত তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়। এখন পান তো দূরের কথা, স্নান করাও যায় না। পুকুর বুজিয়ে বাড়িঘর হয়ে গেছে।
একসময় সবাই সবাইকে চিনত, জানত। বাড়িতে বাড়িতে পাড়াতে পাড়াতে যাতায়াত ছিল। একপাড়ার কারও বিয়ে হলে, কেউ স্কুলে ভাল রেজাল্ট করলে, কেউ মারা গেলে অন্য পাড়াতে খবর পৌঁছে যেত। নিজেদের অজান্তে সবাই যেন সবার সুখদুঃখের অংশীদার হয়ে উঠত। উৎসব-পরবে ভেদাভেদ ছিল না।
হেঁদু-মোছমান ছিল না। দলাদলি নয়, বলতে গেলে গলাগলি হয়ে থাকত সবাই।
হারান চক্রবর্তীর একমাত্র ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল, তাকে আর দেখভাল করার কেউ ছিল না। পূজাআচ্চা করে খায়। পাড়া প্রতিবেশীও দেয় থোয়। চক্তোতী অসুস্থ হলে ক্লাবের ছেলেরা ফটিক ডাক্তারকে দেখালে, ডাক্তার বাবু বললেন, রক্ত নাই শরীরে। রক্ত দিতে হবে। তো ক্লাবের ছেলেরা শহরে নিয়ে গিয়ে সব ব্যবস্থা করেছিল। এখন আর ক্লাবে এসব কাজ হয় না। পার্টি অফিস হয়ে গেছে। সামাজিক কাজের বদলে রাজনীতির কাজটাজ হয়। যারা ঐ রাজনীতি পছন্দ করে না, তারা ক্লাবে আর যায় না। ক্লাবের ছেলেরা ভাগাভাগি হয়ে গেল।

এখন এপাড়া ওপাড়া তো নয়-ই, প্রতিবেশি কেউ কারও খোঁজ নেয় না। কারও সঙ্গে দেখা করে না। যদি বা দেখা হয়, কথা বলে না। যদি বা কথা হয়, সে-কথায় কোনও আন্তরিকতা থাকে না। যেন বলতে হয় তাই বলে। শুনতে হয় তাই শোনে। এত এত মানুষ অথচ সবাই কেমন যেন নিঃসঙ্গ! একা।
চিকু, বিতান, অনু, অর্ক, জয়---এদের প্রত্যেকের মা-বাবা পরস্পরের সঙ্গে ফোন করে জেনে গেল প্রত্যেকের অবস্থা একই। কেউ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি।
চিকুর মা অনুর মাকে বলল, এই তোমার ছেলে কি স্কুলে গেছে?
- কেন! তোমার ছেলে যায়নি?
- আমি তো বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারিনি।
- আমার অবস্থাও তাই।
- তাই?
- হ্যাঁ গো। যা কোনওদিন হয়নি বিয়ের পর ...
- হ্যাঁ, ওর বাবা কাল রাতে কী করে কী করল, কে জানে ...
- ছিঃ ছিঃ কী হবে বলো তো? ওর বাবার ইয়েটা আমার ইয়েতে এমন ভাবে আটকে গেছে, কিছুতেই ছাড়ছে না।
- আমার চিকু ..., কাঁদতে থাকে চিকুর মা।
- আমার অনু ..., কাঁদতে থাকে অনুর মা।
কোনও কোনও দম্পতি বিছানা ঘষটে ঘষটে জানালার কাছে গিয়ে পর্দা তুলে দেখে পাশের বাড়ি। পাশের বাড়ির প্রতিবেশিরাও ওভাবে জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারছে। অনাগত ভয়াবহ ভবিষ্যতের বিপদের আশঙ্কায় শঙ্কিত সবাই। এটাকে কি কলির সন্ধ্যা বলে?
যৌনকর্ম শেষ হলেও স্বামী-স্ত্রী একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারছে না। অনেকটা সারমেয়কুলের মতো। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। হয় ও নি, শোনাও যায়নি কখনও।
চিকুর মা-বাবা অন্তত একটি ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হল, তারা যে-কারণে ঘরবন্দি সেই একই কারণে আজ তাদের মতো সব স্বামী-স্ত্রী ঘরবন্দি। শুধু তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলের উদ্দেশে নিজের মতো করে বেরিয়ে গেছে।
সকালে ছেলেমেয়েরা ঘরে খুব আতঙ্কে ছিল, কিন্তু রাস্তায় সবাই সবাইকে পেয়ে কেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। মার্কেট-মোড়ে প্রতিদিন চা-পানের দোকান, ডাব বিক্রেতা, কচুরিবালা, মুরগির মাংস বিক্রেতা,সব্জি বিক্রেতারা সার করে বসে থাকত। আজ তারা কেউ নেই। শুধু তাই না, যত্রতত্র কাগজের ঠোঙা, প্লাস্টিক, ডাবের খোল, কাটা মুরগির ছাট কিছুই পড়ে নেই। সাইকেল, রিক্সা, বাইক, গাড়িঘোড়াও নেই। কোনও হর্ণ নেই। হইচই নেই। সাবধানে রাস্তা পেরোনোর বালাই নেই। রাস্তার ধারে কত কত গাছ। ফুলের গাছ বেশি, সেসব গাছ থেকে অতি ভোরে ফুল ব্যাপারী রা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে গিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে। সেই গাছগুলো আজ ফুলে ফুলে সেজে আছে। গাছে গাছে সেই ফুল কত সজীব। তাহলে আজকের মতো রোজ গাছে ফুল থাকে না কেন ? রাস্তার কুকুরগুলি রোজ ঘেউ ঘেউ করে। আজ করছে না। কেউ কাউকে তেড়েও যাচ্ছে না। যেন সবার সঙ্গে সবার আজ সন্ধি। বড়রা কেউ না থাকলে রাস্তাঘাট এত সুন্দর হতে পারে.... ভাবাই যায় না। আর রাস্তাটাই যেন স্কুলের খেলার মাঠ। যে যার মতো খেলছে। কারও সঙ্গে কারও কোনও বিরোধ নেই।

তিন
কী করব, কী করব না ভাবতে ভাবতে চিকুর বাবার টিভির কথা মনে এল। একবার খবরটা দেখা দরকার। চিকুদের টিভিতে অ্যালেক্সা ডিভাইস কানেক্ট করা আছে। সন্ধেয় অফিস থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে, চিকুর বাবা বুকে বালিশ গুঁজে বিছানায় উপুড় হয়ে আধ শোয়া অবস্থায় চা খায় আর অ্যালেক্সা ভয়েস রিমোট নিয়ে টিভি দেখতে বসে। যা হুকুম করে তাই টিভি স্ক্রিনে হাজির করে অ্যালেক্সা। অমুক সিনেমা, অমুক সিরিয়াল, অমুক চ্যানেলর অমুক খবর...... নিমেষের মধ্যে হাজির। অ্যালেক্সা যেন একালের আলাদীনের দৈত্য। তবে অ্যালেক্সাকে ঠিক দৈত্য দানব মনে হয় না। মনে হয়, একজন সুশিক্ষিতা অফিসের অধস্তন অনুগতা কর্মী। চিকুর বাবা দেখেছে অফিসের বসের সেক্রেটারি মিস তুষ্টি কে। ‘ইয়েস্স্যার’ ‘ইয়েস্স্যার’ বলে হাসিমুখে নির্দেশ পালন করেই চলে। অফিসে অফিসার পদ মর্যদায় না উঠতে পারলেও ঘরে বসে নিজেকে অ্যালেক্সার ‘বস’ ’ মনে হয়।
রিমোর্ট নিয়ে টিভি অন করে অ্যালেক্সাকে কল দেয়--
- অ্যালেক্সা, আজকের খবর?
- বাচ্চারা রাস্তায়। মা-বাবা জড়াজড়ি, বিছানায়।
- অ্যালেক্সা, মা-বাবা বিছানা ছাড়তে পারছে না কেন?
- কী করে পারবে! তারা কি আর মানুষ আছে?
- মানে?কী হয়েছে?
- কুকুর! কুকুর হয়েছে।
- কিন্তু আমরা তো মানুষ। আমরা কুকুর হতে যাবো কেন?
- তাই? তাহলে শুনুন, আপনারা নিজেদের সামাজিক বলেন তা আপনাদের সামাজিকতা কোথায়? সামাজিক মাধ্যম কে ইর্ষা আর বিদ্বেষে বিষময় করে তুলেছেন। এত ঈর্ষা এত বিদ্বেষ নিয়ে বাঁচেন কী করে? পরস্পর পরস্পরকে কুত্তার বাচ্চা কুত্তা বলেন। আপনার নিজের মনে হয় আপনি ছাড়া বাকি সবাই কুত্তা। আবার সবার মনে হয় সে ছাড়া সবাই কুত্তার বাচ্চা। প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে তো নিজেরাই কুত্তা বানিয়ে চলেছেন। তাহলে কুত্তার মতো যৌন-ক্রিয়ায় এত আপত্তি কেন?
চিকুর বাবা উত্তেজিত হয়, কিছুটা বা বিরক্ত। কি যেন জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল। পারে না। মাথা হেঁট হয়। মনে পড়লো,একবার অফিসের বস, মোটিভেশনাল ক্লাস করার সময় বলেছিলেন, পশু পশুত্ব নিয়ে জন্মায়। পশুত্ব অর্জন করতে হয় না। এটা পশুর প্রকৃতি। মানুষ কিন্তু মনুষত্ব নিয়ে জন্মায় না, তাকে মনুষত্ব অর্জন করতে হয়। যে বিষয়ের চর্চা করা উচিত, আমরা তা করি না। বস কথাগুলো বলে কি ইঙ্গিত করতে চায়ছিলেন তা চিকুর বাবার বুঝতে অসুবিধা হয় নি। যদি ও এসব দার্শনিক তত্ত্ব কথা চিকুর বাবার ভালো লাগছিল না। ফ্ল্যাটের ঋণ শোধের একটা চাপ ছিল। প্রমোশনটা হলে বাড়তি কিছু টাকা আসতো হাতে।
বসের প্রিয় পাত্র হবার জন্য অনেকে অয়েলিং যাকে চামচা গিরি বলে, করে থাকে। বসের মিসেসের গানের টিচার ঠিক করা, ট্রেনের রিজার্ভেশন করে দেওয়া, মেয়ের স্কুলের প্রজেক্ট রেডি করা, বাজার থেকে জ্যান্ত আস্ত কাতল কিনে নিজের পুকুরের মাছ বলে বসের রান্নাঘরে পৌঁছে দেওয়া। মুস্কিল হল, চিকুর বাবার বস এসব ব্যক্তি পুজা অপছন্দ করে। তাই প্রমোশনের জন্য চিকুর বাবা কে ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। অনান্য কলিগদের মনে প্রতিদ্বন্দীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে বিদ্বেষ বপনে কিছুটা সফল ও হয়ে ছিল। তবে শেষ রক্ষা হয় নি। প্রমোশন তার হয়নি। সত্যদার হয়েছিল।
চিকুর বাবার মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। ছেলের জন্য ভিতর অস্থির লাগছে। অ্যালেক্সাকে জিজ্ঞেস করে, আমার সন্তান এখন কোথায়?
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে টিভির স্ক্রিনে ভেসে ওঠে চিকুদের স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটা। অসংখ্য ছেলেমেয়ে। তারা খেলছে। দৌঁড়ছে। পড়ছে। আবার উঠছে। প্রত্যেকেরই চোখে মুখে অপার আনন্দ। কী নিষ্পাপ সব চেহারা। যেন দেবশিশু!
কিন্তু ওদের মধ্যে চিকু কই? চিকুর বাবা অ্যালেক্সাকে জিজ্ঞেস করে। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার ফোকাস পড়ে চিকুর ওপর। চিকুর বাবা দেখে, চিকু খেলছে ইয়াসিনের সঙ্গে। তাঁতিপাড়ার সেখদের বাড়ির ছেলে ইয়াসিন।
চিকুর বাবা ভাল করে চিকুকে দেখার চেষ্টা করে। চিকুর মুখ ইয়াসিনের মুখ হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ইয়াসিনের মুখটা চিকুর মুখের আদল পাচ্ছে।
নিজের স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ছে চিকুর বাবার। চাকরি নিয়ে সোনাদহে আসার আগে অজ পাড়া গাঁয়ে জীবন কেটেছে তার।স্কুলজীবন ই ভালো ছিল বলে এখন প্রায়শই তার মনে হয়। চাষি বাড়ির ছেলে। খাওয়া পরার অভাব ছিল বটে, তবে আনন্দ ও ছিল।
স্কুল টা ছিল তিন কিমি দূরে পাশের গ্রামে। মাঠ পেরিয়ে যেতে হত। অজগর সাপের মত দীর্ঘ গুন আলপথ। চওড়া আলপথের মধ্যভাগ মাথার সিঁথির মত সাদা। হেঁটে যাওয়া মানুষের পায়ের চাপে গজাতে পারে না ঘাস। সাদা সিঁথির দুপাশে না-আঁচড়ানো চুলের মত ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া ঘাস।
এই আলপথ দিয়েই হৈ হুল্লোড় করতে করতে চিকুর বাবারা স্কলে যেত। সফি, জগা, বিষ্টু, মিলি, লখাই, মনিকা,চুমকি, রতনদা, টুটু দা, নজুদা--- আরো সব অনেকে।
চিকুর বাবার ছাতা ছিল না। বর্ষায় স্কুল যাওয়া আসার পথে ছাগল- তাড়ানো বৃষ্টি হলে দৌড়ে সফির ছাতার নীচে মাথা টা গুজে দিত অনায়াসে। দুজনে হাঁটত জড়াজড়ি করে। চিকুর বাবাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে সফি ফিরত বাড়ি । কখনো দমকা হাওয়ায় হাত থেকে ছাতা ফস্কে উড়ে যেত। জলে ভিজে মজা হত। আল্ ছাপিয়ে বৃষ্টি জলের ধারা। সেই জল-ধারায় ছোট ছোট মাছেদের আনাগোনা। কার্তিক অগ্রাহায়ণে ধানের শিস নধর দেহ নিয়ে হিলে পড়ে আলে। হাঁটতে গেলে ধানের শিস লাগে পায়ে। পা ভিজে যায় শিশিরে।
চিকুর বাবা সেই আলপথ ছেড়ে এখন এই সোনাদহ গন্জের কংক্রিটের পথে। এপথে ঘাস নেই। কেবল লোক। লোক। লোক। লোকেরা কেমন দাঁত খিঁচিয়ে থাকে। চোখ বড় বড় করে তাকায়। হাত পাকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে কে বা কারা যেন পথ হাঁটে। জন অরণ্যে হারিয়ে গেছে চিকুর বাবা। ভয়, ক্ষোভ, রাগ -- কখন যে কি হয়, সে বুঝতে পারে না। কোন্ অজান্তে হিংসা আর বিদ্বেষ বাসা বেঁধেছে হৃদপিণ্ডে। এই হৃদপিণ্ড কেবল ঈর্ষা করতে জানে? সোনাদহে কংক্রিটের রাস্তায় বন্ধু সফির ছাতা হাওয়ায় উড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল!
চিকুর বাবা নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে। তার চোখের কোন চিক চিক করে । নিম্নদেশ শিথিল হয়। স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন হয় সে। টিভি অফ করে। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই দরজার দিকে দৌড়ে যায়।
এবার ঘরের দরজা খুলে গেল।

0 Comments

Post Comment